আমাদের টাইপ করা বইগুলোতে বানান ভুল রয়ে গিয়েছে প্রচুর। আমরা ভুলগুলো ঠিক করার চেষ্টা করছি ক্রমাগত। ভুল শুধরানো এবং টাইপ সেটিং জড়িত কাজে সহায়তা করতে যোগাযোগ করুন আমাদের সাথে।
রাসায়েল ও মাসায়েল ৬ষ্ঠ খন্ড প্রিন্ট কর ইমেল
লিখেছেন সাইয়্যেদ আবুল আ'লা মওদূদী   
Monday, 28 February 2011
আর্টিকেল সূচি
রাসায়েল ও মাসায়েল ৬ষ্ঠ খন্ড
গ্রন্থকার পরিচিতি
১। আল্লাহর অস্তিত্ব সম্পর্কে সংশয় নিরসন
২। আল্লাহ ও তাঁর রসুলগণের মধ্যে পার্থক্য করা
৩। জীবজন্তুর উপর দয়া
৪। পাঁচ ওয়াক্ত ও পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায
৫। হানাফি মাযহাবে কি কিছু কিছু মাদক দ্রব্য হালাল?
৬। আদালতের রায় কি শুধু জাহেরীভাবেই কার্যকর, নাকি বাতেনীভাবেও কার্যকর?
৭। সুন্নাহর আইনগত মর্যাদা
৮। সাহরির শেষ সময় কোনটি?
৯। একটি হাদিস থেকে সুদের বৈধতা প্রমাণের অপচেষ্টা
১০। মুসলিম উম্মাহর বহু গোষ্ঠিতে বিভক্তি এবং মুক্তি লাভকারি গোষ্ঠি
১১। কালো খেজাব লাগানো কি বৈধ?-১
১২। কালো খেজাব কি বৈধ?-২
১৩। তাকদীর প্রসঙ্গ
১৪। গোমরাহী ও হেদায়েত
১৫। সূরা আন নাজমের প্রাথমিক আয়াত কয়টির ব্যাখ্যা
১৬। যাকাতকে প্রচলিত করের সাথে যুক্ত করা যায় না
১৭। পিতামাতার অধিকার
১৮। লোহার আংটি পরা কি জায়েয?
১৯। উশর ও খারাজের কয়েকটি সমস্যা
২০। উশরযোগ্য ফল ফসল কি কি?
২১। মোজার উপর মসেহ করার বিধান
২২। কারো সম্মানে দাঁড়ানো কি জায়েয?
২৩। 'প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ দান করা' সংক্রান্ত কুরআনের আদেশের ব্যাখ্যা
২৪। অপ্রাপ্ত বয়স্ক সন্তানদের ভরণ পোষণ প্রসঙ্গে
২৫। কবর আযাব
২৬। কুরআন শিক্ষাদান ও অন্যান্য ধর্মীয় কাজের পারিশ্রমিক নেয়া কি বৈধ?
২৭। ইসলামের ফৌজদারী দণ্ডবিধি সংক্রান্ত কিছু ব্যাখ্যা
২৮। বেতের নামাযে দোয়া কুনূত
২৯। লাইসেন্স ক্রয় বিক্রয়
৩০। কিবলার দিক নির্ণয়ের শরিয়তসম্মত বনাম বিজ্ঞানসম্মত পন্থা
৩১। মৃত ব্যক্তির জন্য ফিদিয়া দান, শোক ও কুরআন খতম
৩২। কয়েদি সৈন্যরা কি নামায কসর করবে
৩৩। পবিত্র কুরআন ও গুপ্ত ওহি
৩৪। ব্যভিচারের অপবাদ
৩৫। কোন কোন প্রাণী হালাল বা হারাম
৩৬। কুরবানীর চামড়া সম্পর্কে শরিয়তের বিধান
৩৭। মৃত ব্যক্তির চামড়া সম্পর্কে শরিয়তের বিধান
৩৮। মৃত প্রাণীর চামড়া সম্পর্কে আরো আলোচনা
৩৯। জবাই হালাল হওয়ার জন্য কি বিস্
৪০। যাকাত সংক্রান্ত কিছু খোলামেলা কথা
৪১। নগদ পুঁজির যাকাত ও তার নিসাব
৪২। বাইয়ে সালাম
৪৩। হযরত আলী রা.-এর জন্য সূর্যকে ফিরিয়ে দেয়ার ঘটনা কি সত্য?
৪৪। কুরাইশের ১২ জন খলিফা ও 'ফিতনায়ে আহলাস'
৪৫। আল্লাহ ও রসূলের কোনো উক্তি কি মানুষকে কর্মবিমুখ করতে পারে?
৪৬। আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয় করা সত্ত্বেও দৈন্যদশার কারণ কি?
৪৭। হযরত আলী রা.-এর বর্ম চুরি-১
৪৮। হযরত আলী রা.-এর বর্ম চুরি-২
৪৯। ইসলামের দৃষ্টিতে গানবাজনা ও নারী পুরুষের মেলামেশা
৫০। আব্দুল্লাহ বিন উবাইর জানাযা
৫১। ইমাম ইবনে তাবারি কি শিয়া ছিলেন?
৫২। ফৌজদারি অপরাধের ক্ষেত্রে আপোস নিষ্পত্তির অধিকার
৫৩। ইসলামের উত্তরাধিকার আইন সম্পর্কে অভিযোগ
৫৪। শরিয়তের দৃষ্টিতে ওয়াকফের সংজ্ঞা ও বিধান
৫৫। আত্মহননকারীর জানাযা নামায
৫৬। হারুত মারুত ফেরেশতাদ্বয় সম্পর্কে এক ভিত্তিহীন অলীক কাহিনী
৫৭। 'চাটান' সম্পাদকের নিকট দুটো চিঠি
৫৮। হাদিস অস্বীকার করা ও স্বীকার করা
৫৯। হাদিস বিরোধী গোষ্ঠির বিভ্রান্তিকর প্রচারণা
৬০। একটি হাদিস সম্পর্কে আপত্তি ও তার জবাব
৬১। সন্তান পালনে নারীর অধিকার
৬২। স্তনের দুধ পানে বিয়ে হারাম হওয়া
৬৩। পারিবারিক আইন ও অর্পিত তালাক
৬৪। ফাসিদ বিয়ে ও বাতিল বিয়ে
৬৫। রসূল সা. কি হযরত সওদা রা. কে তালাক দিতে চেয়েছিলেন?
৬৬। উম্মুল মুমিনীন হযরত সওদার বিয়ে সম্পর্কে আরো আলোচনা
৬৭। কতোখানি দুধ পান করলে বিয়ে হারাম হয়?
৬৮। পিতামাতার আদেশে স্ত্রী তালাক দেয়া যায় কি?
৬৯। রসুল সা.-এর একাধিক বিয়ের যৌক্তিকতা ও সার্থকতা
৭০। বেলুচিস্তানের বাগদান প্রথা
৭১। লটারি ও নির্বাচনী লটারি
৭২। সমবায় সমিতি

<h1>১৬। যাকাতকে প্রচলিত করের সাথে যুক্ত করা যায় না</h1>
দৈনিক পাকিস্তান টাইমসের ৭ই জুন ১৯৬৬ এবং দৈনিক মাশরিকের ৮ই জুন ১৯৬৬ সংখ্যায় ইসলামিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. ফজলুর রহমানের একটি চিঠি ছাপা হয়েছে। চিঠিটিতে বেশ কয়েকটি বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। আমি সংক্ষেপে সেগুলোর স্বরূপ উন্মোচন করা জরুরি মনে করছি।

ডক্টর সাহেব বলেন : "কুরআন কিংবা রসূল সা. যাকাত ছাড়া আর কোনো কর আরোপ করেননি। এছাড়া কোনো কর আরোপ করতে হলে তা যাকাতের সাথেই যুক্ত করতে হবে। এর প্রমাণ হলো, রসূল সা.-এর ঘোড়ার বাবদে যাকাত আদায় করা হতোনা। কিন্তু হযরত ওমর সে বাবদে যাকাত আদায় করেন অর্থাৎ তিনি কিনা একটা নতুন জিনিসকে যাকাতের আওতাভুক্ত করলেন।"

