 |
|
 |
আমাদের টাইপ করা বইগুলোতে বানান ভুল রয়ে গিয়েছে প্রচুর। আমরা ভুলগুলো ঠিক
করার চেষ্টা করছি ক্রমাগত। ভুল শুধরানো এবং টাইপ সেটিং জড়িত কাজে সহায়তা
করতে যোগাযোগ করুন আমাদের সাথে।
রাসায়েল ও মাসায়েল ৬ষ্ঠ খন্ড |
|
|
লিখেছেন সাইয়্যেদ আবুল আ'লা মওদূদী
|
Monday, 28 February 2011 |
পাতা 63 মোট 74
<h1>৬১। সন্তান পালনে নারীর অধিকার</h1>
প্রশ্ন : কাওসার পত্রিকার ৩০ জুলাই ১৯৫২ সংখ্যার ৬ষ্ঠ পৃষ্ঠায় এক প্রশ্নের উত্তরে বলা হয়েছে, "শরিয়তের বিধান অনুসারে তালাক সংঘটিত হলে সকল সন্তানকে নিজের কাছে রেখা দেয়া পিতার শুধু অধিকার নয়, বরং তার জন্য অপরিহার্য। মায়ের কোনো অধিকার নেই সন্তান কাছে রাখার।" অথচ হাদিসে এর বিপরীতে কথা বলা হয়েছে। নিম্নে কয়েকটি হাদিস উল্লেখ করা যাচ্ছে :
১. জনৈক মহিলা রসূল সা.-এর নিকট উপস্থিত হয়ে বলবো : "এ আমার ছেলে। একে আমি পেটে ধারণ করেছি, দুধ খাইয়েছি এবং কোলে পিঠে করে লালন পালন করেছি। এখন ওর বাপ আমাকে তালাক দিয়েছে এবং একে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে চায়।" রসূল সা. বললেন : "যতোদিন তুমি অন্য কোথাও বিয়ে না করবে, ততোদিন এ শিশুর উপর তোমার অধিকার বেশি।" [মিশকাত, শিশুর লালন পালন ও বয়োপ্রাপ্তি]
২. "একবার রসূল সা. এক ছেলেকে বললেন, তুমি ইচ্ছে করলে পিতার কাছে থাকতে পারো আবার ইচ্ছে করলে মাতার কাছে থাকতে পারো।" [মিশকাত, শিশুর লালন পালন ও বয়োপ্রাপ্তি]
৩. এক মহিলা রসূল সা.-এর কাছে হাজির হয়ে বললো : "আমার স্বামী আমার ছেলেকে নিয়ে যেতে চায়। অথচ এই ছেলে আমাকে পানি এনে দেয় এবং আমার অনেক কাজ লাগে।" রসূল সা. ছেলেটিকে বললেন : "এই তোমার পিতা আর এই তোমার মাতা। যার হাত ধরতে চাও, ধর।" ছেলেটি মায়ের হাত ধরলো এবং সে তাকে নিয়ে চলে গেলো। [মিশকাত, শিশুর লালন পালন ও বয়োপ্রাপ্তি]
৪. হযরত আবু হুরায়রা রা.-এর কাছে জনৈক ইরানী মহিলা এলো। তার সাথে ছিলো তার ছেলে এবং তার স্বামী তাকে তালাক দিয়েছিল। স্বামী স্ত্রী হযরত আবু হুরায়রার নিকট নিজেদের ঘটনা বর্ণনা করলো। স্ত্রী বললো, "আমার স্বামী আমার ছেলেকে নিয়ে যেতে চায়" হযরত আবু হুরায়রা বললেন : "সন্তানের ব্যাপারে লটারি করো।' স্বামী এসে বললো : "আমার ছেলের ওপর আমার অগ্রাধিকার নিয়ে কে বিতর্কে লিপ্ত হতে পারে?" তিনি বললেন : "আমি কথাটা বলেছি এই জন্য, আমি রসূল সা.-এর কাছে উপস্থিত থাকা অবস্থায় এক মহিলা এসেছিল। সে বললো, আমার স্বামী আমার ছেলেকে নিয়ে যেতে চায়। অথচ ছেলেটা আমার অনেক কাজ করে দেয় এবং পানি এনে দেয়। রসূল সা. বললেন : তোমরা লটারি দ্বারা নিষ্পত্তি করে নাও। পিতা বললো : আমার ছেলেকে নিয়ে কোনো বিতর্কের অবকাশ নেই। তখন রসূল সা. ছেলেকে বললেন : তোমার পিতা মাতা উভয়ে এখানে রয়েছে। যার হাত ধরতে চাও ধরো। ছেলেটি তার মায়ের হাত ধরলো।" (ঐ)
