আমাদের টাইপ করা বইগুলোতে বানান ভুল রয়ে গিয়েছে প্রচুর। আমরা ভুলগুলো ঠিক করার চেষ্টা করছি ক্রমাগত। ভুল শুধরানো এবং টাইপ সেটিং জড়িত কাজে সহায়তা করতে যোগাযোগ করুন আমাদের সাথে।
রাসায়েল ও মাসায়েল ৬ষ্ঠ খন্ড প্রিন্ট কর ইমেল
লিখেছেন সাইয়্যেদ আবুল আ'লা মওদূদী   
Monday, 28 February 2011
আর্টিকেল সূচি
রাসায়েল ও মাসায়েল ৬ষ্ঠ খন্ড
গ্রন্থকার পরিচিতি
১। আল্লাহর অস্তিত্ব সম্পর্কে সংশয় নিরসন
২। আল্লাহ ও তাঁর রসুলগণের মধ্যে পার্থক্য করা
৩। জীবজন্তুর উপর দয়া
৪। পাঁচ ওয়াক্ত ও পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায
৫। হানাফি মাযহাবে কি কিছু কিছু মাদক দ্রব্য হালাল?
৬। আদালতের রায় কি শুধু জাহেরীভাবেই কার্যকর, নাকি বাতেনীভাবেও কার্যকর?
৭। সুন্নাহর আইনগত মর্যাদা
৮। সাহরির শেষ সময় কোনটি?
৯। একটি হাদিস থেকে সুদের বৈধতা প্রমাণের অপচেষ্টা
১০। মুসলিম উম্মাহর বহু গোষ্ঠিতে বিভক্তি এবং মুক্তি লাভকারি গোষ্ঠি
১১। কালো খেজাব লাগানো কি বৈধ?-১
১২। কালো খেজাব কি বৈধ?-২
১৩। তাকদীর প্রসঙ্গ
১৪। গোমরাহী ও হেদায়েত
১৫। সূরা আন নাজমের প্রাথমিক আয়াত কয়টির ব্যাখ্যা
১৬। যাকাতকে প্রচলিত করের সাথে যুক্ত করা যায় না
১৭। পিতামাতার অধিকার
১৮। লোহার আংটি পরা কি জায়েয?
১৯। উশর ও খারাজের কয়েকটি সমস্যা
২০। উশরযোগ্য ফল ফসল কি কি?
২১। মোজার উপর মসেহ করার বিধান
২২। কারো সম্মানে দাঁড়ানো কি জায়েয?
২৩। 'প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ দান করা' সংক্রান্ত কুরআনের আদেশের ব্যাখ্যা
২৪। অপ্রাপ্ত বয়স্ক সন্তানদের ভরণ পোষণ প্রসঙ্গে
২৫। কবর আযাব
২৬। কুরআন শিক্ষাদান ও অন্যান্য ধর্মীয় কাজের পারিশ্রমিক নেয়া কি বৈধ?
২৭। ইসলামের ফৌজদারী দণ্ডবিধি সংক্রান্ত কিছু ব্যাখ্যা
২৮। বেতের নামাযে দোয়া কুনূত
২৯। লাইসেন্স ক্রয় বিক্রয়
৩০। কিবলার দিক নির্ণয়ের শরিয়তসম্মত বনাম বিজ্ঞানসম্মত পন্থা
৩১। মৃত ব্যক্তির জন্য ফিদিয়া দান, শোক ও কুরআন খতম
৩২। কয়েদি সৈন্যরা কি নামায কসর করবে
৩৩। পবিত্র কুরআন ও গুপ্ত ওহি
৩৪। ব্যভিচারের অপবাদ
৩৫। কোন কোন প্রাণী হালাল বা হারাম
৩৬। কুরবানীর চামড়া সম্পর্কে শরিয়তের বিধান
৩৭। মৃত ব্যক্তির চামড়া সম্পর্কে শরিয়তের বিধান
৩৮। মৃত প্রাণীর চামড়া সম্পর্কে আরো আলোচনা
৩৯। জবাই হালাল হওয়ার জন্য কি বিস্
৪০। যাকাত সংক্রান্ত কিছু খোলামেলা কথা
৪১। নগদ পুঁজির যাকাত ও তার নিসাব
৪২। বাইয়ে সালাম
৪৩। হযরত আলী রা.-এর জন্য সূর্যকে ফিরিয়ে দেয়ার ঘটনা কি সত্য?
৪৪। কুরাইশের ১২ জন খলিফা ও 'ফিতনায়ে আহলাস'
৪৫। আল্লাহ ও রসূলের কোনো উক্তি কি মানুষকে কর্মবিমুখ করতে পারে?
৪৬। আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয় করা সত্ত্বেও দৈন্যদশার কারণ কি?
৪৭। হযরত আলী রা.-এর বর্ম চুরি-১
৪৮। হযরত আলী রা.-এর বর্ম চুরি-২
৪৯। ইসলামের দৃষ্টিতে গানবাজনা ও নারী পুরুষের মেলামেশা
৫০। আব্দুল্লাহ বিন উবাইর জানাযা
৫১। ইমাম ইবনে তাবারি কি শিয়া ছিলেন?
৫২। ফৌজদারি অপরাধের ক্ষেত্রে আপোস নিষ্পত্তির অধিকার
৫৩। ইসলামের উত্তরাধিকার আইন সম্পর্কে অভিযোগ
৫৪। শরিয়তের দৃষ্টিতে ওয়াকফের সংজ্ঞা ও বিধান
৫৫। আত্মহননকারীর জানাযা নামায
৫৬। হারুত মারুত ফেরেশতাদ্বয় সম্পর্কে এক ভিত্তিহীন অলীক কাহিনী
৫৭। 'চাটান' সম্পাদকের নিকট দুটো চিঠি
৫৮। হাদিস অস্বীকার করা ও স্বীকার করা
৫৯। হাদিস বিরোধী গোষ্ঠির বিভ্রান্তিকর প্রচারণা
৬০। একটি হাদিস সম্পর্কে আপত্তি ও তার জবাব
৬১। সন্তান পালনে নারীর অধিকার
৬২। স্তনের দুধ পানে বিয়ে হারাম হওয়া
৬৩। পারিবারিক আইন ও অর্পিত তালাক
৬৪। ফাসিদ বিয়ে ও বাতিল বিয়ে
৬৫। রসূল সা. কি হযরত সওদা রা. কে তালাক দিতে চেয়েছিলেন?
৬৬। উম্মুল মুমিনীন হযরত সওদার বিয়ে সম্পর্কে আরো আলোচনা
৬৭। কতোখানি দুধ পান করলে বিয়ে হারাম হয়?
৬৮। পিতামাতার আদেশে স্ত্রী তালাক দেয়া যায় কি?
৬৯। রসুল সা.-এর একাধিক বিয়ের যৌক্তিকতা ও সার্থকতা
৭০। বেলুচিস্তানের বাগদান প্রথা
৭১। লটারি ও নির্বাচনী লটারি
৭২। সমবায় সমিতি