ডক্টর সাহেব এখানে মূল আলোচ্য বিষয়ের সাথে অন্য অবান্তর বিষয়ের অবতারণা করতে গিয়ে এমন তিনটি উদ্ভট তত্ত্বের জগাখিচুড়ি হাজির করেছেন, যার প্রত্যেকটিই সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ও অবাস্তব। ডক্টর সাহেবের প্রথম মনগড়া তত্ত্বটি হলো, যাকাত এক ধরনের কর। এ বক্তব্য সঠিক নয়। কারণ কর তো এমন একটি সরকারি রাজস্ব, যা সকল ধর্মমতের লোকের কাছ থেকে আদায় করা যায় এবং প্রত্যেক ধনী ও নির্ধন নাগরিক তার সুফল ভোগ করার সমান অধিকারি। এর সম্পূর্ণ বিপরীত যাকাত একটা ইবাদত বিশেষ। শুধুমাত্র মুসলমানদের উপরই যাকাত ফরয। তারা এটা নামাযের মতোই ধর্মীয় আবেগ ও উদ্দীপনা নিয়ে সম্পাদন করে থাকেন। অমুসলিমরা যেমন নামায আদায় করতে বাধ্য নয়, তেমনি যাকাত দিতেও বাধ্য নয়। যাকাত ও করে যদি পার্থক্য না থাকে, তাহলে অমুসলিমদের তো আনন্দে বগল বাজানোর কথা। ইসলামি সরকার যেই তাদের উপর কোনো কর আরোপ করবে, অমুনি তারা এই বলে তা প্রত্যাখ্যান করতে পারবে যে, এটা তো যাকাত। এটা আমাদের উপর নয় মুসলমানদের উপর আরোপিত।

ডক্টর সাহেবের দ্বিতীয় উদ্ভট তত্ত্ব হলো, ইসলাম যাকাত ছাড়া আর কোনো কর আরোপের অনুমতি দেয়না। এ তত্ত্বটিও ভুল যেহেতু যাকাত সাধারণ কর থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস, তাই যাকাত অন্যান্য করের অন্তরায় নয়। হাদিসে বলা হয়েছে :
                                --------------------------------------
অর্থাৎ 'তোমার সম্পদে যাকাত ছাড়াও প্রাপ্য রয়েছে।'

হযরত ওমরের আমলে আমদানীকৃত দ্রব্যাদির উপর কর বসানো হয়েছিল এবং তাকে যাকাত থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে 'ফায়' তথা সরকারি তহবিলের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। কুরআন ও সুন্নাহর কোনো ভাষ্য থেকে এ কথা প্রমাণ করা যাবেনা যে, সরকার রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে বা জনস্বার্থে কোনো কর আরোপ করতে পারবেনা, আর যদি পারে তবে তাকে যাকাতের সাথে যুক্ত করতে হবে। বিগত চৌদ্দশ বছরে কোনো একজন উল্লেখযোগ্য ফেকাহবিদ বা মুজতাহিদও ডক্টর সাহেবের এই উদ্ভট তত্ত্ব মেনে নেননি। কোনো কোনো ফেকাহবিদ যদি কখনো কর আরোপের বিরোধিতা করে থাকেন তবে সেটা শুধু নিপীড়নমূলক করের ক্ষেত্রেই করেছেন। নচেৎ রাজস্ব বিভাগ সব সময় সরকারের রাষ্ট্রীয় অর্থ বিভাগের একটা অংশ হিসেবেই পরিগণিত হয়েছে।

ডক্টর সাহেবের তৃতীয় দাবি এই যে, রসূল সা.-এর যেসব দ্রব্যসামগ্রীর উপর যাকাত আরোপিত হয়েছিল, পরবর্তীকালে তার তালিকায় আরো সংযোজন ঘটে। যেমন হযরত ওমর নতুন করে ঘোড়ার উপর যাকাত বসিয়েছিলেন। ডক্টর সাহেবের এ বক্তব্যটিও সঠিক নয়। তিনি যে উদাহরণ দিয়েছেন, তা দ্বারাও এ তত্ত্ব সমর্থিত হয়না। রসূল সা.-এর পরে যদি অতিরিক্ত দু'একটা জিনিসের উপর যাকাত আরোপিত হয়েও থাকে, তবে পূর্বতন তালিকার সাথে সেই অতিরিক্ত জিনিসের কোনো মৌলিক পার্থক্য নেই। রসূল সা. যেসব জিনিসকে যাকাতযোগ্য বলে ঘোষণা করেছিলেন, তারই কোনো একটির সাথে কোনো ধরণের সাদৃশ্য থাকার কারণে কিয়াসের মাধ্যমে আরেকটি জিনিসের উপর যাকাত ধার্য করা হয়েছে। এমন নয় যে, খেয়াল খুশি মতোই এক একটা জিনিসের উপর যাকাত ধার্য করা হয়েছে। জীবজন্তুর ক্ষেত্রে আসলে যেসব পালিত জন্তু সাধারণভাবে চারণভূমিতে চরে জীবন ধারণ করে এবং বিপুলভাবে বংশ বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে বিরাট বিরাট পালের আকারে লালন পালন করা হয়, সেগুলোর উপরই যাকাত ধার্য করা হয়। যেমন উট, গরু, ছাগল, ভেড়া। এসব জন্তুর সাথে সাদৃশ্য থাকার ভিত্তিতেই হযরত ওমর কিয়াসের রীতি প্রয়োগ করে ঘোড়ার উপর যাকাত ধার্য করেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও হযরত আলী রা. বলেছিলেন এটা পরবর্তী বংশধরদের জন্য কোনো বাধ্যতামূলক নজির নয়। বস্তুত হানাফি মযহাবের সাধারণ ফতোয়া অনুসারে ঘোড়া কোনো যাকাতযোগ্য জন্তু নয়।

ডক্টর সাহেব কিছুদুর অগ্রসর হয়ে বলেন : কুরআনে বর্ণিত যাকাতের খাতগুলো নিষ্ঠার সাথে ও পক্ষপাতমুক্ত দৃষ্টিতে অধ্যয়ন করলে বুঝা যায়, মুসলমানদের যাবতীয় অর্থনৈতিক প্রয়োজন এর আওতাধীন।

তিনি কুরআনের এই খাতগুলোর যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা লক্ষণীয়। 'আমিলীনা আলাইহা' দ্বারা আসলে তো যাকাত আদায় ও বন্টনকার্যে নিয়োজিত লোকজনকে বুঝায়। কিন্তু ডক্টর সাহেবের মতে এর দ্বারা সকল সরকারি কর্মচারি ও কর্মকর্তাকে বুঝায়। 'মুয়াল্লাফাতুল কুলুব' দ্বারা মূলত সেইসব নবদীক্ষিত মুসলমানদেরকে বুঝানো হয়, যাদের মনে মুসলমান সমাজের প্রতি প্রীতি মুহব্বত জন্মানো কাঙ্খিত। অথচ ডক্টর ফজলুর রহমান সাহেব এটিকে 'রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধির তহবিল' বলে আখ্যায়িত করেন। আজকাল রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বলতে কি কি জিনিস বুঝায় তা কারো অজানা নেই। তিনি 'গরিমীন' ও 'রিক্কাব' এর অনুবাদ করেছেন ঋণগ্রস্তদের সাহায্য করা ও দাসমুক্ত করা। কিন্তু ব্রাকেটের মধ্যে তার ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে: (জাতীয় অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করা)। ইংরেজিতে তিনি এর ব্যাখ্যা করেছেন জাতীয় ঋণ পরিশোধ বলে। এর অর্থ দাঁড়ায় এই যে, কোনো দুর্নীতি পরায়ণ ও স্বৈরচারী শাসক যেমন খুশি ঋণ গ্রহণ করতে ও যতো খুশি তার উপর সুদ দিতে পারবে আর এসব যাকাত তহবিল থেকে দিতে পারবে। 'ইবনুস সাবীল' শব্দটি দ্বারা আসলে এমন পর্যটককে বুঝানো হয়েছে, যে প্রবাসে আর্থিক সংকটে পতিত। কিন্তু ডক্টর সাহেব গোটা 'পরিবহন ব্যবস্থা' কে এর আওতাধীন করার পক্ষপাতী। এর অর্থ দাঁড়ায় এই যে, উচ্চ সরকারি কর্মকর্তাদের প্রথম শ্রেণী ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে যাতায়াতও যাকাতের অর্থ দ্বারা নির্বাহ করা যাবে। শুধু হেঁটে চলা ও খালি পায়ে চলা পথিক এই সুবিধা ভোগ করবে তা নয়। কুরআনের এরূপ 'নিষ্ঠাবান ও পক্ষপাতমুক্ত' ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ সম্পর্কেই আল্লামা ইকবাল মন্তব্য করেছিলেন "এদের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দেখে আল্লাহ, রসূল সা. ও জিবরীল পর্যন্ত হতবাক।"

