রাসায়েল ও মাসায়েল ৬ষ্ঠ খন্ড |
|
|
লিখেছেন সাইয়্যেদ আবুল আ'লা মওদূদী
|
Monday, 28 February 2011 |
পাতা 55 মোট 74
<h1>৫৩। ইসলামের উত্তরাধিকার আইন সম্পর্কে অভিযোগ</h1>
প্রশ্ন : আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাণিজ্য বিভাগের একজন ছাত্র। মাওলানা মওদূদী এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত ইসলামি আন্দোলনের মর্যাদা ও গুরুত্ব অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করি। অর্থনীতি ও ভূমি ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে আমাদের জনৈক অধ্যাপক সম্প্রতি মন্তব্য করেন, ভূমি এতো ছোট টুকরায় বিভক্ত হওয়া উচিত নয়। এতে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে তা অলাভজনক (uneconomic) হয়ে যায়। এরপর আলোচনা ইসলামের দিকে মোড় নেয় এবং তিনি বলেন, ইসলামের উত্তরাধিকার আইনও ভূমির খণ্ডবিখণ্ড হওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এ অভিযোগের কোনো সন্তোষজনক জবাব তাৎক্ষণিকভাবে আমার মাথায় আসেনি। আপনি অনুগ্রহপূর্বক বুঝিয়ে দিন, এই যুক্তি ও অভিযোগ কতোখানি সঠিক এবং তা কিভাবে নিরসন করা যায়? কেউ কেউ যুক্তি দেখান, এ কারণেই সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ভূমি এবং উৎপাদনের উৎসকে ব্যক্তিমালিকানা থেকে সরিয়ে নিয়ে গোটা সমাজের মালিকানায় অর্পণ করা হয়। আমি যদিও ইসলামি আকীদা বিশ্বাসে অটল এবং ইসলামের প্রতিটি নির্দেশ ও বিধানকে নির্বিবাদে সমর্থন করি, তথাপি মনের তৃপ্তি এবং আপত্তি উত্থাপনকারী ও বিরোধিতাকারী মহলের জবাব দেয়ার উদ্দেশ্যে অধিকতর নির্দেশনা ও নিশ্চয়তা কামনা করি।
জবাব : আপনার চিঠি পড়ে খুবই অবাক হলাম। প্রথমত, এ জন্য অবাক হলাম যে, ইসলামি বিরোধী মহলের আপত্তি অভিযোগ কতো সহজে আমাদের সমাজে বিস্তার লাভ করে। দ্বিতীয়ত, এ জন্য যে, এ ধরণের আপত্তি ও অভিযোগের কোনো সঠিক ও সমুচিত জবাব দেয়া হয়না। অথচ একজন মুসলমান সামান্য একটু চিন্তা করলে নিজে নিজেই এর জবাব খুঁজে পেতে পারে এবং অন্যদেরেকেও দিতে পারে।
আলোচ্য অভিযোগটাই ধরা যাক। বলা হচ্ছে, ইসলামের উত্তরাধিকার আইন ভূমিকে খণ্ড-বিখণ্ড করতে করতে এতো ছোট করে ফেলে যে, অভিযোগকারীদের ভাষায় তা অলাভজনক হয়ে দাঁড়ায়। এর প্রথম জবাব এই যে, পৃথিবীতে যেখানেই একজন মানুষের বৈধ উপায়ে ভূমি কিংবা অন্যান্য উৎপাদনের উৎসের মালিক হওয়ার অধিকার স্বীকার করা হবে, সেখানে এই মালিকানা অধিকারের স্বীকৃতি থেকেই আপনা আপনি এ কথাও প্রমাণিত হবে যে, সে নিজের মালিকানাধীন সম্পত্তির যতোটুকু আপন জীবদ্দশায় বিনামূল্যে অথবা মূল্যের বিনিময়ে অন্য কারো নিকট হস্তান্তর করতে পারে। আর মৃত্যুর পর ওসীয়ত বা উত্তরাধিকার সূত্রে তার সম্পত্তি এক বা একাধিক উত্তরাধিকারী বা প্রতিনিধির নিকট হস্তান্তরিত হতে পারে। এটা মেনে নেয়া না হলে এমন নিয়ম প্রবর্তন করতে হবে যে, কারো কাছে যতোখানি ভূমি বা সম্পত্তি থাক, তা পুরোপুরিভাবে অন্যের নিকট হস্তান্তরিত হতে হবে। কোনো রকম খণ্ডিত হওয়া চলবেনা। নচেত এভাবে খণ্ডিত হতে হতে এক সময় তার পরিমাণ এতো কম হয়ে যাবে যে, এইসব অর্থনৈতিক পণ্ডিতদের মতানুসারে তা অলাভজনকে (uneconomic) পরিণত হবে।
