আমাদের টাইপ করা বইগুলোতে বানান ভুল রয়ে গিয়েছে প্রচুর। আমরা ভুলগুলো ঠিক করার চেষ্টা করছি ক্রমাগত। ভুল শুধরানো এবং টাইপ সেটিং জড়িত কাজে সহায়তা করতে যোগাযোগ করুন আমাদের সাথে।
রাসায়েল ও মাসায়েল ৬ষ্ঠ খন্ড প্রিন্ট কর ইমেল
লিখেছেন সাইয়্যেদ আবুল আ'লা মওদূদী   
Monday, 28 February 2011
আর্টিকেল সূচি
রাসায়েল ও মাসায়েল ৬ষ্ঠ খন্ড
গ্রন্থকার পরিচিতি
১। আল্লাহর অস্তিত্ব সম্পর্কে সংশয় নিরসন
২। আল্লাহ ও তাঁর রসুলগণের মধ্যে পার্থক্য করা
৩। জীবজন্তুর উপর দয়া
৪। পাঁচ ওয়াক্ত ও পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায
৫। হানাফি মাযহাবে কি কিছু কিছু মাদক দ্রব্য হালাল?
৬। আদালতের রায় কি শুধু জাহেরীভাবেই কার্যকর, নাকি বাতেনীভাবেও কার্যকর?
৭। সুন্নাহর আইনগত মর্যাদা
৮। সাহরির শেষ সময় কোনটি?
৯। একটি হাদিস থেকে সুদের বৈধতা প্রমাণের অপচেষ্টা
১০। মুসলিম উম্মাহর বহু গোষ্ঠিতে বিভক্তি এবং মুক্তি লাভকারি গোষ্ঠি
১১। কালো খেজাব লাগানো কি বৈধ?-১
১২। কালো খেজাব কি বৈধ?-২
১৩। তাকদীর প্রসঙ্গ
১৪। গোমরাহী ও হেদায়েত
১৫। সূরা আন নাজমের প্রাথমিক আয়াত কয়টির ব্যাখ্যা
১৬। যাকাতকে প্রচলিত করের সাথে যুক্ত করা যায় না
১৭। পিতামাতার অধিকার
১৮। লোহার আংটি পরা কি জায়েয?
১৯। উশর ও খারাজের কয়েকটি সমস্যা
২০। উশরযোগ্য ফল ফসল কি কি?
২১। মোজার উপর মসেহ করার বিধান
২২। কারো সম্মানে দাঁড়ানো কি জায়েয?
২৩। 'প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ দান করা' সংক্রান্ত কুরআনের আদেশের ব্যাখ্যা
২৪। অপ্রাপ্ত বয়স্ক সন্তানদের ভরণ পোষণ প্রসঙ্গে
২৫। কবর আযাব
২৬। কুরআন শিক্ষাদান ও অন্যান্য ধর্মীয় কাজের পারিশ্রমিক নেয়া কি বৈধ?
২৭। ইসলামের ফৌজদারী দণ্ডবিধি সংক্রান্ত কিছু ব্যাখ্যা
২৮। বেতের নামাযে দোয়া কুনূত
২৯। লাইসেন্স ক্রয় বিক্রয়
৩০। কিবলার দিক নির্ণয়ের শরিয়তসম্মত বনাম বিজ্ঞানসম্মত পন্থা
৩১। মৃত ব্যক্তির জন্য ফিদিয়া দান, শোক ও কুরআন খতম
৩২। কয়েদি সৈন্যরা কি নামায কসর করবে
৩৩। পবিত্র কুরআন ও গুপ্ত ওহি
৩৪। ব্যভিচারের অপবাদ
৩৫। কোন কোন প্রাণী হালাল বা হারাম
৩৬। কুরবানীর চামড়া সম্পর্কে শরিয়তের বিধান
৩৭। মৃত ব্যক্তির চামড়া সম্পর্কে শরিয়তের বিধান
৩৮। মৃত প্রাণীর চামড়া সম্পর্কে আরো আলোচনা
৩৯। জবাই হালাল হওয়ার জন্য কি বিস্
৪০। যাকাত সংক্রান্ত কিছু খোলামেলা কথা
৪১। নগদ পুঁজির যাকাত ও তার নিসাব
৪২। বাইয়ে সালাম
৪৩। হযরত আলী রা.-এর জন্য সূর্যকে ফিরিয়ে দেয়ার ঘটনা কি সত্য?
৪৪। কুরাইশের ১২ জন খলিফা ও 'ফিতনায়ে আহলাস'
৪৫। আল্লাহ ও রসূলের কোনো উক্তি কি মানুষকে কর্মবিমুখ করতে পারে?
৪৬। আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয় করা সত্ত্বেও দৈন্যদশার কারণ কি?
৪৭। হযরত আলী রা.-এর বর্ম চুরি-১
৪৮। হযরত আলী রা.-এর বর্ম চুরি-২
৪৯। ইসলামের দৃষ্টিতে গানবাজনা ও নারী পুরুষের মেলামেশা
৫০। আব্দুল্লাহ বিন উবাইর জানাযা
৫১। ইমাম ইবনে তাবারি কি শিয়া ছিলেন?
৫২। ফৌজদারি অপরাধের ক্ষেত্রে আপোস নিষ্পত্তির অধিকার
৫৩। ইসলামের উত্তরাধিকার আইন সম্পর্কে অভিযোগ
৫৪। শরিয়তের দৃষ্টিতে ওয়াকফের সংজ্ঞা ও বিধান
৫৫। আত্মহননকারীর জানাযা নামায
৫৬। হারুত মারুত ফেরেশতাদ্বয় সম্পর্কে এক ভিত্তিহীন অলীক কাহিনী
৫৭। 'চাটান' সম্পাদকের নিকট দুটো চিঠি
৫৮। হাদিস অস্বীকার করা ও স্বীকার করা
৫৯। হাদিস বিরোধী গোষ্ঠির বিভ্রান্তিকর প্রচারণা
৬০। একটি হাদিস সম্পর্কে আপত্তি ও তার জবাব
৬১। সন্তান পালনে নারীর অধিকার
৬২। স্তনের দুধ পানে বিয়ে হারাম হওয়া
৬৩। পারিবারিক আইন ও অর্পিত তালাক
৬৪। ফাসিদ বিয়ে ও বাতিল বিয়ে
৬৫। রসূল সা. কি হযরত সওদা রা. কে তালাক দিতে চেয়েছিলেন?
৬৬। উম্মুল মুমিনীন হযরত সওদার বিয়ে সম্পর্কে আরো আলোচনা
৬৭। কতোখানি দুধ পান করলে বিয়ে হারাম হয়?
৬৮। পিতামাতার আদেশে স্ত্রী তালাক দেয়া যায় কি?
৬৯। রসুল সা.-এর একাধিক বিয়ের যৌক্তিকতা ও সার্থকতা
৭০। বেলুচিস্তানের বাগদান প্রথা
৭১। লটারি ও নির্বাচনী লটারি
৭২। সমবায় সমিতি

