আমাদের টাইপ করা বইগুলোতে বানান ভুল রয়ে গিয়েছে প্রচুর। আমরা ভুলগুলো ঠিক করার চেষ্টা করছি ক্রমাগত। ভুল শুধরানো এবং টাইপ সেটিং জড়িত কাজে সহায়তা করতে যোগাযোগ করুন আমাদের সাথে।
রাসায়েল ও মাসায়েল ৬ষ্ঠ খন্ড প্রিন্ট কর ইমেল
লিখেছেন সাইয়্যেদ আবুল আ'লা মওদূদী   
Monday, 28 February 2011
আর্টিকেল সূচি
রাসায়েল ও মাসায়েল ৬ষ্ঠ খন্ড
গ্রন্থকার পরিচিতি
১। আল্লাহর অস্তিত্ব সম্পর্কে সংশয় নিরসন
২। আল্লাহ ও তাঁর রসুলগণের মধ্যে পার্থক্য করা
৩। জীবজন্তুর উপর দয়া
৪। পাঁচ ওয়াক্ত ও পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায
৫। হানাফি মাযহাবে কি কিছু কিছু মাদক দ্রব্য হালাল?
৬। আদালতের রায় কি শুধু জাহেরীভাবেই কার্যকর, নাকি বাতেনীভাবেও কার্যকর?
৭। সুন্নাহর আইনগত মর্যাদা
৮। সাহরির শেষ সময় কোনটি?
৯। একটি হাদিস থেকে সুদের বৈধতা প্রমাণের অপচেষ্টা
১০। মুসলিম উম্মাহর বহু গোষ্ঠিতে বিভক্তি এবং মুক্তি লাভকারি গোষ্ঠি
১১। কালো খেজাব লাগানো কি বৈধ?-১
১২। কালো খেজাব কি বৈধ?-২
১৩। তাকদীর প্রসঙ্গ
১৪। গোমরাহী ও হেদায়েত
১৫। সূরা আন নাজমের প্রাথমিক আয়াত কয়টির ব্যাখ্যা
১৬। যাকাতকে প্রচলিত করের সাথে যুক্ত করা যায় না
১৭। পিতামাতার অধিকার
১৮। লোহার আংটি পরা কি জায়েয?
১৯। উশর ও খারাজের কয়েকটি সমস্যা
২০। উশরযোগ্য ফল ফসল কি কি?
২১। মোজার উপর মসেহ করার বিধান
২২। কারো সম্মানে দাঁড়ানো কি জায়েয?
২৩। 'প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ দান করা' সংক্রান্ত কুরআনের আদেশের ব্যাখ্যা
২৪। অপ্রাপ্ত বয়স্ক সন্তানদের ভরণ পোষণ প্রসঙ্গে
২৫। কবর আযাব
২৬। কুরআন শিক্ষাদান ও অন্যান্য ধর্মীয় কাজের পারিশ্রমিক নেয়া কি বৈধ?
২৭। ইসলামের ফৌজদারী দণ্ডবিধি সংক্রান্ত কিছু ব্যাখ্যা
২৮। বেতের নামাযে দোয়া কুনূত
২৯। লাইসেন্স ক্রয় বিক্রয়
৩০। কিবলার দিক নির্ণয়ের শরিয়তসম্মত বনাম বিজ্ঞানসম্মত পন্থা
৩১। মৃত ব্যক্তির জন্য ফিদিয়া দান, শোক ও কুরআন খতম
৩২। কয়েদি সৈন্যরা কি নামায কসর করবে
৩৩। পবিত্র কুরআন ও গুপ্ত ওহি
৩৪। ব্যভিচারের অপবাদ
৩৫। কোন কোন প্রাণী হালাল বা হারাম
৩৬। কুরবানীর চামড়া সম্পর্কে শরিয়তের বিধান
৩৭। মৃত ব্যক্তির চামড়া সম্পর্কে শরিয়তের বিধান
৩৮। মৃত প্রাণীর চামড়া সম্পর্কে আরো আলোচনা
৩৯। জবাই হালাল হওয়ার জন্য কি বিস্
৪০। যাকাত সংক্রান্ত কিছু খোলামেলা কথা
৪১। নগদ পুঁজির যাকাত ও তার নিসাব
৪২। বাইয়ে সালাম
৪৩। হযরত আলী রা.-এর জন্য সূর্যকে ফিরিয়ে দেয়ার ঘটনা কি সত্য?
৪৪। কুরাইশের ১২ জন খলিফা ও 'ফিতনায়ে আহলাস'
৪৫। আল্লাহ ও রসূলের কোনো উক্তি কি মানুষকে কর্মবিমুখ করতে পারে?
৪৬। আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয় করা সত্ত্বেও দৈন্যদশার কারণ কি?
৪৭। হযরত আলী রা.-এর বর্ম চুরি-১
৪৮। হযরত আলী রা.-এর বর্ম চুরি-২
৪৯। ইসলামের দৃষ্টিতে গানবাজনা ও নারী পুরুষের মেলামেশা
৫০। আব্দুল্লাহ বিন উবাইর জানাযা
৫১। ইমাম ইবনে তাবারি কি শিয়া ছিলেন?
৫২। ফৌজদারি অপরাধের ক্ষেত্রে আপোস নিষ্পত্তির অধিকার
৫৩। ইসলামের উত্তরাধিকার আইন সম্পর্কে অভিযোগ
৫৪। শরিয়তের দৃষ্টিতে ওয়াকফের সংজ্ঞা ও বিধান
৫৫। আত্মহননকারীর জানাযা নামায
৫৬। হারুত মারুত ফেরেশতাদ্বয় সম্পর্কে এক ভিত্তিহীন অলীক কাহিনী
৫৭। 'চাটান' সম্পাদকের নিকট দুটো চিঠি
৫৮। হাদিস অস্বীকার করা ও স্বীকার করা
৫৯। হাদিস বিরোধী গোষ্ঠির বিভ্রান্তিকর প্রচারণা
৬০। একটি হাদিস সম্পর্কে আপত্তি ও তার জবাব
৬১। সন্তান পালনে নারীর অধিকার
৬২। স্তনের দুধ পানে বিয়ে হারাম হওয়া
৬৩। পারিবারিক আইন ও অর্পিত তালাক
৬৪। ফাসিদ বিয়ে ও বাতিল বিয়ে
৬৫। রসূল সা. কি হযরত সওদা রা. কে তালাক দিতে চেয়েছিলেন?
৬৬। উম্মুল মুমিনীন হযরত সওদার বিয়ে সম্পর্কে আরো আলোচনা
৬৭। কতোখানি দুধ পান করলে বিয়ে হারাম হয়?
৬৮। পিতামাতার আদেশে স্ত্রী তালাক দেয়া যায় কি?
৬৯। রসুল সা.-এর একাধিক বিয়ের যৌক্তিকতা ও সার্থকতা
৭০। বেলুচিস্তানের বাগদান প্রথা
৭১। লটারি ও নির্বাচনী লটারি
৭২। সমবায় সমিতি

