আমাদের টাইপ করা বইগুলোতে বানান ভুল রয়ে গিয়েছে প্রচুর। আমরা ভুলগুলো ঠিক করার চেষ্টা করছি ক্রমাগত। ভুল শুধরানো এবং টাইপ সেটিং জড়িত কাজে সহায়তা করতে যোগাযোগ করুন আমাদের সাথে।
রাসায়েল ও মাসায়েল ৬ষ্ঠ খন্ড প্রিন্ট কর ইমেল
লিখেছেন সাইয়্যেদ আবুল আ'লা মওদূদী   
Monday, 28 February 2011
আর্টিকেল সূচি
রাসায়েল ও মাসায়েল ৬ষ্ঠ খন্ড
গ্রন্থকার পরিচিতি
১। আল্লাহর অস্তিত্ব সম্পর্কে সংশয় নিরসন
২। আল্লাহ ও তাঁর রসুলগণের মধ্যে পার্থক্য করা
৩। জীবজন্তুর উপর দয়া
৪। পাঁচ ওয়াক্ত ও পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায
৫। হানাফি মাযহাবে কি কিছু কিছু মাদক দ্রব্য হালাল?
৬। আদালতের রায় কি শুধু জাহেরীভাবেই কার্যকর, নাকি বাতেনীভাবেও কার্যকর?
৭। সুন্নাহর আইনগত মর্যাদা
৮। সাহরির শেষ সময় কোনটি?
৯। একটি হাদিস থেকে সুদের বৈধতা প্রমাণের অপচেষ্টা
১০। মুসলিম উম্মাহর বহু গোষ্ঠিতে বিভক্তি এবং মুক্তি লাভকারি গোষ্ঠি
১১। কালো খেজাব লাগানো কি বৈধ?-১
১২। কালো খেজাব কি বৈধ?-২
১৩। তাকদীর প্রসঙ্গ
১৪। গোমরাহী ও হেদায়েত
১৫। সূরা আন নাজমের প্রাথমিক আয়াত কয়টির ব্যাখ্যা
১৬। যাকাতকে প্রচলিত করের সাথে যুক্ত করা যায় না
১৭। পিতামাতার অধিকার
১৮। লোহার আংটি পরা কি জায়েয?
১৯। উশর ও খারাজের কয়েকটি সমস্যা
২০। উশরযোগ্য ফল ফসল কি কি?
২১। মোজার উপর মসেহ করার বিধান
২২। কারো সম্মানে দাঁড়ানো কি জায়েয?
২৩। 'প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ দান করা' সংক্রান্ত কুরআনের আদেশের ব্যাখ্যা
২৪। অপ্রাপ্ত বয়স্ক সন্তানদের ভরণ পোষণ প্রসঙ্গে
২৫। কবর আযাব
২৬। কুরআন শিক্ষাদান ও অন্যান্য ধর্মীয় কাজের পারিশ্রমিক নেয়া কি বৈধ?
২৭। ইসলামের ফৌজদারী দণ্ডবিধি সংক্রান্ত কিছু ব্যাখ্যা
২৮। বেতের নামাযে দোয়া কুনূত
২৯। লাইসেন্স ক্রয় বিক্রয়
৩০। কিবলার দিক নির্ণয়ের শরিয়তসম্মত বনাম বিজ্ঞানসম্মত পন্থা
৩১। মৃত ব্যক্তির জন্য ফিদিয়া দান, শোক ও কুরআন খতম
৩২। কয়েদি সৈন্যরা কি নামায কসর করবে
৩৩। পবিত্র কুরআন ও গুপ্ত ওহি
৩৪। ব্যভিচারের অপবাদ
৩৫। কোন কোন প্রাণী হালাল বা হারাম
৩৬। কুরবানীর চামড়া সম্পর্কে শরিয়তের বিধান
৩৭। মৃত ব্যক্তির চামড়া সম্পর্কে শরিয়তের বিধান
৩৮। মৃত প্রাণীর চামড়া সম্পর্কে আরো আলোচনা
৩৯। জবাই হালাল হওয়ার জন্য কি বিস্
৪০। যাকাত সংক্রান্ত কিছু খোলামেলা কথা
৪১। নগদ পুঁজির যাকাত ও তার নিসাব
৪২। বাইয়ে সালাম
৪৩। হযরত আলী রা.-এর জন্য সূর্যকে ফিরিয়ে দেয়ার ঘটনা কি সত্য?
৪৪। কুরাইশের ১২ জন খলিফা ও 'ফিতনায়ে আহলাস'
৪৫। আল্লাহ ও রসূলের কোনো উক্তি কি মানুষকে কর্মবিমুখ করতে পারে?
৪৬। আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয় করা সত্ত্বেও দৈন্যদশার কারণ কি?
৪৭। হযরত আলী রা.-এর বর্ম চুরি-১
৪৮। হযরত আলী রা.-এর বর্ম চুরি-২
৪৯। ইসলামের দৃষ্টিতে গানবাজনা ও নারী পুরুষের মেলামেশা
৫০। আব্দুল্লাহ বিন উবাইর জানাযা
৫১। ইমাম ইবনে তাবারি কি শিয়া ছিলেন?
৫২। ফৌজদারি অপরাধের ক্ষেত্রে আপোস নিষ্পত্তির অধিকার
৫৩। ইসলামের উত্তরাধিকার আইন সম্পর্কে অভিযোগ
৫৪। শরিয়তের দৃষ্টিতে ওয়াকফের সংজ্ঞা ও বিধান
৫৫। আত্মহননকারীর জানাযা নামায
৫৬। হারুত মারুত ফেরেশতাদ্বয় সম্পর্কে এক ভিত্তিহীন অলীক কাহিনী
৫৭। 'চাটান' সম্পাদকের নিকট দুটো চিঠি
৫৮। হাদিস অস্বীকার করা ও স্বীকার করা
৫৯। হাদিস বিরোধী গোষ্ঠির বিভ্রান্তিকর প্রচারণা
৬০। একটি হাদিস সম্পর্কে আপত্তি ও তার জবাব
৬১। সন্তান পালনে নারীর অধিকার
৬২। স্তনের দুধ পানে বিয়ে হারাম হওয়া
৬৩। পারিবারিক আইন ও অর্পিত তালাক
৬৪। ফাসিদ বিয়ে ও বাতিল বিয়ে
৬৫। রসূল সা. কি হযরত সওদা রা. কে তালাক দিতে চেয়েছিলেন?
৬৬। উম্মুল মুমিনীন হযরত সওদার বিয়ে সম্পর্কে আরো আলোচনা
৬৭। কতোখানি দুধ পান করলে বিয়ে হারাম হয়?
৬৮। পিতামাতার আদেশে স্ত্রী তালাক দেয়া যায় কি?
৬৯। রসুল সা.-এর একাধিক বিয়ের যৌক্তিকতা ও সার্থকতা
৭০। বেলুচিস্তানের বাগদান প্রথা
৭১। লটারি ও নির্বাচনী লটারি
৭২। সমবায় সমিতি