<h1>২৭। ইসলামের ফৌজদারী দণ্ডবিধি সংক্রান্ত কিছু ব্যাখ্যা</h1>
প্রশ্ন : তরজমানুল কুরআনের জানুয়ারি সংখ্যাটা পড়লাম। এতে জনাব কাযী বশীর আহমদ সাহেবের 'চুরির অপরাধ প্রমাণের উপায়' শীর্ষক নিবন্ধটি পড়ে দেখেছি। এ নিবন্ধের কয়েকটি বক্তব্যের ব্যাখ্যা প্রয়োজন। অন্যথায় স্বস্তি পাচ্ছিনা। তাই আপনাকে কষ্ট দিচ্ছি।
১. ২৬ পৃষ্ঠায় হযরত আবু দারদার বর্ণিত হাদিসে বলা হয়েছে যে, রসূল সা. দাসিটিকে বললেন : 'বলে দাও না।' অর্থাৎ কিনা তিনি দাসিকে চুরির অপরাধ অস্বীকার করা শিখিয়েছিলেন।
২. ২৭ পৃষ্ঠায় হযরত মাগর রা.-এর শাস্তি সম্পর্কে রসূল সা. বললেন যে, 'তোমরা তাকে যেতে দিলেনা কেন?' অথবা, 'তোমরা তাকে ছেড়ে দিলেনা কেন?'
৩. ৩৩ পৃষ্ঠায় সাক্ষ্যদানের এক মাসের মেয়াদ সম্পর্কে যে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে, আমার মতে তাতে এবং লুকিয়ে রাখার পরামর্শ দ্বারা তো অপরাধের মাত্রা বেড়ে যাবে। বলা হয়েছে সাক্ষ্যদান বিলম্ব একাধিক কারণে হতে পারে। এ কথাটির ব্যাখ্যা দরকার।

রসূল সা.-কে গোটা বিশ্বজগতের জন্য  করুণাস্বরূপ পাঠানো হয়েছিল। মদিনার ইসলামি রাষ্ট্রে রসূল সা.-এর উপস্থিতির কারণে অপরাধ প্রায় উধাও হয়ে গিয়েছিল। আমার বিশ্বাস, যে দু'একটা অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল, সেটা শুধু মুসলিম জাতির সংশোধনের নিমিত্তে হয়েছিল। এখন উল্লেখিত হাদিসগুলোর প্রসঙ্গে আসা যাক। চোর বা অভিযুক্তকে তার জবানবন্দী নেয়ার আগেই যদি বলে দেয়া হয় যে, তুমি বল 'অপরাধ করিনি।' তাহলে তাতে অপরাধী তো আরো আস্কারা পেয়ে যাবে। অনুরূপভাবে শাস্তি কার্যকর করার সময় অপরাধীকে পালাতে দিয়ে ন্যায়বিচারের দাবি পূর্ণ হয়না। অপরাধকে চেপে রাখা বা লুকিয়ে রাখার ব্যাপারটিও তদ্রুপ। আমার ব্যক্তিগত অভিমত হলো, যতোক্ষণ কোনো অপরাধ প্রকাশিত হয়ে না পড়ে, ততোক্ষণ তা লুকিনো যেতে পারে। আর তাও এমনভাবে করা চাই যেনো তা দ্বারা সমাজের উপর খারাপ প্রভাব না পড়ে অর্থাৎ অনাচার ও অপরাধের দাপট বেড়ে না যায়। নচেৎ যেসব অপরাধ দ্বারা সমাজে অনাচারের উদ্ভব ঘটে, সেগুলোকে লুকানো বা উপেক্ষা করা সমীচীন মনে হয়না। তা করা হলে হত্যা, চুরি, ডাকাতি, ব্যাভিচার এবং অন্যান্য ঘৃণ্য অপরাধে  লিপ্ত লোকেরা আরো অপরাধ করতে উৎসাহ পাবে।

জবাব : আপনার প্রশ্নগুলোর  জবাব দেবার আগে এ কথা স্পষ্ট করে বলা প্রয়োজন মনে হচ্ছে যে, ইসলাম বিভিন্ন অপরাধের জন্য বিশেষত ফৌজদারী ও অপরাধসমূহের জন্য হুদুদ ও কিসাস নামে যে দন্ড বিধান করেছে, তার উদ্দেশ্য যেমন সমাজের সংশোধন ও শৃঙ্খলা রক্ষা, তেমনি অপরাধীদের চরিত্র ও মানসিকতার পরিশুদ্ধি এবং আখেরাতের আযাব থেকে তাদের নিষ্কৃতি লাভও। এ কারণে কোনো কোনো হাদিসে দৈহিক শাস্তি দেয়ার পর অপরাধীকে তওবা  করানোর উল্লেখ পাওয়া যায়। যাতে গোনাহ থেকে তার দেহ ও মন পাক-সাফ হওয়ার পাশাপাশি সে কেয়ামতের শাস্তি থেকেও রেহাই পায়। অনুরূপভাবে অপরাধসমূহের ব্যাপারে ইসলামি শরিয়তের এও একটা মূলনীতি যে, যতোক্ষণ পর্যন্ত সম্পূর্ণ সন্দেহ মুক্তভাবে অপরাধ সংঘটিত হওয়া প্রমাণিত না হবে, ততোক্ষণ পর্যন্ত শাস্তি প্রযোজ্য হবেনা।

এখন অপরাধ কিভাবে প্রমাণিত হবে সেই প্রশ্নের সুরাহা হওয়া প্রয়োজন। এর সবচেয়ে নিশ্চিত ও অকাট্য পন্থা এই যে, অপরাধী নিজের অপরাধ স্বীকার করবে আর সেই সাথে তার বিরুদ্ধে সাক্ষীও বিদ্যমান থাকবে যে, সে অপরাধটি সংঘটিত করেছে। অপরাধ প্রমাণের জন্য এর চেয়ে অপেক্ষাকৃত নিম্নমানের একটা পন্থা এই যে, অপরাধ স্বীকারোক্তি করছেনা। কিন্তু তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য রয়েছে। তবে খুবই বিরল, বিস্ময়কর ও অসাধারণ একটা পন্থা এমনও রয়েছে যে, আসামীর বিরুদ্ধে সাক্ষী নেই, কিন্তু সে নিজেই স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে অপরাধের কথা স্বীকার করে। এ ধরণের আত্মস্বীকৃত অপরাধী আসলে অনুশোচনা ও তাওবার চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে থাকে এবং সে আখেরাতের মুক্তির স্বার্থে পার্থিব সুখ স্বাচ্ছন্দ্য ও মর্যাদাকে বিসর্জন দিয়ে থাকে। এমনকি নিজের সাধের জীবন পর্যন্ত বিসর্জন দিতে প্রস্তুত হয়ে যায়। এ ধরনের অপরাধী পরিপূর্ণ মানসিক তৃপ্তি ও আন্তরিক আগ্রহ সহকারে দুনিয়ার শাস্তি হয় হোক কিন্তু আখেরাতের মুক্তি নিশ্চিত হোক এই মনোভাব নিয়ে নিজেকে শাস্তির জন্য এগিয়ে দেয়। যদিও এ ধরণের অপরাধীর চরিত্র সংশোধনের জন্য পার্থিব শাস্তি আর তেমন প্রয়োজন থাকেনা। তথাপি ইসলামের ফৌজদারী দন্ডবিধি ইনসাফ ও ন্যায়বিচারের সাধারণ ও সামগ্রিক দাবি পূরণের উদ্দেশ্যে তার উপরও শরিয়তের নির্ধারিত দন্ড কার্যকর করে। এর পেছনে যে প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা ও কল্যাণকর দিকটি নিহিত রয়েছে, সেটি হলো সাক্ষীবাবুদ না থাকা অবস্থায় অপরাধের স্বীকারোক্তি করলেই যদি শরিয়তের নির্ধারিত দন্ড রহিত হয়ে যায়, তাহলে এ ধরণের স্বীকারোক্তি শাস্তি থেকে অব্যাহতি পাওয়ার একটা উপায় বা ছুঁতা হয়ে দাঁড়াবে এবং তার আর কোনো গুরুত্ব ও মূল্য থাকবেনা। ফলে অপরাধীদের দ্বারা আল্লাহ ও মানুষের অধিকার পদদলিত হতেই থাকবে। তা সত্ত্বেও রসূল সা. এ ধরণের অপরাধীদেরকে ওজর পেশ করা, নিজের নির্দোষিতা দাবি করা, কিংবা সন্দেহ সংশয় দ্বারা উপকৃত হওয়ার সর্বোচ্চ পরিমাণ সুযোগ দিয়েছেন।

