আমাদের টাইপ করা বইগুলোতে বানান ভুল রয়ে গিয়েছে প্রচুর। আমরা ভুলগুলো ঠিক করার চেষ্টা করছি ক্রমাগত। ভুল শুধরানো এবং টাইপ সেটিং জড়িত কাজে সহায়তা করতে যোগাযোগ করুন আমাদের সাথে।
রাসায়েল ও মাসায়েল ৬ষ্ঠ খন্ড প্রিন্ট কর ইমেল
লিখেছেন সাইয়্যেদ আবুল আ'লা মওদূদী   
Monday, 28 February 2011
আর্টিকেল সূচি
রাসায়েল ও মাসায়েল ৬ষ্ঠ খন্ড
গ্রন্থকার পরিচিতি
১। আল্লাহর অস্তিত্ব সম্পর্কে সংশয় নিরসন
২। আল্লাহ ও তাঁর রসুলগণের মধ্যে পার্থক্য করা
৩। জীবজন্তুর উপর দয়া
৪। পাঁচ ওয়াক্ত ও পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায
৫। হানাফি মাযহাবে কি কিছু কিছু মাদক দ্রব্য হালাল?
৬। আদালতের রায় কি শুধু জাহেরীভাবেই কার্যকর, নাকি বাতেনীভাবেও কার্যকর?
৭। সুন্নাহর আইনগত মর্যাদা
৮। সাহরির শেষ সময় কোনটি?
৯। একটি হাদিস থেকে সুদের বৈধতা প্রমাণের অপচেষ্টা
১০। মুসলিম উম্মাহর বহু গোষ্ঠিতে বিভক্তি এবং মুক্তি লাভকারি গোষ্ঠি
১১। কালো খেজাব লাগানো কি বৈধ?-১
১২। কালো খেজাব কি বৈধ?-২
১৩। তাকদীর প্রসঙ্গ
১৪। গোমরাহী ও হেদায়েত
১৫। সূরা আন নাজমের প্রাথমিক আয়াত কয়টির ব্যাখ্যা
১৬। যাকাতকে প্রচলিত করের সাথে যুক্ত করা যায় না
১৭। পিতামাতার অধিকার
১৮। লোহার আংটি পরা কি জায়েয?
১৯। উশর ও খারাজের কয়েকটি সমস্যা
২০। উশরযোগ্য ফল ফসল কি কি?
২১। মোজার উপর মসেহ করার বিধান
২২। কারো সম্মানে দাঁড়ানো কি জায়েয?
২৩। 'প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ দান করা' সংক্রান্ত কুরআনের আদেশের ব্যাখ্যা
২৪। অপ্রাপ্ত বয়স্ক সন্তানদের ভরণ পোষণ প্রসঙ্গে
২৫। কবর আযাব
২৬। কুরআন শিক্ষাদান ও অন্যান্য ধর্মীয় কাজের পারিশ্রমিক নেয়া কি বৈধ?
২৭। ইসলামের ফৌজদারী দণ্ডবিধি সংক্রান্ত কিছু ব্যাখ্যা
২৮। বেতের নামাযে দোয়া কুনূত
২৯। লাইসেন্স ক্রয় বিক্রয়
৩০। কিবলার দিক নির্ণয়ের শরিয়তসম্মত বনাম বিজ্ঞানসম্মত পন্থা
৩১। মৃত ব্যক্তির জন্য ফিদিয়া দান, শোক ও কুরআন খতম
৩২। কয়েদি সৈন্যরা কি নামায কসর করবে
৩৩। পবিত্র কুরআন ও গুপ্ত ওহি
৩৪। ব্যভিচারের অপবাদ
৩৫। কোন কোন প্রাণী হালাল বা হারাম
৩৬। কুরবানীর চামড়া সম্পর্কে শরিয়তের বিধান
৩৭। মৃত ব্যক্তির চামড়া সম্পর্কে শরিয়তের বিধান
৩৮। মৃত প্রাণীর চামড়া সম্পর্কে আরো আলোচনা
৩৯। জবাই হালাল হওয়ার জন্য কি বিস্
৪০। যাকাত সংক্রান্ত কিছু খোলামেলা কথা
৪১। নগদ পুঁজির যাকাত ও তার নিসাব
৪২। বাইয়ে সালাম
৪৩। হযরত আলী রা.-এর জন্য সূর্যকে ফিরিয়ে দেয়ার ঘটনা কি সত্য?
৪৪। কুরাইশের ১২ জন খলিফা ও 'ফিতনায়ে আহলাস'
৪৫। আল্লাহ ও রসূলের কোনো উক্তি কি মানুষকে কর্মবিমুখ করতে পারে?
৪৬। আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয় করা সত্ত্বেও দৈন্যদশার কারণ কি?
৪৭। হযরত আলী রা.-এর বর্ম চুরি-১
৪৮। হযরত আলী রা.-এর বর্ম চুরি-২
৪৯। ইসলামের দৃষ্টিতে গানবাজনা ও নারী পুরুষের মেলামেশা
৫০। আব্দুল্লাহ বিন উবাইর জানাযা
৫১। ইমাম ইবনে তাবারি কি শিয়া ছিলেন?
৫২। ফৌজদারি অপরাধের ক্ষেত্রে আপোস নিষ্পত্তির অধিকার
৫৩। ইসলামের উত্তরাধিকার আইন সম্পর্কে অভিযোগ
৫৪। শরিয়তের দৃষ্টিতে ওয়াকফের সংজ্ঞা ও বিধান
৫৫। আত্মহননকারীর জানাযা নামায
৫৬। হারুত মারুত ফেরেশতাদ্বয় সম্পর্কে এক ভিত্তিহীন অলীক কাহিনী
৫৭। 'চাটান' সম্পাদকের নিকট দুটো চিঠি
৫৮। হাদিস অস্বীকার করা ও স্বীকার করা
৫৯। হাদিস বিরোধী গোষ্ঠির বিভ্রান্তিকর প্রচারণা
৬০। একটি হাদিস সম্পর্কে আপত্তি ও তার জবাব
৬১। সন্তান পালনে নারীর অধিকার
৬২। স্তনের দুধ পানে বিয়ে হারাম হওয়া
৬৩। পারিবারিক আইন ও অর্পিত তালাক
৬৪। ফাসিদ বিয়ে ও বাতিল বিয়ে
৬৫। রসূল সা. কি হযরত সওদা রা. কে তালাক দিতে চেয়েছিলেন?
৬৬। উম্মুল মুমিনীন হযরত সওদার বিয়ে সম্পর্কে আরো আলোচনা
৬৭। কতোখানি দুধ পান করলে বিয়ে হারাম হয়?
৬৮। পিতামাতার আদেশে স্ত্রী তালাক দেয়া যায় কি?
৬৯। রসুল সা.-এর একাধিক বিয়ের যৌক্তিকতা ও সার্থকতা
৭০। বেলুচিস্তানের বাগদান প্রথা
৭১। লটারি ও নির্বাচনী লটারি
৭২। সমবায় সমিতি