<h1>২৬। কুরআন শিক্ষাদান ও অন্যান্য ধর্মীয় কাজের পারিশ্রমিক নেয়া কি বৈধ?</h1>
প্রশ্ন : ইসলামি বইপুস্তক অধ্যয়নকালে একটা সমস্যা বারবার মস্তিষ্কে জট পাকায়। আপনার  কাছ থেকে এ সমস্যার সমাধান কামনা করছি। মিশকাত শরিফে হযরত ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত যে, সাহাবিদের একটি দল গ্রামের কাছ দিয়ে যাচ্ছিলেন। এই সময় ঐ গ্রামের এক ব্যক্তি সাপ বা বিচ্ছুর কামড় খায়। জনৈক সাহাবি  কয়েকটি ছাগলের বিনিময়ে সাপে কামড়ানো লোকটিকে সূরা ফাতিহা পড়ে ঝেড়ে দেন। এতে লোকটি সুস্থ হয়ে উঠে। অন্য সাহাবিগণ ছাগল গ্রহণে আপত্তি জ্ঞাপন করেন। অত:পর তাঁরা মদিনা পৌঁছে রসূল সা.-কে সমগ্র ঘটনা খুলে বলেন। রসূল সা. বললেন :
                     -----------------------------------------------
"যে সব জিনিসে তোমরা পারিশ্রমিক নিয়ে থাক, তার মধ্যে আল্লাহর কিতাবই যোগ্যতম।"
পক্ষান্তরে হযরত উবাদা ইবনে সামেত কর্তৃক বর্ণিত এক হাদিসে বলা হয়েছে :
..........----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
"হাদিসের আলোকে কুরআন শিখানোর বিনিময়ে ধনুকের মতো একটা মামুলী জিনিস পারিশ্রমিক হিসেবে নেয়াও শাস্তিযোগ্য ও গোনাহর কাজ সাব্যস্ত হয়েছে।"

উক্ত দুটো হাদিসে সমন্বয় সাধন করা আমার পক্ষে দুষ্কর। হাদিসে যদি একটা নির্দেশই থাকতো চাই তা নিষেধাজ্ঞা হোক কিংবা বৈধতার ছাড়পত্র হোক- তা হলে সেই অনুসারেই কাজ হতো। কিন্তু একই সাথে উভয়টির অনুসরণ কিভাবে সম্ভব? ইমামতি, খতীবগিরি, ইসলামি বিষয়ে শিক্ষাদান ও শিক্ষতার কাজও কুরআন শিক্ষাদানের  মতোই আবার ইসলামি বিষয়ে শিক্ষাদানের কাজও নানা রকমের হয়ে থাকে। কিছু কাজ সমষ্টিক কিছু কাজ ব্যক্তিগত উদাহরণস্বরূপ কোনো একজন শিক্ষক বা ক্বারী কারো বাড়িতে গিয়ে তাকে বা তার ছেলেমেয়েকে কুরআন শিখায় এবং এ কাজে নিজের সময় ও শ্রম ব্যয় করে। এই শিক্ষকের পক্ষে কি গৃহস্থের কাজ থেকে কোনো পারিশ্রমিক নেয়া হারাম হবে? দৃশ্যত এটা খুবই কঠিন অকার্যোপযোগী ব্যাপার বলে মনে হয়। তাই উপরোক্ত হাদিসসমূহের প্রকৃত মর্ম ও তাৎপর্য কি তা সঠিকভাবে বিশ্লেষিত হওয়া প্রয়োজন।

জবাব : যে সকল আলেম কুরআন ও ইসলামি বিদ্যা শিক্ষাদানে কিংবা অন্য কোনো ইসলামি কাজ সম্পাদনে  সময় ও শক্তি ব্যয় করে থাকেন, প্রাচীন আলেমগণ প্রায় পুরোপুরি একমত যে, তাদের পক্ষে প্রচলিত রীতি অনুযায়ী এই কাজের মজুরি ও পারিশ্রমিক গ্রহণ করা সম্পূর্ণ বৈধ শরিয়ত সম্মত। কেউ কেউ বলেন যে, ইবাদতের বিনিময়ে পারিশ্রমিক গ্রহণ করাকে ইমাম আবু হানিফা জায়েয মনে করতেননা, কিন্তু সাম্প্রতিককালের হানাফি ফকীহগণ এই মর্মে ফতোয়া দিয়েছেন যে, ইমামতি, খতীবগিরি ও কুরআন শিক্ষাদানের জন্য আর্থিক পারিশ্রমিক গ্রহণ করা যায়। সূরা ফাতিহা পড়ে ফুঁক দিয়ে তার পারিশ্রমিক গ্রহণ সম্পর্কে যে হাদিসের আপনি উল্লেখ করেছেন, সেটি বুখারির চিকিৎসা সংক্রান্ত অধ্যায় এবং ভাড়া সংক্রান্ত অধ্যায়ে বর্ণিত। হযরত ইবনে আব্বাস এবং হযরত আবু সাঈদ খুদরী এই হাদিসের বর্ণনাকারী। হযরত আবু সাঈদ বর্ণিত যে হাদিসটি ভাড়া সংক্রান্ত অধ্যায়ে সন্নিবেশিত হয়েছে, তার ভাষান্তর নিম্নরূপ :

