আমাদের টাইপ করা বইগুলোতে বানান ভুল রয়ে গিয়েছে প্রচুর। আমরা ভুলগুলো ঠিক করার চেষ্টা করছি ক্রমাগত। ভুল শুধরানো এবং টাইপ সেটিং জড়িত কাজে সহায়তা করতে যোগাযোগ করুন আমাদের সাথে।
রসূলুল্লাহর বিপ্লবী জীবন প্রিন্ট কর ইমেল
লিখেছেন আবু সলীম মুহাম্মদ আবদুল হাই   
Thursday, 21 February 2008
আর্টিকেল সূচি
রসূলুল্লাহর বিপ্লবী জীবন
ইসলামী আন্দোলন ও তার অনন্য বৈশিষ্ট্য
ইসলামী আন্দোলনের প্রাক্কালে দুনিয়ার অবস্থা
জন্ম ও বাল্যকাল
নবুয়্যাতের সূচনা
আন্দোলনের সূচনা
মু'জিযা ও মি'রাজ
হিজরত
নবপর্যায়ে ইসলামী আন্দোলন
ইসলামী আন্দোলনের প্রতিরক্ষা
বদর যুদ্ধের পটভূমি
ওহুদ যুদ্ধ
ওহুদের বিপর্যয়ের পর
খন্দকের যুদ্ধ
হুদাইবিয়া সন্ধির পটভূমি
সম্রাটদের নামে পত্রাবলী
ইসলামী রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা
মক্কা বিজয়
হুনাইনের যুদ্ধ
তাবুক যুদ্ধ
বিদায় হজ্জ এবং ওফাত
পরিশিষ্ট

হিজরত

হিজরত শব্দের সাধারণ অর্থ হচ্ছে পরিত্যাগ কিংবা পরিবর্জন । কিন্তু ইসলামী পরিভাষায় হিজরত বলতে বুঝায় : দ্বীন ইসলামের খাতিরে নিজের দেশ ছেড়ে এমন স্থানে গমন করা যেখানে প্রয়োজন সমূহ পূর্ণ হতে পারে। কারণ ইসলামী জীবন যাপন করার এবং আল্লাহর দ্বীনের দিকে আহ্বান জানানোর আজাদী যে দেশে নেই, সে দেশকে শুধু আয়-উপার্জন ,ঘর-বাড়ি ,ধন-সম্পত্তি কিংবা আত্মীয়-স্বজনের খাতিরে আঁকড়ে থাকা মুসলমানদের পক্ষে আদৌ জায়েয নয়।

প্রসঙ্গত একটি কথা জেনে রাখা দরকার যে,আল্লাহর দ্বীনের প্রতি ঈমান পোষণকারীর পক্ষে কোনো কুফরী রাষ্ট্র ব্যবস্থার অধীনে জীবন যাপন করা কেবল দুটি অবস্থায়ই সঙ্গত হতে পারে। একঃ সংশ্লিষ্ট দেশে ইসলামের কতৃত্ব প্রতিষ্ঠা এবং কুফরী ব্যবস্থাকে ইসলামী ব্যবস্থায় রুপান্তরিত করার জন্যে সে ক্রমাগত চেষ্টা-সাধনা করতে থাকবে - এ যাবত মক্কায় থেকে মুসলমানেরা যেরূপ চেষ্টা-সাধনা করে আসছিল এবং সে জন্যে সর্বপ্রকার দুঃখ-মুসিবত সহ্য করেছিল। দুই :সংশ্লিষ্ট দেশ থেকে তার বেরোবার কোন পথ যদি সত্যই না থাকে কিংবা ইসলামী ধারায় জীবন যাপন ও ইসলামী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার নিমিত্ত চেষ্টা-সাধনা করার উপযোগী কোন জায়গা যদি সে খুঁজে না পায়। কিন্তু দ্বীনের প্রয়োজন পূর্ণ হবার উপযোগী জায়গা যখনি পাওয়া যাবে - এবার মদিনা থেকে যেমন প্রত্যাশা করা গিয়েছিল - তখন অবশ্যই তাদের হিজরত করে সেখানে চলে যেতে হবে। তবে এক্ষেত্রে যারা নিতান্তই অক্ষম ও পঙ্গু এবং যারা অসুস্থতা কিংবা দারিদ্র্যের কারণে কোন প্রকারেই হিজরতের জন্যে সফর করতে সক্ষম নয়, কেবল তারাই ক্ষমা পাবার যোগ্য।