<h1>৩৭। মৃত ব্যক্তির চামড়া সম্পর্কে শরিয়তের বিধান</h1>

ইতোপূর্বে এক ব্যক্তি মৃত জন্তুর চামড়ার ব্যবহার ও বেচাকেনা সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিলেন। সেই প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত জবাব দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তাতে তিনি তৃপ্ত হননি। আরো বিস্তারিত প্রশ্নটি পুনরাবৃত্তি করেছেন।  এবারকার প্রশ্নটি নিম্নরূপ:
প্রশ্ন : আমি মৃত জন্তুর চামড়া  সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলাম যে, প্রক্রিয়াজাত করার আগে তা ব্যবহার বা বিক্রি করা যায় কিনা? আপনি সংক্ষেপে জবাব দিলেন যে, এটা জায়েয আছে। কেনা চামড়ার প্রক্রিয়াজাতকরণ সবার পক্ষে সম্ভব নয়। প্রক্রিয়াজাতকরণের আগে চামড়ার বেচাকেনা নিষিদ্ধ হলে প্রক্রিয়াজাত করার মাধ্যমে তাকে পবিত্র করা সকল মানুষের সাধ্যে কুলাবেনা। অথচ শরিয়তে শুধু প্রক্রিয়াজাতকৃত চামড়াকেই পবিত্র বলে ঘোষণা করা হয়েছে। আমি দু:খের সাথে  জানাচ্ছি যে, মৃত জন্তুর চামড়ার কেনাবেচা সম্পর্কে আপনার জবাবে আমি আশ্বস্ত হতে পারিনি। এর কারণ এই যে, আপনি অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত জবাব দিয়েছেন। জবাবে কোনো দলিল প্রমাণ উল্লেখ করেননি। দ্বিতীয়ত অনুসন্ধান চালাতে গিয়ে ইমাম শওকানীর এ সংক্রান্ত আলোচনা পড়ে আপনার জবাবে আরো বেশি অতৃপ্তি জন্মে গেছে। তিনি নিম্নোক্ত হাদিসটি উদ্ধৃত করেছেন :