<h1>গ্রন্থকার পরিচিতি</h1>

ইসলামী জ্ঞান হস্তান্তরের ধারাবাহিকতা
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. কে আল্লাহ তায়ালা কুরআনের ব্যাখ্যা সংক্রান্ত সূক্ষ্ম ও সুগভীর জ্ঞান ও যোগ্যতা দান করেছিলেন। তিনি কুরআনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ও তত্ত্বজ্ঞানের এতো বিপুল ভান্ডার উন্মোচন করেছিলেন যে, তাকে ইসলামের ইতিহাসে প্রথম মুফাসসিরূপে অবিহিত করা হয়। তাঁর এই অমূল্য তত্ত্বজ্ঞান পরবর্তীকালে তাঁর খ্যাতনামা শিষ্য ইকরামা, মুজাহিদ ও কাতাদা প্রমুখ মুসলিম উম্মাহর কাছে হস্তান্তর করেন। এ ক্ষেত্রে উস্তাদ ও শিষ্য উভয়ের অবদানই অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। অনুরূপভাবে মুসলিম সমাজে হযরত ইমাম আবু হানিফা রহ. এর ফিকাহ শাস্ত্রীয় ব্যুৎপত্তির প্রচারণও ব্যাপক প্রসার ঘটান তাঁরই শিষ্য ইমাম আবু ইউসুফ, ইমাম মুহাম্মদ ও ইমাম জুফার রহ.। পরবর্তীকালে ইমাম ইবনে তাইমিয়ার দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি স্বয়ং ইসলামি জ্ঞান ও পাণ্ডিত্যের এক অতলস্পর্শী সমুদ্র তো ছিলেনই। কিন্তু তাঁর সুযোগ্য শিষ্য ইবনে কাইয়েম আল জাউদী রহ. স্বীয় উস্তাদের জ্ঞান প্রদীপকে শুধু প্রজ্জলিত রাখেননি, অধিকন্তু তার ঔজ্জ্বল্য ও সুষমা আরো বর্ধিত করেছিলেন।
উপমহাদেশে ইমাম শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলবী রহ. ইসলামের পুনরুজ্জীবনে যে অসাধারণ ভূমিকা পালন করেন, তা এতদঞ্চলের ইতিহাসের এক অত্যুজ্জ্বল অধ্যায়।
তাঁর সেই কৃতিত্বপূর্ণ ভূমিকার প্রভাবকে অব্যাহত রাখা ও অধিকতর কার্যকর করার ব্যাপারে তাঁর সুযোগ্য শিষ্যগণের প্রচেষ্টাও অত্যন্ত প্রশংসনীয়। নিকট অতীতে মাওলানা শিবলী নোমানীর শিষ্যগণ শিবলীর চিন্তাধারা যেভাবে চালু রেখেছেন তা জ্ঞানীগণের অজানা নয়। মাওলানা সাইয়েদ সুলায়মান নদভী এঁদের অন্যতম।
বর্তমান যুগের চলমান ইসলামি আন্দোলনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এ ধরনের একাধিক দৃষ্টান্ত মেলে। আলজেরিয়ায় শেখ আব্দুল হামিদ বিন বাদীসের পরবর্তীকালে তার ঘনিষ্ঠ সহচর মুহাম্মদ আল বশীর আল ইবরাহিমী তার কাঙ্খিত কাজকে বিদ্যাগত ক্ষেত্রে যেমন, তেমনি দাওয়াতী ময়দানেও অব্যাহত রাখেন। মিসরে ইমাম হাসানুল বান্না শহীদের আদর্শ ও চিন্তাধারার উত্তরাধিকারীদের মধ্যে অধ্যাপক আব্দুল কাদের আওদা, অধ্যাপক আল বাহী আল খাওলী, সাইয়েদ কুতুব শহীদ ডক্টর ইউসুফ আল কারজাভী, ডক্টর আহমদ আল আবছাল, ইউসুফ আল আজম এবং সাঈদ হাওয়া অন্যতম। এই মনীষীগণ যদিও ইমাম হাসানুল বান্নার প্রত্যক্ষ ছাত্র ছিলেন না। তবে তারা ইমাম হাসানুল বান্নার চিন্তাধারা দ্বারা এতো বেশি প্রভাবিত ছিলেন যে, সঠিক অর্থেই তাদেরকে তাঁর আদর্শিক উত্তরাধিকারীরূপে আখ্যায়িত করা যায়।
মাওলানা মওদূদী রহ. এ যুগের চিন্তা ও কর্মের জগতে যে বিপ্লবী আন্দোলনের সূত্রপাত করেন, তার প্রভাবও সীমাহীন। এই উভয় ময়দানে তাঁর উত্তরাধিকারী হয়েছে এক সর্বাত্মক ইসলামি আন্দোলন। এ আন্দোলন ভারতীয় উপমহাদেশে তাঁর প্রত্যক্ষ শিষ্যদের এবং দুনিয়ার অন্যান্য দেশে তাঁর আধ্যাত্মিক শিষ্যদের নেতৃত্বে চালু রয়েছে। প্রত্যক্ষ শিষ্যদের মধ্যে কতিপয় বিশিষ্টি ব্যক্তিত্ব এমনও রয়েছে, যারা বহু বছর যাবত দিবারাত্র মাওলানার তত্ত্বাবধানে থেকেছেন। এদের মধ্যে মিয়া তোফায়েল মুহাম্মদ, জনাব নঈম সিদ্দিকী, মরহুম আব্দুল হামিদ সিদ্দিকী ও মাওলানা মালিক গোলাম আলীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মিয়া তোফায়েল মুহাম্মদ তো পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমীর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং মরহুম মাওলানা এই গুরুত্বপূর্ণ পদের জন্য তাঁকে বাস্তব প্রশিক্ষণও দিয়েছেন। জনাব নঈম সিদ্দিকী এবং অধ্যাপক আব্দুল হামিদ সিদ্দিকী মরহুম মাওলানার দাওয়াত, চিন্তাধারা ও ইসলামি আন্দোলনের দার্শনিক দিক চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন। উভয়ে সাংবাদিকতার জগতেও মাওলানার অনুসৃত নতুন ধারার বিকাশ ঘটিয়েছেন।
মাওলানা মালিক গোলাম আলী সাহেব এঁদের মধ্যে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তিনি ছাত্র জীবন থেকেই মাওলানা মওদূদীর রহ. সাহচর্যে আসেন এবং শেষ মুহূর্ত্ব পর্যন্ত তা অব্যাহত রাখেন। বললে অত্যুক্তি হবেনা যে, মালিক সাহেব মরহুম মাওলানার সাহচর্যে জীবনের সুদীর্ঘ স্বর্ণপ্রসু অংশ অতিবাহিত করে শুধু যে মাওলানার চিন্তাধারা ও অন্তদৃষ্টিকে গভীরভাবে আত্মস্থ করেছেন তাই নয়, বরং ইসলাম সম্পর্কে সুগভীর পাণ্ডিত্যও অর্জন করেছেন। বস্তুত: মালিক সাহেব পরিভাষা অনুসারে যথার্থভাবেই একজন 'ইসামী' অর্থাৎ 'স্বয়ম্ভু' ব্যাক্তিত্ব। তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবন বৃত্তান্ত থেকে এ সত্য স্পষ্ট হয়ে উঠে।


