আমাদের টাইপ করা বইগুলোতে বানান ভুল রয়ে গিয়েছে প্রচুর। আমরা ভুলগুলো ঠিক করার চেষ্টা করছি ক্রমাগত। ভুল শুধরানো এবং টাইপ সেটিং জড়িত কাজে সহায়তা করতে যোগাযোগ করুন আমাদের সাথে।
রাসায়েল ও মাসায়েল ৬ষ্ঠ খন্ড প্রিন্ট কর ইমেল
লিখেছেন সাইয়্যেদ আবুল আ'লা মওদূদী   
Monday, 28 February 2011
আর্টিকেল সূচি
রাসায়েল ও মাসায়েল ৬ষ্ঠ খন্ড
গ্রন্থকার পরিচিতি
১। আল্লাহর অস্তিত্ব সম্পর্কে সংশয় নিরসন
২। আল্লাহ ও তাঁর রসুলগণের মধ্যে পার্থক্য করা
৩। জীবজন্তুর উপর দয়া
৪। পাঁচ ওয়াক্ত ও পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায
৫। হানাফি মাযহাবে কি কিছু কিছু মাদক দ্রব্য হালাল?
৬। আদালতের রায় কি শুধু জাহেরীভাবেই কার্যকর, নাকি বাতেনীভাবেও কার্যকর?
৭। সুন্নাহর আইনগত মর্যাদা
৮। সাহরির শেষ সময় কোনটি?
৯। একটি হাদিস থেকে সুদের বৈধতা প্রমাণের অপচেষ্টা
১০। মুসলিম উম্মাহর বহু গোষ্ঠিতে বিভক্তি এবং মুক্তি লাভকারি গোষ্ঠি
১১। কালো খেজাব লাগানো কি বৈধ?-১
১২। কালো খেজাব কি বৈধ?-২
১৩। তাকদীর প্রসঙ্গ
১৪। গোমরাহী ও হেদায়েত
১৫। সূরা আন নাজমের প্রাথমিক আয়াত কয়টির ব্যাখ্যা
১৬। যাকাতকে প্রচলিত করের সাথে যুক্ত করা যায় না
১৭। পিতামাতার অধিকার
১৮। লোহার আংটি পরা কি জায়েয?
১৯। উশর ও খারাজের কয়েকটি সমস্যা
২০। উশরযোগ্য ফল ফসল কি কি?
২১। মোজার উপর মসেহ করার বিধান
২২। কারো সম্মানে দাঁড়ানো কি জায়েয?
২৩। 'প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ দান করা' সংক্রান্ত কুরআনের আদেশের ব্যাখ্যা
২৪। অপ্রাপ্ত বয়স্ক সন্তানদের ভরণ পোষণ প্রসঙ্গে
২৫। কবর আযাব
২৬। কুরআন শিক্ষাদান ও অন্যান্য ধর্মীয় কাজের পারিশ্রমিক নেয়া কি বৈধ?
২৭। ইসলামের ফৌজদারী দণ্ডবিধি সংক্রান্ত কিছু ব্যাখ্যা
২৮। বেতের নামাযে দোয়া কুনূত
২৯। লাইসেন্স ক্রয় বিক্রয়
৩০। কিবলার দিক নির্ণয়ের শরিয়তসম্মত বনাম বিজ্ঞানসম্মত পন্থা
৩১। মৃত ব্যক্তির জন্য ফিদিয়া দান, শোক ও কুরআন খতম
৩২। কয়েদি সৈন্যরা কি নামায কসর করবে
৩৩। পবিত্র কুরআন ও গুপ্ত ওহি
৩৪। ব্যভিচারের অপবাদ
৩৫। কোন কোন প্রাণী হালাল বা হারাম
৩৬। কুরবানীর চামড়া সম্পর্কে শরিয়তের বিধান
৩৭। মৃত ব্যক্তির চামড়া সম্পর্কে শরিয়তের বিধান
৩৮। মৃত প্রাণীর চামড়া সম্পর্কে আরো আলোচনা
৩৯। জবাই হালাল হওয়ার জন্য কি বিস্
৪০। যাকাত সংক্রান্ত কিছু খোলামেলা কথা
৪১। নগদ পুঁজির যাকাত ও তার নিসাব
৪২। বাইয়ে সালাম
৪৩। হযরত আলী রা.-এর জন্য সূর্যকে ফিরিয়ে দেয়ার ঘটনা কি সত্য?