"রসূল সা.-এর কতিপয় সাহাবি এক সফরে রওনা হন। তারা এক আরব গোত্রের বস্তিতে পৌঁছে তাদের কাছে খাবার চান। কিন্তু তারা খাবার দিতে অস্বীকার করে। এই সময় ঐ গোত্রের সরদারকে হঠাৎ সাপে দংশন করে। গোত্রের লোকেরা তার চিকিৎসার জন্য অনেক চেষ্টা তদবীর করলো। কিন্তু কোনো ফলোদয় হলো না। অবশেষে তারা উক্ত সাহাবিদের কাছে এলো। ভাবলো তাদের কাছে কোনো ওষুধ থাকতে পারে। তারা বললো, ওহে পথিকগণ! আমাদের সরদারকে বিষাক্ত প্রাণী কামড় দিয়েছে। কোনো চেষ্টা তদবীরেই তার কোনো উপকার হলোনা। আপনাদের কাছে কি এর কোনো ওষুধ আছে? কাফেলার মধ্য থেকে একজন বললো : হ্যাঁ আমি ঝাড় ফুঁক করে থাকি। তবে আল্লাহ সাক্ষী আছেন যে, আমরা তোমাদের কাছে খাবার চেয়েছিলাম তোমরা তা দাওনি। কাজেই তোমরা কি পরিশ্রমিক দেবে তা ঠিক না করা পর্যন্ত আমি ঝাড় ফুঁক করবোনা। এ কথা শুনে গোত্রের লোকেরা এক পাল ছাগল দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলো। অত:পর ঐ সাহবি সূরা ফাতিহা পড়ে ফুঁক দিতে লাগলেন। এতে সর্প দংশিত গোত্রপতি অল্প সময়ের মধ্যেই সুস্থ হয়ে স্বাভাবিকভাবে হাটাচলা করতে লাগলো। গোত্রের লোকেরা প্রতিশ্রুত ছাগলগুলো তাদের কাছে হস্তান্তর করলো। সাহাবিগণের কেউ কেউ ছাগলগুলোকে সফরসঙ্গিদের মধ্যে বন্টন করার পরামর্শ দিলেন। কিন্তু ঝাড় ফুঁককারী সাহাবি বললেন ; এখনই এরূপ করোনা। আমরা রসূল সা.-এর কাছে গিয়ে পুরো ঘটনা বর্ণনা করবো। দেখি তিনি কি বলেন। তাঁরা রসূল সা.-এর কাছে উপস্থিত হয়ে ঘটনাটি জানালেন। রসূল সা. বললেন : ব্যাপার মন্দ নয়। তুমি জানলে কি করে যে, এভাবে ঝাড়ফুঁক করতে হয়? অত:পর বললেন: তোমরা যা করেছ ঠিকই করেছ। তারপর মুচকি হেসে আবার বললেন: ছাগলগুলো বন্টন করে দাও এবং আমার জন্যও এক ভাগ রেখো।"

হযরত ইবনে আব্বাস বর্ণিত হাদিসে এ কথাটাও যুক্ত হয়েছে যে, রসূল সা. বললেন :
                           --------------------------------------
"পারিশ্রমিক গ্রহণের জন্য আল্লাহর কিতাব সবচেয়ে বেশি যোগ্য।"

এ হাদিস সম্পর্কে কিছু কিছু প্রশ্ন ও আপত্তি মনে জাগতে পারে। তবে তা এতো জটিল নয় যে, তার কোনো সমাধানই খুঁজে পাওয়া যাবেনা। উদাহরণস্বরূপ প্রশ্ন করা যেতে পারে যে, কুরআন শিক্ষার সাথে এ ঘটনার কোনো সম্পর্ক নেই। যাদের কাছ থেকে ছাগলগুলো নেয়া হয়েছিল, তারা অতিথিপরায়ণ ছিলনা। তারা মুসলমান ছিলো বলেও উল্লেখ নেই, আর সাহাবিগণ তখন প্রবাসকালীন অভাব ও সংকটে ছিলেন। তাই এ ঘটনা দ্বারা কিভাবে প্রমাণিত হয় যে, কুরআন শিখানোর বিনিময়ে পরিশ্রমিক নেয়া শর্তহীনভাবে বৈধ? অধিকাংশ হাদিস সংগ্রাহক এ হাদিসকে ভাড়া দেয়া (সম্পত্তি ও শ্রম দুটোই এর আওয়াভুক্ত) চিকিৎসা, তাবিজতুমার ও ঝাড়ফুঁক সংক্রান্ত অধ্যায়ে এনেছেন। এ থেকে বুঝা যায় যে, এ ঘটনা ধর্মীয় শিক্ষা কার্যক্রমের সাথে সংশ্লিষ্ট নয়।

কিন্তু এ সকল প্রশ্ন ও আপত্তির জবাব হলো এ হাদিস থেকে অন্ততপক্ষে এতোটুকু প্রমাণিত হয় যে, কুরআনের আয়াতের ব্যবহার করার বিনিময়ে পূর্বনির্ধারিত চুক্তির ভিত্তিতে আর্থিক সুবিধা আদায় করে দেয়া হয়েছে। এ সুবিধা যারা অর্জন করলেন তারা সাহাবি ছিলেন এবং তারা শরিয়তের বিধিনিষেধের অনুগত ছিলেন। স্বয়ং রসূল সা. এ লেনদেনকে বৈধ বলে রায়ও দিয়েছেন। উপরন্তু এখানে একটা মৌলিক তত্ত্ব বলে দেয়া হয়েছে যে, তোমরা যখন অন্যান্য কাজের পরিশ্রমিক নিয়ে থাক, তখন আল্লাহর কিতাব দ্বারা কারো উপকার ও প্রয়োজন পূরণ করে থাকলে তার বদলা নেয়ার তোমরা আরো বেশি হকদার। রসূল সা. এ কাজটাকে কোনো আপদকালীন বা ব্যকিক্রমধর্মী ব্যবস্থা বলেও অভিহিত করেননি। বরঞ্চ এতে নিজের হিস্‌সাও দাবি করেছেন যদিও তা উপহাসচ্ছলেই করেছেন।