<h1>৪০। যাকাত সংক্রান্ত কিছু খোলামেলা কথা</h1>
[ à§§ ]
প্রশ্ন : জামায়াতে ইসলামির বাইতুলমালের মাধ্যমে যাকাত সংগ্রহ ও বন্টন নিয়ে বিভিন্ন সময় আপত্তি তোলা হয়। প্রথমটি হলো, যাকাতের অর্থ সাংগঠনিক তৎপরতার পেছনে ব্যয় করা হয় এবং যেসব কর্মীর উপর যাকাত প্রদান ফরয, তাদেরও বেতনভাতা ইত্যাদি এই খাত থেকে দেয়া হয়। অথচ এটা যাকাত ব্যয়ের বিধিসম্মত খাত নয়। দ্বিতীয় আপত্তি এই যে, যাকাত প্রদানের বিশুদ্ধতার জন্য 'তামলীক' অপরিহার্য শর্ত। এর অর্থ হলো, যাকাত প্রদানকারী কোনো হকদার ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গকে যতোক্ষণ যাকাতের অর্থের সার্বিক মালিকানা ও অবাধ অধিকার না দেয়, ততোক্ষণ সঠিক অর্থে যাকাত দেয়াই হয়না। যেহেতু জামায়াতের বাইতুলমালে যাকাত দেয়ার সময় কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে যাকাত দেয়া হয়না, তাই এটা যাকাত প্রদানের কোনো সঠিক পদ্ধতি নয়। এই আপত্তিগুলোর স্বরূপ উন্মোচন করলে ভালো হয় যে, এগুলো ঠিক কিনা। তামলীকের ব্যাপারটা বিশ্লেষণের পাশাপাশি সাংগঠনিক কাজে যাকাতের অর্থ ব্যয় করা যায় কিনা তাও অবহিত করবেন।