৫. রসূল সা. বলেছেন : যে ব্যক্তি মা ও তার সন্তানের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটবে, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তারও তার প্রিয়জনদের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে দেবেন।
অনুগ্রহপূর্বক উল্লেখিত হাদিস কয়টির আলোকে কাওসারের উক্তিটি শুধরে নেবেন।
জবাব : মনোযোগ আকর্ষণের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আলোচ্য প্রশ্নোত্তরটি যেভাবে কাওসারে ছাপা হয়েছে, তাতে আপনার মনে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক। প্রশ্নকর্তা নিজের বৃত্তান্ত অত্যন্ত বিস্তারিতভাবে লিখেও জানিয়েছিলেন, আবার মুখেও বলেছিলেন। তিনি বিশদ বিবরণ ও যুক্তিপ্রমাণের উল্লেখ ছাড়াই একটা সংক্ষিপ্ত ও অকাট্য জবাব দেয়ার দাবি জানিয়েছিলেন। এই প্রশ্নোত্তর প্রকাশিত হওয়ার কথা ছিলনা। কিন্তু এক অজ্ঞাত কারণে তিনি প্রশ্নের একটা খাপছাড়া সারসংক্ষেপ এবং আমর সংক্ষিপ্ত জবাব ছাপানোর ব্যবস্থা করে ফেলেন। যেভাবেই হোক, ছাপা যখন হয়েই গেছে এবং আপনি তার উপর আপত্তি তুলেছেন, তখন আমি পুনরায় নিজের বক্তব্য সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরছি।
আপনি যে পাঁচটি হাদিস উদ্ধৃত করেছেন, তার পঞ্চম হাদিসটি তো স্বামী স্ত্রীর বিচ্ছেদ ও শিশু সন্তান পালনের সাথে আদৌ সংশ্লিষ্ট নয়। ঐ হাদিসে মা ও সন্তান বলতে মূলত দাসি ও তার সন্তানকে বুঝানো হয়েছে। সেখানে মা ও সন্তানের বিচ্ছেদ দ্বারা সন্তানকে মায়ের কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে পিতার কাছে সমর্পণ করা বুঝানো হয়নি, বরং দাসি ও তার সন্তানদের আলাদা দুই ব্যক্তির হাতে সোপর্দ করা বা বিক্রি করা বুঝানো হয়েছে। এ কাজটা যে নিষিদ্ধ, তা আরো বহু হাদিস থেকেও প্রমাণিত। আর প্রথম চারটি হাদিস থেকে শরিয়তের নিম্নোক্ত বিধিসমূহ রচিত হয় :
১. শিশু সন্তানধারী দম্পত্তির বিয়ে বিচ্ছেদ ঘটলে দেখতে হবে সন্তান একেবারে অবোধ ও মাতৃস্নেহের মুখাপেক্ষী কিনা। যদি তাই হয়, তবে সন্তানকে লালন পালনে মায়ের অধিকার অগ্রগণ্য, যদি সে পুনরায় স্বামী গ্রহণে বিরত থাকে।
২. শিশুর যদি মা বাবার একজনকে বেছে নেয়ার মতো বয়স হয়ে থাকে, তাহলে লটারি করা হবে। আর যদি স্বামী স্ত্রী উভয়ে অথবা কোনো একজন লটারি মানতে অসম্মত হয়, তাহলে শিশুকে স্বাধীনতা দেয়া হবে পিতামাতার মধ্যে যার সাথে সে থাকতে চায় তাকে বেছে নিতে।
