 |
|
 |
আমাদের টাইপ করা বইগুলোতে বানান ভুল রয়ে গিয়েছে প্রচুর। আমরা ভুলগুলো ঠিক
করার চেষ্টা করছি ক্রমাগত। ভুল শুধরানো এবং টাইপ সেটিং জড়িত কাজে সহায়তা
করতে যোগাযোগ করুন আমাদের সাথে।
রাসায়েল ও মাসায়েল ৬ষ্ঠ খন্ড |
|
|
লিখেছেন সাইয়্যেদ আবুল আ'লা মওদূদী
|
Monday, 28 February 2011 |
পাতা 43 মোট 74
<h1>৪১। নগদ পুঁজির যাকাত ও তার নিসাব</h1>
প্রশ্ন : যাকাত সম্পর্কে এবং বিশেষভাবে নগদ অর্থের যাকাত সম্পর্কে আমার মনে কিছু সন্দেহ সংশয় সৃষ্টি হয়েছে, যার কোনো সন্তোষজনক জবাব পাইনি। তাই সেগুলো নিরসনের জন্য আপনার শরণাপন্ন হয়েছি। আমার আপত্তিগুলোর সারসংক্ষেপ হলো, আজকাল সোনা, রূপার আকারে কোনো নিসাবধারীর হাতে নগদ অর্থ থাকেনা। বলা হয়, নগদ অর্থের বিনিময়ে সোনা কোষাগারে রক্ষিত আছে। কিন্তু আমাদের হাতে মুদ্রা নোট ছাড়া আর কিছু থাকেনা এবং চাহিবামাত্র প্রদানের ওয়াদা লেখা থাকে। প্রশ্ন হলো, এইসব কাগজে মুদ্রার উপর কিসের ভিত্তিতে যাকাত আরোপ করা হবে? তবু যদি ধরে নেই যে, এইসব কাগজের মুদ্রাকে সোনা রূপার সমতুল্য মেনে নিয়ে তার উপর যাকাত ফরয হবে, তাহলে দ্বিতীয় প্রশ্ন জাগে যে, এসব কাগজে নোটের সিবাব সোনার ভিত্তিতে ধার্য হবে, না রূপার ভিত্তিতে? উপমহাদেশে আলেম সমাজ সাধারণত নোটগুলোকে রূপার সমতুল্য মনে করেন এবং রূপার নিসাব পঞ্চাশ টাকাকে নগদ অর্থের নিসাব (ন্যূনতম যাকাতযোগ্য পরিমাণ) গণ্য করেন। সোনাকে বাদ দিয়ে মুদ্রাকে রূপার সমকক্ষ আখ্যায়িত করা আমাদের আলেমদের উদ্ভবিত পদ্ধতি না পূর্বতন আলেমদেরও এরূপ ফতোয়া ছিলো, আমার জানা নেই। মুদ্রা যদি রূপার হতো অথবা তাতে রূপার উপকরণ বেশি থাকতো, তাহলেও একে রূপার অধীন আনা ঠিক হতো। কিন্তু রূপাই যখন উধাও হয়ে গেছে, তখন মুদ্রাকে রূপার সাথে যুক্ত করার যুক্তি দুর্বোধ্য। এ ক্ষেত্রে রূপার পরিবর্তে সোনাকে নিসাবের ভিত্তি ধরলে ক্ষতি কি?