যদি মেনেও নেয়া হয় যে, এ হাদিস সরাসরি কুরআন শিখানোর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, তথাপি কিয়াসের মাধ্যমে অত্যন্ত সঙ্গতভাবেই এটিকে কুরআন পড়ানো বা শিখানো বাবদ পারিশ্রমিক গ্রহণের পক্ষেও প্রয়োগ করা যায়। কেননা আল্লাহর কালাম পড়ে ফুঁক দেয়া যেমন একজন রোগীর জন্য উপকারী হতে পারে। তেমনি তার শিক্ষাদানও একজন শিক্ষার্থীর উপকার সাধন করতে পারে। তাই হাফেয ইবনে হাজার এ হাদিসের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেন :
             -------------------------------------------------------------
"হাদিসটিকে অধিকাংশ ফেকাহবিদ কুরআন শিক্ষাদানের বিনিময়ে পারিশ্রমিক গ্রহণের বৈধতার পক্ষে প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করেছেন।"

মুসলিম শরিফের সামাজিক আচরণ সংক্রান্ত অধ্যায়ের চিকিৎসা বিষয়ক পরিচ্ছেদেও এ হাদিসটি রয়েছে। এর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে ইমাম নববী বলেন যে, এর দ্বারা জানা যায় সূরা ফাতিহা ও অন্যান্য সূরা বা দোয়া পড়ে ঝাড়ফুঁক করে মজুরি নেয়া জায়েয আছে বলে প্রমাণিত হয়। তিনি আরো বলেন, ইমাম শাফেয়ী, মালেক, আহমদ, ইসহাক বিন রাহওয়ে, আবু সাওর ও অন্যান্য প্রাচীন ইমামদের অভিমত ও অনুরূপ। এসব মতামত ব্যক্ত হওয়ার পর অবশ্য আরো একটা সমস্যা অবশিষ্ট থেকে যায়। সেটি হলো এসব বর্ণনা অনুসারে যদি কুরআন শিক্ষা দেয়া বাবদ পরিশ্রমিক নেয়া জায়েয হয়, তাহলে কিছু লোক যে খাওয়া কিংবা টাকার লোভে মৃত ব্যক্তির জন্য কুরআনখানি করে, তাও তো জায়েয হওয়ার কথা। অথচ অধিকাংশ ফেকাহবিদ ও হাদিসবেত্তার মতে এ ধরনের কুরআন পড়াতে কোনো সওয়াব নেই।

আমার মতে এর জবাব এই যে, যার জন্য এই কুরআনখানি করা হয়, তার কোনো ইহলৌকিক কল্যাণ সাধন বা তাৎক্ষণিক উপকার করার ইচ্ছে পোষণ কর হয়না। এর দ্বারা আখেরাতের সওয়াব ও কল্যাণ কাম্য হয়ে থাকে। এ জন্য এ কাজ ইসালে সওয়াব নামে পরিচিত। আর সওয়াব বলতে বুঝায় আখেরাতের পূণ্য ও প্রতিদান। এটা শিক্ষাদান, মজুরির ভিত্তিতে কোনো কাজ করা, চিকিৎসা বা তাবিজকুমার ও ঝাড়ফুঁক ইত্যাদির ব্যাপার নয়। তাই উভয় পক্ষের অভিষ্ট পার্থিব কল্যাণ হওয়া চাইনা। এ কাজ পুরোপুরি আল্লাহর ওয়াস্তে করা কর্তব্য। এতে দুনিয়াবি ফায়দা অর্জনের অভিপ্রায় থাকলে এমনকি তার কোনো নামগন্ধও থাকলে এটা নিরর্থক কাজে পর্যবসিত হবে। মোটকথা, ইসালে সওয়াব অর্থাৎ মৃত ব্যক্তির আত্মার কল্যাণার্থে কুরআন পড়া এক ধরণের কাজ। আর কুরআন শিখানো, লেখা ছাপানো ও প্রকাশ করা অন্য ধরনের কাজ।  কোনো মুসলমানকে আল্লাহ যদি এতোটা স্বচ্ছলতা দিয়ে থাকেন যে, সে কুরআনের এইসব খিদমতের বিনিময়ে কোনো দুনিয়াবি পারিশ্রমিকের মুখাপেক্ষী হয়না এবং সে এইসব খিদমত বিনা পারিশ্রমিকে আল্লাহর ওয়াস্তে করে তবে সেটা খুবই ভালো কথা। কিন্তু সে যদি নিজের শ্রমের আর্থিক বিনিময় চায়, তবে দুনিয়ার জীবনে তা নিতে পারে এবং দুনিয়ার জীবনে নেয়া সত্ত্বেও তার নিয়ত যদি বিশুদ্ধ থাকে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের নিমিত্তে তা করে থাকে, তবে সে আল্লাহ চাহে তো আখেরাতের পুরষ্কার থেকেও বঞ্চিত হবেনা। ইমামতি ও খতীবগিরিও এই ধরনের কাজ। কেউ যদি যথেষ্ট সচ্ছল ও বিত্তশালী হয়ে থাকে, তবে তার এসব কাজ বিনা পারিশ্রমিকেই করা উচিত। কিন্তু প্রয়োজন থাকলে প্রচলিত নিয়মে পারিশ্রমিক নিতে পারে। বৃহত্তর ইমামতীর (ইসলামি রাষ্ট্রের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব) দায়িত্ব পালন করে খোলাফায়ে রাশেদীন যদি বায়তুলমাল থেকে ভাতা নিয়ে থাকেন, তবে ক্ষুদ্রতর ইমামতির পারিশ্রমিক নেয়া নাজায়েয হবে কেন? বর্তমান পরিস্থিতিতে এটিকে  নাজয়েয বলে ফতোয়া দিলে ইসলামের খিদমত ও কুরআনের শিক্ষা বিস্তারের কাজ নিদারুণভাবে বিঘ্নিত হবে। এ কাজ বিঘ্নিত হওয়া মারাত্মক ধরণের অনভিপ্রেত ব্যাপার যে, এর কবল থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ক্ষুদ্রতর অনভিপ্রেত কাজ সহ্য করে নিতেই হবে।

