 |
|
 |
আমাদের টাইপ করা বইগুলোতে বানান ভুল রয়ে গিয়েছে প্রচুর। আমরা ভুলগুলো ঠিক
করার চেষ্টা করছি ক্রমাগত। ভুল শুধরানো এবং টাইপ সেটিং জড়িত কাজে সহায়তা
করতে যোগাযোগ করুন আমাদের সাথে।
রাসায়েল ও মাসায়েল ৬ষ্ঠ খন্ড |
|
|
লিখেছেন সাইয়্যেদ আবুল আ'লা মওদূদী
|
Monday, 28 February 2011 |
পাতা 46 মোট 74
<h1>৪৪। কুরাইশের ১২ জন খলিফা ও 'ফিতনায়ে আহলাস'</h1>
প্রশ্ন : মিশকাত শরীফত ও আবু দাউদ শরীফের 'কিতাবুল ফিতান' (কিয়ামতের নিকটবর্তী সময়কার অরাজকতা সংক্রান্ত অধ্যায়) অধ্যয়ন করতে গিয়ে এমন কয়েকটি হাদিস নজর পড়লো যার সঠিক মর্ম ও ব্যাখ্যা উদ্ধার করতে যথেষ্ট বেগ পেতে হচ্ছে। এ ব্যাপারে আপনিও যদি কিছু সাহায্য করেন, তবে আল্লাহর কাছে পুরস্কৃত ও কৃতজ্ঞতাভাজন হবেন।
উদাহরণস্বরূপ, এতে একটি হাদিস এরূপ রয়েছে যে, রসূল সা. বলেছেন : "খিলাফত থাকবে ত্রিশ বছর, অত:পর আসবে রাজতন্ত্র।"
এ হাদিসের বর্ণনাকারী হযরত সফীনা রা. অত:পর বলেন : 'আবু বকরের খিলাফত দুই বছর আর আলীর ছয় বছর।' অর্থাৎ এ হাদিসে ত্রিশ বছরব্যাপী খিলাফত ও চারজন খলিফা সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী রয়েছে। এ ভবিষ্যদ্বাণী মুসনদে আহমদ, তিরমিযী এবং আবু দাউদ বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু এই হাদিসের পাশাপাশি মুসলিম শরিফ এবং সহীহ হাদিস গ্রন্থসমূহে এরূপ আরো কিছু হাদিস রয়েছে, যাতে ১২ জন খলিফার কথা বলা হয়েছে। তারা সবাই কুরাইশ বংশোদ্ভূত হবেন এবং তাদের দ্বারা ইসলামের বিপুল জাঁকজমক ও প্রতাপ প্রতিষ্ঠিত হবে। এই দুই ধরণের হাদিসের সমন্বয়ে কিভাবে হতে পারে, তা আমার যথাযথভাবে বুঝে আসছে না। হাদিস অমান্যকারী গোষ্ঠি কিংবা প্রাচ্যবাদী ফযলুর রহমান ও তার দোসররা এখানে একথা বলার সুযোগ পেতে পারে যে, শীয়া ও সুন্নীরা ঐতিহাসিক ঘটনাবলী ও নিজেদের বদ্ধমূল মতবাদগুলোর আলোকে এ ধরণের হাদিস বানিয়ে নিয়েছে এবং হাদিস গ্রন্থসমূহে ঢুকিয়ে দিয়েছে।
অপর হাদিসটি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রা. থেকে বর্ণিত। এতে রসূল সা. 'ফিতনায়ে আহলাসের' উল্লেখ করেছেন। এ ফিতনা দ্বারা কি বুঝায় জানিনা। রসূল সা. বলেন : এরপর সুখসমৃদ্ধি এবং যুদ্ধ মারামারির ফিতনা দেখা দেবে। এ হাদিসের ভাষা দুর্বোধ্য ও রহস্যময়। এতে বলা হয়েছে যে, রসূল সা.-এর বংশোদ্ভূত এক ব্যক্তি এমন হবে যেনো তার বুক ও উরু একত্রে যুক্ত হয়ে গেছে। এই ব্যক্তি কে হতে পারে এবং এই উপমার তাৎপর্য কি? ইয়াজিদ ও বনু উমাইয়ার সমর্থকদের কেউ কেউ বলেন যে, কারো কারো মতে এর দ্বারা হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের অথবা ইমাম হাসান বা ইমাম হুসাইনের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। কেননা খিলাফত ও ইমারত লাভের জন্য তাদের সংগ্রাম সফল হয়নি এবং অরাজকতা ও অনাচার অব্যহত থাকে।