ফেকাহ বিশেষজ্ঞগণ ইবাদত ও সাধারণ আর্থ সামাজিক তৎপরতার মধ্যে যে পার্থক্য করেছেন, ডক্টর সাহেব তাতেও আপত্তি তুলেছেন এবং বলেছেন, মুসলমানদের সমগ্র জীবনই ইবাদত। এখানে তিনি অনাবশ্যকভাবে মাওলানা মওদূদীর প্রসঙ্গ টেনে বলেছেন যে, আগে তিনিও এই বিভেদের পক্ষপাতী ছিলেননা। এটাও একটা তাত্ত্বিক বিভ্রাট। এ কথা নি:সন্দেহে সত্য যে, ব্যাপক ও সাধারণ অর্থে একজন খাঁটি মুসলসমানের সমগ্র জীবনই ইবাদতের শামিল। কিন্তু তাই বলে ইসলামের মূল স্তম্ভসমূহ যথা-নামায, রোযা, হজ্জ ও যাকাত যে বিশেষ অর্থে ইবাদত নামে পরিচিত এবং এগুলোর শরিয়ত নির্ধারিত নিয়মাবলী ও কাঠামো যে অকাট্য ও অপরিবর্তনীয়। সেই চিরস্বীকৃত মূলনীতি মাওলানা মওদূদী বা অন্য কোনো মুসলমান অস্বীকার করেননা, কখনো করেননি। যাকাত সম্পর্কে হযরত আবু বকরের দ্ব্যর্থহীন ফরমান হাদিস গ্রন্থসমূহে লিপিবদ্ধ রয়েছে। তাতে বলা হয়েছে যাকাতের যে হার আল্লাহর রসূল সা. ধার্য করেছেন, তার চেয়ে বেশি কেউ দাবি করলে তার দাবি মানা যাবেনা। ডক্টর ফজলুর রহমান এই মৌলিক পার্থক্য বিলোপ করে এ যুগের শাসকদেরকে নামায, রোযা, হজ্জ ও যাকাতের মতো ইবাদতগুলো বিকৃত করার অবাধ অধিকার দিতে চান। ইসলামের মূল স্তম্ভসমূহে সামান্যতম পরিবর্তন সাধনের ক্ষমতা যদি রসূল সা.-এর প্রথম খলিফার না থেকে থাকে, তাহলে এখন এগুলোতে রদবদল ঘটানো এবং এর অর্থ ও তাৎপর্য বিকৃত করার অধিকার অন্য কাউকে কিভাবে দেয়া যেতে পারে?

ডক্টর সাহেব সবশেষে ফেকাহ শাস্ত্রকারদের মতভেদের উল্লেখ করেছেন। এ মতভেদের উল্লেখ করে তিনি প্রমাণ করতে চান যে, এ বিষয়ে চিন্তাগবেষণার দ্বার রুদ্ধ করা হয়নি। মতভেদের কথা তো আমরাও স্বীকার করি। কিন্তু প্রথমত, এই মতভেদের তুলনায় মত্যৈকের দিকটা অনেক বেশি লক্ষ্যণীয় ও বলিষ্ঠ। দ্বিতীয়ত, এই মতবিরোধের কোনো না কোনো ভিত্তি কুরআন ও সুন্নাহতে বিদ্যমান। যে বিষয়ে কুরআন ও সুন্নাহতে সুস্পষ্ট ও অকাট্য সিদ্ধান্ত ঘোষিত হয়েছে, সে বিষয়ে ভিন্ন মতের দৃষ্টান্ত অত্যন্ত বিরল। উদাহরণস্বরূপ, কোনো কোনো জিনিসের নিসাব অর্থাৎ যাকাতযোগ্য নূন্যতম ধার্যকৃত পরিমাণে মতভেদ রয়েছে। তার কারণ হলো ঐ ব্যাপারে যে হাদিস রয়েছে, তার বিশুদ্ধতা ও প্রামান্যতা বিতর্কিত। কিন্তু যাকাতের হার নিসাবের চেয়েও অধিকতর মৌলিক গুরুত্বসম্পন্ন ব্যাপার। এই হার সম্পর্কে কোনো দ্বিমত নেই। বিভিন্ন দ্রব্যে যাকাতের যে হার রসূল সা. কর্তৃক নির্ধারিত বলে হাদিসে প্রমাণ পাওয়া যায়, তাতে কোনো হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটানোর পক্ষে কোনো একজন ফেকাহ শাস্ত্রবিদের অভিমতও কি ডক্টর সাহেব তুলে ধরতে পারবেন? যেমন, যেসব দ্রব্যে রসূল সা. শতকরা আড়াই ভাগ হারে যাকাত ধার্য করেছেন, কোনো একজন ফকীহও কি বলেছেন যে, ঐ সব দ্রব্যে এর  চেয়ে কম বা বেশি যাকাত আরোপ করা যায়?

[ ২ ]
ডক্টর ফজলুর রহমান সাহেবের বক্তব্যের জবাবে ১৯৬৬ সালের ১২ জুন তারিখের দৈনিক মাশরিকে আমার যে চিঠিখানা ছাপা হয়, ২২ জুনের মাশরিকে সেই চিঠির উপর জনৈক আব্দুর রশিদের একটি পর্যালোচনা প্রকাশিত হয়। সেই পর্যালোচনার আলোকে আমি আরো কিছু বক্তব্য পেশ করতে চাই।

আমি লিখেছিলাম : "সকল ধর্মাবলম্বীর কাছ থেকে আদায় করা যায় এমন রাজস্বকেই কর বলা হয়।"

এ ব্যাপারে আব্দুর রশিদ সাহেবের মন্তব্য হলো : "এতে করে তো একই দেশে দুটো অর্থনৈতিক কার্যক্রম এবং দুটো সরকার চালু হওয়া অবধারিত হয়ে যাবে। একটা সরকার কর ধার্য করবে, আর ঐ সরকারের অধীন আর একটা সরকার ব্যাপৃত থাকবে যাকাত আদায়ের কাজে।"

আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে এটা বোধগম্য হয়নি যে, আব্দুর রশিদ সাহেব আমার বক্তব্য থেকে যে সিদ্ধান্ত নিতে চাইছেন, তা কিভাবে যুক্তিসিদ্ধ হয়। আমি তো আমার চিঠিতে বা আর কোথাও বলিনি যে, ইসলামি সরকার তো কর আদায় করবে, কিন্তু যাকাত আদায় করবে ঐ সরকারের অধীন আরেক সরকার। ইসলামি সরকার করও ধার্য করবে, যাকাতও আদায় করবে, এতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। রসূল সা.-এর নির্দেশ অনুযায়ী যাকাত শুধু মুসলিম বিত্তশালীদের কাছ থেকে আদায় করা হবে এবং দুস্থ মুসলমানদের উপর নির্দিষ্ট খাতে ব্যয় করা হবে। এ জন্য তার হিসাব-নিকাশ এবং আদায় ও বন্টনের ব্যবস্থা 'বায়তুলমাল' বা সরকারি কোষাগারের অন্যান্য তহবিল থেকে সম্পূর্ণ পৃথক হবে।

তবে কোনো ইসলামি সরকার যদি বিদ্যমান না থাকে, কিংবা থাকলেও কোনো কারণে যাকাত আদায়ের ব্যবস্থা না করে, কিংবা শরিয়তের বিধান মোতবেক তা আদায় বন্টনের ব্যবস্থা না করে, অথবা মুসলমানরা কোনো অনৈসলামিক সরকারের অধীন বসবাস করে, তাহলে যাকাত মাফ হয়ে যাবেনা। কেননা, তা সরকারি কর নয়, নামাযের মতো একটা ফরয ইবাদত। এ ধরনের সকল পরিস্থিতিতে জাগ্রত ঈমানী চেতনাসম্পন্ন মুসলমানরা কোনো আদেশ বা অনুরোধ ছাড়াই স্বেচ্ছায় ও স্বতস্ফূর্তভাবে ব্যক্তিগত পর্যায়ে যাকাত দিয়ে থাকে এবং সম্ভব হলে যাকাতের আদায় ও বন্টনের জন্য কোনো বেসরকারি সংঘবদ্ধ ব্যবস্থা গড়ে তোলে। যাকাতের ফরয ইবাদত বাস্তবায়িত করার এসব স্বতস্ফূর্ত উদ্যোগ কার্যক্রমে আনন্দবোধ করা অভিনন্দন জানানোর পরিবর্তে একে 'সরকারের অধীন সরকার ও দ্বৈত তৎপরতা' বলে যে টিপ্পনী কাটা হয়েছে, বিবেক, প্রজ্ঞা এবং ইসলামি চেতনা ও মর্যাদাবোধের প্রতি এর চেয়ে নিষ্ঠুর পরিহাস আর কি হতে পারে?