আল্লামা ইবনে আবেদীন স্বীয় গ্রন্থ রদ্দুল মুখতারে বলেন :
"পারিশ্রমিকের বিনিময়ে শিক্ষাদানকে যদি অনুমোদন না করা হয়, তবে কুরআন বিস্মৃত ও বিলুপ্ত হয়ে যাবে।"

যে হাদিসে কুরআন শিখানোর বিনিময়ে একটি ধনুক পর্যন্ত গ্রহণ করার বিরুদ্ধে কঠোর হুশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে, এবার সেই হাদিসটির প্রসঙ্গে আসা যাক।
মিশকাত শরিফের ইজারা অধ্যায়ে এ হাদিসটি রয়েছে। এর অনুবাদ নিম্নরূপ :

"হযরত উবাদা ইবনে সামেতকে কুরআন শিক্ষা দানের বিনিময়ে একটি ধনুক দেয়ার প্রস্তাব দেয়া হলে রসূল সা. বললেন : তোমার গলায় আগুনের শিকল পরানো হোক এটা যদি পছন্দ কর তবে এটি গ্রহণ করতে পার।"

কিন্তু এ হাদিস আবু দাউদ ও ইবনে মাজাহ থেকে নেয়া হয়েছে। সেখানে আরো কিছু বিবরণ রয়েছে, যা মিশকাতে উদ্ধৃত করার সময় বাদ পড়ে গেছে। আবু দাউদে হযরত উবাদার বক্তব্য এরূপ 'আমি আহলে সুফফাকে কুরআন পড়াতাম।' ইবনে মাজার হাদিসটিও অবিকল এই ভাষাতেই বর্ণিত। এ থেকে বুঝা যায় যে, এতো কঠোর সতর্ক বাণী আহলে সুফ্‌ফার সাথেই সংশ্লিষ্ট। সাহাবায়ে কেরামের এই দলটির আদৌ কোনো ঘরবাড়ি ছিলনা। খোলা আকাশের নিচে একটি চত্ত্বরে তারা দিনরাত পড়ে থাকতেন। তাদেরকে শিক্ষাদানের বিনিময়ে যদি বায়তুলমাল কিংবা অন্যান্য ধনী লোকদের কাছ থেকে কোনো পারিশ্রমিক নেয়া হতো তবে সেটা ভিন্ন কথা। কিন্তু ইসলামের খিদমতে সদাপ্রস্তুত ও সর্বোত্মকভাবে নিয়োজিত এই নি:স্ব ও সর্বহারা লোকদের কাছ থেকে কোনো পারিশ্রমিক নেয়া কোনো শিক্ষকের জন্যই বৈধ ছিলনা। সে সাহাবি ধনুক দিতে চেয়েছিলেন, তার হয়তো ওটাই একমাত্র সম্বল ছিলো এবং তা দিয়ে তিনি হয়তো জিহাদ কিংবা ভক্ষণযোগ্য প্রাণী শিকার করার কাজ করতেন। এ জিনিসটি থেকে তাকে বঞ্চিত করা কোনো মতেই সঙ্গত হতে পারেনা। তাছাড়া ইমাম সুয়ূতী ও অন্যান্য হাদিস বিশারদগণের মতে ও হাদিসের সনদ দুর্বল। তাই বুখারি ও মুসলিমের মোকাবেলায় এ হাদিস পরিত্যাজ্য অথবা স্বল্প গুরুত্ববহ হবে।

কেউ কেউ এ কথাও বলেছেন যে, হযরত উবাদা প্রথমে কুরআন শিক্ষাদানের কাজটা অবৈতনিকভাবে গ্রহণ করেছিলেন। তাই এ জন্য পারিশ্রমিক নেয়া বৈধ ছিলনা। হাদিসটির যে ব্যাখ্যা আমি উপরে করেছি, আবু দাউদের ব্যাখ্যা সম্বলিত গ্রন্থ 'আউনুল মা'বুদ' এর লেখকও অনুরূপ ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেন :
"আহলে সুফ্‌ফাহ অতি দরিদ্র লোকদের দল। তারা মানুষের দানসদকা দিয়েই জীবিকা নির্বাহ করতেন। সুতরাং তাদের কাছ থেকে কিছু নেয়া সমীচীন ছিলনা।"

এ আলোচনার সংক্ষিপ্ত সার এই যে, যারা কুরআন শিক্ষাদান বা অন্য কোনো দীনি কাজ করেন এবং এ কাজে নিজেদের সময় ও মাথা খাটান, তারা যদি সচ্ছল হন এবং আল্লাহর ভয় ও সন্তোষের তাগিদে কোনো আর্থিক বা বস্তুগত প্রতিদান না চান, তারা অসাধারণ মহত্ব ও মহানুভবতার পরিচয় দিয়ে থাকেন। এ জন্য তারা ইনশাআল্লাহ আখেরাতে অগণিত ও অফুরন্ত পুরস্কার পাবেন। কিন্তু যারা সচ্ছল নন, তাদের জীবিকার ভার যদি সরকার বা সমাজ গ্রহণ করে, অথবা দীনি শিক্ষা গ্রহণকারীরা বা তাদের অভিভাবকরা স্বত:প্রবৃত্ত হয়ে তাদেরকে নির্দিষ্ট বা অনির্দিষ্ট হারে কোনো পারিশ্রমিক দেন, তবে সেটা দেয়া ও নেয়া শরিয়তের দৃষ্টিতে জায়েয। এ ব্যাপারে মুসলিম আলেমগণ বলতে গেলে একমত। [তরজমানুল কুরআন, জুন ১৯৭৪]


