 |
|
 |
আমাদের টাইপ করা বইগুলোতে বানান ভুল রয়ে গিয়েছে প্রচুর। আমরা ভুলগুলো ঠিক
করার চেষ্টা করছি ক্রমাগত। ভুল শুধরানো এবং টাইপ সেটিং জড়িত কাজে সহায়তা
করতে যোগাযোগ করুন আমাদের সাথে।
রাসায়েল ও মাসায়েল ৬ষ্ঠ খন্ড |
|
|
লিখেছেন সাইয়্যেদ আবুল আ'লা মওদূদী
|
Monday, 28 February 2011 |
পাতা 70 মোট 74
<h1>৬৮। পিতামাতার আদেশে স্ত্রী তালাক দেয়া যায় কি?</h1>
প্রশ্ন : পূর্ববর্তী একটি সংখ্যায় এক প্রশ্নের জবাবে আপনি বলেছিলেনম, বাবা মা যদি পুত্রকে তার স্ত্রী তালাক দেবার আদেশ দেয়, তবে কেবলমাত্র সে ক্ষেত্রেই তালাক দেয়া যাবে, যে ক্ষেত্রে শরিয়ত সম্মত কোনো কারণ বর্তমান থাকে। আপনি আরো বলেছেন, হযরত ওমর রা. যে তার পুত্রকে স্ত্রী তালাক দেবার নির্দেশ দিয়েছিলেন, তাতেও শরিয়ত সঙ্গত কারণ ছিলো।
কিন্তু এ জবাবে আমার এ সংক্রান্ত সংশয় দূর হয়নি। এ প্রসঙ্গে অন্য কিছু হাদিস থেকে জানা যায়, পিতামাতা আদেশ করার সাথে সাথে নির্দ্বিধায় স্ত্রী তালাক দিতে হবে। এ ব্যাপারে সবচেয়ে বড় যুক্তি হলে, হযরত ইবরাহীম আ. সম্পর্কে বর্ণিত সেই বিশুদ্ধ হাদিসটি, যাতে তিনি পুত্র ইসমাঈল আ. কে তার দরজায় চৌকাঠ পাল্টাবার আদেশ দেন (অর্থাৎ তা স্ত্রীকে তালাক দেবার আদেশ দেন)। পিতার আদেশ তাঁর নিকট পৌঁছার সাথে সাথে তিনি তার স্ত্রীকে তালাক প্রদান করেন এবং দ্বিতীয় বিয়ে করেন। এ হাদিস থেকে তো একথাই প্রমাণ হয় যে, পিতামাতার আদেশ শোনার সাথে সাথে বিনাবাক্যে ব্যয়ে স্ত্রী তালাক দিতে হবে। অন্যথায় গুণাহগার হবে।
জবাব : এ প্রসঙ্গে পূর্ববর্তী সংখ্যায় আমি যে জবাব দিয়েছিলাম, তা পরিবর্তন করার কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে করিনা। শরিয়াহ্ তালাককে নিকৃষ্টতম বৈধ কাজ বলে আখ্যায়িত করেছে। তাই, শরিয়াহ কারণ ছাড়া তালাক প্রদান করলে আল্লাহর নিকট অবশ্যি অপরাধী গুণাহগার হতে হবে। এ ধরনের তালাকের অশুভ প্রতিক্রিয়া কেবল স্বামী পর্যন্তই সীমিত থাকেনা। বরঞ্চ এ ধরণের তালাক পিতামাতার প্রতি নি:শর্ত আনুগত্যের প্রমাণ। এ ধরণের তালাক দ্বারা স্ত্রী এবং সন্তানের অধিকারও ক্ষুন্ন হয়, তারা কষ্টের মধ্যে নিপতিত হয়।
রসূল সা. স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছেন, স্রষ্টার বিধান অমান্য করে সৃষ্টির হুকুম পালন করা যাবেনা। বিনা কারণে তালাক দেয়াকে আল্লাহ ঘৃণা করেন। অপরের অধিকার ক্ষুন্ন করা এবং অপরকে কষ্টে নিপতিত করাকে আল্লাহ মোটেও পছন্দ করেননা।
হযরত ওমর রা. তাঁর পুত্রকে যে নির্দেশ দিয়েছিলেন, তাতে যে সম্ভাব্য কল্যাণ বিবেচনার কথা বলেছি, সে কথা অপরাপর মুহাদ্দিসগণও স্বীকার করেছেন। যেমন শাইখ আব্দুর রহমান আল বান্না তাঁর মুসনদে আহমদের ব্যাখ্যা গ্রন্থ ফাতহুর রব্বানীর তালাক অধ্যায়ে এই হাদিসটির ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেন :
"একথা সুস্পষ্ট, হযরত ওমর রা. এ কারণেই মহিলাটিকে অপছন্দ করেন যে, তাঁর দৃষ্টিতে সে তাঁর পুত্রের উপযুক্ত ছিলনা। এ নির্দেশের ক্ষেত্রে হযরত ওমর রা.-এর বিবেচনায় অবশ্যি কোনো কল্যাণ ছিলো। কেননা তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে ইলহামও লাভ করতেন। হযরত ওমরের নির্দেশ না হলে নবী করিম সা. ও আবদুল্লাহ রা. কে এ তালাকের অনুমতি দিতেননা, এটাও বিবেচনার বিষয়।"
মোল্লা আলী ক্বারী তাঁর বিখ্যাত 'মিরকাত' গ্রন্থের 'ঈমান' অধ্যায়ের 'কবিরা গুনাহ' পরিচ্ছেদে লিখেছেন :
মিশকাতের যে হাদিসটিতে বলা হয়েছে, তোমরা পিতামাতার সাথে অসদাচরণ করোনা এবং তাদের অধিকার ক্ষুন্ন করোনা এমনকি তারা যদি তোমাকে পরিজন ও সম্পদ ত্যাগ করতেও বলেন। এ হাদিসটি দ্বারা পিতা পুত্রকে স্ত্রী তালাক দেবার নির্দেশ দিলে তা মেনে নেয়া আবশ্যক হয়ে পড়েনা, এই পুত্রবধূর বর্তমানে পিতামাতার যতো কষ্টই হোকনা কেনো। কারণ এই ধরণের তালাকে পুত্র কষ্টে নিপতিত হয়। এরূপ অবস্থায় তাদের আনুগত্য করা যেতে পারেনা। তারা যদি পুত্রকে ভালোই বাসেন, তবে এই ভালোবাসার দাবি তো হলো, শরয়ী কারণ ছাড়া তারা পুত্রকে স্ত্রী তালাক দিতে বলবেন না। তারা পুত্রের কষ্টের কথা অনুভব করবেন। এমতাবস্থায়, তালাক দিতে বলাটা তাদের অজ্ঞতা। অতএব এ ধরণের আদেশ গ্রহণযোগ্য নয়।
হযরত ইবরাহীম আ. কর্তৃক পুত্র ইসমাঈল আ. কে তাঁর স্ত্রী তালাক দেবার যে নির্দেশ হাদিস বর্ণিত হয়েছে, তার পেছনে শরিয়া কারণ বর্তমান ছিলো বলে ধরে নিতে হবে। একজন নবী বিনা কারণে তাঁর পুত্রকে স্ত্রী তালাক দিতে বলবেন তা কিছুতেই কল্পনা করা যায়না। একই কথা হযরত ওমরের ব্যাপার। তিনি তাঁর এক পুত্রকে স্ত্রী তালাক দিতে বলেছিলেন। কিন্তু হযরত ওমর রা. শরিয়তসম্মত কারণ ছাড়া এ ধরণের নির্দেশ দিয়ে থাকবেন বলে মেনে নেয়া যায়না।
এ কথাগুলো আমি আমার নিজের পক্ষ থেকে বলছিনা। বরঞ্চ এ সংক্রান্ত হাদিসগুলোতেই এর সমর্থন রয়েছে। হযরত ইবরাহীম ও ইসমাঈল আ. সংক্রান্ত হাদিস বুখারির 'আম্বিয়া' অধ্যায়ে সবিস্তারে বর্ণিত আছে। এ হাদিস থেকে জানা যায়, ইসলাঈল আ. এবং তাঁর মাকে আরবের মরুভূমিতে রেখে আসার পর হযরত ইবরাহীম আ. মাঝে মধ্যে তাঁদের খোঁজ খবর নেবার জন্যে সেখানে যেতেন। ইসমাঈল আ. এর বিয়ের পর একবার তিনি সেখানে যান। তখন ঘরে কেবল ইসলাঈলের স্ত্রী ছিলেন। তিনি শ্বশুরকে চিনতেন না। হযরত ইবরাহীম আ. তার কাছে তাদের খোঁজ খবর জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, "আমরা অত্যন্ত দুরবস্তায় আছি। দারিদ্র এবং বিপদাপদে নিমজ্জিত আছি।" বধূ অভিযোগের সুরে কথাগুলো বললেন।
