 |
|
 |
আমাদের টাইপ করা বইগুলোতে বানান ভুল রয়ে গিয়েছে প্রচুর। আমরা ভুলগুলো ঠিক
করার চেষ্টা করছি ক্রমাগত। ভুল শুধরানো এবং টাইপ সেটিং জড়িত কাজে সহায়তা
করতে যোগাযোগ করুন আমাদের সাথে।
রাসায়েল ও মাসায়েল ৬ষ্ঠ খন্ড |
|
|
লিখেছেন সাইয়্যেদ আবুল আ'লা মওদূদী
|
Monday, 28 February 2011 |
পাতা 36 মোট 74
<h1>৩৪। ব্যভিচারের অপবাদ</h1>
ব্যভিচারের অপবাদ আরোপ এবং তার শরিয়তবিহিত দন্ড সম্পর্কে আমি নিজের পক্ষ থেকে কিছু বলার আগে সংশ্লিষ্ট অধ্যাদেশের সংক্ষিপ্ত সার তুলে ধরা সমীচীন মনে করছি। ১৯৭১ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি তারিখে সমগ্র পাকিস্তানে জারিকৃত এই অধ্যাদেশ মোতাবেক যে কোনো প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি মৌখিক কিংবা লিখিতভাবে কোনো মুসলমানের বিরুদ্ধে ব্যভিচারের মিথ্যা অভিযোগ আরোপ করলে সে ব্যভিচারের অপবাদ আরোপের অপরাধে অপরাধী বলে বিবেচিত হবে। কোনো মৃত মুসলমানের বিরুদ্ধেও এ ধরনের অপবাদ আরোপ করা হলে সেটা যদি তার পরিবার বা নিকট আত্মীয়দের মনোকষ্টের কারণ হয় তবে তাও ব্যভিচারের অপবাদ আরোপের জন্য শাস্তিযোগ্য বিবেচিত হবে। অভিযোগ আরোপকারী যদি নিজের সপক্ষে চারজন সাক্ষীর সত্য সাক্ষ্য আদালতে পেশ করতে না পারে, তবে তার উপর আশিটি কোড়া মেরে ব্যভিচারের অপবাদ আরোপের দণ্ড কার্যকরী করা হবে এবং তার সাক্ষ্য ভবিষ্যতে আর কখনো গ্রহণযোগ্য হবেনা। কোনো মুসলমানকে অবৈধজাত বা হারামজাদা বলাও ব্যভিচারের মিথ্যা অপবাদ আরোপের শামিল হবে।
অভিযোগ আরোপকারি যদি স্বয়ং আদালতে এই মর্মে স্বীকারোক্তি করে যে, সে ব্যভিচারের অভিযোগ আরোপ করেছে কিংবা আদালতের সামনে সে কোনো মুসলমানের উপর এরূপ অভিযোগ আরোপ করে অথবা দু'জন সত্যবাদী এবং কবীরা গুণাহ থেকে নিবৃত্ত প্রাপ্তবয়স্ক মুসলমান পুরুষ আদালতে এই মর্মে সাক্ষ্য দেয় যে, অমুক ব্যক্তি এ ধরণের অভিযোগ আরোপ করেছে এবং অভিযোগ আরোপকারি স্বীয় অভিযোগ প্রমাণ করতে চারজন সত্যবাদী সাক্ষী পেশ করতে না পারে, তবে এই অভিযোগ আরোপকারি ব্যভিচারের অপবাদ আরোপের অপরাধে দোষী হবে। আসামি যদি অমুসলিম হয়, তবে তার বিরুদ্ধে কোনো অমুসলিমও সাক্ষী হতে পারবে।
যে ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যভিচারের অপবাদ আরোপিত হয়েছে, সে স্বয়ং অথবা তার প্রতিনিধি অপবাদ আরোপকারির বিরুদ্ধে অপবাদ আরোপের অভিযোগ দায়ের করতে পারে। সেই ব্যক্তি জীবিত না থাকলে তার পিতামাতা বা সন্তানরা অভিযোগ দায়ের করতে পারে। পিতামাতা যদি সন্তানের বিরুদ্ধে ব্যভিচারের অভিযোগ আরোপ করে, তবে অপবাদ আরোপজনিত দণ্ড কার্যকর হবেনা।
