রাসায়েল ও মাসায়েল ৬ষ্ঠ খন্ড |
|
|
লিখেছেন সাইয়্যেদ আবুল আ'লা মওদূদী
|
Monday, 28 February 2011 |
পাতা 5 মোট 74
<h1>৩। জীবজন্তুর উপর দয়া</h1>
প্রশ্ন : আমি পশু চিকিৎসা বিভাগের একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী এবং 'জীবজন্তুর প্রতি নিষ্ঠুরতা প্রতিরোধ' কার্যক্রমে নিবেদিত। ইসলামের সেই সব নির্দেশ ও হেদায়াত আমার প্রয়োজন, যা থেকে বুঝা যায় যে, জীব জানোয়ারের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন ও তাদের অধিকার সংরক্ষণ করা মানুষের কর্তব্য। কুরআনে এ বিষয়ে আভাস ইঙ্গিত তো রয়েছে। যেমন জীব জানোয়ারের কান ছিদ্র করাকে শয়তানি কুকর্ম বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তবে আমি আরো কিছু বিস্তারিত নির্দেশাবলী চাই। সম্ভবত হাদিসেও এ ধরনের নির্দেশ থাকতে পারে। তাই আমাকে সেই হাদিসগুলো জানাবেন। লন্ডনে এ উদ্দেশ্যে একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। আমার ইচ্ছে যে, আমি অন্তত সেখানে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে একটি নিবদ্ধ পেশ করি।
জবাব : জীবজন্তুর ব্যাপারে আপনার আগ্রহ ও সহানুভূতি ইসলামি শিক্ষার সাথে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে আপনি একটি নিবন্ধের মাধ্যমে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরার যে চেষ্টা চালাচ্ছেন, তাও অত্যন্ত মহৎ ও অভিনন্দনযোগ্য উদ্যোগ। এ বিষয়ে বহু হাদিস রয়েছে। স্বল্প অবকাশে বেশি সংখ্যক হাদিস যোগাড় করা ও উদ্ধৃত করা তো সহজ নয়। তথাপি আপাতত: হাদিসের অনুবাদ দিচ্ছি। এই সাথে সূত্রের উল্লেখ করা হলে। প্রয়োজন হলে আপনি মূল হাদিসগ্রন্থ থেকে আরবি হাদিসসমূহও পড়ে দেখতে পারেন:
১. রসূলুল্লাহ সা. বলেছেন যে, তোমরা যখন কোনো পশুর উপর সওয়ার হয়ে শস্য শ্যামল এলাকা দিয়ে যাও তখন উক্ত জানোয়ারকে সেখানকার ঘাসপাতা খেয়ে নিজের অধিকার আদায় করতে দাও। আর যখন ঘাস পানিহীন শুষ্ক জায়গায় উপনীত হও, তখন ঐ জায়গাটা তাড়াতাড়ি অতিক্রম করে যাও। (সহীহ মুসলিম, শাসন সংক্রান্ত অধ্যায়, জীবজন্তুর স্বার্থ ও অধিকার বিষয়ক বিধিসমূহ)।
২. একবার রসুলুল্লাহ সা. ভ্রমণরত ছিলেন। ঐ কাফেলায় এক মহিলাও একটি উষ্ট্রীর আরোহিনী ছিলো। এক জায়গায় উষ্ট্রীটি লাফালাফি করলে মহিলা তাকে অভিসম্পাত দিতে লাগলো। রসূলুল্লাহ সা. তাকে বললেন : তুমি ওর পিঠের উপর থেকে নেমে যাও এবং নিজের জিনিসপত্রও নামিয়ে নাও। কারণ তুমি ওকে অভিশাপ দিয়েছো। (সহীহ মুসলিম, সৌজন্য ও সদাচার সংক্রান্ত অধ্যায়, জীবজন্তুকে অভিসম্পাত করার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা)।
৩. রসূলুল্লাহ সা. বলেন : এক পিপাসার্ত পথচারি একটি কূয়ায় নেমে পানি পান করলো। বেরিয়ে যাওয়ার সময় দেখলো একটি কুকুর ছটফট করছে এবং পিপাসার চোটে কাদা মাটি খাচ্ছে। লোকটি মনে মনে বললো, আমার যে দুর্গতি হয়েছিল এই কুকুরটার তো তাই হয়েছে। তাই সে নিজের জুতায় করে কূয়া থেকে পানি এনে কুকুরকে খাওয়ালো। আল্লাহ তার এই কাজটিকে কবুল করে নিলেন এবং তার গুনাহ মাফ করে দিলেন। সাহাবিগণ বললেন : হে রসূল! জীবজন্তুর উপকার করলেও কি সওয়াব হয়? তিনি বললেন : হৃদপিণ্ড ও কলিজার আর্দ্রতার অধিকারি যে কোনো জীবন্ত সৃষ্টির উপকার করলে সওয়াব পাওয়া যায়। (বুখারি, পান সংক্রান্ত অধ্যায়, পানি পান করনোর ফজিলত)।