উপরোক্ত বিধিসমূহ স্বয়ং রসূল সা. থেকে প্রমাণিত। এতে দ্বিমত পোষণ করা কোনো মুসলমানের পক্ষে সম্ভব নয়। তবে আলোচ্য হাদিসগুচ্ছ এবং এ ধরণের অন্যান্য হাদিসের পটভূমি ও প্রেক্ষিত বিবেচনা করে এবং পিতামাতা ও সন্তানদের পারস্পরিক শরিয়ত সম্মত অধিকার ও দায় দায়িত্ব সামগ্রিকভাবে দৃষ্টিতে রেখে প্রাচীন ইমামগণ মায়ের সন্তান পালনের অগ্রাধিকারের উপর আরো কতিপয় শর্ত ও বিধিনিষেধ আরোপ করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, চার মাযহাবের আলেমগণ নিম্নলিখিত দোষগুলোর উল্লেখ করে বলেছেন যে, এগুলো যদি মায়ের মধ্যে বর্তমান থাকে এবং পিতা এগুলো থেকে মুক্ত থাকে, তাহলে মায়ের সন্তান পালনের অগ্রাধিকার রহিত হয়ে যাবে :
দোষগুলো হলো : (ক) ইসলাম পরিত্যাগ করা (খ) পাগল হয়ে যাওয়া (গ) নামায রোযা ত্যাগ করা বা অনুরূপ কোনো প্রকাশ্য গুণাহে লিপ্ত হওয়া (ঘ) চরিত্র নষ্ট হওয়ার আশংকা থাকে এমন পরিবেশে সন্তানকে নিয়ে বাস করা বা এতো দূরবর্তী স্থানে বসবাস করা, যেখানে সন্তানের লেখাপড়া তদারক করা পিতার পক্ষে দূরূহ হয়ে পড়ে। (ঙ) পিতার অক্ষমতা সত্ত্বেও তার কাছে সন্তানের ভরণপোষণের অর্থ দাবি করা (চ) সন্তানের লালন পালনে চরম উদাসিনতা।
অনুরূপভাবে ফেকাহবিদগণের মতে শিশু সন্তানের মায়ের কাছে লালিত পালিত হওয়ার সর্বোচ্চ মেয়াদ ৭ থেকে ৯ বছর। এরপর পিতার অধিকার থাকবে সন্তানকে নিজ দায়িত্বে নিয়ে আসা।
চিন্তা করলে বুঝা যাবে, উল্লেখিত শর্তগুলোর কোনো একটিও উপরোক্ত হাদিসসমূহ বা শরিয়তের সাধারণ নীতিমালার পরিপন্থি নয়। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, সন্তানদের ভরণপোষণ, বৈষয়িক ও নৈতিক লালন, তাদের শিক্ষাদীক্ষা, পেশাগত প্রশিক্ষণ এবং তাদের বিয়ে শাদী ইত্যাদির আসল দায়িত্ব পিতার উপরই বর্তে, মাতার উপর নয়। পরিবারে প্রধান হিসেবে নিজেদেরকে ও পরিবার পরিজনকে দোযখের আগুন থেকে রক্ষা করার যে নির্দেশ কুরআনে রয়েছে, সে নির্দেশ প্রাথমিকভাবে পুরুষকেই দেয়া হয়েছে। এমতাবস্থায় এটা কিভাবে যুক্তিসঙ্গত হতে পারে যে, মাতাকে অনির্দিষ্টকালের জন্য সর্বোতভাবে ও শর্তহীনভাবে সন্তান লালন পালনের অধিকার দেয়া হবে, পিতার ইচ্ছের তোয়াক্কা না করে সে সন্তানকে যেভাবে ইচ্ছে গড়ে তুলবে, অত:পর তার পরিণাম ভোগ করার জন্য সন্তানদেরকে পিতার হাতে সোপর্দ করা হবে? এ জন্য সন্তান লালন পালনের মেয়াদ যৌবন প্রাপ্তিকাল পর্যন্ত দীর্ঘায়িত করার পক্ষে মত দেয়া সঠিক বলে মনে হয়না। কারণ সন্তানরা যৌবনে পদার্পণ করা ও স্বনির্ভর হয়ে