 |
|
 |
আমাদের টাইপ করা বইগুলোতে বানান ভুল রয়ে গিয়েছে প্রচুর। আমরা ভুলগুলো ঠিক
করার চেষ্টা করছি ক্রমাগত। ভুল শুধরানো এবং টাইপ সেটিং জড়িত কাজে সহায়তা
করতে যোগাযোগ করুন আমাদের সাথে।
রাসায়েল ও মাসায়েল ৬ষ্ঠ খন্ড |
|
|
লিখেছেন সাইয়্যেদ আবুল আ'লা মওদূদী
|
Monday, 28 February 2011 |
পাতা 40 মোট 74
<h1>৩৮। মৃত প্রাণীর চামড়া সম্পর্কে আরো আলোচনা</h1>
প্রশ্ন : তরজমানুল কুরআনের এপ্রিল ১৯৭৭ সংখ্যায় মৃত প্রাণীর চামড়া সম্পর্কে আপনার আলোচনা পড়েছি। এ দ্বারা শুধু এতোটুকু কথা স্পষ্ট হলো যে, এ ধরণের চামড়া যতোক্ষণ পাকানো না হয়, ততোক্ষণ তার পবিত্রতা ও ক্রয় বিক্রয়ের ব্যাপারটা বিতর্কিত। তাই অস্বীকার করা যাবেনা যে, মতভেদের গণ্ডি এড়িয়ে চলার খাতিরে অপাকানো চামড়ার ক্রয়বিক্রয় থেকে বিরত থাকাই সতর্কতমূলক ব্যবস্থা। আপনার অবশ্যই জানা থাকার কথা যে, মৃত প্রাণীর অপাকানো চামড়ার ব্যবহার ও ক্রয়বিক্রয় নিষিদ্ধ হওয়া হানাফি ফেকাহবিদদের সর্বসম্মত অভিমত। উদাহরণস্বরূপ হেদায়ার ক্রয়বিক্রয় সংক্রান্ত অধ্যায়ে বলা হয়েছে :
----------------------------------------
"পাকানোর আগে মৃত পশুর চামড়া বিক্রি করা জায়েয নেই।"
কিন্তু আপনি হানাফি মাযহাবের মতামত উল্লেখই করেননি। আপনি যদি তার সাথে একমত না হন, তথাপি এই মাযহাবের মতামতকে একেবারে উপেক্ষা করা ঠিক নয়। কেননা আমাদের দেশে বেশিরভাগ মানুষ এই মতের অনুসারী। আপনি যদি হানাফি মাযহাবের মতামতের বিরোধী হন এবং আপনার দৃষ্টিতে ইমাম বুখারি বা ইমাম ইবনে শিহাব যুহরীর মতটাই বলিষ্ঠতর হয়ে থাকে, তবে আপনি সেইমত গ্রহণ করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে উদার ও প্রশস্ত দৃষ্টিভঙ্গি থাকা সম্ভব। তবে হানাফি মাযহাবের উল্লেখ অবশ্যই করা উচিত, যাতে কেউ এই মতের অনুসারী হতে চাইলে সে যেনো নিছক অজ্ঞতা বা ভুল বুঝাবুঝির কারণে তা পরিত্যাগ না করে।
স্বীকার করি, হানাফি মাযহাবেও যদি ফতোয়ার পরিবর্তন এসে থাকে কিংবা বিবিধ মতামত থেকে থাকে, তাহলে আর বিভ্রাটের কিছু থাকেনা। তবে আমার জানামতে এমন কিছু হয়নি। আপনার হয়তো মনে আছে, ১৯৭৪ সালের জুন সংখ্যা তরজমানে আপনি একটি প্রশ্নের জবাবে কুরআন শিক্ষা দান ও ইসলামি সেবামূলক তৎপরতার জন্য পারিশ্রমিক গ্রহণ করা জায়েয কিনা তা নিয়ে ব্যাপক আলোচনার পর এটাকে জায়েয বলে রায় দিয়েছিলেন। কিন্তু জনৈক আলেম আপত্তি জানিয়ে আপনাকে জাসসাস-এর আহকামুল কুরআনের বরাত দিয়ে লিখেছিলেন, এরূপ পারিশ্রমিক অবৈধ। আপনি এর জবাবে বহুসংখ্যক আধুনিক হানাফি আলেমদের মতামত উল্লেখ করে সেপ্টেম্বর ১৯৭৪-এর তরজমানে পুনরায় বিস্তারিত আলোচনার মাধ্যমে প্রমাণ করে দিয়েছিলেন যে, বর্তমানে হানাফি মাযহাবের ফতোয়া বদলে গেছে। তাই কেউ যদি উপযুক্ত পারিশ্রমিক নিতে চায়, তবে নিতে পারে। অন্যান্য ইমামগণ তো এটা আগে থেকেই জায়েয মনে করেন। এমন পরিস্থিতি যদি এ ক্ষেত্রেও দেখা দিয়ে থাকে বা যে পরিস্থিতিই হোক, যদি ভালো মনে করেন, তবে এ বিষয়ে এই দৃষ্টিকোণ থেকে পুনরায় আলোকপাত করবেন এবং জানাবেন যে, এ ব্যাপারে হানাফিদের মতামত কি এবং তার সাথে আপনি কতখানি মতৈক্য বা দ্বিমত পোষণ করেন?
