রাসায়েল ও মাসায়েল ৬ষ্ঠ খন্ড |
|
|
লিখেছেন সাইয়্যেদ আবুল আ'লা মওদূদী
|
Monday, 28 February 2011 |
পাতা 54 মোট 74
<h1>৫২। ফৌজদারি অপরাধের ক্ষেত্রে আপোস নিষ্পত্তির অধিকার</h1>
প্রশ্ন : প্রচলিত আইনগত পরিভাষা অনুসারে শাস্তিযোগ্য অপরাধসমূহ সাধারণত দেওয়ানী ও ফৌজদারি এই দুই ভাগে বিভক্ত। দেওয়ানী মোকদ্দমা সমূহে সাধারণত আর্থিক জরিমানা বা কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। আর ফৌজদারি মোকদ্দামায় উক্ত দুই ধরণের দণ্ড ছাড়াও গুরুতর অপরাধে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে। ইসলামি আইনের পরিভাষায় 'হুদুদ ও কিসাস' সংক্রান্ত মামলা ফৌজদারি শ্রেণীভুক্ত। কিন্তু এগুলোর মধ্যে পার্থক্য সুস্পষ্টভাবে বুঝে আসেনা। এই শ্রেণীভুক্ত প্রতিটি ফৌজদারি অপরাধ সরকারি হস্তক্ষেপযোগ্য কিনা এবং মামলা দায়ের হওয়ার পর প্রতিটি ফৌজদারি মোকদ্দমা আপোসে নিষ্পত্তিযোগ্য কিনা? অনেকে বলেন, এ জাতীয় প্রত্যেক মামলাতেই সেই দুই পক্ষের ঐক্যমত্যে আপোসে মীমাংসা করা যায়। খুনের মামলায় বাদী ও কিসাস আদায় করার অধিকারী কে? বাদী ও বিবাদী যদি আপোস ও সমঝোতা করে নেয় তাহলে অপরাধ প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও কি রাষ্ট্র বা সরকার কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনা? যদি না পারে, তাহলে ক্ষেত্র বিশেষে হত্যাকাণ্ড বিচার থেকে অব্যাহতি পেয়ে যাবে এবং বিত্তশালী ও প্রভাবশালী অপরাধী মজলুমের মুখ বন্ধ করতে পারবে। যেসব উত্তরাধিকারী খুনের বদলা দাবি করার হকদার তাদের কোনো সদস্য কি এর অধিকার রাখে?
জবাব : ইসলামি আইন অনুসারে কোনো কোনো ফৌজদারি অপরাধ এমন আছে, যাতে আসামীর বিরুদ্ধে সরকার বা প্রত্যেক নাগরিক বাদী বা মামলার পক্ষ হয়ে মামলা দায়ের করতে পারে। যেমন চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি ও ব্যভিচার। এগুলোকে 'হুদুদ' সংক্রান্ত অপরাধ নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এগুলোতে আপোস মিমাংসার অবকাশ নেই। পক্ষান্তরে, কতোক অপরাধ এমনও রয়েছে, যাতে নির্যাতিত বা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বাদী হতে পারে। আর ক্ষতিগ্রস্ত বা নির্যাতিত ব্যক্তি যদি মারা গিয়ে থাকে, তবে শুধু তার অভিভাবক বা উত্তরাধিকারীই বাদী হতে পারে। তবে কোনো উত্তরাধিকারী না থাকলে শাসক ও বিচারক তার অভিভাবক হবে। এছাড়া অন্য কেউ বাদী হতে পারেনা। এসব অপরাধকে 'কিয়াস' সংক্রান্ত অপরাধ বলা হয়। হত্যার অপরাধও কিসাস সংক্রান্ত অপরাধ। এটি হুদুদের অপরাধ নয়। সূরা বনী ইসরাইলের ৩৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে :
---------------------------------------------------------------------------------
"ন্যায়সঙ্গত কারণ ব্যতিত কাউকে হত্যা করোনা। যাকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হয়, আমি তার অভিভাবককে কিসাস দাবি করার অধিকার দিয়েছি।"