যাওয়ার পর পিতার অভিভাবকত্বে আসার কোনো অর্থ থাকেনা। তখন আপন লাভক্ষতি ও ভালোমন্দের দায়দায়িত্ব অনেকটা তাদের নিজেদের ঘাড়েই এসে পড়ে। তাই শরিয়তের অন্তর্নিহিত সুগভীর প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার দাবি হলো, একদিকে লালন পালনের মেয়াদের একটা যুক্তিসঙ্গত সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করে দিতে হবে, অপরদিকে লালন পালনে মায়ের অধিকারের উপরও যুক্তিসঙ্গত শর্ত ও বিধিনিষেধ আরোপ করতে হবে। মায়ের ইসলাম থেকে খারিজ না হওয়া এবং পুনরায় বিয়ে না করার শর্তে হাদিসেই উল্লেখিত হয়েছে। এই বিধিনিষেধ ও শর্তারোপের আলোকে আরো নতুন শর্ত ও বিধিনিষেধ উদ্ভাবন করা যেতে পারে। রসূল সা. যদি উল্লেখিত দুটো শর্তের অতিরিক্ত আর কোনো শর্তের উল্লেখ না করে থাকেন, তবে তার কারণ সম্ভবত এই যে, তাঁর কাছে যেসব বিবাদ নিষ্পত্তির জন্য এসেছিল, তাতে মায়ের দিক থেকে এসব আশংক দেখা দেয়ার কোনো অবকাশ ছিলোনা। নচেত পিতা চুপ থাকতোনা, বরং মায়ের কাছে লালিত পালিত হলে সন্তানের সম্ভাব্য ক্ষতির কথা ব্যক্ত করতো। সে ক্ষেত্রে নিজের অগ্রাধিকার প্রমাণ করার জন্য পিতা শুধু এ কথা বলেই ক্ষান্ত থাকতোনা যে, পুত্রের ব্যাপারে পিতার সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয় এমন কে আছে? বরং সেই সাথে এটাও বলতো যে, সন্তানের মা ওর লালন পালন সুষ্টভাবে করতে পারবেনা। হাদিসগুলো পর্যালোচনা করলে মনে হয়, এইসব ঘটনায় পিতা মাতার কোনো একজনের যোগ্যতা ও অপরজনের অযোগ্যতা নিরূপণের প্রশ্নই ওঠেনি। কেননা যোগ্যতা ও আন্তরিকতার দিক দিয়ে পিতা মাতা উভয়েই সমান। আসল প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিলো মাতৃস্নেহ ও তার মুখাপেক্ষিতার সাথে পিতৃস্নেহের। এ ক্ষেত্রে মাকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে, আর তা নিশ্চিতভাবে এখনও দেয়া হবে। কিন্তু ও দ্বারা প্রমাণ করা যায়না যে, মা যদি সন্তান পালনের গুরুদায়িত্ব পালনে একেবারেই অযোগ্য ও অক্ষম হয়, তবুও তার সন্তান পালনের অগ্রাধিকার বহাল থাকবে এবং সন্তানকে তার কাছেই রাখা হবে।
আমার পূর্ববর্তী জবাবে কোনো ত্রুটি, অসম্পূর্ণতা বা অস্পষ্টতা থেকে থাকলে তা এই সংক্ষিপ্ত আলোচনায় দূর করার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। এখানেও আমি বিস্তারিত আলোচনা থেকে বিরত থেকেছি। আমার জ্ঞানের অসম্পূর্ণতা সম্পর্কে আমি পুরোপুরি সচেতন এবং তা যে নির্ভুল, সে দাবিও আমি করিনা। প্রকৃত ও নির্ভুল জ্ঞানের আধার একমাত্র আল্লাহ।
|
সর্বশেষ আপডেট ( Friday, 04 March 2011 )
|
|
|
|