স্বামী যদি স্ত্রীর বিরুদ্ধে ব্যভিচারের অপবাদ আরোপ করে তবে সে ক্ষেত্রে সাক্ষী আনয়নের পরিবর্তে পবিত্র কুরআন 'লিয়ান' এর পদ্ধতি নির্ধারণ করেছে। এই পদ্ধতি হলো, স্ত্রী যদি অভিযোগটির সত্যতা অস্বীকার করে, তবে স্বামী আদালতের সামনে চারবার আল্লাহর কসম খেয়ে বলবে, "আমি নিজের স্ত্রী, অমুকের মেয়ে অমুকের বিরুদ্ধে যে, ব্যভিচারের অভিযোগ এনেছি, তাতে আমি সত্যবাদী।" চারবার এভাবে বলার পর পঞ্চম বারে বলবে : "যদি আমি আমার স্ত্রীর বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ এনে থাকি তাহলে আমার উপর আল্লাহর অভিসম্পাত হোক।" স্ত্রী যদি অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পেতে চায়, তবে সে উক্ত অভিযোগের জবাবে চারবার আল্লাহর কসম খেয়ে বলবে যে, "আমার স্বামী আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ এনেছে।" অত:পর পঞ্চম বারে বলবে, "সে যদি এই অভিযোগে সত্যবাদী হয়ে থাকে তবে আমার উপর আল্লাহর গযব হোক।" আদালতের বিচারপতি এই পরিস্থিতিতে স্বামী স্ত্রীর বিয়ে বিচ্ছেদের রায় দেবেন। এই রায়ের বিরুদ্ধে কোনো আপিল হবেনা। স্বামী বা স্ত্রী যদি এভাবে কসম খেতে অস্বীকার করে তবে কসম না খাওয়া পর্যন্ত স্বামীকে হাজতে আটক করা হবে এবং স্ত্রীকেও পাল্টা কসম না খাওয়া অথবা স্বামীর অভিযোগ সত্য বলে মেনে না নেয়া পর্যন্ত হাজতে আটক রাখা হবে। সে যদি স্বামীর আরোপিত অভিযোগকে সত্য বলে স্বীকার করে, তবে তার উপর ব্যভিচারের শাস্তি অর্থাৎ প্রস্তরাঘাতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবে।
ব্যভিচারের অপবাদ আরোপজনিত অপরাধ এবং লিয়ানের মামলা ও আপিলের শুনানিতে বিচারকের অবশ্যই মুসলমান হতে হবে। অধ্যাদেশটির শেষ ধারা হলো, যেসব মোকদ্দমা এই অধ্যাদেশ জারি হওয়ার পূর্বে আদালতে দায়ের হয়েছে এবং যে সব অপরাধ এই অধ্যাদেশ জারি হওয়ার পূর্বে সংঘটিত হয়েছে, তার উপর এ অধ্যাদেশ প্রযোজ্য হবেনা।
ব্যাভিচারের অপবাদ আরোপ সংক্রান্ত অধ্যাদেশের সংক্ষিপ্ত সার উপরে বর্ণিত হলো। এবার আমি আমার বিবেচনার যে কয়টি জিনিস এই অধ্যাদেশে সংযোজন অথবা ব্যাখ্যার আকারে উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করি তার উল্লেখ করছি :
১. ইসলামের সাক্ষ্য আইনের আলোকে এটা যে কোনো সাক্ষ্যের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ যে সাক্ষীতে বলতে হবে : "আমি আল্লাহর কসম খেয়ে সাক্ষ্য দিচ্ছি" লিয়ানের ক্ষেত্রেও উভয় পক্ষকে "কসম সহকারে সাক্ষ্য দিচ্ছি" কথাটা বলতে হবে। পবিত্র কুরআনের সূরা নূরে লিয়ানের বিধান বর্ণনা প্রসঙ্গে দু'বার "আল্লাহর কসম সহকারে সাক্ষ্য প্রদান" শব্দটি এসেছে এবং ফকীহগণও সুস্পষ্টভাবে বলেছেন যে, লিয়ানে সাক্ষ্য শব্দটা উচ্চারণ করা অপরিহার্য। স্বামী বা স্ত্রীর শুধু "আল্লাহর কসম খেয়ে বলছি আমি সত্যবাদী বা সত্যবাদিনী" বললে লিয়ান কার্যকর হবেনা। এ জন্য সাক্ষ্য শব্দটা বলাও জরুরি। প্রচলিত বিচার ব্যবস্থায় মামলার উভয়পক্ষ বা সাক্ষীর জবানবন্দী বা সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য সুনির্দিষ্ট ভাষা সম্বলিত ফর্মুলা বা বিধি নির্ধারিত নেই। সাক্ষীতে সাধারণত এ কথাই বলতে বাধ্য করা হয় যে, "আমি ঈমানদারীর সাথে সত্য বলবো।" কোনো কোনো সাক্ষী আল্লাহর কসম কুরআনের কসম খায় অথবা বলে যে, "আমি আল্লাহর হাজির নাজির (উপস্থিত ও চাক্ষুস দর্শক) জেনে বলছি।" এমন রকমারী রীতি যেহেতু প্রথাসিদ্ধভাবে চালু হয়ে গেছে, তাই এসব কথার মাধ্যমে দেয়া জবানবন্দী বা সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য হতে পারে। তবে যেহেতু বর্তমানে আমাদের দেশে আল্লাহর অনুগ্রহে ইসলামি আইন ও বিধান বাস্তবায়নের সূচনা হয়েছে, তাই সাক্ষ্যদানের ভাষা আইনানুগভাবে নির্ধারণ করে দেয়া আবশ্যক। আমার মতে, যার সাক্ষ্য গ্রহণ করা হবে তাকে বলতে হবে, "আমি আল্লাহর কসম খেয়ে সাক্ষ্য দিচ্ছি।" লিয়ানের বেলায়ও উভয় পক্ষকে নিজ নিজ বিবৃতি এই ভাষাতেই শুরু করতে হবে।
২. অধ্যাদেশটির ধারা ৬-তে ব্যভিচারের অপবাদ আরোপের দায় থেকে অব্যাহতি লাভের কয়েকটি ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রের উল্লেখ রয়েছে। তন্মধ্যে একটি ক্ষেত্র হলো, যদি সদুদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে কারো বিরুদ্ধে ব্যভিচারের অপর এমন কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের কাছে বলে যাদের ঐ ব্যক্তির উপর উক্ত ব্যভিচারের অভিযোগের ব্যাপারে আইনানুগ অধিকার থাকে, বা তারা যদি কর্তৃত্বসম্পন্ন কোনো ব্যক্তির নিকট পৌঁছানো হয়, তাহলে সেটা ব্যভিচারের অপবাদ বলে গণ্য হবেনা। এই ব্যতিক্রমী ধারার মধ্যে কি মহৎ উদ্দেশ্য ও কল্যাণ নিহিত রয়েছে, তা আমার বুঝে আসেনি। আমার মতে এই ধারাটি অবাঞ্ছিত এবং এটি বাদ দেয়া উচিত। আসলে এই ধারাটি সম্পূর্ণরূপে মানহানি আইনের একটি বিধির অনুকরণে রচিত। পাকিস্তান দন্ডবিধির ৪৯৯ ধারার অধীন 'অষ্টম ব্যতিক্রমে' এই বিধিটি সন্নিবেশিত হয়েছে। পাকিস্তান দন্ডবিধিতে এর যে উদাহরণ দেয়া হয়েছে আলোচ্য অধ্যাদেশটিতে তা উল্লেখ করা হয়নি। উদাহরণটি নিম্নরূপ :
"A সদুদ্দেশ্য সহকারে Z-এর বিরুদ্ধে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে অভিযোগ রুজু করলো অথবা A সদুদ্দেশ্য সহকারে Z নামক ভৃত্যের চালচলন সম্পর্কে তার মনিবের নিকট নালিশ জানালো, অথবা A সদুদ্দেশ্য সহকারে Z এর চালচলন সম্পর্কে তার পিতার নিকট অভিযোগ দায়ের করলো, এরূপ ক্ষেত্রে A-এর বিরুদ্ধে মানহানি মামলা দায়ের করা যাবেনা।"
এ ব্যাপারে পয়লা কথা হলো, মানহানিজনিত সাধারণ নালিশ এবং ব্যভিচারের অভিযোগ আকাশ পাতাল ব্যবধান। তাই একটিতে অপরটির উপর কিয়াস করা এবং একটির সুবিধা অপরটির ক্ষেত্রে সর্বোতভাবে প্রয়োগ করা ঠিক নয়।