[ ২ ]
প্রশ্ন : জুন মাসের তরজমানুল কুরআনে শিক্ষা দানের পারিশ্রমিক গ্রহণের বৈধতার পক্ষে আপনি যে আলোচনা করেছেন, তা আমার কাছে সন্তোষজনক মনে হয়নি। আপনি লিখেছেন যে, আধুনিক হানাফি ফেকাহ শাস্ত্রকারগণ এর বৈধতার ব্যাপারে একমত। কিন্তু হানাফি ফেকাহশাস্ত্রের আধুনিক যুগ কবে থেকে শুরু হয় এবং প্রাচীন যুগ কবে শেষ হয়, সেটা আমি জানতে পারলাম না। প্রাচীন ইমামদের বরাত দিয়েও আপনি লিখেছেন, তাঁরা সবাই পারিশ্রমিক নেয়াকে জায়েয মনে করেন। এই প্রাচীন ইমামদের দ্বারা আপনি কি বুঝাতে চেয়েছেন।

আল্লামা আবু বকর জাসসাসের লেখা গ্রন্থ আহকামুল কুরআনের ২য় খণ্ডের ৫২৬ পৃষ্ঠায় ঘুষ সংক্রান্ত অধ্যায়ে বলা হয়েছে :

"এ থেকে প্রমাণিত হয়, যে কাজ ফরয হিসেবে অথবা আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে করা হয়, সে কাজে পারিশ্রমিক নেয়া জায়েয নেই। যেমন হজ্জ এবং কুরআন ও ইসলাম শিক্ষাদান ইত্যাদি।"

আহকামুল কুরআনের লেখক প্রাচীন যুগের বা আধুনিক যুগের এবং অন্যদের মোকাবেলায় তাঁর ও তার মতামতের গুরুত্ব কতোখানি জানাবেন।
আপনি ইমাম আবু হানিফার অভিমতের বিপক্ষে শুধুমাত্র শামীর একটি উক্তি উদ্ধৃত করেছেন, যা ইমাম সাহেবের অভিমতের চেয়ে অগ্রগণ্য হতে পারেনা। তাছাড়া আপনার যুক্তির ধাঁচই অন্য রকমের। হানাফি মাযহাবের আলোকে আপনি আলোচনা করেননি। কিন্তু এই বিশেষ ক্ষেত্রটিতে হানাফি মাযহাবের ফতোয়া কি তথা কোন্‌ রায়টি কার্যকর হওয়া উচিত, সে কথা আপনার আলোচনা থেকে জানা যায়না। এ জন্য বিষয়টি পুনরায় বিশ্লেষণ করা আবশ্যক।

জবাব : আল্লামা আবু বকর জাসসাস, তাঁর পূর্বসুরি ও প্রাচীন হানাফি ফকীহগণ যে কুরআন শিক্ষা দিয়ে পারিশ্রমিক নেয়া জায়েয নয় বলে ফতোয়া দিতেন, সে কথা আমার বিলক্ষণ জানা আছে। জাসসাস ইন্তিকাল করেন ৩৭০ হিজরীতে। আমার যতোদূর জানা আছে, ঐ যুগেই অর্থাৎ ৪র্থ শতাব্দীর শেষভাগে হানাফি ফেকাহবিদদের কেউ কেউ ফতোয়া পরিবর্তন করেন এবং পূর্বতন ইমামদের রায়ের সাথে দ্বিমত ব্যক্ত করেন। ফতোয়ায়ে কাযীখান গ্রন্থে ইমাম হাফেজ আবুল্লায়েসের উক্তি এভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে :

"ইমাম আবুল্লায়েস বলেন যে, আগে আমি কুরআন শিক্ষা দিয়ে পারিশ্রমিক নেয়া নাজায়েয বলে ফতোয়া দিতাম........... কিন্তু এখন তা প্রত্যাহার করেছি।"

ফকীহ আবুল্লায়েস আবু বকর জাসসাসের সমসাময়িক এবং ২৭৩ হিজরীতে তাঁর ইন্তিকাল হয়। স্বয়ং কাযীখানও (তাঁর পূরো নাম ফখরুদ্দীন হাসান বিন মানসুর) এটাকে জায়েয বলে ফতোয়া দিয়েছেন। তিনি ৫৯২ হিজরীতে ইন্তিকাল করেন। এর এক বছর পর ৫৯৩ হিজরীতে ইন্তিকাল করেন হেদায়া গ্রন্থের লেখক ইমাম বুরহানুদ্দীন আল মারগী নানী। তিনি হেদায়ার 'ইজারা' অধ্যায়ে প্রথমে এর নাজয়েয হওয়া সংক্রান্ত রায় উদ্ধৃত করেন এবং তারপর বলেন :

"আমাদের কোনো কোনো প্রবীণ মনীষী আজকাল কুরআন শিক্ষাদানের কাজে পারিশ্রমিক গ্রহণ করা জায়েয বলে রায় দিয়েছেন। কারণ আজকাল ইসলামি তৎপরতার শৈথিল্য ও উদাসীনতা দেখা দিয়েছে। কুরআন শিক্ষাদানের জন্য পারিশ্রমিক নেয়া নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে কুরআনের সংরক্ষণ অসম্ভব হয়ে পড়বে। এই অভিমতই এখন ফতোয়া হিসেবে চালু।"

হেদায়ার ব্যাখ্যা গ্রন্থ 'এনায়া' ৭৮৭ হিজরীতে ওফাতপ্রাপ্ত ইমাম আকমালুদ্দীন বলেন :
"প্রাচীন ইমামগণ পারিশ্রমিক নেয়া নাজায়েয বলে রায় দিয়েছিলেন শুধু এ কারণে যে, তৎকালে শিক্ষকদেরকে বায়তুলমাল থেকে ভাতা দেয়া হতো এবং তারা নিজেদের জীবিকার ব্যাপারে কারো মুখাপেক্ষী ছিলেননা। তাছাড়া আল্লাহর সন্তুষ্টির খালেছ উদ্দেশ্যে ইসলামের শিক্ষা বিস্তারে মানুষের মধ্যে আগ্রহ ছিলো। কিন্তু এখন তা আর নেই।"

৭১০ হিজরীতে ওফাতপ্রাপ্ত ইমাম আবুল বারাকাত নাসাফী কানযুদ দাক্বায়েক গ্রন্থে পারিশ্রমিক গ্রহণের বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন : "বর্তমানে কার্যকর ফতোয়া এই যে, কুরআন শিক্ষা দিয়ে পারিশ্রমিক নেয়া চলবে।"

