রাসায়েল ও মাসায়েল ৬ষ্ঠ খন্ড |
|
|
লিখেছেন সাইয়্যেদ আবুল আ'লা মওদূদী
|
Monday, 28 February 2011 |
পাতা 32 মোট 74
<h1>৩০। কিবলার দিক নির্ণয়ের শরিয়তসম্মত বনাম বিজ্ঞানসম্মত পন্থা</h1>
প্রশ্ন : আমি একটি সমস্যার ব্যাপারে আপনার সহায়তা ও নির্দেশনা চাই। এ সমস্যাটি আমার দেশ ............ তে নিদারুণ অস্থিরতার সৃষ্টি করেছে। সমস্যাটি হলো, কতিপয় আধুনিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে এই তথ্য উদঘাটন করা হয়েছে যে, আমাদের দেশের মসজিদের মিহরাবগুলো কাবা থেকে ৩৮ বা ৪০ ডিগ্রি বিচ্যুত। বহুসংখ্যক মুসলমান দাবি জানাচ্ছে যে, এই মসজিদগুলো ভেঙ্গে দিয়ে অথবা মেরামত করে সঠিক কিবলামুখি করা হোক, যাতে নামায বিশুদ্ধভাবে পড়া সম্ভব হয়। অন্য কতক মুসলমান মনে করেন, এরূপ করার প্রয়োজন নেই। তারা দুররে মুখতারের একটি বক্তব্য উদ্ধৃত করে থাকেন। এ থেকে বুঝা যায় যে, মিহরাব যদি ৪৫ ডিগ্রীর চেয়ে কম পরিমাণ কাবা ঘর থেকে দূরে সরে যায়, তাহলেও মসজিদের দিক সঠিক এবং তাতে নামায জায়েয। কিন্তু প্রথম দলের বক্তব্য হলো, কিতাব (দুররে মুখতার) অনেক প্রাচীন যুগের লেখা। আজকের যুগে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সাহায্যে যেভাবে কিবলার দিক নির্ণয় করা যায়, সেকালে তা করা যেতনা। তাই আমাদের উচিত যথাযথভাবে কিবলার দিক নির্ণয় করা।
অনুগ্রহপূর্বক জানাবেন যে, দুররে মুখতারের ফতোয়া এ যুগে অনুসরণ করা যাবে কিনা এবং কিবলার দিক নির্ণয়ে যদি কিছুটা কমবেশি হয়ে যায় তা হলে নামায শুদ্ধ হবে কিনা। যদি শুদ্ধ হয়, তবে এই কমবেশির কোনো সীমা নির্ধারণ করা সম্ভব কিনা?
জবাব : আপনার প্রশ্নের উত্তরে পয়লা কথা হলো, ইসলামি কর্মকান্ডের জন্য আমাদেরকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি উদ্ভাবিত যন্ত্রপাতির উপর অবশ্যই নির্ভর করতে হবে, এমন কোনো বাধ্যবাধকতা শরিয়ত আমাদের উপর আরোপ করনি। এ ধরনের যন্ত্রপাতির উপর নির্ভর করা সর্বাবস্থায় সম্ভব নয় এবং তা সারা দুনিয়ার মুসলমানদের জন্য এ যুগেও কষ্টকর ও বিব্রতকর হয়ে দেখা দিতে পারে।
পবিত্র কুরআনে কিবলামুখি হবার জন্য ---------------- শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। এ শব্দটির অর্থ এ নয় যে, একেবারে নাকের ছিদ্র বরাবর কিবলার দিক নির্ণয় করে পৃথিবীর প্রতিটি অংশে নামায পড়তে হবে। বরঞ্চ এর অর্থ হলো, আল্লাহর ঘর যেদিকে অবস্থিতম, মোটামুটিভাবে সেই দিকে মুখ করে নামায পড়তে হবে। সুনানে তিরমিযীর নামায সংক্রান্ত অধ্যায়ে 'পূর্ব ও পশ্চিমের মাঝে কিবলা রয়েছে' শীর্ষক হাদিসগুলো হযরত আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত নিম্নোক্ত ভাষায় উদ্ধৃত হয়েছে :