প্রাথমিক জীবন
মালিক সাহেব নিরেট পল্লি সমাজে জন্মগ্রহণ করেছেন, যদিও পল্লি সমাজে শিক্ষা সংস্কৃতির প্রসার সীমিত হয়ে থাকে। তবে সেখানে এমন কিছু গুণাবলীরও বিকাশ ঘটতে দেখা যায়, যা ভবিষ্যত জীবনে শিক্ষা ও সংস্কৃতির উত্তম ভিত্তি হিসেবে পরিগণিত হয়ে থাকে। যেমন, সরল সাদাসিধে ও অনাড়ম্বর জীবনযাপন, অল্পে তুষ্টি, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, জ্ঞানী গুণীদের প্রতি আন্তরিক টান ও ভালবাসা। মালিক সাহেব এসব গুণে সমৃদ্ধ হয়েই শহরে পদার্পণ করেন। তার প্রাথমিক জীবন সম্পর্কে তার নিজের বর্ণনা নিম্নরূপ: "সারগোধা জেলার উত্তরাঞ্চলে সোন সেকসর নামে একটা গ্রাম আছে। সেখানেই আমার জন্ম। আমি একটা ধর্মপ্রাণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করি। আমার পিতা খুবই ধার্মিক ব্যক্তি ছিলেন। তাহাজ্জুদ নামাযে অভ্যস্থ ছিলেন। সাধ্যমত নামায, রোযা ও যাবতীয় সৎ কাজে উৎসাহ দেয়া তাঁর স্বভাব ছিলো। আমি শিশুকাল থেকেই লেখাপড়াই খুবই আগ্রহী ছিলাম। স্কুলে একজন ভালো ছাত্র হিসেবে গণ্য ছিলাম। প্রাইমারীর উর্ধে প্রত্যেক শ্রেনীতে ভালো ফলাফলের জন্য বৃত্তি পেতাম। গ্রামের বয়স্ক লোকেরা বলতেন ঐ গ্রামের ইতিহাসে আমিই প্রথম বৃত্তি পেয়েছি।"
পিতামাতার দেয়া প্রাথমিক শিক্ষা মানুষের স্বভাবে গভীরভাবে রেখাপাত করে থাকে। মালিক সাহেবের ব্যক্তিত্বে এই শিক্ষার প্রভাব ও আলামত তার সাথে দেখা করতে গেলে প্রথম দৃষ্টিতেই চোখে পড়ে। বিশেষত: দুটো গুণ অবশ্যই লক্ষ্য করা যাবে, সাদাসিধে জীবন ও ধর্মভীরুতা। এ দুটো গুণ মানব চরিত্রের শ্রেষ্ঠতম ভূষণ বিবেচিত হয়ে থাকে। ইসলামি জ্ঞান ও ইসলামি দাওয়াতের অঙ্গনে ইপ্সিত স্তর অতিক্রম করার সৌভাগ্য যার প্রাপ্য, সে দুটো উপাদানে ভূষিত না হয়ে ঐ স্তরসমূহ অতিক্রম করতে সক্ষম নয়।

লাহোর আগমন
গ্রামীণ জীবনের সব মহৎ গুণে ভূষিত হয়ে মালিক সাহেব নগর জীবনে পদার্পণ করলেন। তিনি বলেন: "আমাদের এলাকায় 'নও শহরা' একটা ছোট খাট কেন্দ্রীয় শহর। সেখানে হাইস্কুল, থানা ও বেসামরিক হাসপাতাল রয়েছ। আমি এই স্কুলেই শিক্ষা লাভ করেছিলাম। এখানে শিক্ষার ব্যবস্থা ও মান তেমন ভালো ছিলনা। এই স্কুলের জনৈক শিক্ষক আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। তিনি লাহোরের অধিবাসী ছিলেন। তাঁকে আমি বললাম লাহোরে গিয়ে লেখাপড়া করার কোনো সুযোগ যদি পাই, তবে খুবই ভালো হয়। আমার প্রস্তাবটা তাঁরও মনোপূত হলো। বিএবিএড এই শিক্ষকের নাম ছিলো মাওলানা আব্দুল গফুর। তার বাড়ি ছিলো কাবুলি মহল্লায়। তিনি সৎ ও দীনদার ছিলেন। তিনি বললেন: আমি আল্লাহ চাহে তো তোমার এ আকাঙ্খা পূরণের ব্যবস্থা করে দেবো। সত্যিই ব্যবস্থা করে দিলেন। আঞ্জুমানে হেদায়াতে ইসলামের পরিচালনাধীন শেরানওয়ালা হাইস্কুলে আমাকে ভর্তি করিয়ে দিলেন এবং উক্ত স্কুলের সবচেয়ে ভালো সেকশনটির অন্তর্ভুক্ত করে দিলেন।"

এভাবে মালিক সাহেব সোন সেকসর গ্রামের সরল ও সীমিত পরিবেশ থেকে বেরিয়ে আকস্মিকভাবে জীবনের প্রথম প্রহরেই লাহোরের মতো শহরে চলে এলেন। এই নতুন পরিবেশে সব কিছুই তাঁর কাছে অদ্ভুত মনে হওয়ার কথা। শিক্ষাঙ্গনে পারস্পরিক প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হওয়ার কথা। আভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে রকমারি রাজনৈতিক বির্তক প্রত্যক্ষ করে থাকবেন নিশ্চয়ই। সভ্যতার উপকরণসমূহ নিত্য নতুন চমক ও চাকচিক্য নিয়ে তাঁর সামনে প্রতিভাত হয়ে থাকবে। আল্লাহর বিশেষ রহমত না থাকলে এসব উপকরণ মানুষকে সত্য পথ থেকে বিভ্রান্তও করে দিতে পারে। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা মালিক সাহেবকে এখানেও তাঁর সাবেক সৎ গুনাবলী সংরক্ষণ করার ও তাকে আরো উৎকর্ষ দানের সুযোগ করে দিলেন। তিনি বলেন: শেরানওয়ালা ইসলামিয়া হাইস্কুলে সকল শ্রেণীর এবং সকল শিক্ষকের রীতি ছিলো যে, নামাযের সময় হলে আমাদের সকল শিক্ষক নিজ নিজ ছাত্রদেরকে সাথে নিয়ে মসজিদে চলে যেতেন। সেখানে তারা নিজেরাও নামায পড়তেন, আর ছাত্রদেরকেও পড়াতেন। কোনো কোনো ছাত্র বলতো শেরানওয়ালা মসজিদ যখন নিকটেই তখন আমরা ঐ মসজিদেই নামায পড়বো। সতরাং ঐ মসজিদেই নামায পড়তে গিয়ে আমি মাওলানা আহমদ আলী সাহেবের দারস ও খুৎবা শোনার সৌভাগ্য লাভ করতে থাকি এবং তাঁর পেছনে নামায পড়তে থাকি। ঐ মসজিদটিতে দীর্ঘদিনব্যাপী নামায পড়ি। সেখানে তৎকালে প্রচুর দারস ও ওয়ায নসীহত ইত্যাদি হতো এবং সেখানকার পরিবেশ পর্যাপ্ত পরিমাণে ইসলামি ভাবধারা বিরাজ করতে।

