রাসায়েল ও মাসায়েল ৬ষ্ঠ খন্ড |
|
|
লিখেছেন সাইয়্যেদ আবুল আ'লা মওদূদী
|
Monday, 28 February 2011 |
পাতা 16 মোট 74
<h1>১৪। গোমরাহী ও হেদায়েত</h1>
প্রশ্ন : সতের বছর বয়স থেকেই আপনার লেখা বইপুস্তক পড়তে শুরু করি। ১৯৫২ সাল নাগাদ প্রায় সকল বই কিনে পড়ে ফেলি। ১৯৫১ সালে করাচিতে জামায়াতের যে বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় তাতেও যোগদান করি। তারপর জামায়াতের সহযোগী সদস্য হয়ে যাই এবং যথাসাধ্য আল্লাহর হুকুম মেনে চলতে চেষ্টা করি।
কিন্তু ১৯৫৩ বা ১৯৫৪ সালে মাসিক পত্রিকার বর্ষপূর্তি সংখ্যা পড়ে এমন গোমরাহ হয়ে যাই যে, প্রায় কুফরির পর্যায়ে গিয়ে উপনীত হই। কয়েকবার আপনার পুস্তক তাফহীমাত (নির্বাচিত রচনাবলী) পড়া সত্ত্ব্বেও সংশয় দুর হয়নি। শেষ পর্যন্ত সকল ইসলামি বই পুস্তক ছেড়ে দেই।
১৯৬৫ সালের ডিসেম্বরে আপনার লেখা 'সুন্নাত কি আইনী হাইসিয়ত' (সুন্নাতে রসূলের আইনগত মর্যাদা) বইখানা হস্তগত হয়। ওটি পড়ার পর অনেক সন্দেহ সংশয় দুর হয়ে যায়। এখন আল্লাহর মেহেরবাণীতে ইসলামি বিধান অনুসরণ করার চেষ্টা শুরু করে দিয়েছি। এখন আমার জানতে ইচ্ছে করে :
১. জীবনের যে অংশটি আমি প্রথমে ইসলামি বিধান অনুসারে অতিবাহিত করেছি, আমি কি তার কোনো প্রতিদান পাবো, না কুফরিতে লিপ্ত হওয়ার কারণে তা বৃথা যাবে?
২. মানুষ যখন বিপদগামী হয়, তখন সময় সময় সদুদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়েও তেমনটি হয়ে থাকে। এমতাবস্থায় একজন সাধারণ মানুষ কিভাবে বুঝবে যে, সে সঠিক পথে আছে কি নেই? সত্য ও ন্যায়ের পথে অবিচল থাকার সঠিক পন্থা কি?
৩. ইসলামের কোনো কোনো বিষয় যদি বিবেক গ্রহণ না করে, তা হলে কি করা উচিত? আমরা ঈমান তো আনতে পারি এবং সে অনুসারে আমলও করতে পারি। কিন্তু মন যুদি তাতে সন্তুষ্ট ও পরিতৃপ্ত না হয় তাহলে কি করা যাবে?