জবাব : কুরআনের আলোকে যারা হকদার, তারা হলো : (১) ফকির (২) মিসকিন (৩) যাকাত কর্মী (৪) যাদের অন্তর আকৃষ্ট করা প্রয়োজন (৫) মুক্তিকামি দাস ও কয়েদি (৬) আকস্মিক ঋণ ও আর্থিক ক্ষয়ক্ষতিগ্রস্ত (৭) আল্লাহর পথে এবং (৮) পথিক। জামায়াতের বাইতুলমালে যাকতের যে অর্থ সংগৃহিত হয়, তা থেকে দরিদ্র, অতিদরিদ্র ও ঋণগ্রস্ত খাতের আওতায় সাধারণ দুস্থ মুসলমানদেরকেও যাকাত দেয়া হয়। আবার ফী সাবিলিল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহর পথের খাত থেকে জামায়াতের বিভিন্ন খাতেও ব্যয় করা হয়। 'আল্লাহর পথে' বলতে সাধারণত আল্লাহর পথে যুদ্ধ সরঞ্জাম সরবরাহ করার জন্য এই খাত থেকে যাকাত দেয়া উচিত। কিন্তু কুরআন, হাদিস, সাহাবায়ে কেরামের উক্তি ও বাস্তব দৃষ্টান্ত এবং ইমামদের মতামত গভীরভাবে অধ্যয়ন করলে এ কথা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, 'আল্লাহর পথ' কথাটা সাধারণভাবে যতোটা সংকীর্ণ ও সীমিত অর্থে গ্রহণ করা হয়, আসলে তা ততোটা সংকীর্ণ ও সীমিত নয়।

কুরআনে 'আল্লাহর পথ' খাতটি বর্ণনা করার সময় যুদ্ধের শর্ত আরোপ করা হয়নি। অথচ এই বিষয়টি ব্যক্ত করার জন্য অন্যান্য স্থানে সাধারণভাবে 'জিহাদ ফী সাবিলিল্লাহ' প্রভৃতি শব্দ উল্লেখিত হয়েছে। অপরদিকে পবিত্র কুরআনে যেখানে শুধু ফী সাবীলিল্লাহ শব্দটি এসেছে, সেখানে জিহাদের অর্থ ব্যাপক রাখা হয়েছে এবং এটিকে ঢালাওভাবে যুদ্ধের অর্থে ব্যবহার করা হয়নি। অনুরূপভাবে যুদ্ধ ছাড়া আল্লাহর আনুগত্যজনিত এমন বহু কাজ রয়েছে, যাকে 'ফী সাবীলিল্লাহ' (আল্লাহর পথে) শব্দ দ্বারা বিশ্লেষিত করা হয়েছে। যে হাদিসটি দ্বারা বিশেষভাবে যুক্তি প্রদর্শন করা হয় যে, ফী সাবিলিল্লাহ (আল্লাহর পথে) দ্বারা আল্লাহর পথে যুদ্ধ বুঝানো হয়েছে সে হাদিসটি আবু দাউদ, আহমদ এবং হাকেমে বর্ণিত হয়েছে। হাদিসটি এই :
---------------------------------------------------------------------------------
"কোনো ধনীর পক্ষে সাদকা গ্রহণ করা জায়েয নয়। তবে সে যদি আল্লাহর পথের যোদ্ধা হয় কিংবা সদকা সংক্রান্ত কাজে নিয়োজিত থাকে অথবা ঋণগ্রস্ত হয় তাহলে জায়েয আছে।"

