 |
|
 |
আমাদের টাইপ করা বইগুলোতে বানান ভুল রয়ে গিয়েছে প্রচুর। আমরা ভুলগুলো ঠিক
করার চেষ্টা করছি ক্রমাগত। ভুল শুধরানো এবং টাইপ সেটিং জড়িত কাজে সহায়তা
করতে যোগাযোগ করুন আমাদের সাথে।
রাসায়েল ও মাসায়েল ৬ষ্ঠ খন্ড |
|
|
লিখেছেন সাইয়্যেদ আবুল আ'লা মওদূদী
|
Monday, 28 February 2011 |
পাতা 10 মোট 74
<h1>৮। সাহরির শেষ সময় কোনটি?</h1>
প্রশ্ন: কিছু লোক অভিযোগ করে বেড়াচ্ছে মাওলানা মওদূদী রা. সাহরির শেষ সময় সম্পর্কে যে মতামত দিয়েছেন, তা কুরআন হাদিসের বক্তব্যের খেলাফ। বলা হয়, তিনি একটি হাদিসের আলোকে আযানের পরও কিছু পানাহার করে নেয়াকে বৈধ বলেছেন। কিন্তু শাহ ওয়ালীউল্লাহ এই হাদিসে উল্লেখিত আযানকে বেলালের রা. আযান বলেআযানের পরও কিছু পানাহার করে নেয়াকে বৈধ বলেছেন। কিন্তু শাহ ওয়ালীউল্লাহ এই হাদিসে উল্লেখিত আযানকে বেলালের রা. আযান বলেছেন। তিনি ফজরের সময় হবার আগে রাত থাকতেই আযান দিতেন। বিষয়টির সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দেয়া প্রয়োজন।
জবাব : আসলে এ বিষয়ে যারা অভিযোগ করেছেন, তাদের অভিযোগ মূলত তাফহিমুল কুরআন সূরা আল বাকারা ১৯৪ টীকার নিম্নোক্ত বাক্যগুলো সম্পর্কে :
"আজকাল লোকেরা সাহরি ও ইফতার উভয় ব্যাপারে অত্যাধিক সতর্কতার কারণে কিছু অযথা কড়াকড়ি শুরু করেছে। কিন্তু শরিয়ত এ দু'টি সময়ের এমন কোনো সীমানা নির্ধারণ করে দেয়নি যে, তা থেকে কয়েক সেকেণ্ড বা কয়েক মিনিট এদিক ওদিক হয়ে গেলে রোযা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। প্রভাতকালে রাত্রির বুক চিরে সাদা রেখা ফুটে উঠার মধ্যে যথেষ্ট সময়ের অবকাশ রয়েছে। ঠিক প্রভাতের উদয়মুহূর্তে যদি কোনো ব্যক্তির ঘুম ভাঙ্গে তাহলে সঙ্গতভাবেই সে উঠে তাড়াহুড়া করে কিছু পানাহার করে নিতে পারে। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রসূলুল্লাহ সা. বলেছেন : যদি তোমাদের কেউ সাহরি খাচ্ছে এমন সময় আযানের আওয়াজ কানে এসে গিয়ে থাকে, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে সে যেন আহার ছেড়ে না দেয়, বরং সে যেনো পেট ভরে পানাহার করে নেয়।"
এ বাক্য কয়টির উপরই বিভিন্ন অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে। অভিযোগসমূহের সারকথা হলো, এ বাক্যগুলোতে যে বক্তব্য দেয়া হয়েছে, তা এই আয়াতাংশের সাথে সাংঘার্ষিক: "আর পানাহার করো, যতোক্ষণ না রাত্রির কালো রেখার বুক চিরে প্রভাতের সাদা রেখা পরিষ্কার দৃষ্টিগোচর হয়।" (সূরা আল বাকারাহ, আয়াত: ১৮৭) আর উপরোল্লেখিত হাদিসে মূলত বেলালের রা. আযানের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। তিনি প্রভাত শুরু হবার অনেক আগে লোকদেরকে সাহরির জন্যে উঠাতে আযান দিতেন।