আব্দুর রশিদ সাহেব বলেন, "যাকাত যদি সরকারি করই না হয় তবে যারা যাকাত দিতে অস্বীকার করেছে হযরত আবু রকর রা. তাদের বিরুদ্ধে জেহাদ করলেন কেন? কই কোনো বেনামাযীর বিরুদ্ধে তো জেহাদ করার আদেশ দেয়া হয়নি?" এ প্রশ্নের জবাবে শুধু এতোটুকুই বলবো যে, যে গৌরবময় যুগের কথা এখানে আলোচিত হচ্ছে, সে যুগের বাস্তব নমুনা আমাদের জন্য চূড়ান্ত দলিল ও সনদস্বরূপ। সে যুগে মুসলমানদের কোনো দল বা গোষ্ঠির নামায বা রোযা নীতিগতভাবে অস্কীকার করা বা কার্যত বর্জন করা একেবারেই অকল্পনীয় ব্যাপার ছিলো আর বাস্তবেও তা কখনো সংঘটিত হয়নি। সে যুগে মুনাফিকরাও নামায পড়তো এবং রোযা রাখতো। হযরত আবু বকর সিদ্দীকের আমলে সর্বপ্রথম এরূপ পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে যে একটি গোষ্ঠি যাকাত দিতে অস্বীকার করলো এবং ব্যাপারটা সাহাবাদের গোচরে আনা হলো। এ বিষয়ে যথেষ্ট পরামর্শ হয়, মতভেদও ঘটে। অবশেষে একটা সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং তা কার্যকরও করা হয়। যাকাত ছাড়া ইসলামের অন্যান্য স্তম্ভগুলোর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এগুলো যে ফরয, এ কথা যে ব্যক্তি মনে ও মুখে অবিশ্বাস ও অস্বীকার করবে, সে নিশ্চিতভাবে মুরতাদ তথা ধর্মচ্যুত ও কাফের হয়ে যাবে।
কিন্তু যে ব্যক্তি এগুলোকে ফরয বলে মানবে এবং কার্যত বর্জন করবে, তাকে ধর্মচ্যুতির শাস্তি দেয়া চলেনা। তবে ইসলামি সরকার তাকে বুঝিয়ে সুজিয়ে, জ্ঞান ও শিক্ষা দান করে এমনকি তিরস্কার ও ভৎসনা করে পথে আনার চেষ্টা কতে পারে এবং সর্বশেষ উপায় হিসেবে তাকে শাস্তিও দিতে পারে।

আব্দুর রশিদ সাহেব আরো লিখেছেন : "যাকাত আর্থিক ও সামাজিক ইবাদতের পর্যায়ভুক্ত। কাজেই হজ্জের মতো এটা রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীন। পাকিস্তান রাষ্ট্রের আর্থিক অবস্থা অধিক সংখ্যক লোককে হজ্জের অনুমতি দেয়ার অনুকূল ছিলোনা বলে সংখ্যা কমিয়ে দেয়া হয়েছে।"

এখানে যে যুক্তির অবতারণা করা হয়েছে, তা এতো নির্বোধসুলভ ও নিম্নমানের এবং সেই সাথে এতো বেদনাদায়ক ও শিক্ষাপ্রদ যে, এ যুগের সরকারগুলো এবং তাদের তৈরি করা ও পোষা তথাকথিত ইসলামি গবেষক ও চিন্তাবিদদের হাতে ইসলামের যে মৌলিক ইবাদতসমূহের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ও রদবদলের ক্ষমতা ন্যাস্ত হলে ইসলামকে যে কিভাবে বিকৃত করা হবে, এ থেকে তা সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এ ব্যাপারে আমি ইতিপূর্বে যে আশংকা প্রকাশ করেছিলাম, আলোচ্য যুক্তিতর্ক দেখে তা সত্য বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। প্রশ্ন হলো-কুরআনের আলোকে আল্লাহর ঘর পর্যন্ত যাওয়ার সুযোগ ও সামর্থ্য সৃষ্টি হলেই যখন হজ্জ ফরয হয়ে যায়, তখন সরকার তাকে বিধিনিষেধ আরোপের অধিকার পায় কোথেকে? বিশেষত, শুধুমাত্র গত দু'বছরেই নয় লাখ গ্যালন দেশি মদ উৎপাদন এবং তিন লাখ একচল্লিশ হাজার দু'শ সতেরো গ্যালন বিদেশি মদ আমদানি করতে যে সরকারের টাকার অভাব হয়নি, কয়েক হাজার হাজীর হজ্জের বন্দোবস্ত করতে সে সরকারের অর্থাভাব হবে কেন?

হযরত ওমরের খেলাফত আমলে ঘোড়ার যাকাত আদায়ের বিষয়টি আমি সংক্ষেপে বর্ণনা করেছিলাম। সেই বর্ণনা থেকেই আব্দুর রশিদ সাহেব 'যাকাতের কিছু না কিছু কেয়াসের সুযোগ আছে' বলার অজুহাত পেয়ে গেছেন। "কিছু না কিছু সুযোগ কথাটা দ্বারা আসলে তিনি এই দরজা পুরোপুরি খুলে দেয়ার ইচ্ছেই ব্যক্ত করেছেন, যাতে সরকার খেয়াল খুশি মতো যে কোনো জিনিসের উপর যে কোনো সময় যে কোনো পরিমাণে যাকাতের নাম দিয়ে কর বসাতে পারে এবং কেউ তাতে টুশব্দটি না করতে পারে। তাই আমি ঘোড়ার যাকাতের ব্যাপারটি আরো একটু খোলাসা করে দিচ্ছি।"

'মুসনদে ইবনে আবি শায়বা' নামক হাদিস গ্রন্থে সুস্পষ্টভাবে বলা আছে যে, হযরত ওমর রা. স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে ঘোড়ার উপর যাকাত আরোপ করেননি। সিরিয়ার একশ্রেণীর মানুষ অত্যাধিক সংখ্যক ঘোড়া পুষতো। তারা নিজেরাই প্রথমে হযরত আবু ওবায়দাকে অনুরোধ করে তাদের কাছ থেকে যাকাত নিতো। তিনি অস্বীকার করেন। তারপর তারা হযরত ওমর রা. কে চিঠি লিখে একই অনুরোধ জানালো। তিনিও এড়িয়ে গেলেন। অবশেষে নাছোড়বান্দা হয়ে তারা সশরীরে হযরত ওমরের কাছে হাজির হলো এবং যাকাত আরোপ করার দাবি জানালো। তিনি বললেন :
                       ------------------------------------------
"এ যাকাত আরোপ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।"

তিনি সিরিয়ায় ফিরে গিয়ে আবার লিখলো, "ঘোড়ার উপর যাকাত দিয়ে আমাদের সম্পদকে পবিত্র করি, এটাই আমাদের কাম্য।" অগত্যা হযরত ওমর সিরিয়ার গভর্নরকে লিখলেন : "ওখানকার ঘোড়ার মালিকরা চাইলে ওদের কাছ থেকে যাকাত নিয়ে নাও এবং ওখানকার গরিবদের মধ্যেই তা বন্টন করে দাও।" এ বিষয়ে অন্যান্য সাহাবিরাও দ্বিধান্বিত ছিলেন। হযরত আলীর রা. বক্তব্য তো আগেই উল্লেখ করেছি। সাহাবিদের এই দ্বিধাদ্বন্দ্বের একমাত্র কারণ ছিলো এই যে, রসূল সা. স্বয়ং সুস্পষ্টভাবে ঘোড়ার উপর যাকাত আরোপের কোনো নির্দেশ দেননি। এ জন্যই হযরত ওমরের রা. এই বাস্তব উদাহরণ সত্ত্বেও হাম্বলি, শাফেয়ি, হানাফি ও মালেকি এই চারটি মযহাবেরই অনুসৃত নীতি এই যে, বংশবৃদ্ধির উদ্দেশ্যে যে ঘোড়া পালন করা হয় এবং যে ঘোড়া মাঠে চরে বেড়ায়, তাতে যাকাত দেওয়ার প্রয়োজন নেই। সুবিখ্যাত গ্রন্থ 'আলফিকহু আলাল মাযাহিবিল আরবায়া' (চার মাযহাবের ফেকাহ) তে বলা হয়েছে : --------------------------- ঘোড়ার কোনো যাকাত নেই এবং এটা সকল মযহাবের সর্বসম্মত রায়।