"হযরত জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ থেকে বর্ণিত, তিনি রসূলুল্লাহ সা.-কে বলতে শুনেছেন যে, আল্লাহ তায়ালা মদ, মৃত প্রাণী, শূকর ও মূর্তির কেনাবেচা হারাম করে দিয়েছেন। বলা হলো, হে আল্লাহর রসূল! মৃত জন্তুর চর্বি সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কি? এই চর্বি দ্বারা নৌকা ও চামড়ায় তেল দেয়া হয় এবং লোকেরা তা দিয়ে প্রদ্বীপ জ্বালায়। তিনি বললেন : না এটা হারাম। অতপর রসূলুল্লাহ সা. বললেন, আল্লাহ ইহুদীদেরকে ধ্বংস করুন! আল্লাহ যখন মৃত প্রাণীর চর্বি হারাম করেন তখন তারা তাকে গলিয়ে ফেলে, তারপর তা বিক্রি করে এবং বিক্রয়লব্ধ অর্থ নিজেদের কাজে লাগায়।"

এ হাদিস সম্পর্কে পর্যালোচনা করতে গিয়ে ইমাম শওকানী বলেন :
"ইবনুল মুনযির মৃত প্রাণীর ক্রয় বিক্রয় হারাম হওয়ার ব্যাপারে ইজমা তথা সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত রয়েছে বলে জানিয়েছেন। বলাই বাহুল্য, মৃত প্রাণীর বেচাকেনা হারাম এ কথার অর্থ তার সকল অংশেরই বেচাকেনা হারাম। তবে মাছ, পঙ্গপাল এবং যে অংশে জীবনের কোনো লক্ষণ বিরাজ করেনা তা হারাম নয়। মৃত প্রাণীর দেহের কোনো অংশকে কাজে লাগানো যে হারাম, সেটা অন্য দলিল দ্বারাও প্রমাণিত। যেমন রসূলুল্লাহ সা.-এর এই হাদিস "মৃত প্রাণীর কোনো কিছুই কাজে লাগিও না।" অর্থাৎ এরূপ ধারণা করা চাইনা যে, মৃত প্রাণী বিক্রি করাটা এ হাদিস দ্বারা বৈধ প্রমাণিত হয়, মৃত প্রাণী বিক্রি করা হারাম। এ হাদিস দ্বারা হারাম জিনিসকে ব্যবহারের বিভিন্ন পন্থা ও কলাকৌশলও অবৈধ প্রমাণিত হয়। বস্তুত, আল্লাহ যে জিনিসকে তাঁর বান্দাহদের জন্য হারাম করেছেন তা বিক্রি করাও হারাম। কেননা তার মূল্য হারাম।" [নাইলুল আওতার, ৫ম খণ্ড, ক্রয় বিক্রয় সংক্রান্ত অধ্যায়]

আমি আশা করি এ বিষয়ে সবিস্তারে লিখবেন এবং আমার ও জনগণের সংশয় দূর করবেন। আল্লাহ আপনাকে উত্তম পুরস্কারে পুরস্কৃত করবেন।