কানযুদ দাক্কায়েক্ব গ্রন্থের টীকাকার ইমাম মুঈনদ্দীন হারাভী (মোল্লা মিসকিন) বলেন :
"অনুরূপভাবে আজকাল এই মর্মে ফতোয়া দেয়া হয় যে, কুরআন ও ফেকাহ শিক্ষাদান বাবদ পারিশ্রমিক নেয়া যাবে। আমাদের প্রবীণ ইমামগণ বলেছেন, উস্তাদকে পারিশ্রমিক দেয়ার জন্য পিতাকে বাধ্য করতে হবে। ইমাম আবু মুহাম্মদ খাইযাখাযমী বলেছেন, আমাদের যুগে ইমাম, মুয়াযযিন ও শিক্ষকের জন্য ইসলামি শিক্ষা দানের বিনিময়ে পারিশ্রমিক নেয়া জায়েয। যখীরা ও রওয়া গ্রন্থেও একথাই বলা হয়েছে।"

শরহে বেকায়া গ্রন্থে আছে :
"যেহেতু ইসলামি কার্যকলাপ শৈথিল্য বিরাজ করছে, সেহেতু কুরআন ও ফেকাহ অধ্যাপনার পারিশ্রমিক গ্রহণ বৈধ বলে ফতোয়া দেয়া হয়ে থাকে, যাতে এ শিক্ষা নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে না পারে।"
১০৮৮ হিজরীতে ওফাতপ্রাপ্ত আল্লামা মুহাম্মদ আলাউদ্দীন হাসকাফী 'আল মুকতার' গ্রন্থে বলেন :
"বর্তমান পরিস্থিতিতে কুরআন ও ফেকাহ শিক্ষা দানের জন্য এবং ইমামতি ও আযান দেয়ার জন্য পারিশ্রমিক গ্রহণ জায়েয বলে ফতোয়া দেয়া হয়েছে। নিয়োগ কর্তাকে নির্ধারিত পারিশ্রমিক দিতে বাধ্য করতে হবে।"

দুররুল মুখতার গ্রন্থের ব্যাখ্যা রদ্দুল মুখতারে ইমাম ইবনে আবেদীন শামী (ওফাত  ১১৯২ হিজরী) উপরোক্ত উক্তির ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে শেখ খায়রুদ্দীস রামলী, ইমাম যায়লায়ী ও অন্যান্য ফকীহদের এই সর্বসম্মত রায় উদ্ধৃত করেছেন :
"কুরআন শিক্ষা দিয়ে পারিশ্রমিক নেয়াকে যদি জায়েয ঘোষণা না করা হতো, তাহলে কুরআনের শিক্ষা বিলুপ্ত হয়ে যেতো। তাই ফকীহগণ এটিকে জায়েয বলে রায় দিয়েছেন এবং এ কাজটি তারা ভালো মনে করেছেন।"

ফতোয়ায়ে আলমগীরীতে পারিশ্রমিক গ্রহণকে যারা বৈধ মনে করেন তাদের সমর্থন করে বলা হয়েছে :
"পারিশ্রমিক গ্রহণের বৈধতার পক্ষে যারা মত দিয়েছেন তাদের বক্তব্যই আমাদের যুগে অগ্রগণ্য।"

প্রাচীন ইমামদের যুগ কবে শেষ হয়েছে এবং আধুনিক ইমামদের যুগের সূচনা কোথা থেকে শুরু হয়েছে- আপনার এ প্রশ্নের জবাব দেয়া কঠিন। সাধারণত এ শব্দ দুটি বক্তব্যকে সংক্ষিপ্ত করার জন্য এবং আপেক্ষিক পরিভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। প্রত্যেক পূর্বসূরী প্রত্যেক উত্তরসূরীর জন্য প্রাচীন এবং প্রত্যেক উত্তরসূরী প্রত্যেক পূর্বসূরীর তুলনায় আধুনিক। তবে ফেকাহ শাস্ত্রীয় ইমামদের বেলায় ৭টি স্তর চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রথম স্তরগুলো মুজতাহিদ ইমামদের। এঁদের থেকে মূলনীতি ও মৌল বিধি উদ্ভাবন ও গ্রহণ করেছেন এবং ইজমা (কুরআন ও হাদিস অভিজ্ঞ ব্যক্তিবর্গের মতৈক) ও কিয়াস (কুরআন, হাদিস ও ইজমার প্রত্যক্ষ সিদ্ধান্ত যেসব ক্ষেত্রে রয়েছে, সেই সব ক্ষেত্রের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ নতুন ক্ষেত্রে পূর্বোক্ত সিদ্ধান্ত কার্যকর করা) এর আলোকে খুঁটিনাটি বিধি প্রণয়নের সূচনা করেছেন। হানাফি মাযহাবের দ্বিতীয় স্তরের ফকীহগণকে 'মুজতাহিদীন ফীল মাযাহিব' অর্থাৎ মাযহাবী মুজতাহিদ বলা হয়।  এদের মধ্যে রয়েছেন ইমাম আবু ইউসুফ, ইমাম মুহাম্মদ ও ইমাম আবু হানিফার অনুসারী। কিন্তু কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও কিয়াস প্রয়োগ করে স্বীয়  উস্তাদের মূলনীতি অনুসারে তারা স্বাধীনভাবেও ফেকাহ শাস্ত্রীয়  খুঁটিনাটি বিধি রচনা করে থাকেন। এ ক্ষেত্রে তাদের মতামত অনেক অনেক সময় ইমাম আবু হানিফার  বা পরস্পরের মতামত থেকে ভিন্ন হয়ে থাকে।