মদিনায় সাধারণ মুসলমানদের হিজরত

মদিনায় ইতোমধ্যেই ইসলাম বেশ কিছুটা প্রচারিত হয়েছিল। এই অবস্থায় মক্কায় যে সব মুসলমান কাফিরদের হাতে উৎপীড়িত হচ্ছিল, হযরত(সা:) তাদেরকে মদিনায় হিজরত করার নির্দেশ দিলেন। এটা টের পেয়েই কাফিররা মুসলমানদেরকে বিরত রাখার জন্যে জুলুমের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিল এবং যাতে মুঠো থেকে বেরিয়ে যেতে না পারে, সে জন্যে সর্বোত ভাবে চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু মুসলমানেরা তাদের ধন প্রাণ ও সন্তান-সন্ততির জীবন বিপন্ন করেও নিছক দ্বীনের খাতিরে দেশ ত্যাগ করাকেই পছন্দ করলো। কোন প্রলোভন বা ভয়-ভীতিই তাদেরকে এই সংকল্প থেকে বিরত রাখতে পারলো না। ক্রমান্বয়ে বহু সাহাবী মদিনায় চলে গেলেন। এখন হযরত(সা:)এর সঙ্গে থেকে গেলেন শুধু হযরত আবু বকর(রা:) এবং হযরত আলী(রা:)। আর থাকলো দারিদ্র্য ও শারীরিক অক্ষমতা হেতু সফর করতে অসমর্থ এমন কিছূ সংখ্যক মুসলমান।

হযরত (সা:) কে হত্যা করার সলা-পরামর্শ

এভাবে নবুয়্যাতের ত্রয়োদশ বছরের সুচনা পর্যন্ত বহূ সাহাবী মদীনায় হিজরত করলেন। কুরাইশরা দেখতে পেল মুসলমানরা একে একে মদীনায় গিয়ে শক্তি সঞ্চয় করছে এবং সেখানে ইসলাম ক্রমশ প্রসার লাভ করছে। এর ফলে তারা অত্যন্ত শংকিত হয়ে উঠলো এবং ইসলামকে চিরতরে খতম করে ফেলার পন্থা সর্ম্পকে চিন্তা-ভাবনা করলে লাগলো। সাধারন জাতীয় সমস্যাবলী সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা ও সলা-পরামর্শ করার জন্যে ‘দারুন্নদ্‌ওয়া’ নামে তাদের একটি জায়গা নির্দিষ্ট ছিলো। সেখানে প্রত্যেক গোত্রের প্রধান ব্যক্তিগণ জমায়েত হলো এবং এই আন্দোলনকে পর্যুদস্ত করার জন্যে কি পন্থা অবলম্বন করা যায়, সে সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা শুরু করলো। কেউ কেউ পরামর্শ দিলো : মুহাম্মদ (সাঃ)-কে শৃংখলিত করে কোন ঘরের মধ্যে বন্দী করে রাখা উচিত। কিন্তু কেউ কেউ মত প্রকাশ করলো যে, মুহাম্মদ (সাঃ) - এর সঙ্গী-সাথীগণ হয়তো আমাদের কাছ থেকে তাঁকে ছিনিয়ে নিয়ে যাবে এবং তার ফলে আমাদের পরাজয়ও ঘটতে পারে; এজন্যে উক্ত পরামর্শ প্রত্যাখ্যান করা হলো। কেউ কেউ আবার পরামর্শ দিলো যে, তাঁকে নির্বাসিত করা উচিত। কিন্তু মুহাম্মদ (সাঃ) যেখানে যাবেন সেখানেই তাঁর অনুগামী বাড়তে থাকবে এবং তাঁর আন্দোলনও যথারীতি সামনে অগ্রসর হবে; এ আশংকায় উক্ত পরামর্শও নাকচ করা হলো। অবশেষে আবু জেহেল পরামর্শ দিলো : ‘প্রত্যেক গোত্র থেকে একজন করে যুবক মনোনীত করা হবে; এরা সবাই এক সঙ্গে মুহাম্মদ (সাঃ)-এর ওপর হামলা করবে এবং তাঁকে হত্যা করে ফেলবে। এর ফলে তাঁর রক্ত সকল গোত্রের মধ্যে বিভক্ত হয়ে যাবে। আর সমস্ত গোত্রের সঙ্গে একাকী লাড়াই করা হাশিমী খান্দানের পক্ষে কিছুতেই সম্ভবপর হবে না।’ এ অভিমতটি সবাই পছন্দ করলো এবং শেষ পর্যন্ত এ কাজের জন্যে একটি রাত ও নির্দিষ্ট করা হলো। সিদ্ধান্ত করা হলো যে নির্দিষ্ট রাতে মনোনীত ব্যক্তিগণ হযরত (সা:) এর বাসভবন ঘেরাও করে থাকবে। ভোরে তিনি যখন বাইরে বেরোবেন ,তখন তারা আপন কর্তব্য সমাধা করবে। এরুপ সিদ্ধান্ত গ্রহণের কারণ এই যে, আরবরা রাতের বেলায় অন্য কারো ঘরে প্রবেশ করাকে পছন্দ করতো না।