কলেজ জীবন
স্কুলের শিক্ষা জীবন শেষে মালিক সাহেব কলেজে ভর্তি হন। সে যুগে কলেজে বৃটিশ শিক্ষা ব্যবস্থা দোর্দণ্ড প্রতাপে চালু ছিলো। এই শিক্ষা ব্যবস্থায় জড়বাদী দর্শনের শিক্ষা এতো বেশি দেয়া হতো যে, ইসলামি আকীদা বিশ্বাস ও নৈতিকতার ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে যেতো। একারণেই বৃটিশ ব্যবস্থার দরুন মুসলিম সমাজে নাস্তিকতা ও ধর্মহীনতা ছড়িয়ে পড়ে এবং তার ফলে মুসলিম যুবসমাজে নানা রকমের অনৈসলামিক মতবাদ ও চিন্তাধারার অনুপ্রবেশ ঘটে। সাহিত্য, ইতিহাস, সমাজ বিজ্ঞান, অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান এককথায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই চিন্তার নৈরাজ্য দেখা দেয়। এখানেও মালিক সাহেব আল্লাহর অসাধারণ অনুগ্রহে সিক্ত থাকেন। তিনি এমন কয়েকজন শিক্ষকের তদারকি লাভ করেন, যারা তাকে মহৎ থেকে মহত্তর হতে সাহায্য করতে থাকেন। মালিক সাহেব ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। এই কলেজে তিনি যেসব অধ্যাপকের সংস্পর্শে আসেন, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মাওলানা আলীমুদ্দীন সালেক মরহুম। তার কাছ থেকে মালিক সাহেব ফার্সি ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষা অর্জন করেন। মরহুম সালেক সাহেবের ধর্মানুরাগী স্বভাব ও মেজাজ সম্পর্কে মালিক সাহেব বলেন: তাঁর শ্রেণীতে কোনো ছাত্র খালি মাথায় বসবে, এটা ছিলো অসম্ভব। প্রত্যেক ছাত্র টুপি নিয়ে আসতো। অন্যান্য পিরিয়ডে তা কোথাও রেখে দিতো ফার্সির পিরিয়ডে টুপি পরতেই হতো। শার্টের বোতাম খোলা থাকলে তিনি আপত্তি জানাতেন এবং বলতন,'বোতাম আটকাও।' কারো মাথা খালি থাকলে তিনি জিজ্ঞেস করতেন:'তোমার নাম কি?' যদি কেউ জবাব দিতো যে, জনাব আমার নাম গোলাম আলী কিংবা গোলাম মুহাম্মদ তাহলে তিনি বলতেন, "না না তোমার অন্নপ্রাসন কোন্ গীর্জায় হয়েছে? তোমার খৃষ্টান নাম কি?"

প্রশিক্ষণের এ পদ্ধতির উপর এ যুগের মনোবিজ্ঞানীরা নানারকম আপত্তি তুলে থাকেন। তবে আমরা মনে করি, মুসলিম যুবকদের প্রশিক্ষণ যেমন তাদের চিন্তাচেতনার সংশোধনের জন্য জরুরি। তেমনি তাদের বাহ্যিক বেশভুষা সংশোধনের জন্যও অপরিহার্য। বাহ্যিক পরিশুদ্ধি আভ্যন্তরীন অবস্থার উপর প্রভাব বিস্তার করে থাকে।

মাওলানা আলীমুদ্দীন সালেক ছাড়া মালিক সাহেব কলেজ জীবনে আরো কয়েকজন মর্যাদাসম্পন্ন শিক্ষকের সান্নিধ্যে আসেন। তাঁরা তার সহজাত প্রতিভা, ইসলামি চেতনা এবং সত্যানুসন্ধানের মনোবৃত্তিকে দমন করার পরিবর্তে আরো উজ্জীবিত করেন। ঘটনাক্রমে এই কলেজেই কিছুদিনের জন্য মাওলানা মওদূদী রহ. শিক্ষক হিসেবে জ্ঞানদান করেন এবং তাঁর সাথে মালিক সাহেবের সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

আমার মতে, পরিস্থিতি ও ঘটনাপ্রবাহের এই ধারাবাহিকতাকে নিছক আকস্মিক ব্যাপার হিসেবে গণ্য করা যায়না। বরঞ্চ সত্যের সন্ধ্যানে ব্যাপৃত মানুষের জন্য সত্যের পথ সুগম করে দেয়ার মানসে আল্লাহর পক্ষ থেকে সহায়তা প্রদান করার যে রীতি প্রচলিত রয়েছে, সেটাই এই পুরো ঘটনা প্রবাহের পেছনে সক্রিয়।

মাওলানা মওদূদীর শিষ্যত্বের যুগ
মাওলানা মওদূদী কিভাবে ইসলামিয়া কলেজের সাথে জড়িত হলেন, সেই পটভূমি বর্ণনা প্রসঙ্গে মালিক সাহেব বলেন:
আমরা জানতে পারলাম এখন থেকে মাওলানা মওদূদী সাহেব ইসলামিয়াত পড়াবেন। মাওলানার আগে এ বিষয়টি পড়াতেন টুনকের মাওলানা ওমর খান। তিনি অত্যন্ত নেককার ও ন্যায়নিষ্ঠ লোক ছিলেন। তিনি অত্যধিক বৃদ্ধ হয়ে যাওয়ায় মাওলানা মওদূদী তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়ে আসেন। কলেজ কর্তৃপক্ষ যখন মাওলানার সাথে আলাপ করেন তখন মাওলানা বলেন : "আমি অবৈতনিক পড়াবো। কোনো পারিশ্রমিক নেবোনা। আমার কাজে তথা শিক্ষাদান পদ্ধতিতে আপনারা কোনো হস্তক্ষেপ করবেন না। আপনারা কোনো বিধিনিষেধ বা কড়াকড়ি আরোপ করবেন না। আমি নিজে খুবই ব্যস্ত মানুষ। তা সত্ত্বেও আপনারা যখন প্রস্তাব দিয়েছেন, তখন এ সুযোগকে কাজে লাগাবো। এভাবে নতুন শিক্ষিত বংশধরের কাছে আমার আহবান পৌঁছে যাবে।"

এই শর্তযুক্ত চুক্তি সম্পাদিত হয়ে যাওয়ার পর মাওলানা মওদূদী রহ. ইসলামিয়া কলেজে ইসলামিয়াত বিষয়ে অধ্যাপনা শুরু করে দেন। মাওলানার হাতে সময় কম থাকতো এবং প্রত্যেক শ্রেণীতে গিয়ে লেকচার দেয়া দুরূহ ছিলো। তাই তাঁর পরামর্শ অনুসারে সকল ছাত্রকে একটি বড় কক্ষে সমবেত করা হতো এবং তিনি একই সময়ে সকলের সামনে ভাষণ দিতেন। মালিক সাহেব বলেন : "এখানেই আমি মাওলানাকে প্রথম দেখলাম। তখন তাঁর চুল একেবারেই কালো ছিলো। কালো টুপি পরতেন। কখনো কখনো রুমী টুপিও পরে আসতেন।"

মাওলানা স্বীয় ভাষণের মধ্য দিয়ে ইসলামের মৌলিক শিক্ষা বিশ্লেষণ করতেন। তিনি বলতেন, ইসলাম কোনো পূজাসর্বস্ব বা নিছক ইবাদত আরাধনার ধর্ম নয়। ইসলামের আনুষ্ঠানিক ইবাদতগুলো আসলে মানুষকে একটা বৃহত্তর ও ব্যপাকতর ইবাদতের জন্য প্রস্তুত করে থাকে এবং এসব ইবাদত সমগ্র জীবনের উপর প্রভাব বিস্তার করে। ইসলামের একটা ব্যাপক সর্বাত্মক সামষ্টিক বিধান রয়েছে, যা জীবনের প্রতিটি অংশের সাথে সম্পৃক্ত। এতে রাজনীতি, অর্থনীতি ও সামাজিক রীতিনীতি রয়েছে। এককথায়, জীবনের সব কিছুই এর অন্তর্ভুক্ত। রাজনীতি এর আওতা বহির্ভুত নয়।

