রাসায়েল ও মাসায়েল ৬ষ্ঠ খন্ড |
|
|
লিখেছেন সাইয়্যেদ আবুল আ'লা মওদূদী
|
Monday, 28 February 2011 |
পাতা 11 মোট 74
<h1>৯। একটি হাদিস থেকে সুদের বৈধতা প্রমাণের অপচেষ্টা</h1>
প্রশ্ন : সরকার যে প্রভিডেন্ট ফান্ড কেটে রাখে, সংশ্লিষ্ট কর্মচারীকে ঐ ফান্ড থেকে সুদ গ্রহণ করা ও না করার এখতিয়ার দেয়া হয়। সেভিং সার্টিফিকেটের ব্যাপারেও তদ্রুপ। জনৈক আলেম আমাকে বলেছেন, সরকার যদি নিজের পক্ষ থেকে কিছু দিতে চায়, চাই তা সুদের নামে হোক বা অন্য কোনো নামে হোক এবং তার হার নির্ধারিত হোক বা না হোক, তা গ্রহণ করা জায়েয। এটা সুদ নয়। তিনি একটা হাদিসের উল্লেখ করেছেন যে, রসূল সা. এক যুদ্ধের সময় প্রতিটি উটের বদলায় দুটো করে উট দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এ ঘটনা থেকে নাকি ইজতিহাদ করা চলে যে, সরকার ইচ্ছে করলে প্রয়োজনের সময় নিজের পক্ষ থেকে কিছু বাড়তি টাকা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে জনগণের কাছ থেকে টাকা ধার নিতে পারে। এভাবে যে বাড়তি টাকা দেয়া হয়, তা জায়েয। প্রমাণ চাইলে তিনি বুলুগুল মুরাম গ্রন্থের কিতাবুল বুয়ূ (ক্রয়-বিক্রয় অধ্যায়) এর একটি হাদিসের উল্লেখ করেন। হাদিসটি হলো, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আ'স বর্ণনা করেন যে :
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
অনুগ্রহপূর্বক উক্ত আলেম এই হাদিস থেকে যেভাবে যুক্তি প্রদর্শন করেছেন, সে সম্পর্কে আলোকপাত করুন। উল্লেখিত মাসয়ালাটি সঠিক কিনা জানাবেন।
জবাব : আপনার উদ্ধৃত হাদিস দ্বারা যদি কোনো আলেম অনুরূপ যুক্তি প্রদর্শন করে থাকেন, যা আপনার প্রশ্নে উল্লেখ করেছেন, তাহলে তার সাথে একমত হওয়া সম্ভব নয়। তার যুক্তিতর্ক একাধিক ত্রুটি ও ভুল বুঝাবুঝিতে পরিপূর্ণ। সতর্কভাবে হাদিসটির শাব্দিক অনুবাদ করলে এ রকম দাঁড়ায় :
"হযরত আমর ইবনে আ'স থেকে বর্ণিত, রসূল সা. তাঁকে একটা যুদ্ধের জন্য যাবতীয় সাজসরঞ্জাম তৈরির নির্দেশ দেন। অত:পর উট শেষ হয়ে গেলে রসূল সা. যাকাতের উষ্ট্রীসমূহের বিনিময়ে উট সংগ্রহ করতে বলেন। অত:পর আমি দুই উটের বিনিময়ে একটা উট নিচ্ছিলাম যতোক্ষণ না যাকাতের উট আদায় হয়ে যায়।"