জবাব : নগদ অর্থ সোনা রূপার পরিবর্তে কাগজে নোটে রূপান্তরিত হলে তার উপর যাকাত আরোপিত হওয়া সন্দেহজনক হয়ে পড়বে-এ বক্তব্য এক অর্থহীন বাগাড়ম্বর ছাড়া আর কিছু নয়। এটা একটা স্বীকৃত সত্য কথা যে, সোনা ও রূপার উপর যাকাত আরোপিত হওয়ার মূল কারণ হলো, তার মাধ্যমে মানুষ নিজের প্রয়োজনাতিরিক্ত ও সঞ্চিত সম্পদ যেমন সংরক্ষণ করতে পারে এবং যখন যেখানে ইচ্ছে, তা দ্বারা নিজের কিংবা অন্যের প্রয়োজন পূরণ করতে পারে। পবিত্র কুরআনের ......------------------------------------------ এই আয়াতটিতে সোনা ও রূপা সম্পর্কে -------- [জমা করে রাখে]। এবং -------- (খরচ করে) এ শব্দ দু'টি সুস্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, এই দুটো জিনিসকে পুঁজির আকারে সঞ্চিত করেও রাখা যায় এবং তার দ্বারা জীবনের নানাবিধ প্রয়োজনও পূরণ করা যায়। দীর্ঘকাল ধরে সোনা রূপা বা সোনা রূপার তৈরি মুদ্রার সাহায্যে এই দুটো কাজ সম্পন্ন হয়ে এসেছে। কিন্তু আজ কাগজে মুদ্রা তার স্থান দখল করেছে। আপনি তা সঞ্চয়ও করতে পারেন, আবার তা খরচ করে আগের কালে যেসব প্রয়োজন পূরণ করতে সোনা রূপার দরকার হতো, সেসব প্রয়োজনও পূরণ করতে পারেন। আজ আপনি কাগজে নোট নিয়ে যদি কোনো দোকানদারের কাছে যান অথবা এমন কোনো লোককে দেন যার টাকার প্রয়োজন, তবে সে একথা বলবেনা যে, এতো শুধু কাগজে ওয়াদা, আমাকে এর বদলে সোনা দাও কিংবা রূপা দাও। বরঞ্চ কাগজে নোটের পরিবর্তে যদি তাকে সোনা বা রূপা দিতে চান, তাহলে সে হতোবুদ্ধি হয়ে পড়বে। মোদ্দাকথা, যে মুদ্রার মূল্যমান আছে, চাই সে মুদ্রা লোহার হোক চামড়ার হোক কিংবা কাগজের হোক। সোনা রূপার উপরও যেমন যাকাত ফরয, এই কাগজে নোটের উপর ঠিক তেমনিভাবেই তা ফরয।
এ প্রশ্ন অবশ্য ভেবে দেখার মতো যে, মুদ্রানোট সোনা বা রূপা দিয়ে তৈরি নয় তার ক্ষেত্রে যাকাতের নিসাব কিভাবে নির্ণয় করা হবে। এ কথা তো সুবিদিত যে, এ ধরণের মুদ্রা যেহেতু সোনা ও রূপার পর্যায়ভুক্ত। তাই নিসাবের ব্যাপারেবও তাকে সোনা ও রূপার সমতুল্যই মনে করতে হবে। মুসলিম ফকীহদের সিদ্ধান্ত হলো, যে মুদ্রা সোনার তৈরি অথবা অন্ততপক্ষে তাতে সোনার উপাদান বেশি, তার নিসাব তো সোনার নিসাবেরই সমান অর্থাৎ ২০ মিসকল বা ২০ দীনার (সাড়ে সাত ভরি) হবে, আর অন্যান্য যাবতীয় মুদ্রায় রূপার নিসাব অর্থাৎ ২০০ দিরহাম বা তার সম ওজনের রূপার মূল্যের সমপরিমাণ সাড়ে ৫২ তোলা হবে। এটা আমাদের ফকীহগণের বিচক্ষণতা, সতর্কতা ও ইজতিহাদী প্রজ্ঞার নিদর্শন যে, সোনার ক্ষেত্রে তো তারা বিভিন্ন হাদিসে যে সোনার নিসাব উল্লেখিত হয়েছে, সেটাই গ্রহণ করেছেন, কিন্তু সোনা ছাড়া আর যতো সম্পদ রয়েছে, যার নিসাব কুরআন বা হাদিসে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি, সেগুলোকে রূপার সমতুল্য ধরেছেন। সোনার তৈরি নয় এমন মুদ্রাও এর অন্তর্ভূক্ত। ফাতওয়ায়ে আলমগীরীতে বলা হয়েছে :
