রাসায়েল ও মাসায়েল ৬ষ্ঠ খন্ড |
|
|
লিখেছেন সাইয়্যেদ আবুল আ'লা মওদূদী
|
Monday, 28 February 2011 |
পাতা 15 মোট 74
<h1>১৩। তাকদীর প্রসঙ্গ</h1>
প্রশ্ন : জনৈক ব্যক্তি এক অদ্ভুত আপত্তি তুলেছে। তার বক্তব্য হলো, ধর্মীয় শিক্ষা অনুসারে প্রত্যেক মানুষের মৃত্যুর সময় নির্দিষ্ট রয়েছে। সেই সময়ের আগ-পাছ হওয়া কোনো প্রকারেই সম্ভব নয়। অথচ আমরা দেখতে পাই, পাশ্চাত্যের জাতিগুলো স্বাস্থ্য রক্ষার নীতিমালা মেনে চলা ও রোগ প্রতিরোধের মাধ্যমে নিজেদের গড় আয়ু বৃদ্ধি ও মৃত্যুর হার হ্রাস করে ফেলেছে। এর দ্বারা বুঝা যায়, আয়ু কমানো বাড়ানো যায় এবং মৃত্যুকে বিলম্বিত করা মানুষের আয়ত্বের ভেতরে। এই দুটো বক্তব্যের মধ্যে কোন্টি সঠিক জানাবেন। আয়ুষ্কালও মৃত্যুর সময় কি নির্দিষ্ট, তাতে রদবদল করার ক্ষমতা মানুষের আছে?
জবাব : আপনি যে প্রশ্ন করেছেন তা আসলে একটা বৃহৎ মৌলিক প্রশ্নের অংশবিশেষ। মৌলিক প্রশ্নটি হলো, আল্লাহর ইচ্ছা ও অদৃষ্টের অধীন মানুষ কতোখানি অক্ষম ও অসহায়, কোন্ সীমানা পর্যন্ত তাকে ইচ্ছা ও কর্মের স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে এবং চেষ্টার দ্বারা ইপ্সিত ফলাফল অর্জন করা কতোদুর তার ক্ষমতা ও সাধ্যের আওতাধীন? এ প্রশ্নটি এমন নয় যে, সংক্ষেপে ও অনায়াসে তার জবাব ইতিবাচক বা নেতিবাচক পন্থায় দেয়া যেতে পারে। জবাবে যদি বলা হয়, মানুষ নিজেই নিজের ভাগ্য গড়তে সক্ষম এবং কোনো উচ্চতর শক্তি তার কার্যকলাপ ও তার ফলাফলের উপর প্রভাবশালী ও আধিপত্যশীল নয়, তাহলে এ বক্তব্য হবে স্পষ্টতই ভ্রান্ত। মানুষ যখন নিজেকে সৃষ্টি করতে সক্ষম নয়, তখন তার কৃতকর্মের স্রষ্টা ও নিয়ন্তা সে কি করে হতে পারে? আবার যদি বলা হয়, সে একেবারেই অক্ষম ও অসহায় এবং তার কোনোই ক্ষমতা ও স্বাধীনতা নেই, তবে সে কথাও স্পষ্টতই অসত্য, বিবেক ও বাস্তব অভিজ্ঞতার পরিপন্থী এবং ইসলামি শিক্ষারও বিপরীত।
প্রকৃত সত্য এই উভয় প্রন্তিক বক্তব্যের মাঝখানে অবস্থিত। একটি নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় মানুষ সীমিত স্বাধীনতার অধিকারী এবং এ স্বাধীনতা মানুষ ও বিশ্বজগতের স্রষ্টারই দান। সেই গণ্ডির বাইরে যাওয়ামাত্র মানুষের সকল স্বাধীনতা বিলুপ্ত ও নি:শেষ হয়ে যায় এবং তার যাবতীয় কর্মতৎপরতা ও তার ফলাফল শেষ পর্যন্ত আল্লাহর ইচ্ছার অধীন হয়ে যায়। নিজের স্বাধীনতা ও অধীনতার সীমানা কতোদুর তা মাপার চেষ্টা করা এবং এই ক্ষমতা ও অক্ষমতার সমন্বয় কিভাবে করা যায় তা নিয়ে মাথাত ঘামানো মানুষের কর্তব্য নয়। মানুষ যতোক্ষণ আপন মানবীয় বলয়ে আবদ্ধ এবং যতোক্ষণ সে সৃষ্টির স্থলে স্রষ্টায় পরিণত হতে না পারছে, ততোক্ষণ সে এই জটিল সমস্যার গভীরতম প্রকোষ্ঠ ও নিগুঢ়তম সমাধানে উপনীত হতে সক্ষম নয়। তার কর্তব্য শুধু এতোটুকুই, যে সীমানা পর্যন্ত তাকে স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে, সেই সীমানার ভেতরে থেকে তার স্বাধীনতা স্বীয় স্রষ্টার ইচ্ছে ও অভিলাষ মোতাবেক প্রয়োগ করতে হবে। আর যে সীমারেখার ওপারে স্বাধীনতা নেই, সেখানে সে স্বাধীন ও স্বয়ম্ভর হবার দাবি করতে পারবেনা।
এই মৌলিক তত্ত্ব বুঝে নেয়ার পর আপনি আয়ুষ্কালের হ্রাস বৃদ্ধির বিষয়টা নিজেই ভেবে দেখুন। আল্লাহ কার মৃত্যুর জন্য কোন্ সময়টা নির্ধারণ করে রেখেছিলেন এবং একটা বিশেষ যুগে ও সময়ে কোনো বিশেষ জাতির জন্য কি হারে গড় আয়ু নির্ধারণ করেছিলেন, তা কে জানে? এটা যদি কারো জানা না-ই থাকে, তবে অমুক ব্যক্তি আল্লাহর নির্ধারিত সময়ে মরার হাত থেকে নিস্তার পেয়েছে, কিংবা সে নিজে বা অন্য কেউ তার আয়ু বাড়িয়ে দিয়েছে এমন দাবি করাটা আপনা থেকেই নিরর্থক হয়ে যায়। এসব আসলে কাণ্ডজ্ঞানহীন কথাবার্তা। অনেকে না বুঝেসুজেই এ ধরনের কথাবার্তা বলে থাকে। আল্লাহ আমাদেরকে যে জ্ঞানবুদ্ধি দিয়েছেন তা কাজে লাগিয়ে যতোদুর সম্ভব রোগ নিরাময় ও স্বাস্থ্য রক্ষার সর্বোত্তম উপায় উপকরণ সংগ্রহ করাই আমাদের একমাত্র করণীয়। সেটা সংগৃহীত হলে আল্লাহর শোকর করা কর্তব্য। এর চেয়ে বেশি কোনো কিছু আমাদের এখতিয়ারে নেই। তা যদি থাকতো, তাহলে আমরা কাউকে রোগে ভুগতেও দিতামনা, মরতেও দিতামনা। কিন্তু রোগ মৃত্যু সম্পূর্ণরূপে রোধ করা আদিম যুগের মানুষেরও সাধ্য ছিলোনা, আজকের কোনো মানুষের পক্ষেও সম্ভব নয়, তা সে যতোবড় চিকিৎসক বা বৈজ্ঞানিকই হোক না কেন। [তরজমানুল কুরআন, সেপ্টেম্বর ১৯৬৪]
|
সর্বশেষ আপডেট ( Friday, 04 March 2011 )
|