৪. একবার স্বপ্নে রসূলু্ল্লাহ সা. এমন এক মহিলাকে দেখতে পান, যাকে একটি বিড়াল আপন নখর দিয়ে আঁচড়াচ্ছিলো। তিনি জিজ্ঞেস করলেন: এই মহিলার কি হয়েছে? তাঁকে জানানো হলো যে, সে ঐ বিড়ালকে বেঁধে রেখেছিলো। ফলে সে ক্ষুধায় মারা গিয়েছিলো। (বুখারি, পান সংক্রান্ত অধ্যায়, পানি পান করনোর ফজিলত )।
৫. একবার কোথাও যাওয়ার সময় রসূলুল্লাহ সা. একটি উটকে দেখলেন, (অনাহারের দরুন) তার পেট ও পিঠ এক সাথে লেগে গেছে। তিনি (সমবেত লোকদেরকে) বললেন : এই অবলা প্রাণীদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় কর। সুস্থ অবস্থায় তাদের উপর আরোহন করো এবং সুস্থ অবস্থায় রেখেই তাদের উপর থেকে নেমে যেও। (আবু দাউদ, জিহাদ সংক্রান্ত অধ্যায়, জন্তুর পিঠে আরোহণকালে যা যা করণীয়)।
৬. একবার রসূলুল্লাহ সা. আনসারদের এক বাগানে প্রবেশ করলেন। সেখানে একটা উট ছিলো। রসূলুল্লাহ সা.-কে দেখে উটটি একটি আক্ষেপসূচক ধ্বনি তুললো এবং তার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। তিনি উটের কাছে গিয়ে তার ঘাড়ে হাত বুলিয়ে দিলেন এবং 'এই উটের মালিক কে, এই উটের মালিক কে বলে, এই উটের মালিক কে' বলে হাকডাক করলেন।
জনৈক আনসার যুবক হাজির হয়ে বললো! 'হে রসূল! এটা আমার।' তিনি বললেন: "এই যে চতুষ্পদ জন্তুগুলো তোমাদের মালিকানায় দেয়া হয়েছে, এদের ব্যাপারে কি তোমরা আল্লাহকে ভয় করোনা? এই জন্তুটি তো আমার কাছে ফরিয়াদ জানাচ্ছে যে, তুমি তাকে ভুখা রাখ এবং কঠোর খাটনি খাটাও।" (আবু দাউদ, উপরোক্ত অধ্যায়)।
৭. রসূলুল্লাহ সা. জীবজন্তুর লড়াই অনুষ্ঠান নিষিদ্ধ করেছেন।
৮. রসূলুল্লাহ সা. একবার পথিপার্শ্বে একটা গাধা দেখলেন, যার মুখমণ্ডলে চিহ্ন খোদিত করা হয়েছে। তিনি বললেন : জানোয়ারের মুখ খোদাইকারি ও মুখে প্রহারকারিকে যে আমি অভিশাপ দিয়েছি, তা তোমরা জান না? (আবু দাউদ, ঐ)।
৯. রসূলুল্লাহ সা. বলেছেন : সাবধান, জীবজন্তুর পিঠকে যাবতীয় কাজকর্মের আখড়া বানিও না। আল্লাহ যে এগুলোকে তোমাদের বশীভূত করেছেন, সেটা শুধু এই উদ্দেশ্যে যে, তোমরা যেনো তোমাদের সেই সব গন্তব্যস্থলে যেতে পারো যেখানে বিনা যানবাহনে পৌঁছাতে তোমাদের ভীষণ কষ্ট হয়। আল্লাহ তায়ালা তোমাদের জন্য যমিন বানিয়েছেন। তোমাদের অন্যান্য কাজ সেই যমিনের উপর বসে সম্পন্ন করো। (আবু দাউদ, ঐ)।
১০. রসূলুল্লাহ সা. পিঁপড়ে ও মৌমাছিকে হত্যা করেত নিষেধ করেছেন। (মুসনদে আহমদ, প্রথম খণ্ড পৃ. ৩৪৭)।
১১. একবার রসূলুল্লাহ সা. সফরে এক জায়গায় যাত্রাবিরতি করেন। জনৈক সাহাবি জঙ্গলে গিয়ে সেখান থেকে একটি পাখির ডিম নিয়ে এলেন। পাখিটি এসে রসূলুল্লাহ সা. ও ঐ সাহাবির মাথার উপর উড়তে ও পাখা ঝাপটাতে লাগলো। তিনি বললেন : তোমরা কেউ ওকে কষ্ট দিয়েছো নাকি? সাহাবি বললেন : আমি ওর ডিম নিয়ে এসেছি। রসূলুল্লাহ সা. বললেন : যাও, ফিরিয়ে দিয়ে এসো। (মুসনদে আহমদ, প্রথম খণ্ড, পৃ. ৪০৪)।
১২. একবার রসূলুল্লাহ সা. এক পিঁপড়ের ঢিবির কাছ দিয়ে যাচ্ছিলেন। ঢিবিটা জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিল। তিনি বললেন : "কাউকে এমন শাস্তি দেয়া কোনো মানুষের পক্ষে বৈধ নয়, যে শাস্তি দেয়ার অধিকার একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট।" (মুসনদে আহমদ, প্রথম খণ্ড, পৃ. ৪২৩) [তরজমানুল কুরআন, জুন ১৯৫৫]
|
সর্বশেষ আপডেট ( Friday, 04 March 2011 )
|