এই পটভূমি পৃষ্টিপথে রেখে যদি হযরত মাগের সংক্রান্ত হাদিসগুলো বিবেচনা করা হয়, তাহলে ঘটনার প্রেক্ষাপট সহজেই বুঝা যায় এবং সকল প্রশ্নের জবাব পাওয়া যায়। একজন অপরাধীর সাধারণ চিত্র এই যে, অপরাধ সংঘটিত করার পর যেনতেন উপায়ে তা ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করে। পুলিশ কোনো না কোনো উপায়ে তার সন্ধান পেয়ে গ্রেফতার করে। সম্ভাব্য যাবতীয় তদন্ত প্রণালী প্রয়োগ করে তার স্বীকারোক্তি আদায় করে। তার বিরুদ্ধে সাক্ষীসাবুদ যোগাড় করে আদালতে সোপর্দ করে এবং আসামীর  উকিল তাতে সর্বপ্রথম এ কথাই শেখায় যে, তুমি আদালতে সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করবে। আপনি যে হাদিসগুলো উদ্ধৃত করেছেন তার কোনোটিই এ ধরনের অপরাধীর সাথে সংশ্লিষ্ট নয়। এ ধরনের আসামীদেরকে যদি আদালতেও এরূপ বলে যে, তোমাকে তো অপরাধী বলে মনে হয়না, তুমি বরং নিজেকে নির্দোষ  বলে দাবি কর। তাহলে তাকে অবশ্যই অপরাধপ্রবণ লোকদের আস্কারা দেয়া হবে এবং সমাজে অপরাধের মাত্রা বাড়বে। কিন্তু যে ব্যক্তি অগ্রসর হয়ে নিজেকে আদালতের কাছে সমর্পণ করে এবং তার নিজের স্বীকারোক্তি ছাড়া আর কোনো সাক্ষ্যও থাকেনা। তার ব্যাপারটা সাধারণ অপরাধীদের মতো নয়। যে ব্যক্তি নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েও অপরাধের স্বীকারোক্তি করে তার সম্পর্কে ভালোভাবে নিশ্চিত হওয়া শুধু সঙ্গতই নয় বরং অত্যাবশ্যকও। তার স্বীকারোক্তি বারবার গ্রহণ করা উচিত এবং কি পরিস্থিতিতে সে স্বীকারোক্তি দিচ্ছে তা বিভিন্ন পন্থায় অনুসন্ধান করা উচিত। যদি সে স্বীকারোক্তি প্রত্যাহার করে কিংবা এমন আচরণ করে যা প্রত্যাহার ও অস্বীকার করার নামান্তর। তাহলে তার প্রত্যাহারকে মেনে নিতে হবে এবং দন্ড প্রয়োগ স্থগিত রাখতে হবে।

হযরত মাগের বিন মালেক আসলামীর ঘটনাটা এ ধরণেরই। তার উপর ব্যাভিচারের দন্ড কার্যকর হয়েছিল। তিনি স্বয়ং রসূল সা.-এর কাছে উপস্থিত হয়ে অপরাধের স্বীকারোক্তি করেছিলেন। তার বিরুদ্ধে আর কোনো রকমের চাক্ষুস বা বাস্তব সাক্ষী ছিলনা। তার সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ ও জেরার পর্যায়ে তার পরিবার ও গোত্রের লোকেরা এই মর্মে সাক্ষ্য দিয়েছিল যে, ইনি আমাদের মধ্যে একজন সৎ লোক। কিন্তু তিনি বারংবার স্বীকারোক্তির পুনরাবৃত্তি করতে থাকায় এবং তার উপর অবিচল থাকায় শেষ পর্যন্ত রসূল সা. তাকে পাথর নিক্ষেপে হত্যার (রজম) শাস্তি দেয়ার রায় ঘোষণা করেন। কিন্তু পাথর নিক্ষেপ করার সময় তিনি কিছুক্ষণ অবিচলভাবে দাঁড়িয়ে থাকার পর ছুটে পালাতে লাগলেন এবং এমন কিছু কথাও বললেন, যা দ্বারা অপরাধ সম্পর্কে কিছু সন্দেহ সংশয় সৃষ্টির অবকাশ দেখা দেয়।

আবু দাউদ ও অন্যান্য গ্রন্থে হযরত জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ থেকে বর্ণিত হয়েছে যে : "হযরত মাগেরকে পাথর মেরে হত্যাকারীদের মধ্যে আমিও ছিলাম। আমরা তাকে নিয়ে বেরিয়ে এলাম মারতে শুরু করলাম। পাথরের আঘাত অনুভব করে তিনি চিৎকার করে বলতে লাগলেন। তোমরা আমাকে রসূল সা.-এর নিকট ফিরিয়ে নিয়ে চলো। আমার গোত্রের লোকেরা আমাকে খুন করেছে। তারা আমাকে ধোকা দিয়েছে। তারা বলেছিল যে, রসূল সা. আমাকে হত্যা করবেননা।"

এ ধরনের আরো হাদিস রয়েছে, যা দ্বারা জানা যায় যে, হযরত মাগের পালাবার এবং শাস্তি থেকে নিস্তার পাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। আর একবার রসূল সা.-এর কাছে যাওয়ার এবং নিজের ব্যাপারে আরো সাফাই বা ব্যাখ্যা দেয়ার সুযোগ দেয়া হোক এও তিনি চেয়েছিলেন। এক হিসেবে এভাবে তিনি তার অপরাধের সাবেক স্বীকারোক্তি প্রত্যাহার করতে চেয়েছিলেন স্বীয় কথা ও কাজের মাধ্যমে। আর না হোক, অন্তত নিজের দেয়া জবানবন্দীতে তিনি কোনো পরিবর্তন বা পরিবর্ধন করতে চেয়েছিলেন। এ জন্য রসূল সা. পরে এসব বিবরণ শুনে বললেন : তোমরা তাকে ছেড়ে দিলেনা কেনো? অর্থাৎ তাকে আমার কাছে এসে পুনরায় জবানবন্দী দিতে দিলেনা কেনো? এ থেকে বুঝা যায়না যে রসূল সা. তার প্রাণদন্ড মওকুফ করেই দিতেন। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত তো তাঁর সর্বশেষ ব্যাখ্যামূলক বক্তব্য শুনেই নেয়া হতো। তবে একথা অনস্বীকার্য যে, তিনি তাকে সাফাই ব্যাখ্যা দানের শেষ সুযোগ দেয়া জরুরি মনে করেছিলেন। হযরত জাবিরের উপরোক্ত হাদিসের শেষাংশে তিনি নিজে বলেন :
-----------------------------------------------------------------------------------------
রসূল সা. বললেন : "তোমরা তাকে ছেড়ে দিলেনা কেনো এবং আমার কাছে নিয়ে এলেনা কেনো?" রসূল সা.-এর একথা বলার উদ্দেশ্য ছিলো এই যে, তিনি পুনরায় তার বিষয়ে তদন্ত ও অনুসন্ধান চালাতেন। এর অর্থ এটা নয় যে, তিনি তার শাস্তি মওকুফ করেই দিতেন।