মাওলানার অনুসৃত ইসলামের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের এই ধারা দেখে কলেজ কর্তৃপক্ষ কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন। এ ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ আর কিছু নয়। মানুষকে মানুষের গোলামী থেকে মুক্তি লাভের এবং স্বেচ্ছাচারী খোদাদ্রোহী ব্যবস্থাকে উৎখাত করে পৃথিবীতে আল্লাহর সত্য দীনকে বিজয়ী করার আহবান ছিলো। এ ধরণের আহবান প্রত্যেক যুগেই প্রত্যেকে কর্তৃত্বশীল ও ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীকে উদ্বিগ্ন করেছে। যে সময়ে মাওলানা ইসলামিয়া কলেজে নতুন প্রজন্মের তরুণদের সামনে ইসলামের এই ব্যাখ্যা পেশ করছিলেন, সেটি ছিলো ইংরেজদের যুগ। ঐ কলেজ শাসকদের আর্থিক সাহায্য নিয়েই চলতো। তাই কলেজ কর্তৃপক্ষ মনে করলেন, মাওলানার এই শিক্ষা কার্যক্রমের দরুণ তাদের ক্ষতি হওয়ার আশংকা রয়েছে। তারা মাওলানাকে নিছক ধর্মীয় শিক্ষার ভেতরে আপন অধ্যাপনা সীমিত রাখতে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু এই বিধিনিষেধ ও নিয়ন্ত্রণ মাওলানার মনপূত ছিলোনা। তিনি যখন বুঝতে পারলেন কর্তৃপক্ষ তার অধ্যাপনায় শংকিত হয়ে পড়েছেন, তখন তিনি স্বত:প্রবৃত্ত হয়ই ঐ কার্যক্রম বন্ধ করে দিলেন।

মাওলানা মওদূদীর সাথে ঘনিষ্ঠতা
মাওলানা মওদূদীর সাথে মালিক সাহেবের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ইতিমধ্যেই গড়ে উঠেছিলো। মালিক সাহেব বলেন : "মাওলানার এক আধটা বক্তৃতা শুনেই আমরা তাকে মন উজাড় করে ভালোবেসে ফেলেছিলাম।"

মাওলানা যখন কলেজ ছেড়ে দিলেন, তখন মালিক সাহেব নিজের লেখাপড়া মাঝপথেই বন্ধ করে দিলেন এবং মাওলানার সাহচর্যে থাকতে আরম্ভ করলেন। এই সাহচার্য নেহায়েত আবেগ বা অন্ধ ভক্তিনির্ভর ছিলোনা। তিনি সচেতনভাবে মাওলানার দাওয়াতকে হৃদয়ঙ্গম করেন, তাঁর সাথে বহু বিষয়ে আলোচনা করেন, অত:পর নিজের সকল দ্বিধাদ্বন্দ্বের অবসান ঘটিয়ে পরিপূর্ণ আত্মতৃপ্তি সহকারে মাওলানার সহযাত্রী হয়ে যান। মালিক সাহেবের কতিপয় শিক্ষক তাঁকে এ পদক্ষেপ থেকে বিরত রাখতে চেষ্টা করেন এবং সেটা তারা ভালো মনে করেই করেন। কিন্তু মালিক সাহেব নিজের মন ও চেতনার আলোকে যে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন, তা অপরিবর্তিত থাকে এবং আল্লাহর ইচ্ছাও তার পেছনে সক্রিয় ছিলো।

লেখাপড়া বাদ দেওয়ার পর মালিক সাহেব দীন প্রতিষ্ঠাকে জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেন। তাঁর জীবনে এটা এমন একটা মৌলিক বিপ্লব ছিলো, যাকে ভাসা ভাসা দৃষ্টিতে দেখে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। একজন তরুণ শিক্ষার্থী, যার উপর তার পিতামাতার হাজারো আশা ভরসা এবং পার্থিব দৃষ্টিতে যার নিজের সামনেও উজ্জ্বল ভবিষ্যতের হাতছানি বিদ্যমান, সে যদি এমন সিদ্ধান্ত নেয়, যাতে পিতামাতার আশা ভরসাও পূর্ণ হয়না এবং নিজের ব্যক্তিগত আকাঙ্খা চরিতার্থ হওয়ারও অবকাশ থাকেনা, তা হলে ঐ সিদ্ধান্তকে নিশ্চিতভাবেই কোনো উচ্চতর ঈমানী প্রেরণার অভিব্যক্তি মনে করতে হবে। ইকামতে দীনের সুমহান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে উপলব্ধি করে মালিক সাহেব মাওলানার কাছে উপস্থিত হলেন এবং বলতে লাগলেন : "আমি নিজের পরাজয় স্বীকার করছি। আমি মনে করি, এটাই একজন মুসলমানের প্রকৃত করণীয় কাজ। আল্লাহ অবশ্যই কোনো মুসলমানকে এমন কাজের নির্দেশ দেননি, যা তার পক্ষে অসম্ভব। আমরা সে কাজকে তার চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারি কিনা, সেটা অবশ্য ভিন্ন কথা।"

জবাবে মাওলানা রহ. এই প্রতিভাধর তরুণের কাছে যে বক্তব্য তুলে ধরেন, তা ইসলামের মহান আহবায়ক হিসেবে তাঁর ব্যক্তিত্বের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য উন্মোচন করে : "বস্তুত: মুসলমানের করণীয় কাজ এটাই। মুসলমান হিসেবে ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগতভাবে পৃথিবীতে ইসলামের দাওয়াত ছড়িয়ে দেয়া এবং দীনকে প্রতিষ্ঠিত করাই আমাদের দায়িত্ব। চাই তাতে সফলতা লাভ হোক বা না হোক। ফলাফল তো আল্লাহর হাতেই। বহুসংখ্যক নবী এমন অতিবাহিত হয়েছেন যে, কেউবা একজন অনুসারী পেয়েছেন, কেউবা দু'জন পেয়েছেন। কেয়ামতের দিন কোনো কোনো নবী মাত্র একজন বা দু'জন করে সাথি নিয়ে আসবেন। কোনো কোনো নবীকে তো পরিবারের লোকেরাও মান্য করেনি। কাজেই এ জিনিসের তোয়াক্কা না করা চাই। আল্লাহর মেহেরবানীতে কোটি কোটি মুসলমান রয়েছে। তারা চাইলে আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠা কেন সম্ভব হবে না?"

মাওলানা সাহেব বললেন : "কমুনিজমকে যখন নিছক একটা মতবাদের আকারে পেশ করা হয়, তখন কেউ ভাবতেও পারেনি যে, মানব প্রকৃতির প্রতিকূল এই মতবাদ এমন প্রতিষ্ঠা লাভ করে করে ফেলবে। কিছু লোক ময়দানে নেমে পড়লো, কম্যুনিজমের জন্য তৎপরতা চালালো এবং তারা সফলতা লাভ করলো। যেসব দেশে কম্যুনিজম বাস্তবায়িত হবে বলে তারা ভেবেছিলো, সেখানে হলোনা। সুসভ্য ও উন্নত দেশগুলোতে কম্যুনিজম চালু করা গেলোনা। রাশিয়াতে গিয়ে চালু হয়ে গেলো। সম্ভব আর অসম্ভব কথাটা তো আপেক্ষিক পরিভাষা। যে উদ্দেশ্যের জন্য মানুষ প্রাণপণ সংগ্রাম করে এবং তার পক্ষে আল্লাহর মঞ্জুরী থাকে, তা সফলতা অর্জন করে। ব্যর্থ হলে সে ক্ষেত্রে আমরা আল্লাহর কাছে দায়মুক্ত হয়ে যাবো এবং বলতে পারবো, হে আল্লাহ  আমরা সাধ্যমত চেষ্টা করেছি।"

মাওলানা মওদূদীর রহ. এই আবেগময় ও প্রেরণাদায়ক জবাবের পর মালিক সাহেব যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন তাও চমকপ্রদ বটে। মালিক সাহেব বললেন : "বাতাস অনুকূলই হোক আর প্রতিকূলই হোক, আমরা পানিতে নৌকা ভাসিয়ে দিয়েছি। আমিও আপনার সাথি। আমি বয়সে তরুণ। ইসলামি শিক্ষা আমার তেমন বেশি নেই, তবে একেবারে অকাট মূর্খও নই। যা হোক, আমি আপনার সাথে যুক্ত হলাম। এই মহৎ উদ্দেশ্যে জীবন উৎসর্গ করার অঙ্গীকার করলাম।"