এখানে প্রথম যে ব্যাপারটি লক্ষ্যণীয়, তা হলো, এক উটের বদলে দুই উট পাওয়া যাবে-এই মর্মে কোনো শর্ত স্বয়ং রসূল সা. আরোপ বা গ্রহণ করেছেন বলে এ হাদিস থেকে প্রমাণিত হয়না। এটা হযরত আমর ইবনুল আ'সের নিজস্ব উক্তি। রসূল সা, তাঁর এ কার্যক্রমের কথা জানতেন কিনা এবং তিনি বহাল রেখেছেন কিনা, সে সম্পর্কে এতে কোনো সুস্পষ্ট বর্ণনা নেই। এমনকি স্বয়ং হযরত আমর যাকাতের উট সংগৃহীত হবার পর এক উটের বদলে দুই উট দিয়েছিলেন কিনা সে কথাও স্পষ্ট নয়।
দ্বিতীয়ত: রেওয়ায়েতটির ভাষা থেকে সুস্পষ্টভাবে এ কথাও জানা যায়না যে, এ ঘটনটা ক্রয় বিক্রয় সংক্রান্ত ছিলো, না ঋণ সংক্রান্ত। টীকাকারদের কেউ কেউ এটাকে ক্রয় বিক্রয় অর্থে গ্রহণ করেছেন এবং কেউ কেউ গ্রহণ করেছেন ঋণ অর্থে। অর্থাৎ কারো ধারণা, উটগুলোকে কিনে নেয়া হয়েছিলো এবং তার দাম হিসেবে অন্য উট দেয়ার কথা ছিলো। আর অন্যদের মতে উটগুলো ঋণ হিসেবে নেয়া হয়েছিলো।
'বুলুগুল মুরাম'-এর গ্রন্থকার এ হাদিসকে হাকেম ও বায়হাকীর বরাতে উদ্ধৃত করে এর বর্ণনাকারীদের বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য বলে আখ্যায়িত করেছেন, সে কথা সত্য, তবে ইমাম বায়হাকী ও ইমাম হাকেমের বর্ণিত প্রত্যেক হাদিস এমন নয় যে, একটা সাধারণ বিশ্বস্ততার সার্টিফিকেটের উপর নির্ভর করেই তা নির্দ্বিধায় গ্রহণ করা যায়। বিশেষত, যখন তার মূল ভাষ্যে জটিলতা ও অস্পষ্টতা বিদ্যমান এবং তার প্রতিপাদ্য বিষয় বিপুল সংখ্যক বিশ্বস্ত হাদিসের পরিপন্থী। বুলগুল মুরামের বিশিষ্ট টীকাকার নওয়াব সিদ্দীক হাসান খান স্বীয় গ্রন্থ 'মিসকুল খিতামে' এই হাদিসকে দুর্বল প্রতিপন্নকারী একাধিক মনীষীর উক্তি উদ্ধৃত করেছেন এবং নিজের অভিমত নিম্নরূপ ব্যক্ত করেছেন :
"আমার মতে এ হাদিসের দুর্বলতার কারণ, এর বর্ণনাকারীদের মধ্যে মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক রয়েছেন, যিনি বিতর্কিত।"
তাছাড়া এ হাদিসে কোন্ যুদ্ধের কথা বল হয়েছে, তা যেমন হাদিসটির মূল ভাষ্য থেকে জানা যায়না, তেমনি টীকাকারদের বক্তব্য থেকেও তার সন্ধান মেলেনা। সুদ ও তদসংশ্লিষ্ট বিষয়টি সংক্রান্ত বিস্তৃত ও চূড়ান্ত বিধিমালা নবুওয়াতের শেষদিকে প্রবর্তিত হয়েছিলো। হয়তো বা এ ঘটনা তার আগেকার। তা যদি হয়ে থাকে তা হলে এ ধরনের লেনদেন বাতিল বলেই সাব্যস্ত হবার কথা।