ইমাম আবু উবাইদ স্বীয় গ্রন্থ 'কিতাবুল আমওয়ালে' লিখেছেন যে, ইরাক, হেযায ও সিরিয়ার মুসলমানগণের সর্বসম্মত রায় হলো, ঘোড়ার যাকাত নেই। অত:পর তিনি বলেন :
                        -----------------------------------------------
"এ ব্যাপারে তাদের মধ্যে আদৌ কোনো মতভেদ আছে বলে আমার জানা নেই।"
আব্দুর রশিদ সাহেব যুক্তির তুবড়ি ছুটিয়েছেন এই বলে যে মক্কী যুগে যাকাতের কোনো ধরাবাধা হার ছিলোনা। তাই যাকাতের হার ও ধরন কোনো চূড়ান্ত ও অপরিবর্তনীয় কিছু নয়। আব্দুর রশিদ সাহেবের যদি জানা না থাকে বা ভুলে গিয়ে থাকেন, তবে আমি তার গোচরে আনতে ও তাকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, শুধু যাকাত নয়, বরং নামায, রোযা এবং ইসলামের বহু বিধানও নির্দেশ পর্যায়ক্রমেই নাযিল ও কার্যকরি হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, নামায আগে মাত্র দু'রাকাত ছিলো আর রোযাও মাত্র কয়েকদিন ছিলো। বর্তমান আকারে নামায মি'রাজের পর এবং রমযানের রোযা বদর যুদ্ধের সময় ফরয হয়। এই সকল বিধানের সর্বশেষ প্রবর্তিত রীতিই চূড়ান্ত বলে গৃহীত হয়। এখন জানতে ইচ্ছে করে, আব্দুর রশিদ সাহেব মক্কী যুগের অজুহাত তুলে নামায রোযার মতো অকাট্য ফরয কাজকেও নিষ্প্রয়োজন সাব্যস্ত করার দুরভিসন্ধি পোষণ করেন কিনা?

প্রথমে যাকাতের কথাই আসা যাক। এ কথা সবার জানা যে, মক্কায় ইসলামি সরকার থাকা তো দুরের কথা, নিরাপদ জীবনাযাপনই অসম্ভব ছিলো। সেখানে যাকাতের নিসাব ও হার নির্ধারণ করা যেমন নিরর্থক ছিলো, তেমনি তা হতো অসময়োপযোগী পদক্ষেপ। যেখানে জীবনেরই নিরাপত্তা ছিলোনা। সেখানে যাকাতের হার ও পরিমাণ ধার্য করার প্রশ্ন ওঠে কি করে? কেইবা যাকাত আদায় করতো, কোথায়ই বা তা রাখা হতো, আর কিভাবেই বা তা বন্টন করা যেতো? এরূপ পরিস্থিতিতে যাকাতের বিস্তৃত বিধিবিধান প্রবর্তিত হয়নি বলে আল্লাহর অনুগ্রহের পূর্ণতা ও পরিপূর্ণ শরিয়ত বিধিবদ্ধ হওয়ার পরও কি ইসলামি ইবাদতগুলোতে কাটছাট এবং নামায,রোযা, হজ্জ এবং যাকাত সব কিছুরই বিকৃতি সাধনের চেষ্টা চলতে থাকবে?

উপসংহারে আব্দুর রশিদ সাহেব এই অভিমতও ব্যক্ত করেছেন যে, যাকাতের মূল বিধান তো অকাট্য ও চিরন্তন, তবে এর বাস্তব খুঁটিনাটি ব্যাপারে বেশি করে উদ্ভাবনী প্রক্রিয়া (কিয়াস) প্রয়োগ করতে হবে।

আমি আব্দুর রশিদ সাহেবকে আবেদন জানাই, গোলকধাঁধা সৃষ্টি করার পরিবর্তে সহজবোধ্য ভাষায় খোলাখুলিভাবে কথা বলুন, যাতে আমরাও বুঝতে পারি, যাকাতের সেই মূল বিধানটি কি জিনিস, যাকে তিনি দয়া করে অকাট্য ও চিরন্তন বলে মেনে নিয়েছেন এবং যাতে তাঁর কেয়াসের বা খুব বেশি কেয়াসের প্রয়োজন হবেনা। [মাশরিক, ২৭ জুন ১৯৬৬]

[ à§© ]
দৈনিক মাশরিকের বিতর্কিকা শীর্ষক কলামে যাকাত সম্পর্কে রফীউল্লাহ সাহেবের যে চিঠি প্রকাশিত হয়েছে, তাতে কোনো কোনো গ্রন্থের পূর্বাপর অসংলগ্ন ও অসম্পূর্ণ উদ্ধৃতি দিয়ে তা থেকে নানা তথ্য প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয়েছে। যেমন ইমাম জাসসাস কৃত আহকামুল কুরআনের ৩য় খণ্ডের ১৩০ পৃষ্ঠার বরাত দিয়ে নিম্নোক্ত উক্তি উদ্ধৃত করা হয়েছে :

"একটি সহীহ হাদিস অনুযায়ী যাকাতের হার কেবল উট ও অন্যান্য জিনিসের জন্য। টাকাকড়ি সোনা রূপার পুরোটাই যাকাত হিসেবে দিয়ে দিতে হবে।"

উক্ত গ্রন্থের এই পৃষ্ঠায় এমন কোনো হাদিস নেই, যার শাব্দিক অনুবাদ উপরোক্ত কথাটা হতে পারে। তবে এই পৃষ্ঠায় হযরত আবুজর গিফারীর বর্ণিত একটি হাদিস রয়েছে। এ হাদিসটির অনুবাদ এ রকম।
"আমি রসূল সা. -কে বলতে শুনেছি যে, উটের বাবদে যাকাত দিতে হবে। আর যে ব্যক্তি দিনার, দিরহাম বা সোনারূপা ঋণ শোধ বা আল্লাহর পথে ব্যয়ের উদ্দেশ্য ব্যতীত জমা করে রাখবে, কেয়ামতের দিন ঐ সম্পদ আগুনে পুড়িয়ে তা দিয়ে তাকে সেক দেয়া হবে।"

হযরত আবুজর গিফারী সম্পর্কে এ কথা সুবিদিত যে, রসূর সা.-এর এ জাতীয় বক্তব্য এবং কুরআনের আয়াত -------------------- এর ব্যাখ্যা ব্যাপারে তাঁর একটা নিজস্ব স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো। তাঁর মতে এর অর্থ এই যে, কোনো মুসলমানের আদৌ কোনো সঞ্চিত সম্পদ থাকা উচিত নয়। কিন্তু সাধারণ সাহাবিগণ ও অন্যান্য বড় বড় ইমামগণ হযরত আবুজরের এই অভিমতকে সঠিক মনে করেননি। হযরত আবুজরের এ অভিমত মেনে নিলে ওসিয়ত, উত্তরাধিকার, হজ্জ, যাকাত প্রভৃতি সংক্রান্ত কুরআনের বহু সংখ্যক নির্দেশ নিস্ক্রীয় ও অকার্যকর হয়ে পড়ে। প্রকৃতপক্ষে উপরোক্ত আয়াত ও হাদিসের মর্ম এই যে, ধন সম্পদ উপার্জন ও সঞ্চয়কে জীবনের লক্ষ্য বানিয়ে নেয়া এবং আল্লাহ এ তাঁর বান্দাদের প্রাপ্য দেয়াকে এড়িয়ে চলা কোনো মুসলমানের উচিত নয়।

বিস্ময়ের ব্যাপার, রফীউল্লাহ সাহেব উল্লেখিত গ্রন্থের ১৩০ পৃষ্ঠা থেকে নিজের গরজ মোতাবেক একটা বক্তব্য উদ্ধার করেছেন বটে। কিন্তু একই পৃষ্ঠার শেষভাগে বিদ্যমান আর একটি বক্তব্য থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়েছেন। সে বক্তব্যটির অনুবাদ এরূপ :

"রসূল সা.-এর বহুল প্রচলিত হাদিসসমূহ থেকে জানা যায় যে, প্রতি দুই'শ দিরহামে পাঁচ দিরহাম এবং প্রতি ২০ দিনারে আধা দিনার যাকাত অবশ্যই দিতে হয়। গবাদি পশুতেও যাকাত দিতে হয়। তবে পুরো সম্পদ দান করে দেয়া জরুরি নয়।"