এ হাদিসের ঠিক বিপরীত হযরত আবু হরায়রা থেকে বর্ণিত আর একটি হাদিস মিশকাতের কিতাবুল ফিতনেই বুখারি শরিফ থেকে উদ্ধৃত হয়েছে। রসূল সা. বলেছেন, কুরাইশের এক যুবকের হাতে আমার উম্মতের ধ্বংস ও পতন ঘটবে। অন্য কয়েকটি হাদিস থেকে জানা যায়, রসূর সা. বখাটে তরুণদের নেতৃত্ব থেকে পানাহ চেয়েছেন।
কেউ কেউ এ দ্বারা বনু উমাইয়ার শাসকদের বুঝিয়েছেন। এমন নিকৃষ্ট ভবিষ্যদ্বাণী দ্বারা বনু উমাইয়াকে বুঝানো কতো দূর সঙ্গত।
জবাব : আপনি যে কয়টি হাদিসের উদ্ধৃত দিয়েছেন, তার সবই সত্য ও সঠিক। এ হাদিসগুলো বিভিন্ন ঐতিহাসিক সত্য ঘটনার পূর্বাভাস দেয়। এ থেকে প্রমাণিত হয়, আমাদের পরম সত্যভাষী রসূল সা.-কে মহাজ্ঞানি আল্লাহ আগাম জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, এ ধরণের ঘটনাবলী সংঘটিত হবে। যেসব হাদিসে খিলাফতের স্থিতিকাল ৩০ বছর বলা হয়েছে এবং যেসব হাদিসে ১২ জন কুরাইশ খলিফার সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে। এই দুই ধরনের হাদিসে কোনো বিরোধ নেই। প্রথমোক্ত হাদিসগুলোতে নবুওয়াতের অনুসারী খিলাফত পুন:প্রতিষ্ঠার ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে। এ হাদিসগুলো অত্যন্ত সুবিদিত ও ব্যাপকভাবে প্রচলিত। এর দ্বারা চার খলিফার রা. খিলাফতের পক্ষে অকাট্য দলিল প্রতিষ্ঠিত হয়। আপনি প্রথম যে হাদিসটির উল্লেখ করেছেন, তাতে সাফীনা রা. বলেন :
---------------------------------------------------------------------------------
"আবু বকরের খিলাফত দুই বছর ধরো আর উমরের দশ বছর, উসমানের বার বছর এবং আলীর ছয় বছর।"
এ হাদিসে হযরত আবু বকর, উমর, উসমান ও আলীর রা. খিলাফতের স্থিতিকাল যথাক্রমে ২ বছর, ১০ বছর, ১২ বছর ও ৬ বছর উল্লেখ করা হয়েছে। এতে ঐতিহাসিক দিক থেকে প্রথম দুই খিলাফতের কিছু বেশি রয়েছে। তবে সামগ্রিক মেয়াদে কয়েক মাস কম এবং শেষোক্ত দুই খিলাফতে কিছু বেশি রয়েছে। তবে সামুগ্রিক বিচারে এই কম বেশিতে তেমন কোনো পার্থক্য হয়না। কেননা হযরত আলীর রা. শাহাদাত রসূল সা.-এর ইন্তিকালের ৩০ বছর পর ৪০ হিজরীতে সংঘটিত হয়। রসূলের জনৈক সাহাবি রসূল সা.-এর উক্তির ব্যাখ্যা এমনভাবে দিয়েছে যে, তা দ্বারা আহলে সুন্নাতের আকীদা ও মতবাদ আপনা আপনি স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আলোচ্য হাদিসে ---------- শব্দটি দ্বারা এ কথাই বুঝানো হয়েছে যে, এ হাদিসে যে খিলাফতের বর্ণনা দেয়া প্রকৃত অর্থে সেটাই সত্যিকার খিলাফত।