আমাদের মতে হযরত জাবিরের এই ব্যাখ্যাই এ ঘটনার যথার্থ ব্যাখ্যা। এ থেকে শরিয়তের এরূপ বিধি প্রণয়ন করার অবকাশ রয়েছে এবং অধিকাংশ ইমাম ও ফকিহ করেছেন যে, আসামীর বিষয়ে  যদি আর কোনো সাক্ষ্য না থাকে এবং সে অপরাধের স্বীকারোক্তি করে তা প্রত্যাহার করে, তবে শরিয়তের বিধান অনুযায়ী তার যে দৈহিক শাস্তি নির্ধারিত রয়েছে, তা রহিত হয়ে যাবে। কেননা স্বীকারোক্তির পর তা প্রত্যাহার করলে অবশ্যই সন্দেহ সংশয় সৃষ্টি হয়ে যায়। আর সন্দেহ সংশয় দ্বারা শরিয়তের শাস্তি মওকূফ হয়ে যায়।

দ্বিতীয় যে হাদিসটি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছেন, সেটি হযরত আবু দারদা কর্তৃক বর্ণিত। এতে বলা হয়েছে, রসূল সা.-এর নিকট চুরির অভিযোগ ধৃত এক মহিলাকে আনা হলো। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন : তুমি কি চুরি করেছো? সে কোনো জবাব দেয়ার আগেই তিনি আবার বললেন 'বল, না।' এ হাদিস হয়তো কোনো কোনো মুহাদ্দিসগণের মতে মারফু এবং এর সনদের ধারাবাহিকতা স্বয়ং রসূল সা. পর্যন্ত প্রসারিত। কিন্তু অধিকাংশ সুদক্ষ হাদিস বিশারদ ও সমালোচকের মতে এ হাদিসের সনদের ধারাবাহিকতা হযরত আবু দারদা পর্যন্ত গিয়েই থেকে আছে। তার পরবর্তী সনদ বিশুদ্ধ নয়। হাফেয ইবনে হাজর স্বীয় গ্রন্থ 'আত্‌ তালখীসুল জাবীরের' কিতাবুল হদুদ-এ [অর্থাৎ ফৌজদারি দন্ডবিধি সংক্রান্ত অধ্যায়ে] বলেন :
---------------------------------------------------------------------------------
হাদিসটির এ অংশকে ইমামগণ সঠিক মনে করেননা যে, তিনি ঐ মহিলাকে  বলেছেন : 'বল, না।' (অর্থাৎ আমি চুরি করিনি) বর্ণনা থেকে রসূল সা. শুধু এ কথা বলেছিলেন : "আমার তো মনে হয়না তুমি চুরি করে থাকবে।" কাযী বশীর আহমদ সাহেব সুনানে বায়হাকীর বরাত দিয়েছেন 'সুবুলুস সালাম' গ্রন্থ থেকে। এটি হাফেজ ইবনে হাজার রচিত 'বুলুগুল মুরাম' এর ব্যাখ্যা। এ মুহূর্তে আমার কাছে সুনানে বায়হাকী বা সুবুলুস সালাম নেই। তবে হাফেজ ইবনে হাজর তালখীসের এই জায়গাটাতেই যে ভাষায় এ হাদিসটি উদ্ধৃত করেছেন, তা থেকে তো মনে হয় যে, সরাসরি রসূল সা. পর্যন্ত পৌঁছে যায়, এমন ধারাবাহিক সনদে বায়হাকী এ হাদিসটি বর্ণনা করেননি। হাফেজ ইবনে হাজর বলেন : "বায়হাকী এ হাদিসটি যেভাবে বর্ণনা করেছেন তাতে এর সনদ হযরত আবু দারদা পর্যন্ত গিয়েই থেকে গেছে।" স্বয়ং হাফেজ ইবনে হাজর 'বুলুগুল মুরামে' চুরির শাস্তি অধ্যায়ে শুধু এই হাদিসটি উদ্ধৃত করেছেন যে, "রসূল সা.-এর নিকট এক চোরকে ধরে আনা হলো। তার কাছে চুরির মাল পাওয়া যায়নি। রসূল সা. তাকে বললেন : আমার মনে হয়না যে তুমি চুরি করেছো।" এটি একটি ভিন্ন হাদিস, যার প্রেক্ষাপট ভিন্ন। আবু দারদা বর্ণিত হাদিসের সাথে এটির শাব্দিক মিলও নেই। মোদ্দাকথা হলো, রসূল সা. কর্তৃক কোনো চোরকে 'তুমি বল আমি চুরি করিনি' বলা আমাদের কাছে প্রমাণিত হয়নি। চুরির অভিযোগে ধৃত যে ব্যক্তিকে তিনি বলেছিলেন যে, আমার মনে হয়না তুমি চুরি করেছো, তার  কাছ থেকে চোরাই মালও উদ্ধার হয়নি এবং তার বিরুদ্ধে কোনো সাক্ষ্য দেয়া হয়েছে এমন কথাও উল্লেখ পাওয়া যায়না। সম্ভবত শুধুমাত্র বাদীর কথায় তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল।