সোনারূপার সবটাই যদি দান করা আবশ্যিক হতো, তাহলে যাকাতের হার নির্ধারণের কি অর্থ থাকতো? সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে হযরত উসমান রা. এবং হযরত আব্দুর রহমান বিন আওফের রা. ন্যায় কেউ কেউ বেশ স্বচ্ছল ও বিত্তশালী ছিলেন। রসূল সা. তাঁদের অবস্থা জানতেন। কিন্তু তিনি তাদের সমস্ত সম্পদ দান করার নির্দেশ দেননি। কাজেই প্রমাণিত হলো যে, সমস্ত টাকা কড়ি ও সোনারূপা দান করা জরুরি নয়।

একটি আলোচনার শুরু থেকে একটা উক্তি পৃথকভাবে নিয়ে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে তার ব্যাখ্যা করা হবে, অথচ ঐ আলোচনার উপসংহারে লেখক সকল দিককে সামনে রেখে যে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন, তা পেশ করা হবেনা, এটা জ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে একটা মারাত্মক অসাধু পন্থা।

পরবর্তীতে একই গ্রন্থে ১৯১ পৃষ্ঠার বরাত দিয়ে পত্র লেখক লিখেছেন :
"হযরত ওমর রা. বাণিজ্যিক পণ্যে অনৈসলামিক দেশের অধিবাসীদের উপর শতকরা দশভাগ যাকাত ধার্য করেছিলেন, চাই তারা মুসলমানই হোক না কেন।"
এখানে আবার তিনি জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে গ্রন্থকারের বক্তব্যের অপব্যাখ্যা করেছেন। বক্তব্যের সঠিক অনুবাদ হলো :

"হযরত ওমর রা. স্বীয় কর্মচারীদেরকে লিখিত নির্দেশ দেন, তারা কোনো বাণিজ্যিক পণ্যের ক্ষেত্রে মুসলমানেদর কাছ থেকে শতকরা আড়াই ভাগ, অমুসলিম সংখ্যালঘুদের কাছ থেকে শতকরা পাঁচ ভাগ এবং অমুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলের অধিবাসীদের কাছ থেকে শতকরা দশভাগ আদায় করে। মুসলমানদের কাছ থেকে আদায়কৃত অংশ আবশ্যিক যাকাত হিসেবে গণ্য হবে এবং সে ক্ষেত্রে বর্ষপূর্তি, নিসাবপূর্তি এবং মালিকানা প্রমাণিত হওয়া সংক্রান্ত অপরিহার্য শর্তাবলীর দিকে অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে।"

এখানে অমুসলিম অঞ্চলের অধিবাসী বলতে অমুসলিমদেরকেই বুঝানো হয়েছে। সেখানকার মুসলমানদের প্রসঙ্গ এখানে আলোচিতই হয়নি। কেননা সেখানকার মুসলমানেদর নিসাবপূর্তি, বর্ষপূর্তি প্রভৃতি শর্তের দিকে লক্ষ্য রাখা এবং সে ব্যাপারে যথাযথ তদন্ত চালানো ইসলামি সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই এ উক্তিটির এরূপ ব্যাখ্যা করা মোটেই ঠিক নয় যে, হযরত ওমর রা. অমুসলিম অঞ্চলের মুসলিম অধিবাসীদের কাছ থেকেও যাকাত নিতেন এবং নির্ধারিত শতকরা আড়াই ভাগের পরিবর্তে দশ ভাগ ধার্য করতেন।

এরপরে রফীউল্লাহ সাহেব উট, ছাগল, ভেড়া ও গরুর যাকাতের প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন এবং সূক্ষ্ম হিসাব কষে আমাদেরকে জানাচ্ছেন যে, এগুলোর হার শতকরা আড়াই ভাগ থেকে ভিন্নতর হয়। এভাবে তিনি অনাহ্‌তভাবে একটি বিষয়ের সাথে আর একটি বিষয়ের তালগোল পাকিয়ে ফেলেছেন। যাকাত সংক্রান্ত ইসলামি বিধানের একজন প্রাথমিক শিক্ষার্থীও জানে যে, গাবাদিপশু, কৃষি ফসল, খনিজ দ্রব্য এসব জিনিসের যাকাতের হার আলাদা আলাদা। প্র্রত্যেক জিনিসের যাকাত শতকরা আড়াই ভাগ-এ কথা কে বলেছে? ফলমূল ও কৃষি ফসলের দশ বা বিশ ভাগের এক ভাগ এবং খনিজ দ্রব্য ও প্রোথিত সম্পদে পাঁচ ভাগের এক ভাগ যাকাত স্বয়ং রসূল সা. কর্তৃক নির্ধারিত। খোলাফায়ে রাশেদিন বা অন্য কেউ এটা নতুন করে ধার্য করেননি। এ থেকে এটাও প্রমাণিত হয়না যে, নগদ টাকাকড়ি, সোনারূপা, বাণিজ্যিক ও শিল্প পণ্যে শতকরা আড়াই ভাগের চেয়ে কম বা বেশি যাকাত হতে পারে।

রফীউল্লাহ সাহেব শাহ ওয়ালীউল্লাহ সাহেবের একটি উক্তিও উদ্ধৃত করেছেন, যাতে দেখা যায়, হযরত ওমর রা, জিযিয়ার হার পরিবর্তন করেছিলেন। কথাটা যদি সঠিকও ধরে নেয়া যায়, তবুও এটা একটা আলাদা ব্যাপার। আলোচ্য বিষয়ের সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। জিযিয়া মুসলমানদের উপর নয় বরং অমুসলিমদের উপর আরোপ করা হয়। এর বিনিময় সরকার তাদের জান মাল ও সম্ভ্রমের রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকে এবং তারা দেশ রক্ষার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পায়। তবে অনিবার্য প্রয়োজনের তাগিদে এবং আনুগত্য ও বিশ্বস্ততার ভিত্তিতে যদি তাদের কাছ থেকে দেশ রক্ষার কাজ নেয়া হয়, তাহলে তাদেরকে জিযিয়া থেকে অব্যাহতিও দেয়া যেতে পারে। অথচ সক্ষম মুসলমানদের উপর থেকে যাকাত কোনো অবস্থায় রহিত হয়না। কোনো সরকার এটা মাফ করা বা রদবদল করার অধিকারী নয়। মোটকথা, রফীউল্লাহ সাহেবের এ কথা কোনোভাবেই সঠিক প্রমাণিত হয়না যে, খোলাফায়ে রাশেদিন যাকাতের হার পরিবর্তন করতেন।

আমি বলেছিলাম, অমুসলিমদের উপর যাকাত আরোপিত হয়নি। এর জবাবে আব্দুর রশিদ সাহেব নামক অপর এক পত্রলেখক লিখেছেন, হযরত ওমরের রা. আমলে একটি খৃষ্টান গোত্র জিযিয়াকে অপমানজনক মনে করে তা দিতে অস্বীকার করলে তাকে যাকাত দিতে বাধ্য করা হয়। তবে প্রচলিত হারের দ্বিগুণ যাকাত ধার্য করা হয়। এই ঘটনার আসল বহস্যটাও আমি সংক্ষেপে বর্ণনা করছি।

ঘটনাটি পেশাদার শিকারী যাযাবর গোত্র বনু তাগলাবের। এরা সিরিয়া ও রোমের সীমান্তে বসবাস করতো। হযরত ওমর যখন তাদের উপর জিযিয়া আরোপ করার ইচ্ছে ব্যক্ত করলেন, তখন তারা ওটা দেয়াকে নিজেদের জন্য কষ্টকর ও গ্লানিকর মনে করলো। কেননা দুনিয়ার অন্যান্য স্বাধীনচেতা যাযাবর গোত্রের মতো তারা নগদ জিযিয়া প্রদান করাকে পরাধীনতার প্রতীক মনে করতো। তাই তারা সীমান্ত অতিক্রম করে রোম সাম্রাজ্যে চলে যাওয়ার সংকল্প করলো।