মিশকাত শরিফের কিতাবুল ফিতানের অব্যবহিত পূর্বে 'কিতাবুর রিকাক' নামক অধ্যায়ের শেষে হযরত নুমান বিন বশীরের বর্ণিত একটি হাদিস রয়েছে। রসূল সা. বলেছেন :
---------------------------------------------------------------------------------
"তোমাদের মধ্যে নবুওয়াত থাকবে যতোদিন আল্লাহ চাইবেন, অত:পর আল্লাহ তা তুলে নেবেন। তারপর নবুওয়াতের পদাংক অনুসারী খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হবে এবং যতোদিন আল্লাহ চাইবেন টিকে থাকবে, তারপর আল্লাহ তা তুলে নেবেন। অত:পর রক্তচোষা রাজতন্ত্র আসবে এবং যতোদিন আল্লাহ চাইবেন টিকে থাকবে। তারপর আল্লাহ তাও তুলে নেবেন। এরপর প্রতিষ্ঠিত হতে স্বৈরাচার, একনায়কত্ব ও ঔদ্ধত্যের শাসন এবং যতোদিন আল্লাহ চাইবেন তা টিকে থাকবে। এরপর আল্লাহ তা তুলে নেবেন। অত:পর পুনরায় নবুওতের পদাংক অনুসারী খিলাফত কায়েম হবে। এরপর রসূল সা. নিরব হয়ে গেলেন।"
এ হাদিসটি মুসনদে আহমদ এবং ইমাম বায়হাকীর দালায়েলুন নবুওয়ত থেকে মিশকাতে উদ্ধৃত হয়েছে। এর একজন বর্ণনাকরীর হাবীব বিন সালের হযরত উমার বিন আব্দুল আযীযের সমসাময়িক। তিনি জানান, হযরত উমার বিন আব্দুল আযীয যখন খিলাফতের আসনে অধিষ্ঠিত হন, তখন আমি তাকে এ হাদিস স্মরণ করিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে লিখে পাঠাই। সেই সাথে আমি লিখি :
--------------------------------------------------------------
"দাঁত দিয়ে চর্বণকারী রাজতন্ত্র এবং স্বৈরচারী শাসনের পর আমি আশা করি আপনিই সেই আমীরুল মুমিনীন হবেন (যার সুসংবাদ এই হাদিসে দেয়া হয়েছে এবং যিনি নতুন করে নবুওয়তের আদর্শে খিলাফতকে প্রতিষ্ঠিত করবেন) এতে হযরত দ্বিতীয় ওমর খুবই খুশি হলেন।"
এ হাদিস দ্বারা খিলাফত আমল ও ফিতনার (অরাজকতার) যুগের ঘটনাবলী সম্পর্কে আরো অনেক তথ্য জানা যায় এবং এও জানা যায় যে, খিলাফতে রাশেদার পর --------- দাঁত দিয়ে চর্বণকারী অর্থাৎ অত্যাচারী রাজকীয় শাসন (অন্য হাদিসে বলা হয়েছে --------- যার অর্থ অত্যাধিক চর্বণকারী অর্থাৎ ভীষণ অত্যাচারী রাজতন্ত্র) অতপর বলপ্রয়োগমূলক তথ্য স্বৈরাচারী শাসন এবং তারপর পুনরায় নবুওয়তের আদর্শবাহী খিলাফত চালু হবে ।১ এ হাদিসে একাধারে হযরত ওমর বিন আব্দুল আযীযের জন্য আনন্দদায়ক সুসংবাদ এবং তার বংশের পূর্বতন শাসকদের জন্য কঠোর নিন্দাবাদ উচ্চারিত হয়েছে। তিনি একজন নি:স্বার্থ ও
__________________
১. হযরত মুয়ায বিন জাবালের বর্ণনা মতে রসূল সা. বলেন : "এই ব্যবহার সূচনা হলো নবুওয়তে ও রহমত দিয়ে। এরপর আসবে খিলাফত ও রহমতের যুগ। তারপর ভীষণ অত্যাচারী রাজকীয় শাসন আসবে এবং পৃথিবী যুলুম ও অত্যাচারে ভরে উঠবে........."