জবাব : আমার জানা আছে যে, জবাই ছাড়া মৃত জন্তুর অপাকানো চামড়া বিক্রি করা না জায়েয- এটাই হানাফি ফকীহগণের ফতোয়া। হেদায়ার উক্তি এবং এ ধরণের অন্যান্য মতামত আমার অজানা নয়। আমার আলোচনায় ঐসব উক্তি ও মতামত অকারণে বাদ দেইনি। হানাফিদের এই ফতোয়ার কোনো পরিবর্তনও হয়নি। কিন্তু হানাফিগণ যখন চামড়ার পবিত্রতা ও অপবিত্র এবং তার ক্রয়বিক্রয় সম্পর্কে আলোচনা করেন, তখন তাঁরা মৃত জন্তুর চামড়ার বিক্রি এবং তার ব্যবহারের জন্য যে 'দাবাগত' এ পাকানোর শর্ত আরোপ করেন, সেটা প্রশ্নোক্তরের বেলায় প্রশ্নকর্তার ও আমার দৃষ্টি এই শেষোক্ত ধরণের পাকানোর উপরই নিষিদ্ধ ছিলো। প্রচলিত ও সুবিদিত আভিধানিক অর্থে চামড়া পাকানো বলতে যা বুঝানো হয় তা এই যে, প্রথমে চামড়াকে শুকানো হয় এবং পচাগলা থেকে রক্ষা করা হয়। তারপর তার দুর্গদ্ধ ও অন্যান্য আবীলতা দূর করা হয় এবং রাসায়নিক বা উদ্ভিজ্য দ্রব্যাদি দ্বারা তাকে নরম করে ও পোক্ত করে ভিন্নরূপে রূপান্তরিত করা হয়। হানাফিদের মতে এ সবের পরিবর্তে যদি মৃত জন্তুর চামড়াকে রোদে শুকিয়ে আর্দ্রতা দূর করা হয় এবং শুধুমাত্র রোদে বা বাতাসে রেখে তাকে যথাসম্ভব গন্ধমুক্ত করা হয় তাহলে তা পবিত্র হয়ে যায় এবং এ ধরণের চামড়া বিক্রয়যোগ্য ও ব্যবহারোপযোগী হয়ে যায়। হানাফি গ্রন্থবলীর ক্রয়বিক্রয় সংক্রান্ত অধ্যায়গুলোতে অনেক সময় বিশদ বিবরণ থাকে না। কেননা গ্রন্থকার তার আগেই পবিত্রতা ও অপবিত্রতা সংক্রান্ত অধ্যায়ে এ বিষয়ে আলোচনা সম্পন্ন করে থাকেন। তাই যাবতীয় খুঁটিনাটি তথ্য জানার জন্য উভয় জায়গা অধ্যয়ন করা প্রয়োজন।
আপনিও হেদায়ার ক্রয়বিক্রয় সংক্রান্ত অধ্যায়ের বরাত তো দিয়েছেন কিন্তু পবিত্রতার অধ্যায় সম্ভবত পড়ে দেখেননি। পবিত্রতা সংক্রান্ত অধ্যায়ের 'কোন্ পানি দ্বারা অযু জায়েয' শীর্ষক অনুচ্ছেদের শেষের দিকে হেদায়া প্রণেতা বলেন :
"যে প্রক্রিয়া দ্বারা চামড়ার গন্ধ দূর হয় এবং তা পচাগলার হাত থেকে রক্ষা পায়, সেটাই দাবাগত বা চামড়ার পাকানো প্রক্রিয়া। চাই এ উদ্দেশ্য রোদে শুকানো দ্বারা অর্জিত হোক কিংবা মাটির নিচে চাপা দিয়ে রাখা দ্বারা হোক।"
কানযুদ দাকায়েকেও পবিত্রতার জন্য প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়াজাতকরণ বা পাকানো তথা দাবাগাতের এরূপ সংজ্ঞাই দেয়া হয়েছে। কুদূরীর ব্যাখ্যা 'আল্ জাওহারাতুন নাইয়েরা'তে এর অধিকতর বিস্তারিত বিবরণ নিম্নরূপ।
"চামড়া পাকানো দু'রকমের হয়ে থাকে। একটা হলো আসল পাকনো, যেমন ডালিম, বাবলা প্রভৃতি গাছের ছাল দিয়ে পাকানো। অপরটি হলো শুধু পবিত্রতার পর্যায়ে আনার জন্য পাকানো, মাটি বা রোদের সাহায্যে পাকানো।"