৪৪। কুরাইশের ১২ জন খলিফা ও 'ফিতনায়ে আহলাস'
৪৫। আল্লাহ ও রসূলের কোনো উক্তি কি মানুষকে কর্মবিমুখ করতে পারে?
৪৬। আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয় করা সত্ত্বেও দৈন্যদশার কারণ কি?
৪৭। হযরত আলী রা.-এর বর্ম চুরি-১
৪৮। হযরত আলী রা.-এর বর্ম চুরি-২
৪৯। ইসলামের দৃষ্টিতে গানবাজনা ও নারী পুরুষের মেলামেশা
৫০। আব্দুল্লাহ বিন উবাইর জানাযা
৫১। ইমাম ইবনে তাবারি কি শিয়া ছিলেন?
৫২। ফৌজদারি অপরাধের ক্ষেত্রে আপোস নিষ্পত্তির অধিকার
৫৩। ইসলামের উত্তরাধিকার আইন সম্পর্কে অভিযোগ
৫৪। শরিয়তের দৃষ্টিতে ওয়াকফের সংজ্ঞা ও বিধান
৫৫। আত্মহননকারীর জানাযা নামায
৫৬। হারুত মারুত ফেরেশতাদ্বয় সম্পর্কে এক ভিত্তিহীন অলীক কাহিনী
৫৭। 'চাটান' সম্পাদকের নিকট দুটো চিঠি
৫৮। হাদিস অস্বীকার করা ও স্বীকার করা
৫৯। হাদিস বিরোধী গোষ্ঠির বিভ্রান্তিকর প্রচারণা
৬০। একটি হাদিস সম্পর্কে আপত্তি ও তার জবাব
৬১। সন্তান পালনে নারীর অধিকার
৬২। স্তনের দুধ পানে বিয়ে হারাম হওয়া
৬৩। পারিবারিক আইন ও অর্পিত তালাক
৬৪। ফাসিদ বিয়ে ও বাতিল বিয়ে
৬৫। রসূল সা. কি হযরত সওদা রা. কে তালাক দিতে চেয়েছিলেন?
৬৬। উম্মুল মুমিনীন হযরত সওদার বিয়ে সম্পর্কে আরো আলোচনা
৬৭। কতোখানি দুধ পান করলে বিয়ে হারাম হয়?
৬৮। পিতামাতার আদেশে স্ত্রী তালাক দেয়া যায় কি?