যেহেতু তারা আরব বংশোদ্ভুত গোত্র ছিলো। তাই মুসলমানদের বৈরী একটা শক্তির সাথে তাদের যুক্ত হওয়া সমীচীন ছিলনা। এ ব্যাপারে তাদের সাথে আলাপ আলোচনা করলে তারা বললো, আমাদের উপর মুসলমানদের মতো যাকাত আরোপ করা হলে আমরা সেটা দিতে রাজি। এর জবাবে হযরত ওমর যে উক্তি করেন, তা সুনানে বায়হাকীতে উদ্ধুত হয়েছে। তিনি বললেন : --------------------------------- "না, এটা তো মুসলমানদের উপর ফরয।" তারা বললো, "আপনি আমাদের গবাদিপশু ও সহায় সম্পদের উপর যে হারে ইচ্ছে কর আরোপ করতে পারেন। তবে তাকে জিযিয়া নামে অভিহিত করবেন না।" অবশেষে তাদের উপর মুসলমানদের যাকাতের দ্বিগুণ কর বসানো হলো। তবে তাকে জিযিয়া নামে আখ্যায়িত করা হয়নি। সেই সাথে তাদেরকে এই শর্তেও রাজি করা হয় যে, তারা তাদের বংশধরকে খৃষ্টান করবেনা। সকল ফেকাহবিদের সর্বসম্মত রায় এই যে, এটি একটি ব্যতিক্রমধর্মী ব্যাপার ছিলো এবং এ ঘটনা থেকে জিযিয়া বা যাকাতের কোনো সাধারণ বিধি প্রণয়ন করার অবকাশ নেই।

[ ৪ ]
ডক্টর ফজলুর রহমান ও তার সতীর্থদের যেসব চিঠিপত্র এ যাবত দৈনিক মাশরিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলোতে একটি মৌলিক বক্তব্য সমস্বরে ক্রমাগত উচ্চারিত হয়ে আসছে। সেই বক্তব্যটি হলো যাকাত একটা কর বিশেষ। সরকার ইচ্ছেমত যে কোনো জিনিসের উপর তা আরোপ এবং যে কোনো খাতে তা ব্যয় করতে পারে। যাকাত ছাড়া আর কোনো কর ইসলামে বৈধ নয়। তাই যে করই আরোপ হোক, তা যাকাত হিসেবেই গণ্য হবে। অন্য কথায় ব্যাপারটা দাঁড়ায় এই যে, যাবতীয় সরকারি রাজস্বের উপর ছাপ তো পড়বে যাকাতেরই, কিন্তু নীতিগতভাবে বা কার্যত যাকাত ও করে আদৌ কোনো ব্যবধানই থাকবেনা। যাকাত যে কতকগুলো নির্দিষ্ট জিনিসের উপর নির্দিষ্ট হারে আরোপ ও কতকগুলো বিধিবদ্ধ খাতে ব্যয় করা বাধ্যতামূলক, সেই প্রাচীন ধারণা বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এ বক্তব্য খণ্ডন করার জন্য যখন যাকাত ও করের মূল পার্থক্য তুলে ধরা হয় এবং বলা হয় যে, সরকার যাকাত এবং তার আদায় ও বন্টনের সুনির্দিষ্ট ও শরিয়ত নির্ধারিত কাঠামোকে বহাল ও অক্ষুন্ন রেখে, অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে অন্যান্য জরুরি কর বসাতে পারে, তখন বলা হয় যে, এভাবে তো দুটো স্বতন্ত্র আর্থিক ব্যবস্থা চালু হয়ে যাবে। অথচ ইসলাম রাষ্ট্রের প্রাপ্য ও আল্লাহর প্রাপ্য ভিন্ন ভিন্ন রকম ধার্য করেনা।

বস্তুত, কোনো যুক্তিনির্ভর ও মনোজ্ঞ আলোচনায় এ ধরণের আসারও স্থুল জবাব আশা করা যায়না। সুনির্দিষ্ট ও বিধিবদ্ধ আয়ের উৎস ও ব্যয়ের খাত রয়েছে এমন একাধিক আর্থিক কার্যক্রমে কি কোনো রাষ্ট্রীয় কোষাগার বায়তুলমাল বা অর্থব্যবস্থায় থাকতে পারেনা? এতোটুকু ভিন্নমুখী দু'টো ধারা থাকলেই দুটো স্বতন্ত্র অর্থব্যবস্থা এবং আল্লাহর ও রাষ্ট্রের দু'রকম অধিকার কোথা থেকে বেরিয়ে আসে, তা আমার বুঝে আসেনা। তবে হ্যাঁদ, যদি আসল উদ্দেশ্য এই হয় যে, যাকাতকে নামে মাত্র বহাল রাখা হবে এবং ইবাদত ও ইসলামের স্তম্ভ হিসেবে তার অস্তিত্ব বিলোপ করা হবে, তাহলে অবশ্য ভিন্ন কথা। সে ক্ষেত্রে কোনো আলোচনার স্বার্থকতা থাকেনা। তেমন হবে ব্যাপারটা যে শুধু যাকাতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবেনা, তা সুস্পষ্ট। বর্তমান বিতর্কের মাঝে এক ব্যক্তি হজ্জের উপর বিধিনিষেধ আরোপের ফতোয়া দিয়েই ফেলেছেন। অনুরূপভাবে নামেযের ব্যাপারেও হয়তোবা কেউ বলে বসবে যে, নামাযের 'মৌল তত্ত্ব' শ্রদ্ধাভরে মেনে নিচ্ছি। তবে তা কোন্‌ কোন্‌  সময়ে দিনে কতবার, কতো রাকাত করে পড়তে হবে এবং তাতে কি কি দোয়া কালাম পাঠ করতে হবে, সে ব্যাপারে ইসলামি সরকারের হাতে রদবদলের ক্ষমতা আছে। আর এই নয়া ফতোয়ার পক্ষেও ভুল বিকৃত দলিল প্রমাণ খোঁজাখুঁজি শুরু হয়ে যাবে।

করাচির ইসলামি গবেষণা সংস্থার (ইদারায়ে তাহকিকাতে ইসলামি) সদস্য মুহাম্মদ খালেদ মাসউদ সাহেবের এক চিঠি দৈনিক মাশরিকের ৬ই জুলায়, ১৯৬৬ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। এতেও পুনরায় কতিপয় হাদিস ও ফেকাহ শাস্ত্রীয় উক্তির কদর্থ করে পাঠকদেরকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা চালানো হয়েছে। আমি আপাতত ঐ বিধির বক্তব্য খণ্ডনে কালক্ষেপণের পরিবর্তে কয়েকটি মৌলিক বিষয় ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরছি এবং এই বিতর্কের সাথে সংশ্লিষ্ট সকলকে এ বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তাভাবনা করার আহবান জানাচ্ছি।

১. একটি ইসলামি রাষ্ট্র যদি যাকাত ছাড়া আর কোনো কর আরোপ করতে না পারে, এমনকি অমুসলিমদের কাছ থেকে আদায় করা করকেও যাকাত নামে অভিহিত করা স্থির হয়, তাহলে এ প্রশ্ন না উঠে পারেনা যে, ইসলামে যাকাত ও জিযিয়া নামে দুটো আলাদা আলাদা পরিভাষা কেন তৈরি হয়েছে? এ পরিভাষা দুটো হাদিস বা ফেকাহ শাস্ত্র থেকে উদ্ভুত হয়নি, বরং খোদ কুরআনেই তা উল্লেখিত হয়েছে। কুরআনে এ পরিভাষা দুটো ব্যবহৃতও হয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন স্থানে ও স্বতন্ত্র আঙ্গিকে। কুরআনে যাকাতের উল্লেখ বেশিরভাগ নামাযের সাথেই হয়েছে এবং স্পষ্টই সে নির্দেশ নামাযের নির্দেশের মতো মুসলমানদের প্রতিই জারি হয়েছে। সদকার নির্দেশও যেখানেই এসেছে, পূর্বাপর প্রসঙ্গ দেখলে বুঝা যায় যে, সেখানে রসূল সা.-কে মুসলমানদের পাপ স্খলন ও সংশোধনের উদ্দেশ্যে তাদের কাছ থেকে সদকা গ্রহণ করতে ও তাদের সান্ত্বনার উদ্দেশ্যে তাদের কল্যাণের জন্য দোয়া করতে বলা হয়েছে। অপরদিকে যেখানে জিযিয়ার প্রসঙ্গ আলোচিত হয়েছে, সেখানে পাশাপাশি ইহুদি ও খৃষ্টানদের উল্লেখ রয়েছে। সুতরাং যে ব্যক্তি সচেতনভাবে কুরআন পড়ে, তার পক্ষে এ কথা বিশ্বাস করা সম্ভব নয় যে, সরকার জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকল নাগরিকের উপর যে করই আরোপ করবে তা যাকাতে পর্যবসিত হবে এবং তা যে কোনো মুসলমানের উপর ইচ্ছেমত ব্যয় করা যাবে।