এরপর আপনার আর মাত্র একটা আপত্তির মীমাংসা বাকি আছে। সেটি এই যে, তরজমানুল কুরআনের জানুয়ারি সংখ্যার à§©à§© পৃষ্ঠায় সাক্ষ্যের মেয়াদের যে ব্যাখ্যা  দেয়া হয়েছে এবং তা লুকানোর যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তা দ্বারাও অপরাধ প্রবণতা উৎসাহিত হবে। এ ব্যাপারে ইতোমধ্যেই আলোচনা অনেক দীর্ঘয়িত হয়ে গেছে। যদি আবারও সবিস্তারে আলোচনা করি তবে আরো দীর্ঘায়িত হয়ে গেছে। যদি আবারও সবিস্তারে আলোচনা করি তবে আরো দীর্ঘায়িত হবে। আপাতত সংক্ষেপে শুধু এতোটুকু বলতে চাই যে, লেখক স্বীয় পুস্তক বিশেষত তার মূল অংশ হানাফি মাযহাব অনুসারেই লিখেছেন। অন্যান্য মাযহাব নিয়ে তেমন কিছু  লেখেননি। তাই আলোচ্য নিবন্ধে যেসব ফেকাহ শাস্ত্রীয় মাসয়ালা ও খুঁটিনাটি বিধি সন্নিবেশ করেছেন, তার উপর সকল ইমাম ও ফকীহকে একমত হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। আমাদের দেশের আলেমগণ সম্মিলিত হয়ে এসব বিষয়ে চিন্তা গবেষণা চালাতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ এই বিধিটাই ধরা যাক যে, চুরি, মদ্যপান ও ব্যভিচারের মামলায় সাক্ষীকে অপরাধ সংঘটিত হওয়ার এক মাসের মধ্যে আদালতে সাক্ষ্য দিতে হবে। নচেত তার সাক্ষ্য শ্রবণ ও গ্রহণযোগ্য হবেনা। অবশ্য বিলম্বের কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ প্রদর্শন করলে সাক্ষ্য শোনা ও গ্রহণ করা হবে। আজকাল পুলিশের তদন্ত চার্জশিট প্রদান ও আদালতি কার্যক্রমের যে রীতি চালু রয়েছে, তাতে সাক্ষ্য প্রদানের মেয়াদের ক্ষেত্রে তারা এরূপ কড়াকড়ি আরোপ করলে ন্যায়বিচার বিঘ্নিত হতে পারে। তাছাড়া এ বিধিটা কেবলমাত্র কার্যপ্রণালীর সাথে সম্পর্কযুক্ত বিধায় এতে রদবদলের অবকাশ রয়েছে। এ ব্যাপারে খোদ হানাফি ফেকাহবিদদের মধ্যেই মতভেদ রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ 'রদ্দুল মুখতার' গ্রন্থে ফৌজদারী দন্ডবিধি অধ্যায়ে ব্যভিচারের সাক্ষ্যদান সংক্রান্ত পরিচ্ছেদে বলা হয়েছে :

"জ্ঞাতব্য যে, ইমাম হানিফার মতে সাক্ষ্য শ্রবণের মেয়াদ কি হবে এবং সে মেয়াদ অতিক্রান্ত হলে কি করতে হবে, সেটা প্রত্যেক যুগে বিচারপতির বিবেচনার উপর নির্ভরশীল।"

অনুরূপভাবে নিবন্ধটিতে যেভাবে অপরাধ চেপে রাখাকে তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দানের চেয়ে উত্তম বলা হয়েছে এবং এক মাসের পরে সাক্ষ্য দানকারীকে ফাসেক ও অগ্রহণযোগ্য আখ্যা দেয়া হয়েছে, তাও বিবেচনা সাপেক্ষ এবং এ বক্তব্যকে ঢালাওভাবে সমর্থন করা কঠিন। হাদিসে মুসলমানের দোষত্রুটি ঢেকে রাখতে বলা হয়েছে, তা সত্য  কিন্তু এ মূলনীতিকে প্রত্যেক অপরাধ ও অপরাধীর বেলায় প্রয়োগ করা চলে না। অবশ্য কিছু কিছু ক্ষেত্র এমন রয়েছে যেখানে সাক্ষের প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ করা সম্ভব হয়না। যেমন ব্যভিচারের দন্ড বিধান করতে চারজন সাক্ষ্য প্রয়োজন। কিন্তু ব্যভিচার একজন সাক্ষীর সামনে সংঘটিত হয়ে বসলো এবং ব্যভিচারী অপরাধের কথা স্বীকার করবে কিনা নিশ্চিত নয়। এরূপ ক্ষেত্রে উক্ত একক সাক্ষীর পক্ষে ঘটনা চেপে রাখা ও নিরব থাকাই উত্তম। নচেত অপরাধ ধামাচাপা প্রচার করা ছাড়া আর কোনো লাভ হবেনা। কিন্তু সর্বক্ষেত্রে সকল অপরাধ ধামাচাপা দেয়া অপরাধের সাথে আপোস করা ও সাক্ষ্য গোপন করার নামান্তর, যা কুরআন ও সুন্নাহর বহু জায়গায় সুস্পষ্টভাবে নিন্দিত হয়েছে। স্বয়ং হানাফি ফকীহগণ সাক্ষ্যের যে মেয়াদ নির্ধারণ করেছেন তা থেকে ব্যভিচারের মিথ্যা অপবাদ আরোপের সাক্ষ্যদানকে ব্যতিক্রম বলে ঘোষণা করেছেন। কেননা তাদের মতে এ ক্ষেত্রে হক্কুল ইবাদ অর্থাৎ মানবাধিকারও জড়িত। অথচ অন্যান্য অপরাধ যথা চুরি ও ব্যভিচারের ব্যাপারেও এ কথা বলার অবকাশ রয়েছে যে, এগুলোর একটা দিক মানবাধিকারের সাথে জড়িত। হেদায়ার যে স্থানে ব্যভিচারের অপবাদ আরোপের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যদানের মেয়াদ শিথিলযোগ্য বলা হয়েছে, ঠিক সেই স্থানেই ইমাম শাফেয়ীর ভিন্নমত তুলে ধরা হয়েছে। ইমাম শাফেয়ী কোনো অপরাধকেই নিছক আল্লাহর অধিকার পদদলিত করা মনে করেননা, বরং একদিক দিয়ে তাকে মানবাধিকারের সাথে সংশ্লিষ্ট মনে করেন। এ জন্য সাক্ষ্য দানের মেয়াদ নির্ধারণ করাকে তিনি সমর্থন করেননা। এ ব্যাপারে শুধু ইমাম শাফেয়ী কেন, অন্যান্য ইমামগণও হানাফিদের থেকে ভিন্নমত পোষণ করেন। 'আল ফিকহু আলাল মাযাহিবিল আরবায়া' গ্রন্থের ৫ম খণ্ডে ফৌজদারী দন্ডবিধি অধ্যায়ে, ৭২ পৃষ্ঠায় আল্লামা আব্দুর রহমান আল জাযিরী সাক্ষ্যদানের কোনো মেয়াদ নির্দিষ্ট নেই। শিরোনামে বলেন :
"মালেকী, শাফেয়ী ও হাম্বলী মাযহাবের অভিমত এই যে, ব্যভিচার, ব্যভিচারের অপবাদ আরোপ ও মদ্যপানের ক্ষেত্রে অপরাধ সংঘটিত হওয়ার দীর্ঘকাল পরেও সাক্ষ্য শ্রবণযোগ্য। কারণ সাক্ষ্য প্রদানের পর দন্ড কার্যকর হওয়া একটা আইনসম্মত অধিকার। এই অধিকারকে বাতিল করতে পারে, এমন কোনো দলিল আমাদের কাছে নেই।" [তরজমানুল কু্রআন, জুলাই ১৯৭৮]