জবাব : আপনার দ্বিতীয় চিঠি পড়ে মনে হয়, আপনার মতে মৃত প্রাণীর দেহের সকল অংশের ব্যাপারে শরিয়তের বিধান এক ও অভিন্ন চাই তা গোশত হোক বা চামড়া হোক, পশম হোক বা হাড়গোড়, শিং বা নখ যা-ই হোক। তাছাড়া একটিমাত্র হাদিস দ্বারাই আপনি মৃত দেহের সকল অংশকে হারাম মনে করে নিয়েছেন। আমার মতে এ ধারণা ঠিক নয়। হাদিস বিশারদগণ ও মুজতাহিদ (চিন্তাবিদ ও গবেষক) ইমামগণের সংখ্যাগুরু অংশ মৃত দেহের সকল অংশের উপর একই বিধান প্রয়োগ করেননি। উদাহরণস্বরূপ, আপনি সহীহ বুখারির ক্রয়বিক্রয় সংক্রান্ত অধ্যায়ের "প্রক্রিয়াজাতকরণের আগে মৃত প্রাণীর চামড়া সংক্রান্ত বিধান" শীর্ষক হাদিসগুচ্ছ দেখুন। এতে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস বর্ণনা করেন, একবার রসূলুল্লাহ সা. একটা মৃত ছাগল দেখতে পেলেন। তিনি বললেন : তোমরা এর চামড়া কাজে লাগালে না কেনো? সাহাবায়ে কেরাম বললেন : এতো মরা জন্তু। রসূলুল্লাহ সা. বললেন : এটা শুধু খাওয়া হারাম। এরপর আরো কয়েকটি হাদিসগুচ্ছ বর্ণনা করার পর ইমাম বুখারি আরো একটি হাদিসগুচ্ছ অধীনে আপনার উদ্ধৃত হাদিসটি সন্নিবেশিত হয়েছে। এ হাদিসে  মৃতদেহ  ও তার চর্বি হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। উভয় হাদিস যে সনদের দিক দিয়ে বিশুদ্ধ তাতে কোনো সন্দেহ থাকতে পারেনা। এর একটি অপরটি দ্বারা রহিত হয়ে যাওয়ারও কোনো প্রমাণ নেই। তাই এ কথা না মেনে উপায় থাকেনা যে, মৃত প্রাণীর পুরো দেহ গোশত সমেত দাম ঠিক করে বিক্রি করা তো অবশ্যই নিষিদ্ধম, তবে চর্বি ও গোশত ছাড়া দেহের অন্যান্য অংশ অথবা অন্ততপক্ষে তার চামড়া ব্যবহার করা যেহেতু জায়েয হবে।

ফাতহুল বারীতে হাফেজ ইবনে হাজর এ হাদিসের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে এ কথাই বলেছেন যে, এই হাদিস ও তার শিরোনাম থেকে বুঝা যায়, ইমাম বুখারি ব্যবহারের বৈধতা থেকে ক্রয়বিক্রয়ের বৈধতার পক্ষে যুক্তি দর্শিয়েছেন। কেননা যে জিনিস ব্যবহার করা জায়েয, তার ক্রয়বিক্রয়ও জায়েয। আর যে জিনিসের ব্যবহার নিষিদ্ধ, তার বেচাকেনাও নিষিদ্ধ। হযরত ইবনে আব্বাসের বর্ণিত হাদিসগুলোকে ইমাম বুখারি 'জবাইযোগ্য প্রাণী ' সংক্রান্ত অধ্যায়ে পুররুল্লেখ করেছেন। এর একটির অনুবাদ একটু আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। অপরটিতে রসূলুল্লাহ সা.-এর উক্তি একটু ভিন্নভাবে বর্ণিত হয়েছে :
                         ---------------------------------------
"এই ছাগলটির মালিক যদি এর চামড়াটি কাজে লাগাতো, তাহলে অসুবিধা কি ছিলো?"

এই উক্তির ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে ইবনে হাজর বলেন, ইমাম যুহরী এ হাদিস থেকে মৃত প্রাণীর চামড়া ব্যবহার করাকে শর্তহীনভাবে বৈধ সাব্যস্ত করেছেন, চাই তা নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় পাকানো হোক বা না হোক। ইমাম দাউদ যাহেরীর মতামতও তদ্রুপ। এছাড়া বুখারি শরিফের 'কসম ও মান্নত' সংক্রান্ত অধ্যায়ে হযরত ইবনে আব্বাস হযরত সওদা থেকে বর্ণনা করেছেন যে, আমাদের একটা ছাগল মারা গিয়েছিল। আমরা তার চামড়া পাকিয়ে নিলাম এবং ব্যবহার করতে লাগলাম। ক্রমান্বয়ে তা একটা পুরানো পানি মশকের মতো হয়ে গেলো।