এ প্রসঙ্গে সর্বশেষ ও সবচাইতে লক্ষণীয় কথা এই যে, এ হাদিস জীবজন্তুর লেনদেন ও বিনিময় সংক্রান্ত। আর এ ব্যাপারটা নগদ টাকাকড়ি ও জিনিসপত্রের লেনদেন থেকে একেবারেই আলাদা। গাবাদিপশুর কোনো নির্ধারিত বাজার দর বা রেট নেই। এগুলোকে মাপা ও ওজন করা যায়না এবং বয়স প্রজাতি কর্মক্ষমতা উপকারিতার বিচারে একই শ্রেণীর এক জানোয়ারের সাথে আরেক জানোয়ারের অনেক পার্থক্য থাকে। এজন্য বিশেষভাবে জীবজন্তুর ক্ষেত্রে শরিয়তের বিধি তেমন কড়া ও চূড়ান্ত নয়। এ কারণেই ফেকাহবিদ ও হাদিসবেত্তাদের এ বিষয়ে বিস্তর মতান্তর ঘটেছে যে, যখন নগদে অথবা বাকিতে জীবজন্তুর বিনময় করা হবে, অথবা জীবজন্তু ঋণ হিসেবে দিয়ে জীবজন্তুই ফেরত নেয়া হবে, তখন সেক্ষেত্রে কমবেশি করা জায়েয কিনা। কারো কারো মতে, জীবজন্তর বয়স ও সংখ্যা ইত্যাদির দিক দিয়ে কমবেশি করলেও ব্যাপারটা যদি বেচাকেনা সংক্রান্ত হয় ও নগদ বিনিময় হয়, তাহলে সেটা জায়েয। কিন্তু জীবজন্তুর বিনিময়ে জীবজন্তুর ঋণের আদান প্রদান জায়েয নেই। এ মতের পক্ষে একটি হাদিস বুলুগুল মুরামের এই অধ্যায়েই রয়েছে :
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
"হযরত সামুরা বিন জুনদুব থেকে বর্ণিত, রসূল সা. জীবজন্তুর বিনিময়ে জীবজন্তুর বাকি বেচাবেকা নিষিদ্ধ করেছেন।"
এই মতেরই অনুসারিদের দৃষ্টিতে হযরত আমর ইবনুল আ'সের বর্ণিত হাদিস দলিল হিসেবে গ্রহণযোগ্য হতে পারেনা। কেননা জীবজন্তুর বিনিময়ে জীবজন্তুর বাকি কেনাবেচা যদি নিষিদ্ধ হয়ে থাকে, তাহলে জীবজন্তুর ঋণ হিসেবে দিয়ে পরে আবার জীবজন্তুর আদায় করা কিভাবে জায়েয হয়?
কোনো কোনো ফেকাহবিদ জীবজন্তুর বিনিময় আদৌ জায়েয মনে করেননা। চাই তা নগদে হোক বা বাকিতে হোক, কিংবা লেনদেনটা ঋণের হোক বা কেনাবেচার হোক।
কিন্তু আপনার ও উক্ত আলেম সাহেবের যিনি, প্রভিডেন্ট ফান্ড ও সেভিং সার্টিফিকেট (অথবা অন্যান্য ঋণ) এর ক্ষেত্রে সুদকে নিছক একটি দুর্বল হাদিসের ভিত্তিতে হালাল করার চেষ্টা চালিয়েছেন- উভয়েরই এ কথা পুনরায় ভালোভাবে বুঝে নেয়া উচিত যে, বিনিময়ে কমবেশি করা জায়েয কি নাজায়েয, তা নিয়ে যে মতভেদের কথা একটু আগেই উল্লেখ করা হলো, সেটা সোনারূপা বা টাকাকড়ির সাথে আদৌ সংশ্লিষ্ট নয়। ওটার সম্পর্ক শুধুমাত্র জীবজন্তু কিংবা অন্য কিছু দ্রব্যাদির সাথে। নচেত ১৪০০ বছরব্যাপী প্রাচীন ও আধুনিক মুসলিম আলেমদের সকলে এ ব্যাপারে পূর্ণ একমত যে, টাকা পয়সার নগদ অথবা ঋণ আদান-প্রদানে বাড়তি প্রদানের অগ্রিম শর্ত আরোপ করা নি:সন্দেহে সুদ এবং অকাট্যভাবে হারাম। এই সর্বসম্মত নীতির ভিত্তি কুরআন ও সুন্নাহর দ্ব্যর্থহীন ও চিরন্তন ঘোষণার উপর প্রতিষ্ঠিত। দুর্বল অস্ত্র দিয়ে এই ভিত্তিকে বিধ্বত্ব বা নড়বড়ে করার সাধ্য কারো নেই। [তরজমানুল কুরআন, আগস্ট ১৯৬৩]
|
সর্বশেষ আপডেট ( Friday, 04 March 2011 )
|