রাতের কালো রেখার বুক চিরে প্রভাতের সাদা রেখা পরিষ্কার হয়ে না উঠা পর্যন্ত পানাহার করা যে জায়েয, কুরআন মজিদের এ বক্তব্য সম্পর্কে কোনো মুসলমানই অজ্ঞাত নয়। কিন্তু সন্ধ্যার লাল রেখার মতোই সাহরির শেষ সময় সম্পর্কে প্রাচীন আলিমগণের মধ্যে বিভিন্ন মতের লোক ছিলেন। তাঁদের মতামতসমূহ প্রসিদ্ধ এবং অধিকাংশ কিতাবে লিপিবদ্ধ আছে।
তাঁদের কারো মতে প্রভাতের একেবারে প্রাথমিক রেখা সূচিত হবার সাথে সাথেই পানাহার নিষিদ্ধ হয়ে যায়। আবার কেউ মনে করেন, প্রভাতের সাদা রেখা উজ্জ্বল হয়ে না উঠা পর্যন্ত পানাহারের অবকাশ থাকে। এই মতভেদ স্বয়ং হানাফি ফকীহগণের মধ্যেও রয়েছে। শাহ ওয়ালীউল্লাহ র. নিজেও তাঁর 'আল মুসাবভা' গ্রন্থে ফতোয়ায়ে আলমগীরীর সূত্রে লিখেছেন:
ফতোয়ায়ে আলমগীরীতে উল্লেখ হয়েছে, (রোযার ব্যাপারে সাহরির শেষ সময়) প্রভাতের সূচনালগ্ন থেকে ধরা হবে, নাকি চতুর্দিকে আলোর আভা ছড়িয়ে পড়লে, এ বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। এর মধ্যে প্রথম মতটি সতর্কতামূলক আর দ্বিতীয় মতটি প্রশস্ত ও সহজ। অধিকাংশ ওলামা দ্বিতীয় মতের সমর্থক।
বিভিন্ন হাদিস থেকে দ্বিতীয় মতটির সমর্থন পাওয়া যায়। যেমন, সুনানে নাসায়ির 'সাহরি' অধ্যায়ে এই হাদিসটি বর্ণিত হয়েছে :
যায়িদ থেকে বর্ণিত। "আমরা হুযাইফা রা. কে জিজ্ঞেস করলাম, রসূলুল্লাহর সাথে আপনি কোন্ সময় খেতেন? তিনি বললেন : আমরা যখন সাহরি খেতাম, তখন দিনের আলো ছড়িয়ে পড়তো, কেবল সূর্য উঠার বাকি থাকতো।"
আবু দাউদের সেই হাদিসটির কথাই ধরুন, যেটি তাফহিমুল কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে। হাদিসটির বিভিন্ন ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন, এই হাদিসে বর্ণিত আযানের অর্থ মাগরিবের আযান। কেউ কেউ বলেছেন, ফজর সূচনার আযান। কিন্তু হাদিসটিতে পানাহার বিষয়ক যে আলোচনা হয়েছে, তা কেবল তখনই অর্থবহ হতে পারে, যখন রোযাদারের নিজের ভোর হয়ে গেছে বলে একিন না হবে। তা না হলে এ প্রসঙ্গে এ হাদিস অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়।
শাহ ওয়ালীউল্লাহ তাঁর হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগায় যে ব্যাখ্যা করেছেন, সেটা হাদিসের আরেকটি ব্যাখ্যা। তার বিবরণ হলো : রমযানে হযরত বেলাল লোকদের ঘুম থেকে উঠানোর জন্য একটি আযান দিতেন প্রভাত সূচনার পূর্বে আর প্রভাত সূচনার সময় আরেকটি আযান দিতেন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম রা. শাহ ওয়ালীউল্লাহর রা. বক্তব্য হলো, আবু দাউদের হাদিসে যে আযানের পর পানাহারের অনুমতি দেয়া হয়েছে, সেটি বেলালের রা. এই আযান বা প্রভাত হবার পূর্বেই তিনি রাত থাকতে দিতেন।
শাহ্ সাহেবের ব্যাখ্যার ব্যাপারে কেউ যেনো এই ভ্রান্তিতে নিমজ্জিত না হন যে, তিনি যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন সেটাই একমাত্র সঠিক ব্যাখ্যা, অথবা সেটাই অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য ব্যাখ্যা, কিংবা সেই ব্যাখ্যার সপক্ষে কোনো মজবুত সমর্থন আছে।