বুখারি শরিফের 'জবাইযোগ্য জন্তু' অধ্যায়ে হযরত ইবনে আব্বাস থেকে যে হাদিস বর্ণিত হয়েছে, তার ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে 'উমদাতুল ক্বারী'তে হাফেজ বদরুদ্দীন আইনি বলেছেন, এ হাদিসের আলোকে অধিকাংশ ফকীহ ও মুফতিগণ পাকানো চামড়ার ব্যবহার বৈধ বলে রায় দিয়েছেন। ইমাম আবু হানিফা, ইমাম শাফেয়ী ও ইমাম মালেকের সর্বশেষ সিদ্ধান্ত ঠিক তাই। ইমাম আহমদ সম্পর্কে তিরমিযীর বরাত দিয়ে আইনি লিখেছেন, তিনি প্রথমে 'মৃত জন্তুর কোনো কিছুই ব্যবহার করো না' এই হাদিস অনুসারে আদৌ ব্যবহার না করার পক্ষপাতি ছিলেন। কিন্তু পরে এ হাদিসের সনদের দুর্বলতাবশত পরিত্যাগ করেন। আলোচ্য হাদিস প্রসঙ্গে হাফেজ ইবনে হাজরও এ কথাই লিখেছেন। আইনি ও ইবনে হাজর উভয়ে একথাও লিখেছেন যে, মৃত প্রাণীর সবকিছুই নিষিদ্ধ এই মর্মে যে কয়টি হাদিস বর্ণিত আছে, তার প্রত্যেকটির সনদ নিয়ে দ্বিরুক্তি রয়েছে এবং বিশুদ্ধ হাদিসের বিরোধী হওয়ার কারণে ঐ হাদিসগুলো অগ্রহণযোগ্য। এ হাদিসগুলোর মধ্যে একটির বর্ণনাকারী হচ্ছেন ইবনে আলীম, যিনি সাহাবি ছিলেন কিনা তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। তার বর্ণনা একটি চিঠির উপর নির্ভরশীল। চিঠি আর যাই হোক, সরাসরি শ্রবণের সমপর্যায়ভুক্ত নয়।

সহীহ বুখারির পর সহীহ মুসলিমের হাদিসগুলো বিবেচনায় আনা যাক। এতে 'মৃত জন্তুর চামড়া পাকালে পবিত্র হয়ে যায়।' শীর্ষক হাদিসগুচ্ছে প্রথমে ঐ চারটি হাদিসই হযরত ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত এবং চারটিই ছাগলের চামড়া সংক্রান্ত। এতে এ কথাও উল্লেখ রয়েছে যে, মৃত ছাগলটি ছিলো হযরত মাইমুনার চাকরানীর। সামান্য শাব্দিক পার্থক্যের কথা বাদ দিলে এর সব ক'টির বাদবাকি বক্তব্য বুখারি শরিফে বর্ণিত হাদিসগুলোর অনুরূপ। এরপর হযরত ইবনে আব্বাসের আরো কয়েকটি হাদিস রসূলুল্লাহ সা. থেকে বর্ণিত হয়েছে এবং সেগুলোও পাকানো চামড়ার পবিত্রতা প্রমাণ করে। এগুলোর ভাষা এরূপ :
                      -----------------------------------------------
এই সমস্ত হাদিসের বিশদ ব্যাখ্যা লিখে ইমাম নববী সর্বমোট সাতটি অভিমত তুলে ধরেছেন। সেগুলো নিম্নরূপ :
à§§. ইমাম শাফেয়ীর মতে কুকুর ও শূকর ছাড়া সকল প্রাণীর  চামড়া পাকালে পবিত্র হয়ে যায়, চাই তা ভিজে হোক বা শুকনো হোক।
২. ইমাম আহমদের অপেক্ষাকৃত পরিচিত অভিমত এই যে, কোনো চামড়াই পাকানো দ্বারা পবিত্র হয়না।
৩. ইমাম আওযায়ী, আবুস সাওর ও ইবনে মুবারকের মত এই যে, শুধুমাত্র হালাল প্রাণীর চামড়া পাকালে পবিত্র হয়।
৪. ইমাম আবু হানিফার মত হলো, শূকর ছাড়া সকল প্রাণীর চামড়া পাকালে পবিত্র হয়ে যায়।
৫. ইমাম মালেকের প্রসিদ্ধ মত এই যে, প্রত্যেক প্রাণীর বাহ্যিক অংশ অর্থাৎ উপরের অংশ পাকালে শুকনো অবস্থায় পবিত্র হতে পারে।
৬. ইমাম দাউদ জাহেরীর মতে প্রত্যেক প্রাণীর চামড়া পাকালে পবিত্র হতে পারে।
৭. ইমা যুহরীর মত এই যে, পাকানো ব্যতিরেকেও মৃত প্রাণীর চামড়া পবিত্র।