নি:সন্দেহে এ হাদিস দ্বারা আল্লাহর পথে যুদ্ধরত ধনী ব্যক্তিকে যাকাত দেয়া জায়েয প্রমাণিত হয়। কিন্তু এ কথা প্রমাণিত হয়না যে, ফী সাবীলিল্লাহ খাত থেকে শুধুমাত্র সশস্ত্র যোদ্ধাই অংশ পাবে। অন্যান্য হাদিস থেকে জানা যায়, রসূল সা. এই খাতের আওতায় হাজীদেরকে যাকাতের উট ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছেন। এ কারণে হানাফি ফকীহগণের মধ্য থেকে ইমাম মুহাম্মদ, ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম হাসান 'ফী সাবীলিল্লাহ'র খাতের আওতায় হাজিদের যাতায়াত ব্যয় নির্বাহ করা জায়েয বলে রায় দিয়েছেন। শামী দ্বিতীয় খণ্ডের ২৫ পৃষ্ঠায় ছাত্রদেরকেও 'ফী সাবীলিল্লাহ' খাতের আওতাভুক্ত গণ্য করা হয়েছে, চাই তারা 'সাহেবে নিসাব' হোকনা কেনো (অর্থাৎ তাদের উপর যাকাত ফরয হয়ে থাকনা কেনো।) হানাফি তাফসিরকার আল্লামা আলুসী স্বীয় তাফসির রুহুল মায়ানীতে 'ফী সাবীলিল্লাহ' এর তাফসির প্রসঙ্গে হানাফি মতামত তুলে ধরে বলেন :
"এ দ্বারা শিক্ষার্থীও বুঝানো হয়েছে। ফাতওয়ায়ে যহীরিয়াতে শুধুমাত্র ছাত্রদেরকেই বুঝানো হয়েছে। কিন্তু 'আল বাদায়ে ওয়াস সানায়ে' গ্রন্থে এরূপ ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে যে, আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায় এমন যাবতীয় কাজ এর অন্তর্ভুক্ত। কাজেই আল্লাহর আনুগত্য ও কল্যাণমূলক কাজে যে-ই তৎপর হবে, সে এর আওতাভুক্ত হবে।"

হানাফিগণ ছাড়া অন্যান্য মাযহাবের ফকীহগণও এই খাতকে যোদ্ধাদের মধ্যে সীমিত রাখেননা। তারা এর আওতা আরো ব্যাপক বলে মনে করেন। মালেকী মাযহাবের ইমাম ইবনে আরাবি স্বীয় গ্রন্থ 'আহকামুল কুরআনে' 'ফি সাবীলিল্লাহ' এর সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবে :
"ইমাম মালেক বলেছেন, আল্লাহর পথ অনেক। আহমাদ ও ইসহাস বলেন : আল্লাহর পথ দ্বারা হজ্জ বুঝানো হয়েছে। তবে আমার মতে তাদের বক্তব্যের প্রকৃত তাৎপর্য হলো, হজ্জ জিহাদের মতোই আল্লাহর পথগুলোর মধ্যে একটি পথ।"

উপমহাদেশের একাধিক আলেমও সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, ফী সাবীলিল্লাহ বলতে ইসলামের আওতাভুক্ত যাবতীয় তাত্ত্বীক ও বাস্তব তৎপরতা বুঝায়। সীরাতুন্নবী ৫ম খণ্ডে মাওলানা সাইয়েদ সুলায়মান নাদভী মরহুম বলেন :
অধিকাংশ ফকীহ ফী সাবীলিল্লাহ দ্বারা শুধু জিহাদ বুঝিয়েছেন। কিন্তু এই সংজ্ঞা সঠিক মনে হয়না। উপরে বর্ণিত আয়াত :
---------------------------------------------------------------------------------
"ফী সাবীলিল্লাহ অর্থ যে শুধু জিহাদ নয় সে ব্যাপারে সবাই একমত। বরঞ্চ এদ্বারা যে কোনো সৎ কাজ ও ইসলামের কাজ বুঝায়।"

বিহারের ইমারাতে শরিয়াহ'র নেতা মাওলানা আব্দুস সামাদ রহমানি স্বীয় গ্রন্থ 'কিতাবুল উশর ওয়ায্‌ যাকাত'-এ ইসলামি তৎপরতায় নিয়োজিত লোকদেরকে ফী সাবীলিল্লাহর আওতাভুক্ত করেছেন।

মাওলানা ইসলাহী ও মাওলানা আব্দুল গাফফার মাসানের পরামর্শক্রমে মাওলানা মওদূদী র. সরকারের এক প্রশ্নের জবাবে লিখেছিলেন যে :
"ফী সাবীলিল্লাহ অর্থ আল্লাহর পথে জিহাদ, চাই তা অস্ত্র দ্বারা হোক অথবা কলম,  মুখ বা হাত পায়ের শ্রম ও ছুটাছুটির মাধ্যমে হোক। প্রাচীন ইমামদের মতে এর দ্বারা শুধুমাত্র আল্লাহর দীনের প্রচার, প্রতিষ্ঠা ও ইসলামি দেশসমূহের প্রতিরক্ষার জন্য পরিচালিত চেষ্টা সাধনা ও তৎপরতা বুঝায়।"