পূর্বতন শাসকদের জন্য কঠোর নিন্দাবাদ উচ্চারিত হয়েছে। তিনি একজন নি:স্বার্থ ও খোদাভীরু মানুষ ছিলেন বলে নিজেকে এই পরম সুসংবাদের যোগ্য পাত্রে পরিণত করার জন্য সর্বদা চেষ্টা করেছেন। বনু উমাইয়া শাসকদের যুলুম অত্যাচারের প্রতিকারের যথাসাধ্য ব্যবস্থা করেছেন। এমনকি কেউ ইয়াযীদকে আমীরুল মুমিনীন বললে তাকে বেত্রাঘাত পর্যন্ত করেছেন।
অপর যে হাদিসগুলোতে খলিফাদের উল্লেখ পাওয়া যায়, সেগুলোও নি:সন্দেহে সহীহ হাদিস। তবে তার মর্ম ও তাৎপর্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। এসব হাদিস সাধারণভাবে ১২ জন খলিফার কথা বলা হয়েছে। এ হাদিসগুলো থেকে শুধু এতোটুকু জানা যায় যে, কুরাইশ বংশ থেকে এমন ১২ জন নামকরা শাসক জন্ম নেবে, যাদের শাসনামলে ইসলাম ও মুসলমানদের ঐক্য ও সংহতি মোটামুটি বজায় থাকবে, যাদের শাসনামলে ইসলাম ও মুসলমানদের ঐক্য ও সংহতি মোটামুটি বজায় থাকবে, রাষ্ট্রীয় প্রশাসন ভেঙ্গে পড়বেনা এবং অরাজকতা দেখা দেবেনা। এসব শাসকের নামধাম চিহ্নিত করার কোনো প্রয়োজন নেই। কেননা তা করতে গেলে অনেক জটিলতার সম্মখীন হতে হয়। তথাপি হাদিসের ব্যাখ্যাকরণ নাম পরিচয় নির্ণয়ের চেষ্টা করেছেন। কেউ কেউ চারজন খোলাফায়ে রাশেদীনকেও এই সংখ্যার অন্তর্ভুক্ত মনে করেন এবং তাদের দ্বারা শুরু করে আরো আটটি নাম উল্লেখ করেন। কেউ কেউ খোলাফায়ে রাশেদীন ছাড়া অন্য ১২ জন শাসকের নাম গণনা করে থাকেন। আমার জানামতে সন্নি আলেমদের মধ্য থেকে কেউ এসব হাদিসকে অনির্ভরযোগ্য বা অগ্রহণযোগ্য বলেননি। তবে তারা কেউ এগুলো দ্বারা রসূল সা.-এর বংশোদ্ভূত ১২ জন ইমামকেও বুঝাননি। সঠিক কথাও তাই। এর অর্থ ১২ ইমাম তো হতেই পারেনা। কারণ এসব হাদিস দ্বারা যে রাজনৈতিক ক্ষমতা ও আধিপত্য বুঝায়, তা ঐ ১২ ইমাম কখনো অর্জন করতে পারেনি। বিষয়টা আরো স্পষ্ট করে তুলে ধরার জন্য ইমাম সুনানে আবু দাউদ থেকে সংশ্লিষ্ট দুটো হাদিস তুলে ধরছি। এ দু'টি হাদিস দ্বারা বিষয়টা আরো সহজে বুঝে আসবে।
আবু দাউদের কিয়ামতের নিকটবর্তী অরাজকতা সংক্রান্ত হাদিসগুচ্ছে একটি হাদিস হযরত জাবের বিন সামুরা কর্তৃক রসূল সা. থেকে নিম্নরূপ বর্ণিত :
---------------------------------------------------------------------------------
"সমগ্র উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধকারী ১২ জন কুরাইশ বংশোদ্ভূত খলিফা মুসলমানদের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত এই 'দীন' অক্ষুন্ন থাকবে।"