-------------------------------------------------------------
"রসূল সা. বলেছেন : পূর্ব ও পশ্চিমের মাঝে আমাদের কিবলা রয়েছে।"
রসূল সা.-এর উক্তি উচ্চারিত হয়েছিল মদিনাবাসীকে লক্ষ্য করে। মদিনা মক্কা থেকে উত্তরে অবস্থিত হওয়ায় মদিনাবাসী দক্ষিণমুখী হয়ে নামায পড়ে থাকেন। এ হাদিস থেকে বুঝা গেলো যে, মদিনাবাসীর মুখ যদি পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যবর্তী দিকে থাকে তা হলেই তাকে কিবলামুখি ধরে নেয়া হবে। এ হাদিস আরো অনেক সাহাবি থেকে বর্ণিত হয়েছে। এ ছাড়া হানাফি মাযহাবভুক্ত ফকীহগণসহ সকল ফকীহ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, কিবলামুখি হওয়ার ব্যাপারে অল্পবিস্তর পার্থক্য ক্ষতিকর নয়। খোদ মদিনা শরিফ সম্পর্কে যন্ত্রপাতির সাহায্যে অনুসন্ধান চালিয়ে দেখা গেছে যে, মসজিদে নববী হুবুহু কাবা শরিফমুখি নয়।
ফেকাহ শাস্ত্রীয় বিশেষজ্ঞগণ ও মূলনীতিটি এভাবেও বর্ণনা করেছেন যে, যে ব্যক্তি কাবা শরিফ স্বচক্ষে দেখতে পায়, তার জন্য হুবুহু কাবা অভিমুখি হয়ে নামায পড়া অপরিহার্য। কিন্তু কাবা শরিফ যার দৃষ্টিসীমার ভেতরে অবস্থিত নয় সে যদি সামান্য কিছু হেরফের করে বসে, তবে তাতে কোনো অসুবিধা নেই। হানাফি ফেকাহবিদগণ এ সিদ্ধান্তও ব্যক্ত করেছেন যে, কোনো অঞ্চলে যদি প্রাচীন আমলের মুসলমানরা কোনো মসজিদ নির্মাণ করে থাকে এবং পরে জানা যায় যে, সেই মসজিদ কাবার দিক থেকে সামান্য কিছুটা বিচ্যুত, তাহলে মসজিদ ভাংচুর করে তাকে সঠিক কিবলামুখি বানানোর চেষ্টা করা ঠিক নয়। বড় জোর ভবিষ্যতের নির্মিতব্য মসজিদ সুক্ষ্ম অনুসন্ধান ও বাছবিচারের আশ্রয় নেয়া যেতে পারে। অবশ্য তাও একেবারে অপরিহার্য নয়।
'বাহরুর বায়েক' গ্রন্থে ফাতওয়ায়ে খায়ারিয়ার বরাত দিয়ে ইমাম আবু হানিফার নিম্নরূপ অভিমত তুলে ধরা হয়েছে :
"ইমাম আবু হানিফা বলেছেন : পাশ্চাত্যবাসীর কিবলা পূর্বদিক, প্রাচ্যবাসীর কিবলা পশ্চিম দিক, উত্তর দিকের অধিবাসীদের কিবলা দক্ষিণ দিক এবং দক্ষিণ দিকের অধিবাসীদের কিবলা উত্তর দিক। সুতরাং সামান্য হেরফের ক্ষতিকর নয়।"
কতোটুকু হেরফের গ্রহণীয় এবং কতটুকু নয়, তাও সীমা নির্দেশ করেছেন ফেকাহবিদগণ। তারা বলেছেন, ৪৫ ডিগ্রি পর্যন্ত হেরফের গ্রহণীয়। তার বেশি হলে কিবলামুখি ধরা যাবেনা।