জামায়াতে ইসলামির একমাত্র লক্ষ্য ইসলাম কায়েম করা। সংগঠনের ও তার কর্মীদের সকল তৎপরতা যাতে এই লক্ষ্য অর্জনে নিবেদিত থাকে সেজন্য জামায়াত সর্বাত্মক চেষ্টায় নিয়োজিত। দানশীল লোকদের নিশ্চিত হওয়া কর্তব্য, ইসলাম প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পরিচালিত জামায়াতে ইসলামির যাবতীয় তৎপরতা ফী সাবীলিল্লাহর আওতায় পড়ে কিনা? এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারলে তাদের যাকাত জামায়াতের বাইতুলমালে দিতে পারেন। আর এ ব্যাপারে নিশ্চিত  না হতে পারলে যেখানে খুশি সেখানে দিতে পারেন।

তামলীক অর্থাৎ মালিক বানিয়ে যাকাত দেয়ার ব্যাপারে যে আপত্তি তোলা হয় তার জবাব হলো, আমাদের মতে, কাউকে ব্যক্তিগতভাবে মালিক বানানো যাকাত দেয়ার জন্য অপরিহার্য শর্ত নয়। সাধারণত কুরআনে বর্ণিত ------------ শব্দটিতে 'লাম' রয়েছে, সেই 'লাম' কে মালিকানা ধরে নিয়ে মালিক বানিয়ে দেয়ার অপরিহার্য প্রমাণ করা হয়। কিন্তু প্রচলিত আরবি ভাষায় 'লাম' অক্ষরটি শুধুমাত্র মালিকানাসূচক অর্থেই ব্যবহৃত হয়না। বরং এটি কখনো কখনো মালিকানার পরিবর্তে নিছক ব্যবহারিক সুবিধা ভোগ করা বুঝাতেও ব্যবহৃত হয়। যেমন কুরআনের একটি আয়াতে বলা হয়েছে :
                            ---------------------------------------
"আল্লাহ পৃথিবীকে স্বীয় সৃষ্টির জন্য স্থাপন করেছেন।"

এখানে সৃষ্টিকে পৃথিবীর মালিকানা নয় বরং পৃথিবীর সুযোগ সুবিধা দেয়া বুঝাতে হয়েছে। তাছাড়া ব্যক্তিগতভাবে মালিক বানানো জরুরি শর্ত হিসেবে নিলেও সেটা কেবল সেই অবস্থায় সম্ভব ও প্রযোজ্য, যখন মুসলমানদের সমস্ত যাকাত আদায় করার যোগ্য কোনো সরকার বা সামষ্টিক সংগঠন বিদ্যমান না থাকে। কিন্তু একটি ইসলামি রাষ্ট্রের বাইতুলমালে যখন যাকাত শরিয়ত সম্মতভাবে ও ইস্পিত উপায়ে আদায় করা হয়, তখন সে ক্ষেত্রে ব্যক্তিগতভাবে মালিক বানিয়ে যাকাত দেয়ার প্রশ্নই উঠেনা। তাছাড়া সামষ্টিকভাবে যাকাত সংগ্রহ করার পর ইসলামি সরকার যদি তা এমন কোনো সামষ্টিক খাতে বিনিয়োগ করে, যার দ্বারা যাকাতের হকদাররা সামগ্রিকভাবে উপকৃত হয়, তবে সেটাও যাকাত বন্টনের একটা বৈধ পন্থা হবে। ইসলামি সরকার না থাকলে মুসলমানদের কোনো ইসলামি ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান যদি একই পন্থায় যাকাত আদায় ও বিলি বন্টনের ব্যবস্থা করে, তবে শরিয়তের আলোকে তাতেও কোনো রকম আপত্তি তোলার অবকাশ নেই।