৬৯। রসুল সা.-এর একাধিক বিয়ের যৌক্তিকতা ও সার্থকতা
৭০। বেলুচিস্তানের বাগদান প্রথা
৭১। লটারি ও নির্বাচনী লটারি
৭২। সমবায় সমিতি

<h1>৫৫। আত্মহননকারীর জানাযা নামায</h1>
প্রশ্ন : জনৈক মৌলবি সাহেব খুবই জোর দিয়ে বলে থাকেন, আত্মহননকারীর জানাযা পড়া হারাম। তিনি এ কথা নিয়ে সর্বত্র সোচ্চার। তাকে জানানো হলো যে, এ বিষয়ে আপনার সাথে চিঠির আদান প্রদান হয়েছে এবং আপনি সংক্ষিপ্তভাবে জবাব দিয়েছেন যে, রসূল সা. আত্মহননকারীর জানাযা পড়তে বা পড়াতে নিষেধ করেছেন এমন কোনো প্রমাণ হাদিসে পাওয়া যায়না। কেবল এতোটুকু জানা যায় যে, তিনি নিজে জানাযা পড়াননি, কিংবা বলেছেন যে আমি তো পড়াবো না এতে ঐ মৌলবী সাহেব বলেন, আপনি সংক্ষিপ্ত জবাব দিয়ে দায় সেরেছেন এবং এ জবাব অজ্ঞাতপ্রসূত। তিনি যথারীতি জোর দিয়েই বলে যাচ্ছেন, আত্মহননকারীর জানাযা পড়া অকাট্যভাবে নাজায়েয ও নিষিদ্ধ। তিনি আরো বলেন, আবু দাউদ শরিফ, নাসায়ী শরিফ, ফাতওয়ায়ে আযীযিয়া প্রথম খণ্ড, ফাতওয়ায়ে নুরুল হুদা, তাহাবী, জামেয়ূর রুমুয, বুলুগুল মুরাম, নবম শ্রেণীর ইসলামিয়াত এই সমস্ত পুস্তকে আত্মহননকারীর জানাযা নিষিদ্ধ লেখা রয়েছে এবং এসব গ্রন্থের লেখকগণ এটা অবৈধ মনে করেন। তিনি 'কাশফুল গুষ্মা' নামক গ্রন্থের বরাত দিয়েছেন। তার ধারণা, আপনি এসব কিতাব দেখেননি অথবা পড়তে পারেননা।

অনুগ্রহপূর্বক বিশদভাবে জানাবেন, এ ধরণের লোকের জানাযা পড়া জায়েয আছে কিনা? যিনি জানাযা পড়বেন বা পড়াবেন তিনি কি গুনাহগার হবেন? মৌলবী সাহেবের ফতোয়া অনুযায়ী তো তিনি গুনাহগার হবেন। আমাদের আশংকা, এ জিনিসটা বেশ বড় রকমের কোন্দলের জন্ম দিতে পারে এবং সুস্পষ্ট জবাব না দেয়া পর্যন্ত সে কোন্দল হয়তো থামবেনা।

জবাব : আত্মহননকারীর জানাযা পড়ার ব্যাপারটা ফিকাহ শাস্ত্রকারগণ ও হাদিসবেত্তাগণের মধ্যে বিতর্কিত এবং খোদ হানাফি ফিকাহবিদদের মধ্যে এ বিষয়ে মতভেদ বয়েছে। তবে আমার মতে অগ্রগণ্য মত হলো, আত্মহত্যাকারীর জানাযা পড়া জায়েয। কিন্তু মুসলিম সমাজের গণ্যমাণ্য ব্যক্তিবর্গ  ইচ্ছে করলে নামাযে অংশগ্রহণ  নাও করতে পারেন। কোনো মুসলমান কবিরা গুনাহে লিপ্ত হবার কারণে কাফের হয়ে যায়না। সুন্নি মুসলমানরা এ ব্যাপারে একমত। যে ব্যক্তি ঈমান ও ইসলামের চৌহদ্দী থেকে বেরিয়ে যায়না, তার জন্য মাগফিরাতের দোয়া করা যেমন জায়েয, জানাযা পড়াও তেমনি জায়েয বলে আমি মনে করি। কেননা জানাযাও এক ধরণের মাগরিফাতের দোয়া ছাড়া আর কিছু নয়। পবিত্র কুরআনে শুধুমাত্র মুশরিকদের জন্য ক্ষমা চাইতে নিষেধ করা হয়েছে, অথবা যে ব্যাক্তির মুনফেকী সর্বজনবিদিত ছিলো এবং রসূল সা.