বিশিষ্ট মুহাদ্দিস হাফেজ আল মুনযিরী 'মুখতাসারে সুনানে আবু দাউদ' গ্রন্থে এই হাদিস সম্পর্কে একটি বিস্তারিত মন্তব্য যুক্ত করেছেন। এখানে 'দীন' শব্দের অর্থ শাসন ব্যবস্থা ও সাম্রাজ্য। ১২ খলিফা অতিবাহিত হওয়ার পর শাসন ব্যবস্থার বিলুপ্তি ঘটবে। এ হাদিসে শুধু রাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থার ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে নিছক প্রশংসাসূচক বক্তব্য দেয়া হয়নি। এরপর কারো কারো মতানুসারে ইয়াযীদ থেকে শুরু করে ইবরাহীম বিন মুহাম্মদ ও মারওয়ান বিন মুহাম্মদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। অত:পর আরো কয়েকটি মতামতও তুলে ধরা হয়েছে। তবে এসবই অনুমানসর্বস্ব ও কাল্পনিক। তাই ঐসব মতামত এখানে পুনরুল্লেখের প্রয়োজন নেই।
একই গ্রন্থে উক্ত হযরত জাবের বিন সামুরা রা. থেকে অপর একটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, আমি রসূল সা.-কে বলতে শুনেছি :
---------------------------------------------------------------------------------
"১২ জন খলিফা পর্যন্ত এ দীন বিজয়ী থাকবে....... তারা সবাই কুরাইশী হবে।"
'তাহযীবে সুনানে আবু দাউদ' গ্রন্থে লেখক হাফেজ ইবনে কাইয়েম এ হাদিসের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেন যে, এ হাদিসে খলিফা শব্দটি সাধারণ শাসক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, যেমন হযরত আবু হুরায়রা বর্ণিত হাদিসে আছে :
---------------------------------------------------------------------------------
"আমার পরে অচিরেই এমন খলিফারা আসবে, যারা মুখে যা বলবে কাজেও তাই করবে এবং তাদেরকে যা আদেশ করা হবে তাই করবে। আবার তাদের পরে এমন খলিফারা আসবে যাদের কাজ হবে তাদের কথার বিপরীত এবং তাদের কার্যকলাপ শরিয়তের বিধিসম্মত হবেনা।"
এ হাদিসে যাদের কথা ও কাজে মিল থাকবেনা এবং শরিয়তবিরোধী কাজ করবে তাদেরকেও খলিফা বলা হয়েছে।
মোট কথা, নবুওয়তের আদর্শবাহী খিলাফত এবং সাধারণ খিলাফত ও শাসন সম্পর্কে উক্ত দু'ধরনের ভবিষ্যদ্বাণী সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। এ দু'ধরনের ভবিষ্যদ্বাণী যাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, তারা ঐতিহাসিক ও গুনগত মানের দিক দিয়ে পরস্পর থেকে ভিন্ন ও বিরোধী হতে পারে, কিংবা তাদের মধ্যে শুধুমাত্র এতোটুকু প্রভেদ থাকতে পারে যে, কেউ সাধারণ ধরণের শাসক এবং কেউ বিশেষ ধরণের শাসক। তবে উক্ত দু'ধরণের ভবিষ্যদ্বাণীর