এখানে কুরআনে অভিভাবকের অধিকার বুঝাতে সুলতান' শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। এর অর্থ হলো স্বীকৃত বা প্রদত্ত ক্ষমতা (Locus standi) যার বলে সে কিসাসের দাবি জানাতে পারে। আল্লাহর এই উক্তি থেকে ইসলামি আইনের এই মৌল তত্ত্ব উদগত হয় যে, খুনের মামলায় আসল বাদী সরকার নয় নিহতের অভিভাবক। আর নিহতের অভিভাবক বলতে ইসলামের উত্তরাধিকার আইন অনুসারে যারা নিহতের পরিত্যক্ত সম্পত্তির অংশ পায় তাদেরকেই বুঝায়।
ইমাম কাসানী রহ. স্বীয় গ্রন্থ 'আলবাদায়ে ওয়াস্ সানায়ে' এর ৭ম খণ্ডে
-----------------------------------
"কিসাস বা খুনের বদলা চাওয়ার অধিকারী কে কে" শিরোনামে বলেন :
"নিহত ব্যক্তির হয় উত্তরাধিকারী থাকবে, না হয় থাকবে না। যদি তার উত্তরাধিকারী থেকে থাকে, তাহলে সেই উত্তরাধিকারীই নিহত ব্যক্তির প্রতিনিধি ও স্থলাভিষিক্ত হয়ে থাকে এবং প্রত্যেক উত্তরাধিকারী নিহত ব্যক্তির পক্ষ থেকে খুনের বদলা ঋণ ইত্যাদির ব্যাপারে বাদী হয়ে থাকে।"
এই মৌল বিধান ফিকাহ শাস্ত্রের অন্যান্য গ্রন্থেও লেখা রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, হিদায়ার হত্যা সংক্রান্ত অধ্যায়ে বলা হয়েছে :
"উত্তরাধিকার যেভাবে অর্জন করা যায় কিসাসও সেইভাবে আদায় করতে হয়। উত্তরাধিকারী মৃত ব্যক্তির কাছ থেকে তার পরিত্যাক্ত সম্পদের প্রাপ্য অংশ ও ঋণ যেভাবে পায়, কিসাসও সেভাবেই পাবে। কেননা কিসাস হচ্ছে প্রাণের বদলা। অন্যান্য আর্থিক প্রাপ্য ও রক্তপণে মালিকানা ও অধিকার যার প্রাপ্য, কিসাসেও মালিকানা ও অধিকার তারই প্রাপ্য হবে।"
হিদায়ার ব্যাখ্যা গ্রন্থ 'ইনায়া'তে এবং অপর ব্যাখ্যা গ্রন্থ 'ফাতহুল ক্কাদীরে' উপরোক্ত মৌল বিধান উল্লেখ করার পর আরো ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে : "ইমাম আবু হানিফার মতে মূল তত্ত্ব এই যে, কিসাস আদায় করা উত্তরাধিকারীর এখতিয়ারাধীন।"
ইমাম আবু হানিফার দুই শিষ্য ও সহচর ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মদের যুক্তি ফাতহুল ক্কাদীরে নিম্নরূপ বর্ণনা করা হয়েছে :
"ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মদের মতে কিসাস আদায় করা প্রাথমিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বা নির্যাতিত ব্যক্তির স্বত:সিদ্ধ অধিকার। (সে জীবিত থাকলে নিজেই আদায় করবে, যেমন কোনো অঙ্গ প্রত্যঙ্গের ক্ষয়ক্ষতি হয়ে থাকলে তার কিসাস বা ক্ষতিপূরণ অর্জন করবে, আর মারা গিয়ে থাকলে) এ অধিকার সর্বোতভাবে উত্তরাধিকার সূত্রে উত্তরাধিকারীর প্রতি হস্তান্তরিত হবে, ঠিক যেমন মৃত ব্যক্তির অন্যান্য সহায়সম্পদ উত্তরাধিকারীদের মালিকানায় হস্তান্তরিত হয়ে থাকে।"
ইসলামি শরিয়তের আরো একটি বিধান এই যে, দায়িত্বশীল পর্যায়ে লোকদের ভুলক্রটি হলে তাদের অধিকতর কঠোর জবাবদিহির সম্মুখীন হতে হয় এবং সাধারণ মানুষের তুলনায় তাদের সাথে নম্র ও সদয় আচরণের পরিবর্তে অধিকতর কঠোর আচরণ করা হয়। সূরা আহযাবের ৩০ নম্বর আয়াতে উম্মুল মুমিনীনদেরকে বলা হয়েছে :