এখানে উল্লেখযোগ্য যে, জামায়াতের ইসলামির ন্যায় আরো বহু সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান নিজেদের যাবতীয় প্রয়োজনে যাকাতের অর্থ জামায়াতের মতোই ব্যয় করে থাকে। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানের কোনো কোনোটি মনে করে, ব্যক্তিগতভাবে মালিক বানিয়ে দেয়া শর্ত। তাই এই শর্ত পূরণের জন্য যাকাত হস্তগত হওয়ার পর সেই প্রতিষ্ঠানের নি:স্ব ব্যক্তিগত হাতে সমর্পণ করা হয় এবং তৎক্ষণাৎ আবার তাদের কাছ থেকে ফেরত নিয়ে সামষ্টিক তহবিলে জমা করা হয়। আমরা মনে করি এ কৌশল একটা অনর্থক ও অনাবশ্যক প্রহসন আগে ভাগে স্থির করা থাকে এবং তা সম্পূর্ণরূপে প্রদর্শনীমূলক হয়ে থাকে। প্রকৃত ও স্থায়ীভাবে মালিক বানানোর উদ্দেশ্য কখনোই সক্রিয় থাকেনা।

প্রসঙ্গত আরো একটা কথা খোলামেলা বলে দেয়া জরুরি মনে হচ্ছে। আপনার প্রশ্ন থেকে মনে হয়, আপনি শুধু এমন ব্যক্তিকেই যাকাতের হকদার মনে করেন, যার উপর যাকাত ফরয নয়। আপনার এরূপ ধারণা থেকে থাকলে তা সঠিক নয়।

প্রথমত দু'টি খাত দরিদ্র ও অতি দরিদ্রের ক্ষেত্রে। এ শর্ত কিছুটা প্রযোজ্য বটে। কিন্তু অন্যান্য খাতে যদি এই শর্ত বাধ্যতামূলক আরোপ করা হয়, তাহলে বাদবাকী ছ'টি খাতকে আলাদাভাবে উল্লেখ করার অর্থই থাকেনা। কেননা যার উপর যাকাত দেয়া ফরয নয়, সে প্রথম দুই খাত দরিদ্র ও অতি দরিদ্রের আওতাভুক্ত হয়ে যাকাতের হকদার হয়েই যাবে। তার জন্য যাকাত পাওয়ার আর কোনো যোগ্যতা উল্লেখ করার বা নজরে রাখার তেমন কোনো আবশ্যকতাই থাকেনা। একাধিক কারণে কেউ যাকাতের হকদার হলে নি:সন্দেহে সে অধিকতর অগ্রাধিকার পাবে। কিন্তু দরিদ্র অতি দরিদ্র ছাড়া কুরআনে বর্ণিত অন্য কোনো খাতের আওতায় কেউ যাকাতের হকদার প্রমাণিত হলে সে ধনী হলেও এবং তার উপর যাকাত ফরয হলেও যাকাত নিতে পারবে। এ কথা একাধিক হাদিস থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত। এ ব্যাপারে একটি হাদিস ইতিপূর্বে উদ্ধৃত হয়েছে।

পরিশেষে আরো একটি বিষয় স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়া প্রয়োজন। সেটি হলো, যাকাত জামায়াতে ইসলামির বাইতুলমালের আয়ের একমাত্র উৎস নয়। জামায়াতের আয়ের একধিক উৎস রয়েছে। তন্মোধ্যে বই পুস্তক প্রকাশনার আয় রয়েছে সদস্য ও সহযোগি সদস্যদের মাসিক ও এককালীন সাহায্যও রয়েছে এবং দাতাদের দানও রয়েছে। তাই জামায়াতের ভাতাভোগি কর্মীরা যাকাত থেকেই ভাতা নিচ্ছে, অথবা জামায়াতের যাবতীয় কাজ যাকাতের অর্থের উপর নির্ভর করেই চলছে, এরূপ ধারণা করা ভুল। আল্লাহর মেহেরবানীতে এখন তো অবস্থা এরূপ যে, একাধিক বড় বড় শহরে জামায়াতের জনসেবা বিভাগ ও চিকিৎসালয় কর্মরত রয়েছে এবং বেশিরভাগ যাকাত ও সদকার অর্থ তাতেই ব্যয় হচ্ছে। বাইতুলমালে যাকাত জমা হলে তার যথারীতি পৃথক হিসাব সংরক্ষণ করা হয়। গরিব লোকদের সাহায্য কার্যক্রমে যা কিছু ব্যয় হয়  তার হিসাবও আলাদা রাখা হয়। জামায়াতের অন্যান্য ব্যয়ের খাত এতো বেশি যে, যাকাতের বাদবাকী সমুদয় অর্থও যদি তাতে ব্যয় হয়, তাহলেও তাতে তার ব্যয়ের একটা অংশমাত্র নির্বাহ হয়। কাজেই যাকাত তার যথাযথ খাতে ব্যয় হবেনা এরূপ আশংকার কোনো কারণই অবশিষ্ট থাকেনা। [তরজমানুল কুরআন, সেপ্টেম্বর ১৯৫৪]