সহীহ মুসলিম, ক্রয়বিক্রয় সংক্রান্ত অধ্যায়ে 'মদ ও মৃত জানোয়ার হারাম' শীর্ষক হাদিসগুচ্ছের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে ইমাম নববী লিখেছেন, ইমাম শাফেয়ীর মতে অপবিত্র জিনিসগুলো কেবল খাওয়া ও শরীরে লাগানো নিষিদ্ধ। অন্য সকল প্রকারের ব্যবহার বৈধ।

যা হোক, এ হাদিসগুলো এবং তার উল্লেখিত ব্যাখ্যা থেকে আমার কাছে এটা সন্দেহতীতভাবে প্রমাণিত যে, মুসলিম উম্মাহর সংখ্যাগরিষ্ঠের নিকট অন্ততপক্ষে হালাল প্রাণীগুলোর চামড়ার ব্যবহার ও ক্রয়বিক্রয় বৈধ এবং তা পাকানোর পর পবিত্র হয়ে যায়, চাই জবাই হওয়ার পরিবর্তে স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করে থাকনা কেনো। আশ্চর্যের ব্যাপার, ইমাম দাউদ যাহেরীকে নাইলুল আওতারের পঞ্চম খণ্ডেরই ১৪ পৃষ্ঠায়  'অনুকরণযোগ্য মহান প্রাচীন ইমাম' বলে উল্লেখ করা সত্ত্বেও ইমাম শওকানী মৃত প্রাণীর চামড়ার প্রশ্নে তাঁর ঠিক বিপরীত অবস্থান নিয়েছেন। ইমাম দাউদ যেখানে প্রত্যেক প্রাণীর চামড়াকে সর্বাবস্থায় পবিত্র মনে করেন, ইমাম শওকানী সেখানে কোনো চামড়াকেই কোনো অবস্থায়ই পবিত্র মনে করেননা।

বিচারপতি শওকানীর যে মত আপনি উদ্ধৃত করেছেন, আমি তার সাথে একমত নই। তবে এ ব্যাপারে বিশদ আলোচনা জরুরি মনে করিনা। তিনি আল মুনতাকীর যে হাদিস আবু দাউদ ও মুসনাদে আহমদ থেকে উদ্ধৃত করেছেন যে, "আল্লাহ তায়ালা যখন কোনো জাতির জন্য কোনো জিনিস খাওয়া হারাম করে দেন, তখন তার বিক্রয়লব্ধ অর্থও হারাম করেন," সে সম্পর্কে আমি শুধু এতোটুকু বলবো যে, আমার নগণ্য বুদ্ধি বিবেচনা মোতাবেক যেভাবে অন্য কয়েকটি সহীহ হাদিস থেকে মৃত প্রাণীর চামড়ার ব্যবহারের বৈধতা প্রমাণিত হয়, তেমনিভাবে তার কেনাবেচার বৈধতাও প্রমাণিত হয়। কেননা কেনাবেচাও এক ধরণের ব্যবহার। ইমাম খাত্তাবীর এ উক্তি বিভিন্ন হাদিস গ্রন্থের টীকাকারগণও উল্লেখ করেছেন যে, মৃত প্রাণীর গোশত নিজের পালিত কুকুরকে খাওয়ানো যায় এবং এটাও এক ধরণের বৈধ ব্যবহার। কোনো কোনো হাদিসে শিকার ধরা কিংবা পাহারার কাজের জন্য কুকুর পোষা ও বিক্রি করা জায়েয বলা হয়েছে। অথচ কুকুরের গোশত হারাম ও অপবিত্র। অনুরূপভাবে পালিত গাধা ও খচ্চর হারাম। তাই বলে এ দুটি প্রাণীকে ব্যবহার করা ও ক্রয় বিক্রয় করা কি হারাম? আপনি এবং ইমাম শওকানী যদি এটাকেও হারাম মনে করেন, তবে আমি এর উপরও এই আপত্তি তুলতে পারি যে, ইমাম শওকানী যেমন এই আলোচনা প্রসঙ্গেই লিখেছেন : "ইমাম মালেকের প্রসিদ্ধ মত এই যে, শূকর পবিত্র।" এটা কোনো চলনসই মাযহাবের ভিত্তি হতে পারেনা, এ কথাটাও তদ্রুপ। ইমাম শওকানী আরো লিখেছেন যে, অর্থাৎ কিনা তিনিও মনে করেন, উপযুক্ত দলিল (সহীহ হাদিস) এর ভিত্তিতে পাকানো চামড়া ব্যবহার করা জায়েয। এরপর আপনি কি চান যে, প্রত্যেকে নিজের জানোয়ারের চামড়া নিজেই পাকিয়ে নিক এবং নিজেই ব্যবহার করুক, আর ব্যবহার করতে না পারলে অন্যকে বিনামূল্যে দিয়ে দিক? আমার মতে, এটা একটা অকার্যোপযোগী এবং অবিবেচিত মত এবং এটা শরিয়তের উদ্দেশ্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।