-কে জানানোও হয়েছিল, সেরূপ ব্যক্তির জানাযা পড়া থেকে তাঁকে বিরত রাখা হয়েছিল। এছাড়া আর কোনো গুনাহগার বা পাপাচারীর জানাযা যদি রসূল সা. নিজে না পড়িয়ে থাকেন,  তবে আমার মতে, সেটা কোনো এক ধরণের তিরষ্কার ভৎর্সনা ছিলো এবং তা অনেক সময় নিতান্তই সাময়িক ব্যাপার বলে গণ্য হতো। এ দ্বারা এ কথা বুঝানো হয়নি যে, এ ধরনের লোকের জানাযা অন্য কেউ পড়তে পারবেনা। বরঞ্চ কোনো কোনো সময় তিনি তার জানাযা পড়ার জন্য সাহাবিগণকে নির্দেশ দিয়েছেন। এর একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো ঋণগ্রস্থ ব্যক্তির জানাযা। কোনো সাহাবি ইন্তিকাল করলেই তিনি জিজ্ঞেস করতেন, এই ব্যক্তি ঋণগ্রস্থ নয় তো? যদি হতো, তাহলে তিনি নিজে জানাযা পড়াতেননা, তবে অন্যান্য সাহাবিকে পড়তে আদেশ দিতেন। পরবর্তীকালে এরূপ ব্যবস্থাও হয়েছিল যে, কোনো ব্যক্তি ঋণ পরিশোধের দায়িত্ব নিতো কিংবা যদি বায়তুলমাল থেকে পরিশোধ করার ব্যবস্থা নেয়া হতো তবেই রসূল সা. জানাযা পড়িয়ে দিতেন। আত্মহননকারীর ব্যাপার তদ্রুপ। আমার জানামতে রসূল সা. আত্মহত্যার জানাযা পড়তে নিষেধ করেছেন এবং তাকে বিনা জানাযায় দাফন করা হয়েছে-এমন কথা কোনো সহীহ হাদিসে নেই। যে অপরাধের সংঘটকের জানাযা নামায পড়ানোর সদয় অনুমতি স্বয়ং রসূল সা. দিয়েছেন এবং সাহাবায়ে কিরাম যার জানাযা পড়েছেন তার জানাযা এখন সর্বোতভাবে নিষিদ্ধ করা কিভাবে জায়েয হয়, আমার বুঝে আসেনা। এটা আমার বিলক্ষণ জানা আছে যে, কতোক ফকিহ আত্মহত্যা ও অন্যান্য কবিরা গুনাহে লিপ্ত ব্যক্তির জানাযা না পড়ার পক্ষে ফতোয়া দিয়েছেন। কিন্তু আমি এই ফতোয়া সর্বক্ষেত্রে প্রয়োগ ঠিক মনে করিনা। ইমাম ইবনে হাযমের মতে অতি বড় গুনাহগার ব্যক্তিও মাগফিরাতের দোয়া ও জানাযা নামাযের মুখাপেক্ষী। তার এই মতটি আমার কাছে অগ্রগণ্য। আমি আগেই বলেছি, রসূল সা. স্বয়ং আত্মহত্যাকারীর জানাযা পড়াননি। হাদিসে শুধু এতোটুকুই পাওয়া যায়। মুসলিম শরিফের জানাযা সংক্রান্ত অধ্যায়ের শেষের দিকে হযরত জাবির বিন সামুরা থেকে বর্ণিত নিম্নোক্ত হাদিস উদ্ধৃত হয়েছে :
---------------------------------------------------------------------------------
"রসূল সা.-এর নিকট তীর বা বর্শার আঘাতে আত্মহত্যা করেছে এমন এক ব্যক্তির লাশ আনা হয়। তিনি তার জানাযা পড়াননি।"