"দিরহাম (রৌপ্য মুদ্রা) যদি মিশ্র ধাতুর তৈরি হয় কিন্তু রূপাই তার প্রধান উপাদান হয় তবে তাকে নির্ভেজাল রূপার মুদ্রা ধরা হবে। অর্থাৎ তাতে ওজনের দিক দিয়ে রূপার যাকাত ধার্য হবে। আর যদি ভেজাল উপাদানের প্রাধান্য থাকে, তাহলে তা রূপার মতো হবেনা। সুতরাং দেখতে হবে, তা যদি চালু মুদ্রা হয় অথবা তা বাণিজ্যের উদ্দেশ্য ব্যবহৃত হয়, তবে তার মূল্য ধর্তব্য হবে। যদি তার মূল্য যাকাতযোগ্য দিরহামের সর্বনিম্ন পরিমাণের সমান হয়ে যায়, তাহলে এইসব ভেজাল মুদ্রারও যাকাত দিতে হবে।"
কাগজে নোটসহ আজকালকার সকল চালু মুদ্রা, ভেজাল রৌপ্য মুদ্রার সংজ্ঞার আওতায় আসতে পারে। তাই তার আইনানুগ মূল্যের বিচারে তার উপর যাকাত ধার্য হবে এবং তার নিসাব হবে রূপার নিসাবের মতো। এগুলোতে সোনার পরিবর্তে রূপার নিসাব গ্রহণ করার একাধিক যুক্তি রয়েছে। প্রথম যুক্তি হলো, বাণিজ্যিক পণ্যে যাকাতের নিসাব যে ২০০ দিরহার রূপার নিসাবের সমপরিমাণ, সে কথা বিভিন্ন হাদিস ও সাহাবিদের আচরণ থেকে জানা গেছে। আর নগদ অর্থ ও বাণিজ্যিক পণ্য ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এ জন্য বাণিজ্যিক পণ্যের নিসাবে যদি সোনার পরিবর্তে রূপাকে মানদণ্ড ধরা হয়, তাহলে নগদ অর্থের ক্ষেত্রে সেটাই আপনা আপনি প্রযোজ্য হবে। দ্বিতীয় যুক্তি হলো, সনদ ও বিশুদ্ধতার দিক দিয়ে রূপার নিসাব সম্বলিত হাদিসগুলোর মান অত্যন্ত উঁচু। এমনকি বুখারি ও মুসলিমে যেখানে পাঁচ উকিয়ার নিসাবের উল্লেখ রয়েছে। সেখানেও হাদিস বিশারদদের সর্বসম্মত রায় এই যে, পাঁচ উকিয়া দ্বারা ২০০ দিরহার বুঝানো হয়েছে। যে হাদিসগুলোতে সোনার নিসাব বর্ণিত হয়েছে, তাতে এ বৈশিষ্ট অনুপস্থিত। আরো একটা যুক্তি এই যে, যেসব জিনিসের নিসাব বর্ণিত হয়নি এবং সোনা ও রূপার উভয়ের সাথে তার সাদৃশ্য রয়েছে, তাতে রূপাকে নিসাব নির্ণয়ের মানদণ্ড হিসেবে গ্রহণ করা এ জন্য উত্তম বিবেচিত হয়ে যে, তা দ্বারা যাকাতের হকদাররা অধিকতর উপকৃত হবে।
মোদ্দাকথা, ইমাম ও ফকীহগণ যে নগদ অর্থে যাকাত দেয়া জরুরি বলে আখ্যায়িত করেছেন এবং এর নিসাব নির্ণয়ে সোনার পরিবর্তে রূপাকে মানদণ্ড ধরেছেন। এর সপক্ষে বলিষ্ঠ যুক্তি ও প্রমাণ রয়েছে এবং এটা উপমহদেশের আলেমদের মনগড়া কোনো ব্যাপার নয়। উপমহাদেশে আলেমগণ স্থায়ীভাবে ৫০ রূপিয়া নগদ অর্থের যাকাতের নিসাব ধার্য করেছেন- এ কথা ঠিক নয়। এ উক্তি ভ্রান্ত ধারণাপ্রসূত। প্রকৃত ব্যাপার হলো, যে যুগে আলেমগণ এই নিসাব ধার্য করেছিলেন, তখন রূপিয়া ছিলো রূপার তৈরি মুদ্রা, অবশ্য রূপা তার প্রধান উপাদান ছিলো। সেই মুদ্রার ওজন ছিলো এক তোলা। এ হিসেবে তৎকালে ৫০ বা ৫২ রূপিয়া প্রায় ২০০ দিরহাম(সাড়ে ৫২ তোলা) সম ওজনের ও সমমূল্যের ছিলো। তাই জনসাধারণ যাতে সহজে বুঝতে পারে, সে জন্য এভাবে মাসয়ালা প্রচার করা হলো যে, ৫০ রূপিয়ার উপর যাকাত হবে। পরবর্তীকালে পরিস্থিতি একদম পাল্টে গেছে। এখন সেই রূপার মুদ্রাও নেই। পঞ্চাশ তোলা রূপার মূল্যও ৫০ রূপিয়া নেই। তাই এখন নগদ অর্থের নিসাবে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার প্রচলিত বাজারমূল্যকে মানদণ্ড ধরতে হবে এবং তা প্রতিদিনের সংবাদপত্রের মাধ্যমে জানা যেতে পারে। যার কাছে সারা বছর এই পরিমাণ নগদ অর্থ থাকবে সে যাকাত দেবে। [তরজমানুল কুরআন, মার্চ ১৯৬৮]
|
সর্বশেষ আপডেট ( Friday, 04 March 2011 )
|
|
|
|