---------------------------------------------------------------------------------
"হে নবী সহধর্মিনীগণ তোমাদের কেউ কোনো সুস্পষ্ট অন্যায় কাজে লিপ্ত হলে তাকে দ্বিগুণ শাস্তি দেয়া হবে।"
এর অর্থ এই নয় যে, তাদের দ্বারা এ ধরণের কিছু ঘটার আশংকা ছিলো। বরং এ কথার উদ্দেশ্য ছিলো তাদেরকে এই মর্মে সতর্ক করা যে, ইসলামি সমাজে তাদের মর্যাদা যতো উঁচু, সে অনুপাতে তাদের দায়িত্ব ততোই কঠোর। হানফি ফিকাহ শাস্ত্রের নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ 'আলবাহরুর বায়েকের' বরাত দিয়ে মাওলানা আব্দুস শাকুর লাখনোভী সাহেব স্বীয় গ্রন্থ 'ইলমুল ফিকাহ'র তৃতীয় খণ্ডে 'রোযার কাযা ও কাফফারা' শিরোনামে লিখেছেন :
"কোনো রাজার উপর কাফফারা ওয়াজিব হলে তাকে দাসমুক্ত করা বা ৬০ জন দরিদ্র ব্যক্তিকে আহার করানোর নির্দেশ দেয়া উচিত নয়। কারণ এটা তার পক্ষে মোটেই কঠিন কাজ নয়। এতে তার কোনো শিক্ষা হবেনা। তাকে বরং ৬০টি রোযা রাখার নির্দেশ দেয়া উচিত। এটা তার জন্য কঠিন কাজ হবে এবং এতে হয়তো পরবর্তী রমযানের রোযা এভাবে নষ্ট করবেনা।"
শাস্তিদানের ব্যাপারে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে সরাকারেরও বিশেষ শাস্তি প্রয়োগের ক্ষমতা রয়েছে। এ প্রসঙ্গে আব্দুর রহমান আলজাযরী স্বীয় গ্রন্থ 'আলফিকহু আলাল মাযাহিবিল আরবায়ার' ৫ম খণ্ডে ২৬৫ পৃষ্ঠায় লিখেছেন :
"যদি নিহত ব্যক্তির অভিভাবকরা হত্যাকারীকে ক্ষমা করে দেয় এবং ম্যাজিস্ট্রেট অনুভব করে যে তাকে মাফ করলে জননিরাপত্তা বিপন্ন হবার আশংকা রয়েছে, তাহলে তিনি ঐ ক্ষমার পরেও হত্যাকারীকে যে শাস্তি দিতে চান দিতে পারেন।"
এখানে উল্লেখিত বিধানের আলোকে ইসলামি আদালতে গৃহীত কার্যক্রমের একটি দৃষ্টান্তও লক্ষ্য করুন।
গুজরাটের শাসনকর্তা প্রথম আহমাদ শাহর (মৃত্যু ১৪৩২ খৃস্টাব্দ) জামাতা তারুণ্য ও রাজকীয় আত্মীয়তার সুবাদে ঔদ্ধত্য ও অহংকারের বশে এক নিরপরাধ ব্যক্তিকে খুন করে। সুলতান প্রথম আহমদ শাহ যখন ঘটনা জানতে পারলেন, তখন স্বীয় জামাতাকে বেঁধে কাযীর দরবারে পাঠিয়ে দিলেন। কাযী নিহত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীদেরকে দুশো উট দিয়ে আপোশ করিয়ে জামাতাকে সুলতানের কাছে হাজির করলেন। সুলতান বললেন : নিহত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীরা ক্ষমা করতে রাজি হয়ে গেলেও আমি স্বয়ং এটা মানতে রাজি নই। কারণ এভাবে বিত্তশালী লোকেরা অবৈধ হত্যাকাণ্ডে দু:সাহসী হয়ে উঠবে। অবশেষে সুলতানের জামাতাকে হত্যা করা হয়। সুলতানের আদেশে তার লাশ একদিন ফাঁসিতে ঝুলতে থাকে, যাতে জনগণ শিক্ষা গ্রহণ করে। (মিরয়াতে সেকেন্দারী, পৃ. ৪৫-৪৬ ও 'হিন্দুস্থান কে আহদে রফতা সাচ্চি কাহানিয়া' উপমহাদেশের অতীত যুগের সত্য ঘটনাবলী আযম গড় থেকে মুদ্রিত, পৃ. ১৫৫) [তরজমানুল কুরআন, ফেব্রুয়ারি ১৯৮০]
|
সর্বশেষ আপডেট ( Friday, 04 March 2011 )
|