এর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে ইমাম নববী বলেন যে, হযরত ওমর বিন আব্দুল আযীয ও ইমাম আওযায়ীর মতে এরূপ ব্যক্তির জানাযা জায়েয নেই। তবে ইমাম হাসান বসরী, ইমাম নাখয়ী, ইমাম মালেক, ইমাম আবু হানিফা, ইমাম শাফেয়ী ও অন্যান্য সংখ্যাগরিষ্ঠ আলেমের মতে তার জানাযা পড়া যাবে। এ হাদিসের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তাঁরা বলেন, রসূল সা.-এর জানাযা না পড়ানোর উদ্দেশ্য ছিলো কেবল জনগণকে সাবধান করা, যেনো তার  এই গুনাহর কাজ না করে। সাহাবায়ের কিরাম তার জানাযা পড়েছেন। এরপর ইমাম নববী সেই ঋণগ্রস্থ ব্যক্তির উদাহরণ দিয়েছেন এবং কাযী ইয়াযের উক্তি উদ্ধৃত করেছেন যে, প্রত্যেক মুসলমানের জানাযা পড়া উচিত  এটাই সকল আলেমের অভিমত, চাই তার উপর শরিয়তের দণ্ড কার্যকর হয়ে থাক, পাথর নিক্ষেপে মারা যাক কিংবা আত্মহত্যা করুক। আবু দাউদের জানাযা সংক্রান্ত অধ্যায়েও এই মর্মে একটি হাদিস রয়েছে এবং তাতে রসূল সা.-এর শুধুমাত্র এই কথাটির উদ্ধৃতি রয়েছে যে, আমি এ ব্যক্তির জানাযা পড়াবোনা। এ হাদিসের ব্যাখ্যায় ইমাম খাত্তাবী বলেন, অধিকাংশ ফকীহর মত, এরূপ ব্যক্তির জানাযা নামায পড়া হবে। হাফেয মুনযিরীও বলেছেন, রসূল সা.-এর জানাযা না পড়ানোর উদ্দেশ্য ছিলো মানুষকে হুশিয়ার করা। তিরমিযী শরিফের জানাযা সংক্রান্ত অধ্যায়েও এই মর্মে একটি হাদিস সন্নিবেশিত হয়েছে। হাদিসটি নিম্নরূপ :
---------------------------------------------------------------------------------
"হযরত জাবের বিন সামুরা জানান, এক ব্যক্তি আত্মহত্যা করেছিল, রসূল সা. তার জানাযা পড়াননি।"

এ হাদিসের ব্যাখ্যায় ইমাম তিরমিযী বলেন যে, আত্মহত্যাকারীদের জানাযা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। অনেকের মতে, প্রত্যেক মুসলমানের এমনকি আত্মহত্যাকারীরও জানাযা নামায জায়েয। ইমাম আহমদের মত হলো, নেতা ও শাসকের জানাযা পড়ানো ঠিক নয়। তবে অন্যদের পড়া উচিত। মাওলানা আব্দুর রহমান মুবারকপুরী স্বীয় গ্রন্থ 'তুহফাতুল আহওয়াযী'তে প্রথমে ইমাম নববীর উপরোক্ত বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন। অতপর 'নাইলুল আওতার' এর বরাত দিয়ে ইমাম শওকানীর উক্তি তুলে ধরেছেন যে, ইমাম মালেক, ইমাম শাফেয়ী, ইমাম আবু হানিফা এবং অধিকাংশ আলেমের মতে ঘোরতর পাপিরও জানাযা নামায পড়া জায়েয। আত্মহত্যাকারীর জানাযা যদিও রসূল সা. পড়াননি, কিন্তু সাহাবায়ে কিরাম পড়িয়েছেন। সুনানে নাসায়ী থেকেও এই বক্তব্য সমর্থিত হয়। কেননা হাদিসে রসূল সা.-এর কেবল এতোটুকু কথা উদ্ধৃত করা হয়েছে যে, ------------ 'তার জানাযা আমি তো পড়াবোনা।' এর তাৎপর্য অন্য কথায় এই দাঁড়ায় যে, রসূল সা. শুধু নিজেই জানাযা নামায থেকে বিরত থেকেছেন, কিন্তু সাহাবায়ে কিরামকে পড়বার অনুমতি দিয়েছেন।