[ ২ ]
প্রশ্ন : আমি তরজমানুল কুরআনের জুলাই, ১৯৭৮ সংখ্যায় আপনার "ইসলামের ফৌজদারী দন্ডবিধি সম্পর্কে কতিপয় ব্যাখ্যা" শীর্ষক জবাব পড়েছি। অত:পর আমি মিশকাত শরিফ, আবু দাউদ শরিফ ও অন্য কয়েকটি হাদিস গ্রন্থে এই বিষেয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট হাদিসগুলোও অধ্যায়ন করেছি। এর ফলে আমার মনে আরো কিছু প্রশ্ন জন্ম নিয়েছে। রসূল সা. যে মহিলাকে চুরির অপরাধে হাতকাটার শাস্তি দিয়েছিলেন তার সম্পর্কে কোনো কোনো হাদিস বলা হয়েছে যে, সে কোনো গহনা বা অন্য কোনো জিনিস ধার নিয়েছিল। পরে তা প্রতারণার মাধ্যমে আত্মসাত করে। এ জন্য সে হাতকাটা দন্ড ভোগ করে। প্রশ্ন এই যে, কোনো জিনিস চেয়ে আনার পর ফেরত দিতে অস্বীকার করলে তাও কি চুরির পর্যায়ে পড়ে এবং  সে জন্য চুরির শাস্তি হাতকাটা কার্যকর হতে পারে? আবু দাউদ শরিফে এ কথাও বর্ণিত হয়েছে যে, এই মহিলাকে শাস্তি দেয়ার আগে রসূল সা. বলেছিলেন, যে মহিলা এ অপরাধ করেছে সে কি তওবা করবে? কিন্তু সে যখন তওবা করলো না তখন তাকে শাস্তি দেয়া হলো। এখানে প্রশ্ন উঠে যে, তওবা দ্বারা চুরির শাস্তি বা শরিয়ত নির্ধারিত অন্য কোনো শাস্তি রহিত হতে পারে কি? এই হাদিস কয়টি থেকে স্পষ্ট উল্লেখিত প্রশ্ন কয়টির জবাবও তরজমানুল কুরআনের মাধ্যমে দিলে খুবই ভালো হয়।

জবাব : হাতকাটার শাস্তি প্রয়োগের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ যে ঘটনা রসূল সা.-এর যুগে সংঘটিত হয়েছিল, সেটি ছিলো বনি মাখযুম গোত্রের এ মহিলা সংক্রান্ত। এ কথা সত্য যে, তার সম্পর্কে কিছু কিছু হাদিসে বলা হয়েছে যে, সে গহনা ইত্যাদি ধার নিয়ে যেতো এবং পরে তা অস্বীকার করতো। কোনো কোনো হাদিসে চেয়ে নেয়ার পরিবর্তে চুরি করার উল্লেখ রয়েছে। এসব জবাবের কিছু প্রয়োজনীয় বিবরণ নিম্নে দেয়া হলো।

সর্বপ্রথম যে কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন তা হলো এই যে, বিশুদ্ধতম হাদিসসমূহে চেয়ে নেয়ার পরিবর্তে চুরি করার কথাই বলা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, বুখারি শরিফের ফৌজদারি দন্ডবিধি সংক্রান্ত অধ্যায়ে শাস্তির ক্ষেত্রে সুপারিশ অবাঞ্ছিত শিরোনামে একটিমাত্র হাদিসই ইমাম বুখারি উদ্ধৃত করেছেন। সে হাদিসটির ভাষান্তর নিম্নরূপ : হযরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, কুরাইশ গোত্র চুরির অপরাধে ধৃত এই মাখযুমী মহিলা সম্পর্কে  খুবই চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন ছিলো। তারা বলাবলি করছিল যে, রসূলুল্লাহ সা.-এর অতীব প্রিয়পাত্র উসামা বিন যায়েদ ছাড়া আর কেউ এ ব্যাপারে সুপারিশ করতে সাহসি হবেনা। তাই হযরত রসূল সা.-এর সাথে আলোচনা করতে গেলে তিনি বললেন, "আল্লাহর ঘোষিত শাস্তি সমূহের ব্যাপারে কি তুমি সুপারিশ করতে এসেছো?" অত:পর তিনি  উঠে দাঁড়ালেন এবং ভাষণ দিতে লাগলেন। "হে জনমণ্ডলী! তোমাদের পূ্র্বতন লোকেরা এ জন্যই গোমরাহ হয়ে গিয়েছিল যে, তাদের মধ্যে সম্ভ্রান্ত পরিবারের কেউ চুরি করলে তারা তাকে ছেড়ে দিতো এবং দুর্বল শ্রেণীর কেউ চুরি করলে তাকে শাস্তি দিতো। আল্লাহর শপথ করে বলছি, মুহাম্মদ সা.-এর কন্যা ফাতেমাও যদি চুরি করতো তবে আমি তার হাতও কেটে দিতাম।"

এ হাদিসে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে এবং অকাট্যভাবে বারবার চুরি শব্দের উল্লেখ করা হয়েছে। এ দ্বারা দ্ব্যর্থহীনভাবে বুঝা যায় যে, ঐ মহিলা চুরিই করেছিল এবং চুরির অপরাধেই তার হাত কাটা হয়েছিল। হতে পারে যে, চুরির সাথে সাথে তার ধার করে আনা জিনিসপত্র আত্মসাত করারও অভ্যাস ছিলো। কিন্তু চুরির অপরাধি হবার ব্যাপারে তো কোনো সন্দেহ নেই। কেননা ধার করা জিনিস আত্মসাত করার উপর চুরি শব্দটির প্রয়োগ আরবি ভাষায় নেই। অধিকতর বিশুদ্ধ মত অনুসারে এই মহিলার নাম ছিলো ফাতিমা। আর এ ঘটনার সময় রসূল সা.-এর কন্যাদের মধ্যে একমাত্র হযরত ফাতিমাই জীবিত ছিলেন। তাই তিনি বিশেষভাবে তার নাম উল্লেখ করেন। চুরির অপরাধে দন্ডিত এই ফাতিমা বিশিষ্ট সাহাবি এবং উম্মুল মুমিনীন হযরত উম্মে সালমার সাবেক স্বামী হযরত আবু সালমার ভ্রাতৃত্ব কন্যা ছিলো। হযরত আয়েশা রা. এ কথাও বলেছেন যে, এই মহিলা পরে খাঁটি মনে তওবা করে বিয়ে করেছিল। আমি বিভিন্ন বিষয়ে রসূল সা.-এর কাছ থেকে জেনে নিয়ে তাকে জবাব দিতাম। অধিকাংশ মুহাদ্দিস চুরির বদলে ধার গ্রহণ সম্বলিত বর্ণনাকে বিরল বর্ণনা আখ্যায়িত করে অগ্রাহ্য করেছেন। হাফেজ ইবনে হাজর ইমাম কুরতুবীর বরাত দিয়ে লিখেছেন :
"ধার করে এনে অস্বীকার ও আত্মসাত করার বর্ণনার চেয়ে  চুরি সংক্রান্ত বর্ণনাই সমধিক পরিচিত ও বিশুদ্ধ।"

মুসলিম শরিফ ও আবু দাউদ শরিফেও উভয় ধরণের হাদিস বর্ণিত হয়েছে ইমাম নববী এগুলোর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেন :
"আলেমগণের মতে এসব হাদিসের তাৎপর্য এই যে, ঐ মহিলা চুরির কারণেই হাতকাটা দন্ড পেয়েছিল। জিনিসপত্র ধার করার বিষয়টি তার একটা অতিরিক্ত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য লক্ষণ হিসেবে উল্লেখিত করেছেন। ইমাম মুসলিম এ ঘটনা সংক্রান্ত সবক'টি হাদিস উদ্ধৃত করেছেন। কিন্তু হাতকাটার বর্ণনা সম্বলিত হাদিসে দ্ব্যর্থহীনভাবে বলা হয়েছে যে, শাস্তিটা চুরির কারণেই কার্যকর হয়েছিল। এ থেকে জানা যায় হাতকাটার শাস্তি প্রদানের ঘটনা একটাই এবং তা এই মহিলা সংক্রান্ত। যদিও কোনো কোনো আলেম একথাও বলেছেন যে, এই মর্মে যে হাদিস বর্ণিত হয়েছে তা অত্যন্ত বিরল এবং অধিকাংশ রাবীর হাদিসের বিরোধী। তাই এটা আমলযোগ্য নয়। অধিকাংশ আলেমদের অভিমত এই যে, ধার করা জিনিস আত্মসাত করার জন্য হাত কাটা হয়নি।"