মধ্যে আদৌ এমন কোনো তাৎপর্যগত বিরোধ নেই, যার দরুন কোনো জটিলতার উদ্ভব হতে পারে এবং কুচক্রী ও কুটতার্কিক মহল কোনো স্বার্থ উদ্ধার করতে পারে, কিংবা শিয়া খারেজী বা অন্য কোনো ভ্রান্ত মতের প্রবক্তারা একে নিজেদের পক্ষে ব্যবহার করতে পারে। এখানে এক জায়গায় সুনির্দিষ্টভাবে চার খোলাফায়ে রাশেদীনকে বুঝানো হয়েছে, আর এক জায়গায় সাধারণভাবে ১২ জন খলিফার কথা বলা হয়েছে। বলাবাহুল্য, এর প্রকৃত মর্ম কি তা সুনির্দিষ্টভাবে একমাত্র আল্লাহই জানেন।
এবার 'ফিতনায়ে আহলাস' সংক্রান্ত হাদিসগুলোর আলোচনায় আসা যাক। মিশকাতে এ হাদিসের ভাষা নিম্নরূপ :
---------------------------------------------------------------------------------
"আমরা রসূল সা.-এর কাছে বসা ছিলাম। তিনি বহুসংখ্যক ফিতনার (অরাজকতা ও দুর্যোগ) উল্লেখ করলেন এবং এ বিষয়ে অত্যন্ত ব্যাপক আলোচনা করলেন। এক পর্যায়ে তিনি ফিতনায়ে আহলাসের কথা বললেন। একজনে বললো, ফিতনায়ে আহলাস কি জিনিস?১ রসূল সা. বললেন : এটা পলায়ন ও মারামারি কাটাকাটি। এরপর আরেক ফিতনার উদ্ভব ঘটবে সমৃদ্ধি ও প্রাচুর্য থেকে। আমার বংশোদ্ভূত এক ব্যক্তির পদতল থেকে তা ফুটে বেরুবে। সে আমার লোক বলে কেবল খোদাভীরু লোকেরা। এরপর জনগণ এমন এক ব্যক্তিকে মেনে নেবে, যার বুকের সাথে যেনো উরু যুক্ত হয়ে গেছে। এরপর আর একটা ঘোরতর দুর্যোগ আসবে, যা আমার উম্মতের প্রতিটি ব্যক্তিকে একটা না একটা চাঁটি মারবে। এরপর যখন জানানো হবে যে, এ দুর্যোগ কেটে গেছে, তখন তা আরো দীর্ঘস্থায়ী হবে। মানুষ সকালে মুমিন ও বিকেলে কাফের হবে। শেষ পর্যন্ত মানুষ দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে যাবে। একটি হবে ঈমানদারীর শিবির, যেখানে মুনাফেকির চিহ্নও থাকবে না। আরেকটি হবে মুনাফেকীর শিবির, যেখানে ঈমানের নাম গন্ধও থাকবেনা। যখন এমন পরিস্থিতি দেখা দেবে, তখন দাজ্জালের অপেক্ষায় থাকবে। আজ না হোক, কাল তার আবির্ভাব ঘটবে।"
____________________
১. 'হাল্স' এর বহুবচন আহলাস। আহলাস এক ধরনের কালো আবরণকে বলা হয় যা জন্তুর দেহে জড়ানো হয় কিংবা মেঝেতে বিছানো হয়। এ দ্বারা অব্যাহতভাবে ঘটাতে থাকা ভয়ংকর ও আতংকজনক ঘটনাবলীতে বুঝানো হয়েছে, যার ফলে মানুষ ঘরে বসে থাকতে বাধ্য হয়।