আমি শুরুতেই বলেছি, হানাফি ফিকাহ শাস্ত্রবিদগণের মতামতও দু'রকমের পাওয়া যায়। তবে আমি মনে করি, জায়েয হওয়ার মতটিই অপেক্ষাকৃত শুদ্ধ ও অগ্রগণ্য। দুররে মুখতারে বলা হয়েছে :
                 ----------------------------------------------------------
"সজ্ঞানেও যদি কেউ আত্মহত্যা করে তবে তাকে গোসল দিতে হবে ও জানাযা পড়তে হবে। এটাই কার্যকর বিধান বা ফতোয়া।"

এই উক্তির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ইমাম ইবনে আবেদীন 'রদ্দুল মুখতারে' বলেন : "সেসব হিসেবে দাঁড় করেছেন, তাদের যুক্তির পক্ষে হাদিস থেকে সমর্থন পাওয়া যায়না। হাদিসে শুধু বলা হয়েছে যে, রসূল সা. জানাযা পড়াননি। শুধু শিক্ষা দেয়াই এর উদ্দেশ্য ছিলো।  এমন কথা বলা হয়নি যে, সাহাবায়ে কিরামও জানাযা পড়েননি। রসূল সা.-এর জানাযা পড়ানো এবং অন্যদের জানাযা পড়ানো এক কথা নয়। এরূপ ব্যক্তি তওবা করেনি বা তার তওবা কবুল হয়নি, এমন কথা বলা কঠিন। কেননা তওবা তো যে কোনো গুনাহগারের কবুল হতে পারে, এমনকি কাফেরেরও হতে পারে।"

'রদ্দুল মুকতার' গ্রন্থকারের উপরোক্ত অভিমত সম্পূর্ণ সঠিক ও ন্যায়সঙ্গত। যে ব্যক্তিকে সবাই মুসলমান বলে জানে এবং কাফের আখ্যায়িত করার মতো যথেষ্ট অকাট্য যুক্তি নেই, তাকে জানাযার নামায ও দোয়া দ্বারা উপকৃত হওয়ার অবাধ অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যায়না। কেননা হাদিসের সুস্পষ্ট উক্তি দ্বারা এ অধিকার প্রত্যেক মুসলমানকে দেয়া হয়েছে। হাদিসে এক মুসলমানের উপর অপর মুসলমানের প্রাপ্য যে কয়টি অধিকার বর্ণনা করা হয়েছে, জানাযা পড়া তার অন্যতম। তাছাড়া যে সমাজে আমরা বসবাস করছি, তাও দৃষ্টিপথে রাখতে হবে।

এখানে অসংখ্য লোক এমন রয়েছে, যারা নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত ইত্যাদি ফরয তরক করে চলছে এবং নরহত্যা, মদ্যপান, ব্যভিচার ও অন্যান্য কবিরা গুনাহে লিপ্ত। তাদের সবার জানাযা পড়া হবে, আর কেবল আত্মহত্যাকারীর জানাযা পড়া হবেনা এবং অন্যদেরকেও পড়তে নিষেধ করা হবে- এটা একটা অদ্ভুত ব্যাপার। এ কথা নি:সন্দেহে সত্য যে, আল্লাহ ও রসূল সা. যদি সুস্পষ্ট ভাষায় বলে দিতেন যে, আত্মহত্যাকারী বা অমুক কবিরা গুনাহকারীর জানাযা কোনো মুসলমান পড়তে