[ ২ ]
প্রশ্ন : 'যাকাত সংক্রান্ত কিছু খোলামেলা কথা' এই শিরোনামে লেখা আপনার জবাব পড়েছি। আপনি যাকাতের উপর ব্যয়েল খাতসমূহ বর্ণনা করতে গিয়ে দু'খানা গ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়েছেন। উভয় উদ্ধৃতিতে আপনি কিছু শব্দ বাদ দিয়েছেন: 'রুহুল মায়নী'র উদ্ধৃতিতে 'ফকির' শব্দটি বাদ দিয়েছেন এবং 'বাদায়েউস সানায়ে' থেকে দেয়া উদ্ধৃতিতে 'মহুতাজ' শব্দটি বাদ দিয়েছেন। পুনরায় নজর বুলিয়ে শুধরে দেবেন।

জবাব : পত্রলেখকের পত্র থেকে মনোযোগ আকর্ষণের জন্য আমরা তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ। তবে তার এই অভিযোগ ভুল বুঝাবুঝি থেকে সৃষ্ট বলে মনে হয়। 'বাদায়েউস সানায়ে'র উদ্ধৃতি আমি আলাদাভাবে মূল কিতাব থেকে দেইনি। 'ফী সাবীলিল্লাহ' শব্দের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে রুহুল মায়ানী'র লেখক  যেসব উক্তি উদ্ধৃত করেছেন, আমি আলোচনার দীর্ঘসূত্রিতা এড়াতে সেগুলো থেকে  কয়েকটি তুলে দিয়েছিলাম। এসব উদ্ধৃতির মধ্যে একটি ছিলো বাদায়েউস সানায়ে থেকে নেয়া। আপনার পক্ষ থেকে মনোযোগ আকর্ষণ করার পর যখন মূল 'বাদায়ে' দেখলাম, তখন নিশ্চিত হলাম যে, সেখানে 'ফী সাবিলিল্লাহ' কথাটির সাথে ---------- (যেনো সে অভাবি ও পরমুখাপেক্ষী হয়) কথাটিও ছিলো। কিন্তু রুহুল মায়ানীতে এ কথাটি আনা হয়নি। এ জন্য আমার উদ্ধৃতিতেও কথাটি অন্তর্ভূক্ত হতে পারেনি। আমি ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো শব্দ বাদ দেয়া বা লুকানোর চেষ্টা করিনি। তবে আল বাহর, আননিহায়া ও আহকামুল কুরআন থেকে নেয়া উদ্ধৃতিগুলো আমি সংক্ষেপকরণের মানসে বাদ দিয়েছি। এসব উদ্ধৃতি না দেয়ার কারণ শুধু এই যে, যে স্থানে এগুলো উল্লেখ করা হচ্ছিলো, সেখানে মূল আলোচ্য বিষয় ছিলো, 'ফী সাবিলিল্লাহ'র অর্থ শুধু আল্লাহর পথে সশস্ত্র সংগ্রাম, না অন্যান্য সৎ কাজ  এবং কল্যাণমূলক কাজও তার অন্তর্ভুক্ত? তাই যেসব উদ্ধৃতি সরাসরি তার সাথে সম্পৃক্ত, তার মধ্য থেকে কয়েকটি তুলে দেয়া হয় এবং অন্যগুলো বাদ দেয়া হয়।