জবাব : হাদিস অমান্য করার মতো কুফরি মতবাদের দিকে আকৃষ্ট হয়ে যাওয়ার পরও যে আল্লাহ আপনাকে সঠিক পথে ফিরে আসার সুযোগ দিয়েছেন, সে কথা জেনে খুবই খুশি হলাম। দোয়া করছি, যেনো আল্লাহ আপনাকে সত্য দীনের উপর অবিচল রাখেন এবং ভবিষ্যতে আর কখনো আপনি পদস্খলনের শিকার না হন। আপনার প্রশ্ন কয়টির সংক্ষিপ্ত জবাব নিম্নে দেয়া হলো :
১. আপনি যদি হাদিস অমান্য করার কুফরি মতবাদে বহাল থাকতেন তাহলে তো নি:সন্দেহে আপনার অতীত ইসলামি জীবনের যাবতীয কার্যকলাপ বৃথা হয়ে যেতো। কিন্তু এখন যেহেতু গোমরাহীর অবস্থাটা স্থায়ী হয়নি বরং আপনি ইসলামের দিকে ফিরে এসেছেন, তাই আল্লাহ আপনাকে পূর্ববর্তী সৎকর্মের পুরষ্কারও দেবেন। খোদার কুরআন থেকেই এ কথার প্রমাণ পাওয়া যায়। সূরা হাদিদের শেষাংশে একদল লোককে ঈমান আনার জন্য দ্বিগুণ পুরস্কার দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। কোনো কোনো তফসিরকারের মতে এ দলটি দ্বারা আহলে কিতাব তথা ইহুদী ও খুষ্টানদেরকে বুঝানো হয়েছে। তারা হযরত মুহাম্মদ সা.-এর নবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্ব পর্যন্ত তো মুসলমানই ছিলো। কিন্তু তাঁর নবুওয়ত ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে তার উপর ঈমান না আনায় তারা কাফের হয়ে যায়। এতদসত্ত্বেও আল্লাহ তাদেরকে সুসংবাদ দিয়েছেন যে, তোমরা যদি এখনও মুসলমান হয়ে যাও, তাহলে তোমরা প্রথমে যে ইসলামি জীবনযাপন করেছো, তার প্রতিদান বাতিল হবেনা। কতিপয় সহীহ হাদিস থেকেও জানা যায় যে, এ ধরনের আহলে কিতাব দ্বিগুণ পুরস্কার পাবে।
২. মানুষ যে কখনো কখনো সদুদ্দেশ্য নিয়েও গোমরাহীর পথে চলে যায় তা অস্বীকার করা যায়না। তবে এরূপ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মধ্যে তিনটি বৈশিষ্ট্য বজায় থাকলে সাধারণ স্বীয় গোমরাহী উপলব্ধি করতে তার বিলম্ব ঘটেনা। প্রথমত, নিজের চোখ কান ও মনমগজকে অর্গলবদ্ধ করে না রাখা, যাতে তার সামনে যা-ই আসুক সে যেনো তা খোলা চোখ ও মুক্ত মন নিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে পারে, চাই সে জিনিস তার রুচি ও মেজাজ মর্জির পরিপন্থীই হোক না কেনো। দ্বিতীয়ত, মানুষ যে মতই নির্ধারণ করে, তা যেনো সে সততা ও নিরপেক্ষতার সাথে এবং নি:স্বার্থভাবে করে, আর বিবেকের স্বতস্ফূর্ত দাবিকে দমিয়ে দেয়ার চেষ্টা না করে। অনেক সময় এমন হয় যে, অন্যায় পথে চলাটা প্রবৃত্তির খায়েশ চরিতার্থ করার সহায়ক এবং তার সাথে নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থ জড়িত বলেই মানুষ তা ভালোবাসে এবং সত্য ও ন্যায়ের উপর তাকে অগ্রাধিকার দেয়। তৃতীয়ত, সব সময় আল্লাহর কাছে দোয়া করতে থাকা যেনো তিনি তাকে সরল ও সঠিক পথ দেখান ও গোমরাহী থেকে বাঁচিয়ে রাখেন। এটা খুবই জরুরি জিনিস। নামাযে সূরা ফাতেহা পড়ার সময় আমরা এই দোয়াই করে থাকি। বস্তুত: গোমরাহী ও সুপথ প্রাপ্তির আসল উৎস আল্লাহ তায়ালাই। তাই তাঁর কাছে প্রেরণা ও শক্তি প্রার্থনা করা সর্বাবস্থায় অপরিহার্য।
৩. ইসলাম যে আল্লাহরই প্রেরিত দীন এবং তার যাবতীয় শিক্ষা ও বিধান যে সর্বোতভাবে হীতকর বিজ্ঞানসম্মত, সে সম্পর্কে সামগ্রিকভাবে পরিপূর্ণ আস্থা ও সন্তোষ লাভ করাই যথেষ্ট। এর পর ইসলামের প্রতিটি বিধি ও প্রতিটি বিষয় সম্পর্কে বিবেকের পূর্ণ তৃপ্তি অর্জন করা জরুরিও নয়, সম্ভবও নয়। [তরজমানুল কুরআন, মে ১৯৬৬]
|
সর্বশেষ আপডেট ( Friday, 04 March 2011 )
|