তৃতীয় স্তরটি 'মুজতাহিদীন ফিল মাসায়েল' এর স্তর। যেসব ব্যাপার ইমাম আবু হানিফা এবং তার শিষ্যদের কোনো ঘোষিত মতামত বা ফতোয়া নেই, এরা সেই সব ব্যাপারে ইজতিহাদ করে বিধিমালা  রচনা করে থাকেন। ইমাম তাহাবী, ইমাম কারখী, শামসুল আইম্মা সারাখসী, ফখরুল ইসলাম বাযদবী, কাযীখান প্রমুখ এই স্তরের অন্তর্ভুক্ত। মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতার স্থিরীকৃত নীতিমালার আলোকে এরা সেই সব বিষয়ে রায় দিয়ে থাকেন, যেসব বিষয়ে আগে কোনো রায় উদ্ধৃত নেই এবং কুরআন হাদিস থেকেও কোনো নির্দেশ পাওয়া  যায়না।

চতুর্থ স্তর হলো আসহাবে তাখরীজ তথা শরিয়তের বিধিমালা সংকলকদের। ইমাম আবু বকর জাসসাস এবং তার সমকালীন ফকীহগণ এই স্তরের আওতাভুক্ত। এই স্তর এবং পরবর্তী স্তরসমূহের ফকীহগণ পূর্ববর্তী মুজতাহদিদের তুলনায় মুকাল্লিদ অর্থাৎ নিরেট অনুগামী হিসেবে পরিচিত। তবে তাদের উক্তিসমূহ ও মতামতগুলো মনোনিবেশ সহকারে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে যে, তারা ইজতিহাদের দাবিদার না হলেও ইজতিহাদী গবেষণা ও অনুসন্ধান চালিয়ে শরিয়তের মূল উৎস কুরআন ও হাদিস থেকে শরিয়তের বিধি প্রণয়ন কর্মকান্ড থেকে একেবারে রিক্ত নন। তাঁরা কখনো কখনো আপন উস্তাদের অস্পষ্ট ও দ্বার্থবোধক উক্তির ব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন এবং সম্ভাব্য একাধিক রায়ের কোনো একটিতে শরিয়তের উৎসের সাথে বা ইমামগণের নির্ধারিত নীতিমালার সাথে অধিকতর সঙ্গতিশীল আখ্যা দিয়ে থাকেন। কখনো কখনো পরিবর্তিত সময় ও পরিস্থিতি বিবেচনা করে ঘোষিত ফতোয়ার পরিবর্তন সাধন ও পরিবর্তন বৈধ করে থাকেন।

পঞ্চম স্তরের ফকীহগণও পূর্ব মতামতগুলোকে ছাটাই বাছাই করে কোনোটি গ্রহণ কোনোটি বর্জন করেন। যেসব বিধি সাধারণ মানুষের জন্য সহজতর অথচ মৌলিক নীতিমালার বিরোধি নয় সেগুলোকেই তারা অগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন। এই স্তরকে 'আসহাবে তারজীহ' তথা অগ্রাধিকার নির্ণয়কারীদের স্তর বলা হয়। আবু হাসান কুদুরী ও বুরহানুদ্দীন মরগনানী (হেদায়ার গ্রন্থকার) এই স্তরের আওতাভুক্ত।

৬ষ্ঠ স্তরকে বলা হয় 'আসহাবে তমীয' তথা নির্বাচক বা বাছাইকারীদের স্তর। প্রাচীন ইমামগণের বর্ণিত মতামত থেকে কোনটি সবল ও কোনটি দুর্বল কোনটি ব্যাপক ও কোনটি বিরল তা তারা চিনতে ও বাছাই করতে পারেন এবং অধিকতর প্রামাণ্য মতকে নির্বাচন করে সংকলিত করে থাকেন। কানযুদদাক্বায়েক্ব, দুররে মুখতার ও বেকায়ার গ্রন্থকারগণ এই স্তরের। তারা প্রত্যাখ্যাত ও দুর্বল  মতামতকে বাদ দিয়ে ব্যাপকভাবে গৃহীত ও প্রচলিত মতামতের উপর নির্ভর করেন।

সপ্তম তথা সর্বশেষ স্তরে যারা আছেন তাদেরকেও নিরেট মুকাল্লিদ তথা অন্ধ অনুসারি ভাবা ঠিক নয়। তারা সচরাচর স্বতন্ত্র গ্রন্থ লেখেননি, তবে প্রাচীন গ্রন্থাবলীতে তারা এমন টীকা ও ব্যাখ্যা সংযোজন করেছেন যে, তা দ্বারা প্রাচীন গ্রন্থাবলীর বক্তব্য সহজে  বোধগম্য হয়। এসব টীকা ও ব্যাখ্যাকে উপেক্ষা করে কোনো শিক্ষার্থী প্রাচীন  গ্রন্থাবলী দ্বারা উপকৃত হতে পারেনা ও শরিয়তের প্রয়োজনীয় বিধান ও নির্দেশ প্রণয়ন করতে পারেনা।

যা হোক, এই সব মনীষীর প্রত্যেক উত্তরপুরুষ পূর্বতনদের তুলনায় আধুনিক এবং পরবর্তীদের তুলনায় প্রাচীন। তাদের কোনো স্তরকে এরূপ অকাঠ্যভাবে চিহ্নিত করা যায়না যে, তাদের পূর্ববর্তীরা সবাই প্রাচীন এবং পরবর্তীরা সবাই আধুনিক। তবে আমাদের তুলনায় তারা সকলেই প্রাচীন ও অগ্রণি। যে সকল ফকিহ ও মুহাদ্দিস প্রথম থেকেই ও মাসয়ালার ব্যাপারে বৈধতার প্রবক্তা তারাও আমাদের প্রবীণ মুরব্বী। তাই আমি যে বলেছি, পূর্বতন আলেমগণ এ ব্যাপারে প্রায় একমত সে কথা ভুল নয়। আমি ইমাম আবু বকর রাযী (জাসসাস) সম্পর্কে আর কোনো মন্তব্য করা প্রয়োজন ও সমীচীন মনে করিনা। কেননা অন্যান্য হানাফি ইমামদের সুচিন্তিত অভিমত আমি আগেই তুলে ধরেছি। [তরজমানুল কুরআন, সেপ্টেম্বর ১৯৭৪]



সর্বশেষ আপডেট ( Friday, 04 March 2011 )