পারবেনা, তাহলে আমরা কখনো এ হুকুম অমান্য করার ধৃষ্ঠতা দেখাতাম না। কিন্তু এ ধরণের সুস্পষ্ট নির্দেশ যখন নেই, তখন সঠিক তথ্যনির্ভর মত এবং সতর্ক কর্মপন্থা এটাই হতে পারে যে, আমরা কোনো ব্যক্তির জানাযা পড়তে না চাইলে নাই পড়লাম, কিন্তু যে ব্যক্তি কাফের নয় এবং ইসলামের গণ্ডির বাইরে নয়, তার জানাযা পড়া নিষেধ বলে ফতোয়া দেয়া উচিত নয় এবং অন্যদেরকেও জানাযা পড়া থেকে বিরত রাখা উচিত নয়।

যে মুসলমান কাফেরদের সাথে লড়াই করতে গিয়ে শহীদ হয়, তার সম্পর্কেও হানাফি মাযহাবের মত হলো,  তার জানাযা ওয়াজিব। কিন্তু বহু ইমাম ফকীহ ও মুহাদ্দিস বলেন, তার জানাযা পড়া হবেনা এবং তাকে গোসলও দেয়া হবেনা। এ ধরনের শহীদকে রক্তমাখা কাপড়সহই দাফন করতে হবে। আমি অকুন্ঠচিত্তে স্বীকার করি যে, এই দ্বিতীয় মতের সপক্ষে অধিকতর বিশুদ্ধ হাদিস রয়েছে। তবে হানাফি মতের সপক্ষেও নির্ভরযোগ্য হাদিস রয়েছে। যা হোক, শহীদের ব্যাপার স্বতন্ত্র এবং তার সাথে অন্য কোনো মৃত ব্যক্তিকে তুলনা করা যায়না, আত্মহত্যাকারীকে তো নয়ই। হাদিসে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলা হয়েছে যে, রক্তের প্রথম  ফোটা গড়ানো মাত্রই শহীদের সকল গুনাহ মাফ হয়ে যায়। হতে পারে, আল্লাহর পথে নিহত ব্যক্তির প্রতি বিশেষ সম্মান প্রদর্শনের প্রতীক হিসেবে এবং তাঁর গুনাহ মাফ হওয়ার সুনিশ্চিত ও অকাট্য প্রতিশ্রুতির কারণে তাঁর জানাযা বাদ দেয়ার বিধান রয়েছে।

আমার এ আলোচনার এরূপ অর্থ ঠিক হবেনা যে, আমি আত্মহত্যাকে নগণ্য পদঙ্খলন মনে করি। আত্মহত্যা নি:সন্দেহে এক সাংঘাতিক ও গুরুত্বর মহাপাপ। সহীহ হাদিসে এর পরিণতি জাহান্নাম বলে ঘোষণা করা হয়েছে এবং রসূল সা. বলেছেন : যে অস্ত্র দ্বারা কোনো ব্যক্তি আপন  প্রাণ সংহার করে দোযখে সেই অস্ত্রই চিরস্থায়ী নির্যাতন যন্ত্র হিসেবে তার উপর চাপিয়ে দেয়া হবে এবং সে তা দ্বারা নিরন্তর আত্মহত্যার ব্যর্থ চেষ্টা চালাতে থাকবে। এ কাজ চরম কাপুরুষতা ও আল্লাহর প্রতি কুধারণা, হতাশা ও অকৃতজ্ঞতা পোষণের প্রমাণ বহন করে। তাই এ কাজ কোনো অবস্থাতেই কোনো মুসলমানের জন্য জায়েয নয়। কোনো মানুষ নিজের প্রাণের স্রষ্টাও নয়, মালিকও নয় যে, যখন ইচ্ছে এবং যেভাবে ইচ্ছে, তাকে ধ্বংস করবে। তথাপি এমন হতভাগা মানুষ যদি মুসলমান হয়ে থাকে, তবে তার জানাযা পড়া আমার মতে জায়েয। হয়তো বা আল্লাহ তাকে মাফ করে দিতেও পারেন, চাই সেটা শাস্তি ভোগের পরেই হোক। [তরজমানুল কুরআন, জুলাই ১৯৭৫]



সর্বশেষ আপডেট ( Friday, 04 March 2011 )