প্রসঙ্গত, আমি পত্র লেখককে আরো একটি কথা জানিয়ে দেয়া জরুরি মনে করছি। হানাফি ফকীহগণ  ফকির (দরিদ্র) ও মিসকিন (অতিশয় দরিদ্র) এই দুটি খাত ছাড়া যাকাতের অন্যান্য খাতের সাথেও ঢালাওভাবে দরিদ্র ও অভাবের যে শর্ত জুড়ে দিয়েছেন, তার অর্থ যদি এই মনে হয় যে,  কেউ 'ফী সাবিলিল্লাহ'র অধীন কোনো সৎ কাজ অথবা হজ্জ কিংবা জিহাদ ইত্যাদি করতে চাইলে তার যাকাতের হকদার হওয়ার জন্যও তার উপর যাকাত ফরয না হওয়া জরুরি, তাহলে আমরা এর সাথে একমত নই। এ কথা সত্য যে, হানাফি মতের কিতাবসমূহ পড়লে আপাত দৃষ্টিতে এরূপ ধারণা জন্মে যে, এ ব্যাপারে হানাফি ও শাফেয়ীদের মধ্যে কিছু মতভেদ রয়েছে। শাফেয়ীগণ 'আল্লাহর পথ' ও 'পথিক' ইত্যাদি খাত থেকে ধনী ব্যক্তিদেরকে যাকাত দেয়া জায়েয মনে করেন, আর হানাফিগণ অভাব ও দরিদ্রকে জরুরি শর্তরূপে গণ্য করেন। কিন্তু হানাফি ফকীহগণের মতামত গভীরভাবে অধ্যয়ন করলে স্পষ্টতই মনে হয় যে, যাকাতের হকদার হওয়ার জন্য যে ধরণের অস্বচ্ছলতা ও পরমুখাপেক্ষিতাকে তারা ফকির ও মিসকিন ছাড়া অন্যান্যদের বেলায়ও শর্তরূপে গণ্য করেন, সেই পরমুখাপেক্ষিতা অবিকল ফকির মিসকিনের মতো নয়। ফকির মিসকিনরা ঘরে বসেও পরমুখাপেক্ষী ও অভাবে জর্জরিত থাকে। কিন্তু অন্যরা কেবল 'আল্লাহর পথে' নেমেই অভাবে পড়ে ও পরমুখাপেক্ষী হয়ে যায়। কিন্তু সে ব্যক্তি যদি জিহাদে যেতে চায়, হজ্জে যেতে চায়, কিংবা আল্লাহর পথে বা সৎ কর্মশীলতার পথে চেষ্টাসাধন করতে চায়, তাহলে এসব কাজ সম্পন্ন করতে যেসব উপায় উপকরণ ও সাজ-সরঞ্জাম দরকার, তা হয়তো সে নিজে যোগাড় করতে পারেনা। এ ধরনের লোক এক হিসেবে সচ্ছল, আর এক হিসেবে পরমুখাপেক্ষী। এ কারণেই হানাফিগণ তাকে অভাবি আখ্যা দিয়ে যাকাতের উপযুক্ত মনে করেন। এদিক বিবেচনা করলে ফকীহদের মতভেদ নিছক শাব্দিক মতভেদ হিসেবে বহাল থাকে এবং হানাফি ও অন্যান্য ফকীহদের মধ্যে সত্যিকার কোনো মতভেদ অবশিষ্ট থাকেনা।

পুনরায় দীর্ঘসূত্রিতা আশংকা না থাকলে আহকামুল কুরআন থেকে এবং বিশেষভাবে বদায়েউস সানায়ে থেকে পুরো আলোচনা উদ্ধৃত করে দেখতাম যে, আমার উপরোক্ত বিশ্লেষণ উক্ত গ্রন্থদ্বয়ের আলোচনায় সমর্থিত হয়েছে। মোটকথা, আমি যে ব্যাখ্যা দিয়েছি, হানাফি মাযহাবে ফকির ও মিসকিন ছাড়া অন্যান্য খাতের সাথে পরমুখাপেক্ষিতার শর্ত আরোপ করা হয়েছে, তার সঠিক ব্যাখ্যা এটাই। এর অন্য কোনো ব্যাখ্যা যদি করা হয় তা নিম্নোক্ত হাদিসের বিরুদ্ধে যাবে :
                          ---------------------------------------------------
"কোনো ধনী ব্যক্তির জন্যে যাকাত গ্রহণ বৈধ নয়, তবে আল্লাহর পথের সৈনিক .......।" [তরজমানুল কুরআন, নভেম্বর ১৯৫৪]



সর্বশেষ আপডেট ( Friday, 04 March 2011 )