আসল ব্যাপার 'মুযালিমুস্ সুনান' এবং 'মিরকাত' প্রভৃতি গ্রন্থে উপরোক্ত তিনটি ব্যাখ্যাই বর্তমান আছে। কিন্তু সবগুলো মতই 'বলা হয়েছে' অথবা 'এরূপ হতে পারে' এর সাথে বলা হয়েছে। কোনো একটি মতকেও অকাট্যভাবে এবং আস্থার সাথে গ্রহণ করা হয়নি। প্রকৃতপক্ষে, এইসব ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ কিছু না কিছু সন্দেহ সংশয় থেকে মুক্ত নয়। পক্ষান্তরে এইসব ব্যাখ্যার পরিবর্তে মাওলানা মওদূদী যে সরল সোজা ব্যাখ্যা করেছেন, তা কেবল সন্দেহ সংশয় থেকেই মুক্ত নয়, বরঞ্চ অপর একটি হাদিস সরাসরি এ ব্যাখ্যাকে সমর্থন করে। সে হাদিসটি ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল মুসনাদে আবু হুরাইরায় বিশুদ্ধ এবং মুত্তাসিল সনদের সাথে উদ্ধৃত করেছেন। হাদিসটি নিম্নরূপ :
"তোমাদের কেউ যখন (সাহরি) খাবার অবস্থায় আযান শুনে, তখন সে যেনো খাবার শেষ না করে বরতন (প্লেট) রেখে না দেয়। মুয়াযযিন এই আযান তখন দিতো যখন প্রভাত সূচিত হয়ে যেতো।"
আবু দাউদ এবং মুসনাদে আহমদের এই দু্'টি হাদিসেরই রাবী হলেন আবু হুরাইয়া রা. উভয় হাদিসই একই শিরোনামের অধিনে বর্ণিত হয়েছে। এ থেকে পরিষ্কার বুঝা যায়, শেষোক্ত হাদিসটি প্রথমোক্ত হাদিসটির ব্যাখ্যা বর্ণনা করছে। এ শেষোক্ত হাদিসটির বিবরণ থেকে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হলো যে, হাদিসে যে আযানের সময় পানাহার শেষ করার কথা আলোচিত হয়েছে, তা রাতের আযান নয়, বরং প্রভাত সূচনার আযান। সে আযান দিতেন সাধারণত ইবনে উম্মে মাকতুম রা. এখানে একথাও প্রমাণ হলো যে, মাওলানা মওদূদীর এই বক্তব্য হুবুহু হাদিসের অনুরূপ যে : "ঠিক প্রভাতের উদয় মুহূত্বে যদি কোনো ব্যাক্তির ঘুম ভাঙ্গে তাহলে সঙ্গতভাবেই সে উঠে তাড়াহুড়া করে কিছু পানাহার করে নিতে পারে।" এটা আল্লাহর এবং তাঁর রসূলের পক্ষ থেকে একটি সহজতর বিধান। আল্লাহর কোনো বান্দাহ যদি এর সুবিধা গ্রহণ করে, তবে অপর কারো থলে থেকে কিছু কমে যায় না। সুতরাং এ ব্যাপারে মনে সংকীর্ণতা বোধ করার কি প্রয়োজন আছে?
এবার দেখা যাক, কোনো কোনো বুযর্গ এখানে আযানের অর্থ যে বেলালের আযান করেছেন, তার হেতু কি? তাদের প্রতি শ্রদ্ধা অন্তরে রেখেই বলছি, তাঁদের এ ব্যাখ্যা কিছুতেই আমরা গ্রহণ করতে পারিনা। কারণ বেলাল তা লোকদেরকে সাহরি খাবার জন্যে উঠাতেই আযান দিতেন। সুতরাং তাঁর আযানের সময় খাবার অবস্থায় থাকা এবং আযান শুনে তাড়াহুড়া করে খেয়ে নেয়ার অনুমতি একেবারেই অবান্তর। তাঁর আযানের পর ঘুম থেকে উঠে তো লোকেরা ধীরে সুস্থে সাহরি খেতো। তাড়াহুড়া করে কিছু খেয়ে নেবার অনুমতির প্রশ্ন তো কেবল তখনই সৃষ্টি হতে পারে যখন দ্বিতীয় আযানের সময় কারো ঘুম ভাঙ্গবে, কিংবা এটা ঐ ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে যে খুব দেরিতে সাহরি খেতে শুরু করেছে এবং তার খাবার শেষ না হতেই দ্বিতীয় আযান পড়েছে। [তরজমানুল কুরআন, ডিসেম্বর ১৯৬২]
|
সর্বশেষ আপডেট ( Friday, 04 March 2011 )
|
|
|
|