২. 'বাধ্যতামূলক সদকা' তথা যাকাতের অর্থ ব্যয়ের ৮টি খাত কুরআনে বর্ণিত হয়েছে। প্রত্যেক সরকারি কর যদি যাকাত হয়, তাহলে সরকারকে তা প্রত্যেক খাতেই ব্যয় করতে হবে। সরকার যেখানেই তা ব্যয় করবে, তা আপনা আপনি যাকাতের বৈধ খাত হিসেবেই গণ্য হবে। প্রকৃত ব্যাপার যদি তাই হয়, তাহলে তো আল্লাহ তায়ালার যাকাত ব্যয়ের খাত নির্ধারণ করাটি সম্পূর্ণ বৃথা ও পণ্ডশ্রম হয়ে গেছে (নাউজুবিল্লাহ) এর ফলে এই সব খাতের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে অনেককে ভীষণ বিড়ম্বনার মধ্যে পড়তে হচ্ছে। 'পথিকের' খাত ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কেউবা বিমানযোগে ভ্রমণকেও এর আওতায় এনে দিচ্ছে। আবার কেউবা 'যাকাত কর্মীর' ব্যাখ্যা এমনভাবে করেছে যে, বেসামরিক সরকারি কর্মচারীদের বেতনও এই খাত থেকে দেয়া বৈধ সাব্যস্ত করা হচ্ছে। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে, সামরিক কর্মচারীদের এই খাতের আওতায় আনার কথা তাদের মনে থাকেনা। অথচ বেসামরিক সরকারি কর্মচারী যদি 'যাকাত কর্মী' খাতের আওতায় আসতে পারে, তাহলে সামরিক কমীচারীদের কি দোষ, তারা এ খাত থেকে কেন বঞ্চিত হবে?

৩. পবিত্র কুরআনে যাকাত ব্যয়ের খাতসমূহের মধ্যে দরিদ্র ও নি:স্ব লোকদেরকে সর্বাগ্রে উল্লেখ করা হয়েছে। একাধিক হাদিস থেকেও জানা যায় যে, যাকাত ধনীদের কাছ থেকে নিয়ে দরিদ্রদের মধ্যে বন্টন করতে হবে। ছয়খানা প্রখ্যাত বিশুদ্ধ হাদিস গ্রন্থে হযরত ইবনে ওমরের বর্ণিত হাদিসে বলা হয়েছে, জীবিকা উপার্জনে সক্ষম কোনো সুস্থ সবল লোক এবং কোনো স্বচ্ছল লোকের জন্য যাকাত গ্রহণ বৈধ নয়। কয়েকটি হদিসে শুধুমাত্র কতিপয় ব্যতিক্রমধর্মী পরিস্থিতিতে ধনী লোককেও যাকাত গ্রহণের অনুমতি দেয়া হয়েছে। নচেৎ সাধারণ স্বীকৃত মূলনীতি এটাই যে, ধনী লোকদের জন্য যাকাত গ্রহণ জায়েয নয়।

যাকাত ও সাধারণ করের মধ্যে আরো একটা মৌলিক পার্থক্য হলো, যাকাত শুধু নিসাবধারী (নির্দিষ্ট ন্যূনতম বার্ষিক সঞ্চয়ের অধিকারী) ধনী ব্যক্তিদের কাছ থেকে আদায় ও গরিবদের মধ্যে বন্টন করতে হয়। পক্ষান্তরে করের বোঝা ধনী গরিব নির্বিশেষে সকল নাগরিকের উপর পড়ে। আর কর আদায় বাবদ যে রাজস্ব সরকারি কোষাগারে জমা হয়, তা দ্বারা অনেক সময় ধনীরা বেশি এবং গরিবেরা কম উপকৃত হয়ে থাকে। এ জন্য আল্লাহ এ তার রসূল সা. গরিবদের স্বার্থ রক্ষার্থে যাকাতের একটা বিশেষ তহবিল গঠন করেছেন, যাতে ধন সম্পদ একতরফাভাবে ধনীদের কাছ থেকে শুধুমাত্র গরিবদের দিকেই আবর্তিত হয়ে থাকে। অন্য কোনো সরকারি করে এ ব্যবস্থা নেই। কিন্তু এ যুগের এক ধরনের পণ্ডিত মহারথী প্রয়োজনের চেয়ে বেশি উদারতা ও মহানুভবতার পরাকাষ্ঠা দেখাতে গিয়ে যাকাত ও প্রচলিত করের পার্থক্য একেবারেই বিলোপ করতে ইচ্ছুক, যার পরিণামে আল্লাহ ও রসূলের আদেশও লংঘন করা হবে গরিবদের হকও নষ্ট হবে। অর্থাৎ দুনিয়া ও আখিরাতে দুটোই গোল্লায় যাবে।

৪. যাকাত সম্পর্কে রসূল সা.-এর  আরো একটা ফরমান একাধিক হাদিসে ঘোষিত হয়েছে। এ ফরমানে জানা যায় যে, রসূল সা.-এর বংশধরের জন্য যাকাত হালাল নয়। রসূল সা. নিজে রাষ্ট্রের কর্ণধার ছিলেন এবং সরকারি কর্মচারীদেরকে 'যাকাত কর্মীর' আওতাধীন করার নতুন উদ্যোগ রাষ্ট্র প্রধানের যাকাতের অংশ পাওয়ার কথা। কিন্তু রসূল সা. নিজে কখনো যাকাত বা 'বাধ্যতামূলক সদকা' দ্বারা উপকৃত হননি।

এমনকি হযরত হাসান রা. শিশুকালে সদকার একটা খেজুর মুখে দিলে রসূল সা.  তৎক্ষণাৎ জোরপূর্বক তা মুখ থেকে বের করে দেন এবং বলেন, এটা আমাদের জন্য হারাম।

ফেকাহ শাস্ত্রকারগণ সুস্পষ্টভাবে বলেছেন যে, বনু হাশেম গোত্রের লোকদের জন্য যাকাত গ্রহণ করা জায়েয নয়। এখন যারা সকল সরকারি কর্মচারীর জন্য যাকাত হালাল করে দিতে চান, তাদের কাছে আমি জানতে চাই যে, রসূল সা. এই দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা থাকা অবস্থায় তারা সৈয়দ, আলভী, ও আব্বাসী বংশোদ্ভুত কর্মচারীদের উপর কিভাবে যাকাত ব্যয় করবেন? আল্লাহর নবী সা. যখন অসাধারণ ত্যাগের মনোভাব দেখিয়ে নিজেকে ও নিজের বংশধরকে যাকাত থেকে বঞ্চিত করেছেন, তখন এই নিষেধাজ্ঞাকে অবজ্ঞা করার অধিকার কার আছে? আর এই নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকা অবস্থায় সরকারি কোষাগারে যাকাত ছাড়া আর কোনো অর্থ না থাকলে এই সব কর্মচারীর বেতন কোথা থেকে আসবে?

শরিয়তের নির্ধারিত যাকাত ব্যবস্থায় রদবদল করলে এবং যাকাতের সাথে সাধারণ করকে মিলিয়ে মিশিয়ে একাকার করে ফেললে যে জটিল ও কুৎসিত পরিস্থিতির সৃষ্টি হবার সম্ভাবনা রয়েছে, তার কয়েকটি দিক সম্পর্কে আমি সংক্ষেপে আভাস দিলাম। প্রতিটি বক্তব্যের সপক্ষে যুক্তি ও কুরআন হাদিসের সুস্পষ্ট উক্তির আলোকে প্রমাণাদিও উল্লেখ করেছি। অধিকাংশ প্রমাণই কুরআন ও হাদিসের সুস্পষ্ট উক্তি থেকে সংগৃহীত, অপরিচিত ও বিরল ফেকাহ শাস্ত্রিয় বিধির উপর নির্ভরশীল নয়। যারা সত্যনিষ্ঠ ও ইনসাফপ্রিয় এবং যারা ইসলামের বিকৃতি সাধনের বাতিকে ভোগেননা, তাদের কাছে আমার অনুরোধ, আমার কথাগুলো ঠাণ্ডা মাথায় পুনরায় বিবেচনা করুন এবং হঠকারীতার নীতি পরিহার করে চলুন। [তরজমানুল কুরআন, জুন ১৯৬৬]



সর্বশেষ আপডেট ( Friday, 04 March 2011 )