এ ব্যাপারে দুররে মুখতারের যে উক্তি উদ্ধৃত করা হয়েছে, তা যথার্থ এবং তা অবিকল শরিয়তের অভিপ্রায় প্রতিফলিত করে। বর্তমান পরিস্থিতিতে এই নীতি প্রযোজ্য। কেননা সেই যুগেও যখন ডিগ্রী পরিমাপ পূর্বক এই ফতোয়া দেয়া হয়েছে, তখন ভূগোল বা জ্যামিতির আলোকে ডিগ্রিকৃততে কোনো হেরফের হতে পারেনা। এ ফতোয়ার স্বপক্ষে কুরআন ও হাদিসেও দলিল রয়েছে, যেমন ইতিপূর্বে আলোচিত হয়েছে। ফাতওয়ায়ে খায়ারিয়াতে এ উক্তি উদ্ধৃত হয়েছে যে: "অর্থাৎ ৪৫ ডিগ্রির বেশি বিচ্যুতি ঘটলে কিবলার দিক পাল্টে যাবে। কেননা সে ক্ষেত্রে যে এক চতুর্থাংশ ভূমির উপর মক্কা শরিফ অবস্থিত, তা দিকরেখা থেকে সরে যাবে। এ ধরনের বিচ্যুতিতে নামায নষ্ট হয়ে যাবে আর এর চেয়ে কম বিচ্যুতিতে দোষ নেই।"
আপনি এ কথাও উল্লেখ করেছেন যে, আপনাদের দেশের মসজিদগুলোর কিবলার দিক থেকে বিচ্যুতি ৩৮ বা ৪০ ডিগ্রির বেশি নয়। কাজেই এতোখানি হেরফের সত্ত্বেও এই সব মসজিদের কিবলামুখিতা বিশুদ্ধ বলে ধরে নিতে হবে এবং এসব মসজিদে কোনো রদবদল ঘটানোর প্রয়োজন নেই। ভারতীয় উপমহাদেশেও এক সময় জনৈক উঁচ দরের জ্যামিতি বিশেষজ্ঞ এ ধরনের হিসাব করে বলেছিলেন যে, উপমহাদেশের কোনো মসজিদ সঠিকভাবে কিবলামুখি নয় এবং তাতে নামায জায়েয নয়। তার যুক্তিকে এ দেশের আলেম সমাজ সর্বসম্মতভাবে ভ্রান্ত আখ্যায়িত করে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। সকল মসজিদ আজও অক্ষতভাবে বহাল রয়েছে। এ ধরনের দুর্বল ও খোড়া যুক্তির অজুহাতে সুনির্মিত আল্লাহর ঘরগুলোকে ভাঙ্গা অত্যন্ত অপছন্দনীয় কাজ। দুনিয়াতে এমন বহু মসজিদ থাকতে পারে, যা সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন ও তাদের পরবর্তী মনীষীগণ নির্মাণ করে গেছেন। আমরা কি সেই সবগুলোকে ভাঙ্গতে আরম্ভ করবো? সহীহ হাদিস থেকে জানা যায়, হাতীম নামক অংশটি আগে কাবা শরিফের অন্তর্ভুক্ত ছিলো। কাবা শরিফ পুননির্মাণের সময় তা কোনো কারণে বাইরে থেকে যায়। রসূল সা.ও তা বায়তুল্লাহর অন্তর্ভুক্ত করেননি। বরং আল্লাহর ঘর যেমন ছিলো তেমনি থাকতে দিয়েছেন। মসজিদগুলোকে ভাংচুর করা বা ধসানো অত্যন্ত মারাত্মক ধৃষ্টতা। এ ধৃষ্টতার অর্থ যে সমস্ত মহান পূর্বপুরুষগণ মসজিদগুলো নির্মাণ করেছেন এবং যারা এতে নামায পড়ে গেছেন, তারা সবাই অন্যায় করেছেন। আর এখন কতোক লোক সেই স্বকল্পিত অন্যায়ের ক্ষতিপূরণ করছেন। [তরজমানুল কুরআন, আগস্ট ১৯৮০]
|
সর্বশেষ আপডেট ( Friday, 04 March 2011 )
|