দ্বিতীয় প্রকারের পাকানো প্রক্রিয়া কেবল পবিত্রকরণের জন্য যথেষ্ট। এ সম্পর্কে কুদূরীর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে যে, এভাবে পাকানো চামড়া যদি পুনরায় পানিতে ভিজে যায়, তাহলে অনেকের মতে তা আবার অপবিত্র হয়ে যায়। আবার কারো কারো মতে তার পবিত্রতা বহাল থাকে। শেষোক্ত মতই অধিকতর প্রসিদ্ধ। চামড়া পাকানো বা প্রক্রিয়াজাতকরণের এই উভয় পন্থায় বিবরণ শরহে বেকায়া, মুনিয়াতুল মুসাল্লীর ব্যাখ্যা আশ শারহুল কবীর এবং অন্যান্য গ্রন্থেও রয়েছে। শুধুমাত্র পবিত্রতা অর্জনের লক্ষ্যে যে পাকানোর প্রক্রিয়া চলে, তার বিবরণ কবীরীতে এরূপ দেয়া হয়েছে :
"ওষুধ প্রয়োগ ছাড়াও চামড়া পচাগলা থেকে রক্ষা করা যেতে পারে এবং তার গন্ধ দূর হতে পারে। চামড়ার উপর মাটি দিয়ে বা মাটির নিচে চামড়া পুতে রেখে তার আর্দ্রতা দূর করলেই তা সম্ভব। রোদে বা বাতাসে রেখে আর্দ্রতা শুকানোর দ্বারাও এটা অর্জিত হতে পারে। আমাদের কাছে এ ধরনের চামড়া পাকানো গ্রহণযোগ্য।"
আমি আমার পূর্ববর্তী আলোচনায় চামড়া পাকানোর যে প্রক্রিয়ার কথা বলেছি, সেটা হলো আসল ও কারিগরি প্রক্রিয়া, যাকে প্রচলিত পরিভাষায় 'চামড়া পাকানো বা প্রক্রিয়াজাতকরণ' (আরবিতে দাবাগাত এবং ইংরেজিতে Tanning) বলা হয়। কিন্তু হানাফি ফকীহগণ যে দাবাগাতকে পবিত্রতা ও বিক্রির জন্য গ্রহণযোগ্য মনে করেন, তাতে মৃত প্রাণীর চামড়া বিক্রি করার আগে তাকে মাটি কিংবা লবণের সাহায্যে অথবা তা ছাড়াও যদি সম্ভব হয় দুর্গন্ধমুক্ত করতে হবে। এরপর তা নির্বিঘ্নে বেচাকেনা করা জায়েয। গোশত খাওয়া হালাল এমন জন্তু বিনা জবাইতে মারা গেলে তার চামড়া অপাকানো অবস্থায় বিক্রি করাকে যারা জায়েয মনে করেন, তাদের সম্পর্কে আমি শুধু এ কথাই বলবো যে, তাদের মতও ভিত্তিহীন ও গুরুত্বহীন নয়। তাদের কেউ কেউ যুক্তি দেখান যে, কুরআনে যেখানে মৃতপ্রাণী ইত্যাদিকে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে, সেখানে এই ঘোষণার সম্পর্ক শুধু খাওয়ার সাথে। খাওয়ার জিনিস কেবল গোশত এবং সেটাই শুধু হারাম। মৃতদেহের অন্যান্য অংশ, যার খাওয়ার সাথে কোনো সম্পর্ক নেই, বরং অন্যভাবে ব্যবহারযোগ্য, তা কাজে লাগানো হারাম নয়। স্বয়ং হানাফি ফকীহদের কেউ কেউ মৃত জন্তুর চুল, হাড় ও রগের ব্যবহার বৈধ বলে রায় দিয়েছেন। 'ফিসহুস সুন্নাহ' গ্রন্থের প্রথম খণ্ডের পবিত্রতা সংক্রান্ত অধ্যায়ে বলা হয়েছে :
"মৃত জন্তুর হাড়, শিং. চুল, পালক পবিত্র। কেননা পবিত্রতাই মূল অবস্থা। অপবিত্রতার পক্ষে কোনো প্রমাণ নেই।"
এরপর উক্ত গ্রন্থে একটি হাদিস উদ্ধৃত করা হয়েছে। দারুকুতনী ও ইবনে মুনযির বর্ণিতত এ হাদিসটি নিম্নরূপ :
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
"হযরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাসের পুত্র উবাইদুল্লাহ বর্ণনা করেন যে, রসূল সা. মৃত জন্তুর দেহের অংশগুলো থেকে কেবল তার গোশত হারাম করেছেন। চামড়া, চুল, পশমে (অর্থাৎ তার ব্যবহারে) কোনো দোষ নেই।"
এ হাদিসটি ইমাম ইবনে হুমামও ফাতহুল ক্বাদীরের পানি সংক্রান্ত অনুচ্ছেদের শেষ ভাগে উদ্ধৃত করেছেন এবং বলেছেন, এ হাদিসে কোনো খুঁত নেই এবং মানের দিক থেকে তা অন্ততপক্ষে মোটামুটি ভালো। [তরজমানুল কুরআন, মার্চ ১৯৭৮]
|
সর্বশেষ আপডেট ( Friday, 04 March 2011 )
|
|
|
|