সন্দেহ নেই, এ হাদিসে একাধিক্রমে দু'তিনটি দুর্যোগ সম্পর্কে আমাদেরকে সতর্ক করা হয়েছে। এর প্রত্যেকটির ব্যাপারে আমাদের আল্লাহর আশ্রয় চাওয়া প্রয়োজন। এর মধ্যে একটি ফিতনা বা দুর্যোগ এমন যে, মনে হয় তাতে চারদিকে ভয়ংকর লুটতরাজ মারামারি হুড়োহুড়ি ও চরম অরাজকতা বিরাজ করবে। এরপর আবার এক প্রাচুর্য ও বিলাসী জীবন আসবে আরেক দুর্যোগের আকারে। যার তত্ত্বাবধানে এর আবির্ভাব ঘটবে সে রসূল সা.-এর বংশোদ্ভূত হলেও হযরত নূহের ছেলের মতো মর্যাদা ও সম্মানের যোগ্য পাত্র হবেনা। কেননা, রসূল সা. বলেছেন, খোদাভীরু লোকেরাই তাঁর বন্ধু ও আপনজন হয়ে থাকে।
'ফিতনায়ে আহলাস' দ্বারা আসলে কি বুঝানো হয়েছে, সেটা তো আল্লাহই ভালো জানেন। কিন্তু যে মুসলমানের মনে বিন্দু পরিমাণও ঈমান আছে, সে এ কথা কল্পনাও করতে পারবেনা যে, নবীর বংশোদ্ভূত যে ব্যক্তির কথা রসূল সা. এই হাদিসে বলেছেন, তা দ্বারা সামান্যতম ইঙ্গিতও হযরত ইমাম হাসান ও হুসাইনের দিকে করা হয়ে থাকতে পারে। (নাউজুবিল্লাহ) তাদেরকে তো হাদিসে ---------- (বেহেশতের যুবকদের নেতা) বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এহেন পুন্যাত্মা হাসান ও হুসাইনের রা. খোদাভীরুতা, চরিত্রের নির্মলতার কথা অস্বীকার করার সাহস কার হতে পারে এবং কিভাবে হতে পারে? অনুরূপভাবে বুক ও উরু একাকার হয়ে যাওয়া ব্যক্তির মতো শব্দটি যে ব্যক্তির ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে, সে সম্পর্কেও এমন ধারণা করার আদৌ কোনো অবকাশ নেই যে, রসূল সা. হযরত আব্দুল্লাহ বিন যুহাইরের মতো মর্যাদাবান সাহাবিকে এরূপ শব্দ দ্বারা চিত্রিত করবেন। একথা সত্য যে, খেলাফতের পদটি তাঁর করায়ত্ত হয়নি এবং তাঁর শাতাদাতের আগেই তাঁর সন্তানরা পর্যন্ত মারওয়ানের দলে ভিড়ে গিয়েছিল, কিন্তু রসূর সা.-এর নিবেদিতপ্রাণ সাহাবি হযরত যুহাইর এবং যাতুন নিকাতাইন উপাধিতে ভূষিত আবু বকর কন্যা হযরত আসমার কলিজার টুকরো আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর সম্পর্কে তিনি এমন অপমানজনক শব্দ কিভাবে প্রয়োগ করতে পারেন? বুক ও উরু একাকার হওয়া কথাটা ইংরেজি ও উর্দুতে 'ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেয়া' অথবা 'গোলাকার ছিদ্রে চতুষ্কোণ পেরেক' বলার সমতুল্য অর্থাৎ অযোগ্য ও অপাংক্তেয়। পক্ষান্তরে কোনো ব্যক্তি কোনো পদের যোগ্য বিবেচিত হলে আরবিতে বলা হয় : ------------------------- অর্থাৎ 'হাতের সাথে বাহুযুক্ত ' বা বাহুর সাথে কনুই যুক্ত।