দ্বিতীয়ত: অধ্যাদেশের উল্লেখিত ধারাটিকে পাকিস্তান দন্ডবিধির আলোচ্য ধারাটির সমতুল্য মনে করে কেউ যদি উক্ত উদাহরণ দ্বারা সুবিধা ভোগ করার চেষ্টা করে তবে সেটা সঙ্গত হবেনা। কেনো আদালতে ব্যভিচারের অভিযোগ তুললেই তো তা যথারীতি ব্যভিচারের অপবাদে পর্যবসিত হয় এবং সে কথা অধ্যাদেশে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে।
পিতার কাছে সন্তানের বা মনিবের কাছে ভৃত্যের নামে ব্যভিচারের অভিযোগ তোলা হলে পিতা বা মনিব যদি ব্যাপারটা আদালতে আনতে না চায়, তাহলে তো ভিন্ন কথা। কিন্তু যদি পিতা বা পুত্র বা ভৃত্য স্বয়ং অভিযোগকারীর বিরুদ্ধে অপবাদের মামলা ঠুকে দেয়। তাহলে তো ইসলামি আইন অনুসারে অভিযোগকারী চারজন সত্যবাদী সাক্ষী হাজির না করা পর্যন্ত অপবাদের দন্ড থেকে কিছুতেই নিস্তার পেতে পারেনা। তখন বাদী এই ওজর দিয়ে রেহাই পেতে পারবেনা যে, আমি তো সদুদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে অভিযোগটি কেবলমাত্র সংশ্লিষ্ট কর্তৃত্বশীলের গোচরীভূত করেছিলাম। এ কারণে আমি এই ব্যতিক্রম এ রক্ষাকবচকে ইসলামি শরিয়তের আলোকে নিস্প্রয়োজন ও অবৈধ মনে করি।
৩. এই অধ্যাদেশের ৬নং ধারার (C) উপধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি কারো বিরুদ্ধে ব্যভিচারের অভিযোগ আরোপ করলে তা প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত করার একটি পন্থা এই যে, দু'জন সৎ, কবীরা গুণাহ থেকে মুক্ত প্রাপ্ত বয়স্ক মুসলমান পুরুষ সাক্ষীকে আদালতে হাজির করবে। কিন্তু ৩নং ধারার অপবাদ আরোপের দায়ে ধরা পড়ার যে কয়টি সম্ভাব্য ক্ষেত্র বর্ণনা করা হয়েছেম, তার (I) তে বলা হয়েছে যে, এরূপ একটি ক্ষেত্র হলো, আসামি কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে আদালতে ব্যভিচারের অভিযোগ রুজু করলো, কিন্তু নিজের সমর্থনে চারজন সাক্ষী হাজির করতে পারলোনা। এখানে শুধুমাত্র (Four witnesses) শব্দ রয়েছে, কিন্তু সাক্ষীর কোনো গুণ বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ নেই। এখানেও সাক্ষীর সেই গুণাবলী জুড়ে দেয়া বাঞ্ছনীয়, যা ব্যভিচারের অভিযোগ প্রমাণের জন্য ৬নং ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ সাক্ষীকে সত্যবাদী এবং কবীরা গুণাহমুক্ত হতে হবে। মামলার সাক্ষীদের সৎ ও সত্যবাদী হওয়া যে ইসলামি বিচার ব্যবস্থার অন্যতম প্রধান মূলনীতি, সে কথা কুরআন ও সুন্নাহ থেকে প্রমাণিত। ফেকাহ শাস্ত্রকারগণ বিশেষভাবে ফৌজদারি অপরাধ সংক্রান্ত ব্যাপারে এটিকে অত্যাবশ্যক বলে ঘোষণা করেছেন। যদিও অধ্যাদেশটির পূর্বাপর প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে এখানে ঐ গুণগুলো অনুল্লেখিত থাকাতে ওগুলোর প্রয়োজন নেই বুঝা যায়না। তথাপি সন্দেহ ও অনিশ্চয়তা নিরসনের খাতিরে উক্ত গুণগুলো সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করাই উত্তম।
|
সর্বশেষ আপডেট ( Friday, 04 March 2011 )
|
|
|
|