মৃত জন্তুর সকল অংশ ও তার ব্যবহার হারাম হওয়ার ব্যাপারে ইজমা রয়েছে। এ কথাও সঠিক নয়। ইজমা তো দূরে থাক, কোনো কোনো অংশের ব্যবহার হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। আবু দাউদের 'হাতির দাঁত ব্যবহার'  শীর্ষক হাদিস থেকে জানা যায় যে, স্বয়ং রসূল সা. হযরত ফাতিমার জন্য হাতির দাঁতের তৈরি সামগ্রি ক্রয়ের ব্যবস্থা করেছেন। বুখারিতে ইমাম যুহরীর উক্তি উদ্ধৃত হয়েছে যে, "আমি প্রাচীন মনীষীদের অনেককে হাতি ও অন্যান্য মৃত প্রাণীর দাঁতের তৈরি চিরুনী ব্যবহার করতে দেখেছি।" অনুরূপভাবে দেহের চুল, শিং, ক্ষুর ইত্যাকার অংশ, যাতে রক্ত সঞ্চলিত হয়না এবং জীবনের লক্ষণ অনুপস্থিত থাকে, তা মৃত প্রাণীর হলেও অধিকাংশ ফেকাহ শাস্ত্রকারের মতে তা ব্যবহার করা জায়েয।

এবার মৃত প্রাণীর চর্বির প্রসঙ্গে আসা যাক। রসূল মা.-এর সুস্পষ্ট উক্তির আলোকে এটা নি:সন্দেহে অপবিত্র ও হারাম। কিন্তু চামড়াকে চর্বির পর্যায়ে ফেলাও আমার মতে সঠিক নয়। বিশেষত যখন চামড়ার বিধান পৃথক হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে। হযরত জাবির বর্ণিত হাদিসে সাহাবায়ে কেরাম বিশেষভাবে চর্বি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কিন্তু চামড়ার কথা জিজ্ঞেস করেননি। কাজেই আমার জ্ঞানমতে ঐ হাদিস থেকে চামড়া সম্পর্কে কোনো বিধান জানা যায়না। তাছাড়া মৃত প্রাণীর চর্বির যে ধরণ এ হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে, তার সবই এমন যে, তার তৈলাক্ততা শরীর বা কাপড়ে লেগে যাওয়ার প্রবল আশংকা রয়েছে। এ কথা বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন হয়না যে, প্রদীপে, নৌকায় বা চামড়ায় চর্বি ব্যবহৃত হলে যখনই ঐ সব জিনিসে হাত বা কাপড়ের ছোঁয়া লাগবে, অমনি তা অপবিত্র হয়ে যাবে। অনিবার্য প্রয়োজনে অপবিত্র জিনিসের এমন ব্যহ্যিক ব্যবহার যদি সম্ভব হয়, যাতে এ ধরণের লেগে যাওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি না হয়, তা হলে আমার ধারণা মতে  তা এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়েনা। [তরজমানুল কুরআন, এপ্রিল ১৯৭৭]



সর্বশেষ আপডেট ( Friday, 04 March 2011 )