ইমাম আবু দাউদ ধার করা জিনিস অস্বীকার ও আত্মসাত করা সংক্রান্ত হাদিস বর্ণনা করেছেন বটে। তবে তার ব্যাখ্যায় মাওলানা শামসুল হক স্বীয় গ্রন্থ আউনুল মাবুদে ইলাম যায়লায়ীর বরাত দিয়ে বলেছেন যে :
"এটা সুবিদিত যে, অন্যের জিনিসপত্র ধার করে নেয়া তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল বলেই এ বিষয়টির উল্লেখ করা হয়েছে। মাখযুমী হওয়াটা যেমন তার বংশীয় পরিচয় ছিলো, তেমনি চেয়ে ধার আনা জিনিস আত্মসাত করা তার একটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত সে চুরি করে বসলো। ফলে রসূল সা. তার হাত কেটে দিলেন।"

আবু দাউদ শরিফের অপর ব্যাখ্যামূলক গ্রন্থ 'মায়ালিমুস সুনানে' ইমাম খাত্তাবীও প্রায় অনুরূপ বক্তব্যই রেখেছেন। তিনি বলেছেন :
"আলোচ্য হাদিসটিতে ধারে জিনিসপত্র নিয়ে অস্বীকার ও আত্মসাত করার উল্লেখ রয়েছে। যাতে এই বিশেষ বৈশিষ্ট্য দ্বারা তাকে চেনা যায়। কেননা তার মাখযুমী বংশ পরিচয়টি যেমন সর্বজনবিদিত ছিলো, তেমনি তার এই বদঅভ্যাসটিও সকলের কাছে পরিচিত ছিলো। আর এই বদঅভ্যাসটি ক্রমান্বয়ে বাড়তে বাড়তে চুরির কাছে ধারণ করে এবং চুরি করার দৃষ্টতা দেখায়।"

হাফেয ইবনে হাজর ফতহুল বারীতে এই হাদিসগুলো সম্পর্কে বিশধ আলোচনা করেছেন। ইমাম কুরতুবীর যে বক্তব্য ইতিপূর্বে উদ্ধৃত করা হয়েছে, সেটি তিনি শুরুতেই তুলে ধরেছেন। পরবর্তী সময়ে তিনি কুরতুবীর বরাত দিয়েই আরো কয়েকটি যুক্তি প্রদর্শন করেছেন, যা দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, হাত কাটার শাস্তি চুরির কারণেই দেয়া হয়েছিল। যুক্তিগুলো নিম্নরূপ :

প্রথমত : হাদিসের শেষের এই উক্তিটি যে, "মুহাম্মদ সা.-এর মেয়ে ফাতিমাও যদি চুরি করতো তবে আমি তার হাতও কেটে দিতাম" অকাট্যভাবে প্রমাণ করে যে, চুরির কারণেই হাতকাটা হয়েছিল। যদি ধার করে আনা জিনিস অস্বীকার করার কারণে হাত কাটা হতো, তা হলে চুরির উল্লেখ করার প্রয়োজন হতোনা।
সে ক্ষেত্রে রসূল সা. বলতেন :
                        -----------------------------------------
"ফাতিমা রা.ও যদি ধার করে আনা জিনিস অস্বীকার করতো........।"

দ্বিতীয়ত : হাতকাটার শাস্তিটা যদি ধার জিনিস অস্বীকার ও আত্মসাতের কারণে দেয়া হতো, তাহলে এ ধরনের অপরাধের জন্য হাতকাটা শাস্তি স্থায়ীভাবে চালু হয়ে যেতো। যে কোনো ব্যক্তির কাছে অন্য কারো কোনো জিনিস পাওনা থাকলে এবং সে তা ফেরত দিতে অস্বীকার করলেই অমনি তার উপর নেমে আসতো হাতকাটা শাস্তি। চাই সে ঐ জিনিস ধার করে এনে থাক, বা অন্য কোনো পন্থায় তার দায়ভুক্ত হোক।

তৃতীয়ত : যদি ধার করে আনা জিনিস সংক্রান্ত হাদিসের এই মর্ম গ্রহণ করা হয় যে, তার আলোকে ধার চেয়ে আনা জিনিস ফেরত দিতে অস্বীকার করলেই হাতকাটা অবধারিত হয়ে দাঁড়ায়। তাহলে সেটা রসূল সা.-এর নিম্নোক্ত অকাট্য হাদিসের বিরুদ্ধে যায় :
                       ---------------------------------------
"গচ্ছিত সম্পদ আত্মসাতকারী, ছিনতাইকারী ও লুণ্ঠনকারীর হাত কাটতে হবেনা।"

হাফেয ইবনে হাজর কুরতুবীর এই যুক্তিগুলোর পর্যালোচনা করে আরো বলেন : "আত্মসাতকারী এবং ছিনতাইকারীদের ব্যাপারে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত রয়েছে যে, তাদের হাতকাটা হবেনা যতোক্ষণ না সেটা ডাকাতি ও রাহাজানির পর্যায়ে পড়ে। (অবশ্য আত্মসাত প্রভৃতি অপরাধে অন্য কোনো দমনমূলক বা নিরোধমূলক শাস্তি বা জরিমানা আরোপ করা যেতে পারে।)"

উপরোক্ত আলোচনা থেকে এ কথা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, হাদিসে যেখানেই হাতকাটার শাস্তির উল্লেখ রয়েছে, সেখানে উক্ত শাস্তি চুরির সাথেই সম্পৃক্ত অন্য কোনো ধরণের খেয়ানত বা জবরদখলের সাথে নয়। পবিত্র কুরআনেও ------------------- শব্দ রয়েছে, যার দ্বারা সর্বসম্মতভাবে কেবল চোর নারী ও পুরুষ বুঝায়। এই সাথে হাদিসে হাতকাটার জন্য অতিরিক্ত কিছু শর্ত ও বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে, যার আলোকে ফকীহ ও মুহাদ্দিসগণ সুদূরপ্রসারী বিধিমালা প্রণয়ন করেছেন। যেমন চোরাই মাল সুরক্ষিত স্থান থেকে চুরি হওয়া চাই, দ্রুত নষ্ট হওয়ার যোগ্য জিনিস না হওয়া চাই। তার মূল্য একটা নির্দিষ্ট পরিমাণের চেয়ে কম না হওয়া চাই। তার মালিকানায় চোরের কোনো অংশ না থাকা চাই ইত্যাদি। এ সব বিধির বিস্তারিত বিবরণ দেয়ার এখানে অবকাশ নেই।

এবার হাদিসের একটি অংশের ব্যাখ্যা প্রয়োজন। এই অংশটিতে বলা হয়েছে যে, রসূল সা. জিজ্ঞেস করলেন অপহরণকারিণী মহিলা কি আল্লাহ ও তাঁর রসূলের কাছে তওবা করতে প্রস্তুত আছে? কিন্তু এর উত্তরে মহিলা উঠলো না এবং কোনো কথাও বললোনা।