দৃঢ়তা ও অবিচলতা
এই বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত নেয়ার পর মালিক সাহেব লেখাপড়া অসম্পূর্ণ রেখে দিলেন। আগেই বলেছি মালিক সাহেব লেখাপড়া অসম্পূর্ণ রেখে দেয়ার পর তার সুযোগ্য শিক্ষকগণ তাকে অনেক বোঝালেন যে, এটা নিতান্তই আবেগতাড়িত সিদ্ধান্ত। শিক্ষা সম্পূর্ণ না করা কোনো বুদ্ধিমানসুলভ পদক্ষেপ নয়। কিন্তু মালিক সাহেব স্বীয় সিদ্ধান্তে অটল রইলেন এবং ঐসব বিদ্বান ব্যক্তির এ ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো যে, মালিক সাহেব নিছক আবেগের বশবর্তী হয়ে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। মালিক সাহেব এ সিদ্ধান্তটা খুব জেনে বুঝেই নিয়েছিলেন এবং পরবর্তী সময়ে স্পষ্ট হয়ে গেলো যে, যে ফায়সালাকে লোকেরা শিক্ষার অপরিপক্কতা থেকে উদ্ভূত বলে ভেবেছেন, সেটা মালিক সাহেবের জন্য শুধু যে শিক্ষার উন্নতির সোপান সাব্যস্ত হয়েছিল তা নয়, বরং তার কর্মের উৎকর্ষ সাধনে সহায়ক হয়েছিল।

এবার মালিক সাহেব মাওলানার সার্বক্ষণিক সহযোগী ও সহকর্মী হয়ে গেলেন। নিজের দৈনন্দিন প্রয়োজন পূরণে পরিবারের উপর বোঝা চাপানোর পরিবর্তে লাহোরের অভ্যন্তরেই কয়েকটি টিউশন যোগাড় করে নিজের ব্যয় নির্বাহের ব্যবস্থা করে নিলেন। বাদ বাকি সময় মাওলানার সাথে কাটিয়ে তাঁর বিভিন্ন কাজে অংশ নিতে লাগলেন। ক্রমে টিউশনের পেশার প্রতিও তার বিতৃষ্ণা ধরে গেলো। কেননা দেশে বৃটিশ সাম্রাজ্যের শক্তি বৃদ্ধি সহায়ক যে শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলিত ছিলো এ কাজটা তারই এক ধরণের সেবা ছাড়া কিছু নয়। তাই তিনি প্রাইভেট পড়ানোর কাজটাও ছেড়ে দিলেন এবং একেবারেই বেকার হয়ে গেলেন। মালিক সাহেবের এ সিদ্ধান্তে মাওলানা বেশ খানিকটা ভাবনায় পড়ে গেলেন যে, এখন কি হবে। কারণ মাওলানা নিজেও তখন খুবই অনটনের মধ্যে ছিলেন এবং মালিক সাহেবের জন্য জীবিকার সংস্থান হতে পারে এমন কোনো কাজ তাঁর হাতে ছিলনা। মালিক সাহেব নিজেও কাজকর্ম না করে মাওলানার উপর আর্থিক বোঝা হয়ে বসতে চাইছিলেন না। পক্ষান্তরে তিনি এটাও অনুভব করলেন যে,  তিনি মাওলানাকে ভাবনায় ফেলে দিয়েছেন। তবে তিনি মাওলানার উদ্বেগ এই বলে নিরসন করলেন যে, "আল্লাহ একটা না একটা উপায় বের করে দেবেন। তিনিই উপায় উপকরণের সংগ্রাহক ও নিয়ামক।"

কথাটা খুবই সাদামাটা এবং সংক্ষিপ্ত বটে। তবে এর ভেতর দিয়ে সেই শিক্ষারই প্রতিফলন ঘটেছিল, যা মাওলানা মওদূদী রহ. বিংশ শতাব্দীর বস্তুবাদী মানুষকে বিতরণ করেছিলেন।

জলন্ধরে এক'বিরল পণ্যের' আবির্ভাব
মালিক সাহেবের নবোদ্ভুত পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে মাওলানা নিজের এক বন্ধু আব্দুল আযীয শারক্কীকে জলন্ধরে চিঠি লিখে পাঠালেন যে, এই সত্যনিষ্ঠ যুবকটির একটা কিছু কর্মসংস্থান করুন। শারক্কী সাহেব মালিক সাহেবকে জলন্ধর ডেকে নিলেন এবং সেখানে ছোট একটা লাইব্রেরি খুলে সেটি তার দায়িত্বে সমর্পণ করলেন। এই লাইব্রেরির অবস্থা কি ছিলো, তা লাইব্রেরির সাইন বোর্ডে মালিক সাহেবের নিজে লিখে টানানো নিম্নো পংক্তিটি থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় : "একটা বিরল পণ্যের আবির্ভাব ঘটেছে, যদিও অধিকাংশ খরিদ্দার এ সম্পর্কে অজ্ঞ। আমরা এ শহরে সবার চেয়ে ভিন্ন ধরনের দোকান খুলেছি।"

এহেন অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে তার দিনরাত অতিবাহিত হতে থাকে। দোকান থেকে কোনো আয় রোজগার হতো না। জীবিকা উপার্জনের সকল পথ রুদ্ধ ছিলো। এমন অগ্নি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া খুব কম লোকের পক্ষেই সম্ভব হয়ে থাকে। আল্লাহ যাদের বিশেষ অনুগ্রহ বর্ষণ করেন, সেই ভাগ্যবান ব্যক্তিরা ছাড়া এ পরীক্ষায় কেউ উত্তীর্ণ হতে পারে না। বস্তুত মালিক সাহেব এই মুষ্টিমেয় ভাগ্যবানদের মধ্যেই গণ্য।

জামায়াতের প্রতিষ্ঠা সম্মেলনে যোগদান
১৯৪১ সালে যখন মাওলানা মওদূদী রহ. জামায়াত প্রতিষ্ঠার সংকল্প নেন, তখন যেসব সমমনা ব্যক্তিকে চিঠি লিখে লাহোরে ডেকে আনেন, তাদের মধ্যে মালিক সাহেবও ছিলেন। তিনি জলন্ধর থেকে এ সম্মেলনে যোগদান করেন। এই সম্মেলনেই জামায়াতে ইসলামী প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এদিক থেকে বিবেচনা করলে মালিক সাহেব জামায়াতের সেইসব সদস্যের অন্যতম, যাদেরকে জামায়াতে ইসলামীর'আস সাবেকুন আল আউয়ালুন' (সর্বপ্রথম দলভুক্ত) সদস্য উপাধিতে ভূষিত করা যায়।

দারুল ইসলামে অবস্থান
জামায়াত প্রতিষ্ঠার পর মাওলানা রহ. যখন পুনরায় পাঠানকোর্টস্থ দারুল ইসলামে গিয়ে বসবাস করা শুরু করলেন, তখন মালিক সাহেবকে জলন্ধর থেকে নিজের কাছে ডেকে আনেন এবং জামায়াতে ইসলামীর প্রকাশনীর দায়িত্ব তার হাতে সমর্পণ করেন। মালিক সাহেব'মাকতাবায়ে জামায়াতে ইসলামী'র পরিচালক ছিলেন বটে, তবে বইপুস্তকের প্যাকিং করা ও পোস্ট অফিসে পৌঁছানোর কাজ পর্যন্ত তিনি নিজেই করতেন। এক অনাবিল সম্মোহনে তিনি এ কাজ সমাধা করতে থাকেন। এতে তার না ছিলো গৌরবের প্রতি কোনো আগ্রহ, না ছিলো ধন সম্পদের কোনো মোহ আর না ছিলো নিজের দারিদ্র্য নিয়ে কোনো উদ্বেগ।