অন্যকথায় এর অর্থ দাঁড়ায় এই যে, অলাভজনক হওয়ার কল্পিত আশংকা থেকে নিস্তার পাওয়ার উদ্দেশ্যে সম্পত্তির ব্যবহার ও হস্তান্তরের অধিকার সীমিত রাখতে হবে এবং উত্তরাধিকারের প্রচলিত ধারা বদলে দিতে হবে। যার কাছে দশ একর জমি আছে, সে তা বিক্রি করতে বা অন্য কোনোভাবে হস্তান্তর করতে চাইলে পুরো জমিটাই হস্তান্তর করতে হবে। আর সে মারা গেলে তার স্ত্রী ও একাধিক সন্তান থাকলেও তাদের কোনো একজনকেই উত্তরাধিকার দিতে হবে এবং বাদবাকী সবাইকে বঞ্চিত করতে হবে। অন্যথায় একাধিক পুত্র থাকলে এবং তাদের মধ্যে সমান হারে বন্টন করা হলে পুনরায় সেই একই পরিস্থিতির উদ্ভব হবে। পাশ্চাত্য সমাজে দীর্ঘকাল ধরে এবং কোথাও কোথাও এখনো প্রথম সন্তানের উত্তরাধিকার লাভের আইন (Law of phimo Beniture) চালু আছে। এ আইনে জ্যেষ্ঠ পুত্রকে সকল সম্পত্তির উত্তরাধিকারী করে বাদবাকী সবাইকে বঞ্চিত করা হয়। তদের দৃষ্টিতে ন্যায়নীতি, সাম্য, ধর্ম ও নৈতিকতার দাবি যেনো এটাই যে, সমান সমান অংশের হকদারদের মধ্যে থেকে কেবল একজনকে গোটা সম্পত্তি দিয়ে দেয়া হবে আর অন্যদেরকে শুধু এ জন্য বঞ্চিত রাখা হবে, যেনো সম্পত্তি ক্রমান্বয়ে ভাগ হতে না থাকে।
এর বিকল্প আর একটা সমাধান সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি থেকে উদ্ভাবন করা হয়েছে। সেটি হলো, জাতীয় মালিকানার প্রতারণাপূর্ণ ধূয়া তুলে প্রতিটি মানুষের মালিকানা হরণ করার চেষ্টা করা হয় এবং জাতির কতিপয় পরাক্রমশালী ব্যক্তির হাতে সমগ্র জাতির যাবতীয় সম্পদ ও উপায় উপকরণ দিয়ে দেয়া হত। এটা কি সত্য নয় যে, সমাজতান্ত্রিক দেশের কৃষক শ্রমিকের অবস্থা অন্যান্য পাশ্চাত্য দেশের মেহনতী মানুষের তুলনায় বহুগুণ বেশি শোচনীয়। লাখ লাখ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে ও জেল জুলুমের শিকার করা হয়েছে। কৃষি খামারগুলোতে কর্মরত শ্রমিকরা নিজেরা না খেয়ে মরলেও যে পরিমাণ ফসল উর্ধতন কর্মকর্তাদের কাছে হাজির করতে বলা হয়, তা ঠিকমতই হাজির করা হয়। কখনো কখনো যৌথ খামারে কর্মরত মায়েদের শিশু সন্তান পর্যন্ত পুরো খোরাক পায়না। এটা কেবল পুঁজিবাদের অভিযোগ নয়, সারা দুনিয়ার প্রচারিত সমাজতান্ত্রিক পুস্তকাদিতেও এসব বাস্তব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
এরপর ইসলামি কিংবা অন্য কোনো উত্তরাধিকার আইনের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তোলা হয়েছে, তার সোজা ও সহজ জবাব হলো, এ সম্পত্তি বিভাজ্য নয় কিংবা ভাগ করলে লাভজনক হয়না, তাকে তার মালিকগণ যৌথ মালিকানায় বহাল রেখেও লাভবান হতে পারে।। দশ একর জমিতে দশজন মালিকের সত্ত্ব অক্ষুন্ন রেখেও তাকে কাজে লাগানো যায়। জমিকে খণ্ডবিখণ্ড না করে তার ফসল ভাগ করে নেয়া যায়। একজন উত্তরাধিকারী ইচ্ছে করলে নিজের অংশ বিক্রি করে দিতে পারে এবং অপর ব্যক্তি তা কিনে নিতে পারে। ইচ্ছে করলে সকলে মিলে গোটা জমি অন্যের কাছে বিক্রি করে দিয়ে মূল্য পরস্পরে বন্টন করে নিতে পারে। এই কর্মপন্থা ঘরোয়া সম্পত্তি, বাড়ি, দোকান, বাণিজ্য পণ্য, এক কথায় সব রকমের সম্পত্তির বেলায় অবলম্বন করে চলে।
বহু কারখানা ও যৌথ ব্যবসা সংস্থা এমন রয়েছে যাতে ব্যক্তি মালিকানা ও উত্তরাধিকারের সকল নীতি বজায় রাখা হয়, অথচ এসব সংস্থা তার নির্দিষ্ট রূপ নিয়ে পুরুষানুক্রমিকভাবে টিকে থাকে। সমবায় খামার সমবায় নীতির ভিত্তিতে একাধিক মালিক নিজ নিজ সম্পত্তি থেকে সম্মিলিতভাবে লাভবান হতে পারেন।
উত্তরাধিকারের অর্থ এটা নয় যে, সম্পত্তির খণ্ডিত বন্টন হতেই হবে। এর অর্থ শুধু এই যে, প্রত্যেক উত্তরাধিকারীর উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্য অংশ স্বীকৃত ও সংরক্ষিত থাকা চাই। একাধিক মালিক বা উত্তরাধিকারী ইচ্ছে করলে আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহারের মাধ্যমে বড় বড় ভূ-সম্পত্তিকে একত্রে যৌথ পরিচালনাধীন রেখে তা থেকে সব রকমের ফসলাদি লাভ করতে পারে।
|
সর্বশেষ আপডেট ( Friday, 04 March 2011 )
|