হাদিসের এই অংশটি সম্পর্কে সর্বাগ্রে যে কথা বলা হয়েছে তা এই যে, এই শেষোক্ত কথাগুলো এক মহিলা বর্ণনাকারী সফিয়া বিনতে আবি উবাইদ হযরত ইবনে উমার রা. থেকে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এ সম্পর্কে প্রমাণ পাওয়া যায় না যে, এরা দু'জন সমসাময়িক এবং সফিয়া সরাসরি ইবনে উমারের মুখ থেকে হাদিস শুনেছেন। তাই সনদের ধারাবাহিকতা ছিন্ন হওয়ার কারণে হাদিসটিতে দুর্বলতা বা খুঁত রয়েছে। দ্বিতীয় কথা এই যে, শাস্তি কার্যকর করার আগে রসূল সা. যদি তাকে তওবা করতে বলে থাকেন, তবে তা দ্বারা এ কথা বুঝা যায়না যে, তওবা করেই শাস্তি মাফ হয়ে যেতো। কোনো কোনো টীকাকার এরূপ ব্যাখ্যাও করেছেন যে, রসূল সা. স্বয়ং ইসলামি আইনের অন্যতম উৎস ও রচয়িতা হবার সুবাদে তওবার পর শাস্তি কার্যকর নাও করতে পারতেন। তবে এই ক্ষমতা স্বয়ং রসূল সা.-এর ব্যক্তিসত্তা ছাড়া আর কারো নেই। যাই হোক, এটা একটা বাস্তব সত্য যে, রসূল সা. ইসলামি দন্ডবিধির ব্যাপারে এ ধরনের ক্ষমতা কখনো প্রয়োগ করেননি।

কুরআন ও হাদিসের অন্যান্যা অকাট্য উক্তি থেকেও এ কথাই জানা যায় যে, কেবলমাত্র তওবা দ্বারা সূরা মায়েদায় বর্ণিত সশস্ত্র বিদ্রোহ ও অরাজকতা সৃষ্টির পার্থিব শাস্তিই শুধু ক্ষমা করা যেতে পারে। আর এই ক্ষমার জন্যও কুরআন এই শর্ত আরোপ করেছে যে, এই অপরাধ সংঘটনকারী, যাকে ফেকাহ শাস্ত্রীয় পরিভাষায় দস্যূ বা ডাকাত বলা হয়, ধরা পড়া বা নাগালের মধ্যে আসার আগেই তওবা করে স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করে। রসূল সা. নিজের উপস্থিতিতে যেসব অপরাধের শাস্তি কার্যকর করেছেন, সেসব ক্ষেত্রে সাধারণত অপরাধীকে তওবা করতে বলতেন। তওবা করার এই উপদেশ ও প্রেরণাদানের অবকাশ শাস্তি কার্যকর করার আগেও ছিলো আর মৃত্যুদন্ড না হলে শাস্তি প্রয়োগের পরেও ছিলো। কোনো কোনো সময় রসূল সা. শাস্তি প্রয়োগের পরে তওবা করিয়েছেন। কিন্তু অন্যান্য ঘটনায় হয়তো রসূল সা. শাস্তি কার্যকর করার আগে তওবা করার আহবান জানিয়েছেন এবং তওবার পরে শাস্তি কার্যকর করার ইচ্ছে পোষণ করতেন। হাদিসের এ অংশে মাখযুমী মহিলাকে এমন কথা বলা হয়নি যে, তুমি যদি তওবা কর তবে পার্থিব সাজা থেকে রেহাই পাবে। হাদিসের এ অংশটির ভাষা এরূপ :
                  ----------------------------------------------------
"কোনো মহিলা কি আল্লাহ ও তাঁর রসূলের কাছে তওবা করতে প্রস্তুত আছে?"

এ কথা সন্দেহাতীতভাবে সত্য যে, একনিষ্ঠ তওবা ছাড়া অপরাধীর পরকালীন শাস্তি থেকে মুক্তি লাভের আর কোনো উপায় নেই। অপরাধী যদি সাচ্চা দিলে তওবা না করে এবং দুনিয়ার শাস্তি ভোগ করার পর আল্লাহ থেকে আরো দুরে সরে যায়, মনে মনে ক্ষুব্ধ ও ক্ষিপ্ত হয়। তাহলে তার পক্ষে দুনিয়ার শাস্তি দ্বারা আখেরাতের আযাব থেকে নিস্তার পাওয়ার নিশ্চয়তা লাভ করা কঠিন। কিন্তু কোনো অপরাধীকে এরূপ বলা যে, 'তুমি তওবা করলে তোমার শাস্তি রহিত করা হবে' শরিয়তের প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার পরিপন্থী। বিশেষত দাগি ও ঝানু অপরাধী কিংবা অপরাধ সংঘটিত করেও তা অস্বীকার করে এমন দুর্বৃত্তকে এ ধরণের আশ্বাস দেয়া শরিয়তের দৃষ্টিতে নিতান্ত অবিজ্ঞাসূলভ কাজ। রসূল সা. যদি তওবা ও সৎপথে ফিরে আসার পর কোনো অপরাধীর আইনানুগ শাস্তি ক্ষমা করতেন, তাহলে এই ক্ষমার সবচেয়ে যোগ্য বিবেচিত হতেন সেইসব মহান সাহাবি, যারা স্বয়ং রসূল সা.-এর দরবারে হাজির হয়ে বারংবার এবং দৃঢ়তার সাথে নিজের কৃত পাপের স্বীকারোক্তি করেছিলেন। এদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন হযরত মাগের বিন মালেক এবং গমেদিয়া গোত্রের সেই মহীয়সী মহিলা, যিনি পাথরের আঘাতে মৃত্যুদন্ড গ্রহণের জন্য প্রথমে সন্তান প্রসবের পর এবং তার পরে পুনরায় শিশুর দুধ খাওয়ানোর মেয়াদ শেষে নিজেকে সমর্পণ করেন। তাদেরকে যদি তওবা না করনো হয়ে থাকে অথবা তওবা করানোর বিষয় হাদিসে উল্লেখ না থেকে থাকে, তাহলেও তাদের এই মৃত্যুদন্ডের জন্য আত্মসমর্পণ করা এবং পুন:পুন: আত্মসমর্পণ করাটাই এমন এক বাস্তব ও খালেস তওবা, যার পরে মৌখিক তওবার আর কোনো প্রয়োজন পড়েনা। বস্তুত এ জন্যই তাদের সম্পর্কে রসূল সা. দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছিলেন যে, তারা এমন তওবা করেছে, যা তাদের সমগ্র গোত্রে কিংবা সমগ্র নগরীতে বন্টন করে দিলেও সকলেই ক্ষমা পেয়ে যাবে, চাই যতো বড় গুণাহগারই থাক না কেনো। আর মহিলা সম্পর্কে বলেছেন যে, সে যে নিজের প্রিয় জীবন উৎসর্গ করে দিয়েছে এর চেয়ে বড় তওবা আর কি হতে পারে। [তরজমানুল কুরআন, জানুয়ারি ১৯৭৯]



সর্বশেষ আপডেট ( Friday, 04 March 2011 )