মালিক সাহব আজন্ম জ্ঞানপিপাসু। দারুল ইসলামে তিনি পেয়েও গেলেন জ্ঞানার্জনের পরিবেশ। এই পরিবেশ সম্পর্কে তিনি নিজের মনোভাব ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেছেন : "এই জায়গায় আমার মন বসে গেলো। এমন পরিবেশ আর কখনো পাইনি। সেখানে আমাদের নিজস্ব একটা বসত ছিলো। নিজস্ব পরিবেশ ছিলো। খুবই নিয়মিতভাবে কুরআন ও হাদিসের শিক্ষাদান করা হতো। মাওলানা আমিন আহসান ইসলাহী দারসে কুরআন এবং মাওলানা মওদূদী রহ. দারসে হাদিস দিতেন। মাওলানা রহ. সেখানে সমগ্র মিশকাত শরিফ পড়িয়েছেন।" "দারুল ইসলামের জীবন ছিলো অত্যন্ত সহজ সরল। সব কাজ আমরা নিজ হাতে করতাম। নিজেরাই পানি উঠাতাম। জ্বালানী কাঠ নিজেরাই কেটে আনতাম এবং রাতে নিজেরাই নিজেদের পাহারা দিতাম।"

এই সময় মালিক সাহেব আরবি ভাষায় নিজের দক্ষতা বৃদ্ধি করেন। বিশ্রাম ও বিনোদনের সময়টায় তিনি দারুল ইসলামের নিকটবর্তী আপারবারী নদীর কিনারে গিয়ে বসতেন এবং আরবি ব্যাকরণ ও রচনা রপ্ত করার সাধনায় নিয়োজিত হতেন। শুরুতে লাহোরে থাকাকালে তিনি ব্যক্তিগতভাবে আরবি ভাষা শেখার সূচনা করেছিলেন। দারুল ইসলামে অবস্থানকালে তাতে উন্নতি সাধন করেন। বর্তমানে মালিক সাহেব পাণ্ডিত্যের যে উঁচু মর্যাদায় আসীন, তা তার সেই নিয়মিত অধ্যবসায়ের বদৌলতেই অর্জিত হয়েছে, যাকে তিনি নিজের অভ্যাসে পরিণত করেছিলেন।

লাহোরে মাওলানা মওদূদীর ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর দারুল ইসলামের গোটা কাফেলা লাহোর চলে আসে। এখানে পৌঁছার পর মাওলানা রহ. আর তাকে প্রকাশনা বিভাগের দায়িত্বে রাখেননি। তার পরিবর্তে এই অসাধারণ প্রতিভাকে তিনি নিজের বিশেষ সহকারী নিযুক্ত করে অধিকতর মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেন। এভাবে মৌলিক গবেষণা ও গ্রন্থ প্রণয়নের দায়িত্ব দিয়ে তাকে সর্বাত্মক জ্ঞান চর্চার অঙ্গনে স্থানান্তরিত করেন। এরপর মালিক সাহেবের জন্য জ্ঞানের ভূবনে ক্রমোন্নতির দুয়ার খুলে যায়। এই দুয়ার খোলার কাজে মাওলানার সযত্ন তত্ত্বাবধান যেমন অবদাব রাখে, তেমনি স্বয়ং মালিক সাহেবের একনিষ্ঠতা, একাগ্রতা এবং দুনিয়ার মোহবর্জিত নিরাসক্ত জীবনও পদে পদে তাকে সহায়তা দেয়। উস্তাদের উদার দান এবং শাগরিদের একনিষ্ঠ সাধনা এ দুই উপাদান মিলিত হয়ে জ্ঞানের সুবিশাল রাজ্যে সন্ধানীর অবাধ পদচারণার পথ সুগম করে তোলে। মালিক সাহেব শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মাওলানার বিশেষ সহকারী হিসেবে কর্মরত থাকেন। "বস্তুত: এটা একমাত্র আল্লাহ প্রদত্ত পরম সৌভাগ্য, যে তিনি নিজের মনোনীত লোকদেরকেই দিয়ে থাকেন।" (আল কুরআন) এই তাত্ত্বিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি মালিক সাহেব একজন কর্মী হিসেবে আন্দোলনের অন্যান্য খিদমত যথারীতি চালিয়ে যান। উদাহরণস্বরূপ, বিভিন্ন মসজিদে জুমার খুৎবা দান, প্রশিক্ষণ শিবিরগুলোতে ভাষণ ও দারস দান ইত্যাদি।

মালিক সাহেবের সাথে আমার প্রত্যক্ষ পরিচয় ও যোগাযোগ ঘটে ১৯৫৫ সালে। আমি জামায়াতের আরবি বিভাগ 'দারুল আরুবাতে' যোগ দিই ১৯৫৫ সালের মার্চ মাসে। সে সময় মালিক সাহেবের পরিচালিত 'প্রশ্নোত্তর বিভাগ' সরাসরি মাওলানার রহ. সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলো। কাজের দিক দিয়েও এই দুই বিভাগের পারস্পরিক সাদৃশ্য ছিলো। একটির সম্পর্ক পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ এবং অপরটির সম্পর্ক পাকিস্তান বহির্ভূত জগতের সাথে ছিলো। এভাবে বহু বছর যাবত এ দুটো বিভাগ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলতে থাকে। কোনো মানুষকে জানা ও চেনার জন্য এতোটুকু ঘনিষ্ঠতা যথেষ্ট হয়ে থাকে। তাছাড়া আমি ও মালিক সাহেব কমপক্ষে চৌদ্দ বছর ইসরাতে প্রতিবেশি হিসেবে বসবাস করেছি। উভয়ের বাসগৃহের সাথে মামুলি একটা দেয়ালের ব্যবধান ছিলো। এই দীর্ঘ প্রতিবেশিত্বের বিবরণ এক কথায় দিতে গেলে বলতে পারি যে, "মালিক সাহেব একজন সহনশীল ও সহানুভূতিশীল প্রতিবেশি।"