কিন্তু একজন নবীর স্ত্রী এবং একজন নবীর পুত্রবধূর পক্ষে এতোটা অধৈর্য হয়ে পড়া কিছুতেই ঠিক হয়নি। এতোটা লাগামহীন কথাবার্তা বলা মোটেও উচিত হয়নি। একজন বৃদ্ধ অপরিচিত মেহমান তার ঘরে এলো আর তিনি তাঁর সাথে এ ধরনের কথাবার্তা বলা শুরু করলেন, নিজেদের অভাব অভিযোগের ফিরিস্তি তুলে ধরতে শুরু করলেন, এমনটি কিছুতেই তার জন্যে মানানসই হয়নি। এ কারণে হযরত ইবরাহীম আ. সিদ্ধান্ত নিলেন, এ মেয়ে আমাদের সংসারের উপযোগী নয়। তিনি তাকে বলে এলেন, "ইসমাঈল ফিরে এলে তাকে আমার সালাম বলবে এবং তার ঘরের কপাট পাল্টাবে বলবে।" ইসমাঈল ফিরে এলে বউ তাকে বললেন, এই ধরনের একজন বৃদ্ধ এসেছিলেন এবং তিনি এই কথা বলে গেছেন। বউ পুরো ঘটনা তাঁকে বললেন। ইসমাঈল পিতার বক্তব্যের উদ্দেশ্য বুঝে নিলেন এবং স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দিলেন। হাদিস থেকে আরো জানা যায়, ইসমাঈল আবার বিয়ে করেন এবং ইবরাহীম আ. পুনরায় তাঁদের দেখতে আসেন। এবারও ইসমাঈল বাড়িতে ছিলেননা। ইবরাহীম আ. এ বউকে অত্যন্ত ধৈর্যশীল, কষ্টসহিষ্ণু এবং সৎস্বভাবের অধিকারীনি দেখতে পান। অপরিচিত বৃদ্ধকে তিনি চেনেননি। কিন্তু তিনি তাঁর সাথে অত্যন্ত মর্যাদাব্যঞ্জক ব্যবহার করেন। তিনি বলেন, আমরা ভালো আছি। সুন্দরভাবে আমাদের দিনাতিপাত হচ্ছে। তিনি সাথে সাথে আল্লহর প্রশংসাও করেন। অপর একটি বর্ণনা থেকে জানা যায়, তিনি বলেছেন, "আল্লাহ আমাদের অনেক কিছু দিয়েছেন। পানি, দুধ, গোশত সবই পাওয়া যায়। আপনি তশরীফ রাখুন, আমি আপনার পানাহারের ব্যবস্থা করছি।"
হযরত ইবরাহীম এই বউ-এর জন্যে কল্যাণের দোয়া করলেন। বললেন, "তোমার স্বামী এলে বলবে, ঘরের কপাট যেনো ঠিক রাখে।" এই বউটির চারিত্রিক সৌন্দর্য একথা থেকেও ফুটে উঠে, ইসমাঈল ঘরে ফিরে এলে তিনি তাকে বলেন, আপনি যাওয়ার পর অত্যন্ত ভালো ও সম্মানিত একজন বুযুর্গ তশরীফ এনেছিলেন। এরপর বিস্তারিত ঘটনা তিনি স্বামীকে বলেন।
এ বিস্তারিত কাহিনী থেকে জানা যায়, হযরত ইবরাহীম এমনি এমনি ঘরের কপাট (অর্থাৎ-স্ত্রী) পরিবর্তন করতে হুকুম দেননি। বরঞ্চ তিনি আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞান ও প্রজ্ঞাই কাজে লাগিয়েছিলেন। এভাবে আল্লাহ তায়ালা তাঁর পুত্রকে একটি উত্তম স্ত্রী দান করলেন, যিনি সর্বদিক থেকে একজন নবীর স্ত্রী হবার উপযুক্ত।
এই বিস্তারিত আলোচনার পরও আমার মতে এই বিষয়ের শরয়ী দৃষ্টিভঙ্গি হলো, বাবা কিংবা মা যদি পুত্রের কাছে তর স্ত্রীকে তালাক দেবার দাবি করে, তবে এক্ষেত্রে ছেলের জন্যে করণীয় হলো : তাদের দাবি বা আদেশের সপক্ষে যদি শরিয়তসম্মত যুক্তি থাকে, তবে ছেলে স্ত্রী তালাক দিয়ে দেবে, অন্যথায় ছেলের জন্যে তাদের দাবির কারণে স্ত্রী তালাক দেয়া জরুরি নয়। [তরজমানুল কুরআন, জুন ১৯৬৪]
|
সর্বশেষ আপডেট ( Friday, 04 March 2011 )
|
|
|
|