কোনো কোনো বিজ্ঞজন হাদিসের এই প্রবচনগুলোকে বিশেষ কয়েকটি ঐতিহাসিক ঘটনা ও ব্যক্তিত্বের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বলে দেখাবার চেষ্টা করেছেন, যেমন হেজাযের শাসনকর্তা শরিফ হুসাইন যখন তুর্কীদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে ইংরেজদের প্রতি সমর্থন জানান, তখন সে যুগের কতিপয় আলেম ভেবেছিলেন যে, এই ব্যক্তিই হয়তো হাদিসের সেই ------------ অর্থাৎ বুকের সাথে উরুযুক্ত ব্যক্তি।
কিন্তু আমার নগণ্য মতে, মুসলিম উম্মাহ এখনো ভয়াবহ দুর্যোগের শিকার হয়নি। কেননা পরবর্তী বাক্য থেকে জানা যায় যে, এ দুর্যোগ ক্রমান্বয়ে তার পক্ষপুট বিস্তার করতেই থাকবে এবং শেষ পর্যন্ত সমগ্র দুনিয়া নির্ভেজাল ঈমানদারী ও নির্ভেজাল মুনাফিকীর পতাকাবাহী দু'টি শিবিরে বিভক্ত হয়ে যাবে। এরপর দাজ্জাল ও হযরত ঈসার আবির্ভাব ঘটবে এবং সম্ভবত কিয়ামতও ঘনিয়ে আসবে। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সাহায্য করুন এবং সকল ফিতনা থেকে রক্ষা করুন। আমীন।
কুরাইশের যে বখাটে তরুণদের হাতে মুসলিম উম্মাহর ধ্বংস সাধিত হবে বলে রসূল সা. পূর্বাভাস দিয়েছেন, তা সম্পূর্ণ সত্য। সহীহ বুখারি ও মুসলিমে এ হাদিসগুলো সন্নিবেশিত হয়েছে। একথা সত্য যে, একাধিক সাহবি ও তাবেঈন এবং বহুসংখ্যক মুহাদ্দিস ও প্রাচীন আলেম বনু মারওয়ান ও বনু উমাইয়ার স্বৈরাচারি জালেম, রগচটা শাসক ও সরকারি কর্মকর্তাদেরকে এই ভবিষ্যদ্বাণীর পাত্র বলে অভিহিত করেছেন। এটা তিক্ত হলেও এমন এক অকাট্য সত্য, যা অস্বীকার করার উপায় নেই। ইতিহাসের পাতা থেকে এই কালিমা মোচন কিংবা এর উপর প্রলেপ দিয়ে বা সাদা রং লাগিয়ে এর কুৎসিত দৃশ্য ধামাচাপা দেয়ার সাধ্য কারো নেই। ঐতিহাসিক, হাদিসবেত্তা, ফেকাহ শাস্ত্রকার বা আকীদা বিশারদ যিনিই হোন, আহলে সুন্নাহ ও প্রাচীন ন্যায়নিষ্ঠ আলেমগেণের নিরপেক্ষ ও ভারসাম্যপূর্ণ নীতির অনুসারি হলে কেউ ইতিহাসের এই কলংকময় ও রক্তমাখা অধ্যায়গুলোকে উপেক্ষা ও অস্বীকার করতে পারবেনা।
এ সম্পর্কে বিশদ আলোচনায় না গিয়ে আমি শুধু সুনান তিরমিযির একটি বর্ণনা উদ্ধৃত করছি। ফিতনা সংক্রান্ত অধ্যায়ে ইমাম তিরমিযি হিশাম বিন হাসসানের একটি উক্তি উদ্ধৃত করেছেন। উক্তিটি এই :
-----------------------------------------------
"গণনাকারীরা যখন হিসাব করেছেন যে, হাজ্জাজ বিন ইউসুফ কতজনকে বেঁধে হত্যা করেছে। তখন তাদের সংখ্যা এক লাখ বিশ হাজারে গিয়ে দাঁড়িয়েছে।"
এটা ইমাম আবু ঈসা তিরমিযির বর্ণনা, যিনি ইমাম বুখারির সুযোগ্য শিষ্য এবং যার কাছ থেকে স্বয়ং ইমাম বুখারি ও হাদিস সংগ্রহ করেছেন। [তরজমানুল কুরআন, ফেব্রুয়ারি ১৯৬৮]
|
সর্বশেষ আপডেট ( Friday, 04 March 2011 )
|
|
|
|