মালিক সাহেবের পাণ্ডিত্য ও মনীষা
জ্ঞানগত দিক দিয়ে মালিক সাহেক একজন বর্ণাঢ্য ও বহুমুখী ব্যক্তিত্ব। যদিও তিনি কলেজের পড়াশুনা অসম্পূর্ণ রেখে দিয়েছিলেন, কিন্তু ইংরেজি ভাষায় তার অসাধারণ দখল রয়েছে। ইংরেজি সাহিত্যে তার পড়াশুনা অত্যন্ত ব্যাপক। এ কারণেই বিশ্বের চলমান পরিস্থিতি এবং আদর্শিক ও তাত্ত্বিক আন্দোলনগুলো সম্পর্কে তিনি পূর্ণমাত্রায় ওয়াকিবহাল। মরহুম মাওলানার ইংরেজি পত্রালাপে মালিক সাহেবের যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে মালিক সাহেবের দক্ষতার একটা উদাহরণ এই যে, অধ্যাপক আব্দুল হামিদ সিদ্দিকী ইংরেজি ভাষায় যেসব রচনা লিখে থাকেন, তা তিনি অনেক পীড়াপীড়ি করে মালিক সাহেবকে দিয়ে যাঁচাই বাছাই করিয়ে নেন। বিশেষত 'লাইফ অব মুহাম্মদ' সা. পবিত্র কুরআনের ইংরেজি অনুবাদ এবং সহীহ মুসলিমের ইংরেজি অনুবাদ মালিক সাহেবের নজর বুলানো গ্রন্থ। ইংরেজি থেকে উর্দুতে মালিক সাহেব যে অনুবাদ কর্মগুলো সম্পাদন করেছেন তাতেও তাঁর ভাষাগত দক্ষতা ও পরিপক্কতার প্রতিফলন ঘটে। আরবি ভাষায় তো মালিক সাহেবের দখল তার স্বকীয় চেষ্টারই ফসল। প্রাচীন ও আধুনিক উভয় ধরনের আরবি সাহিত্যে তিনি সুদক্ষ। হাদিস ও ফিকাহ শাস্ত্রের জটিলতম ও সূক্ষ্মতম বিষয়গুলোতে মালিক সাহেবের যে সুগভীর পাণ্ডিত্য, তা পাকিস্তানে অতি অল্প সংখ্যক লোকের মধ্যেই পাওয়া যায়। ফেকাহ শাস্ত্রে সাধারণ মাসয়ালা থেকে শুরু করে পারিবারিক বিধান ও পারস্পরিক লেনদেন সংক্রান্ত বিধি এবং রসূল সা.-এর জীবনেতিহাস ও সমরবৃত্তান্তের যে সব বিষয় মাদরাসাগুলোতেও কদাচিত পড়ানো হয়ে থাকে, সেসব বিষয় মালিক সাহেবের কণ্ঠস্থ। এই জ্ঞান মাওলানার রহ. সাথে দৈনন্দিন মাসয়ালাগুলো নিয়ে আলাপ আলোচনায় অংশগ্রহণের বদৌলতেই অর্জিত হয়েছে। সাধারণভাবে মালিক সাহেবের বেশ কয়েকটা লেখাই অত্যন্ত উঁচু জ্ঞানের গবেষণা ও যুক্তিবুদ্ধি সমৃদ্ধ। তবে তার জ্ঞানের গভীরতার সবচেয়ে বড় স্বাক্ষর হলো তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনা 'খেলাফত ও মুলকিয়াত পর ইতিরাযাত কা এলমী জায়েযা' (খেলাফত ও রাজতন্ত্র সংক্রান্ত প্রশ্নাবলীর তাত্বিক পর্যালোচনা) এ গ্রন্থটি পড়লে বুঝা যাবে তিনি একিদিকে যেমন ফেকাহ ও হাদিস বিশারদ, অপরদিকে তেমনি ইতিহাস ও ইসলামি রাষ্ট্র বিজ্ঞানের একজন অন্যতম বিশেষজ্ঞ।

আধুনিক আরবি সাহিত্যেও তিনি যথেষ্ট ব্যুৎপত্তি সম্পন্ন। এ যুগের বিশিষ্ট সিরিয় আলেম মরহুম ডক্টর মোস্তফা সাব্বায়ীর লেখা হাদিস বিষয়ক নিবন্ধ সমষ্টি, (যা উর্দুতে 'সুন্নাতে রসূল' নামে অনূদিত ও প্রকাশিত হয়েছে) এবং মিসরের ইখওয়ান নেতা শহীদ আব্দুল কাদের আওদীর প্রণীত গ্রন্থ 'আল ইসলাম ওয়া আওযাউনাল কানুনিয়াহ' এর উর্দু অনুবাদ 'ইসলাম কা নিযামে কানুন' (ইসলামের আইন ব্যবস্থা) মালিক সাহেবের আরবি ভাষায় পারদর্শীতার প্রকৃষ্টতম দৃষ্টান্ত।

উর্দুতেও আল্লাহ তায়ালা তাঁকে অত্যন্ত প্রাঞ্জল বাচনভঙ্গীর অধিকারী করেছেন। তাঁর বাচনভঙ্গীতে স্বয়ং মাওলানা মওদূদীর বাকরীতির প্রতিফলন ঘটতে দেখা যায়। মাওলানার রচনার দুটো বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। একটি হলো চমকপ্রদ বর্ণনাভঙ্গী আর অপরটি ক্ষুরধার যুক্তি।

মালিক সাহেবের লেখাতেও এ দুটো বৈশিষ্ট্য অনেকাংশে বিদ্যমান। প্রকৃত ব্যাপার এই যে, মালিক সাহেব মাওলানার সাহচার্য থেকে তাঁর গুণাবলী আয়ত্ত করার ব্যাপারে এতোটা কৃতিত্ব দেখিয়েছেন যে, কোনো কোনো লেখায় উভয়ের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করাই কঠিন হয়ে পড়ে। এ যেন ফুলের সাহচার্যে মাটির সুরভিত হয়ে যাওয়ার আরেক জ্বলন্ত উদাহরণ।

ব্যক্তিত্ব
মালিক সাহেবের ব্যক্তিগত গুণাবলী ও স্বভাব চরিত্রে অতীতের মহান মনীষীদের ছাপ লক্ষ্যণীয়। তাঁর ব্যক্তিত্ব আপাদমস্তক বিনয়ে মণ্ডিত। আত্ম প্রশংসার প্রবণতা নামমাত্রও নেই। মেজাজের দিক দিয়ে একেবারেই মাটির মানুষ। কথাবার্তায় কোমলতা, প্রয়োজন ছাড়া নীরবতা পালন, বৈঠককাদিতে মাপজোখ কথা বলে ক্ষান্ত থাকা, বেশভূষা ও চালচলনে একেবারেই সাদাসিধে, বিদ্যার অতলান্ত সাগর অথচ বিদ্যার গর্ব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত, জ্ঞানের অন্বেষায় সাহসী ও সংকোচহীন, আর মুখে সব সময় একই কথা যে, আমি একজন শিক্ষার্থী মাত্র।

মালিক সাহেব ১৯৮১ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিগত মনোনয়নক্রমে ফেডারেল ইসলামি আদালতের বিচারপতি নিযুক্ত হন। চার বছর এই পদে বহাল থাকেন। ১৯৮৫ সালে আদালত থেকে অব্যাহতি পান। বর্তমানে তিনি মানসূরায় ইসলামি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে আগের মতই গবেষণা কর্মে নিয়োজিত।

১৯২০ সালে মালিক সাহেবের জন্ম। আল্লাহ তাকে দীর্ঘজীবী করুন। সৎকর্মে নিয়োজিত রাখুন।

বক্ষমান গ্রন্থ রাসায়েল ও মাসায়েল ৬ষ্ঠ খণ্ড মালিক সাহেবের বিভিন্ন সময়ে লেখা প্রশ্নোত্তরের সমষ্টি। এর অধিকাংশ প্রশ্নোত্তর স্বয়ং মাওলানা মওদূদীর রহ. জীবদ্দশায় তিনি লিখেছিলেন। তার উপর মাওলানার এতোটা আস্থা জন্মে গিয়েছিল যে, একসময় তাঁর লেখা জবাবগুলো মাওলানা আর পড়ে দেখারও প্রয়োজন বোধ করতেন না। এ যাবত আমরা কেবল মাওলানা মওদূদীর রহ. রচনাবলীই পাঠকবর্গের সামনে হাজির করেছি। এবার তাঁর এক সুযোগ্য শিষ্যের রচনা পেশ করতে পেরে আমরা আনন্দিত।




খলিল হামেদী
ডাইরেক্টর
ইদারায়ে মা'আরেফে ইসলামি
মানুসূরা, লাহোর
১৫ নভেম্বর ১৯৮৬ ঈসায়ী




বিস্‌মিল্লাহির রাহমানির রাহিম



সর্বশেষ আপডেট ( Friday, 04 March 2011 )