কিন্তু আল্লাহ তাআলার কৃপায় দুশমনদের ঐসব গোপন অভিসন্ধির কথা হযরত (সা:) এর কাছে যথারীতি পৌঁছতে থাকে। অতঃপর সেই প্রতিক্ষিত সময়টি এলো,যখন তিনি মক্কা ছেড়ে মদিনায় গমন করার জন্যে ওহী যোগে নির্দেশ পেলেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে হিজরতের দুদিন আগে থেকেই তিনি আবু বকর সিদ্দিক (রা:) এর সঙ্গে এ সম্পর্কে পরামর্শ করেন এবং এই মর্মে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে, তার সাথে হযরত আবু বকর(রা:) ও গমন করবেন। সফরের জন্যে দুটি উষ্ট্রী ঠিক করা হলো এবং কিছু পাথেয়ও তৈরি করা হলো।

মক্কা থেকে রওয়ানা

কাফির কুরাইশগণ হযরত(সা:) কে হত্যা করার জন্যে যে রাতটি নির্দিষ্ট করেছিল, সেই রাতেই তিনি আলী(রা:) কে ডেকে বললেন :‘আমি হিজরতের নির্দেশ পেয়েছি এবং আজ রাতেই মদিনা রওয়ানা হয়ে যাচ্ছি । আমার কাছে বহু লোকের আমানত জমা রয়েছে। এগুলো তুমি প্রত্যুষে লোকদের কাছে প্রত্যার্পণ করে দিয়ো। আর আজ রাতে তুমি আমার বিছানায় থেকো,যেন আমি ঘরে আছি ভেবে লোকেরা নিশ্চিন্ত থাকে।

কুরাইশরা ইসলাম বৈরিতার কারণে হযরত(সা:) এর রক্তের নেশায় উন্মাদ হয়ে উঠেছিল; কিন্তু এ অবস্থায়ও তারা হযরত(সা:) কে এতোখানি আমানতদার ও বিশ্বাসভাজন মনে করতো যে, তাদের নিজ নিজ আমানত ও মাল-মাত্তা এনে তার কাছে জমা রাখতো।

নির্দিষ্ট রাতে কাফিররা হযরত(সা:) এর গৃহ ঘেরাও করলো। রাত যখন গভীর হলো , হযরত(সা:) নিরবে ও নিশ্চিন্তে ঘর থেকে বের হলেন । সে সময় তিনি সূরা ইয়াছিনের একটি আয়াত (فَأَغْشَيْنَاهُمْ فَهُمْ لاَ يُبْصِرُونَ) à¦ªà¦¾à¦  করছিলেন। তিনি এক মুঠো মাটি হাতে নিয়ে ‘শাহাতিল ওজুহ ’(মুখমন্ডল আচ্ছন্ন হয়ে যাক) কথাটি বলে কাফিরদের দিকে ছুঁড়ে মারলেন এবং তাদের ব্যূহ ভেদ করে নিবিঘ্নে বেরিয়ে গেলেন। সে সময় আল্লাহর কুদরতে অবরোধকারি গণ যেন তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলো; ফলে তারা হযরত(সা:) কে বেরিয়ে যেতে দেখতে পেলো না।প্রথমে তিনি হযরত আবু বকর (রা:) এর গৃহে গমন করলেনএবং সেখান থেকে তাকে নিয়ে মক্কার বাইরে গিয়ে সওর পর্বত গুহায় আশ্রয় নিলেন।

ভোরবেলা কাফিরগণ দেখতে পেলো, হযরত (স) মক্কা ছেড়ে চলে গেছেন। তারা অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে পড়লো এবং তাঁর সন্ধানে চারদিকে ছুটাছুটি শুরু করলো। একবার তারা খুঁজতে খুঁজতে‘ সওর’র্পবত তাদের পদধ্বনি শুনে হযরত আবু বকর (রা) কিছুটা বিচলিতও হয়ে উঠলেন। তার কারণ,তার নিজের জীবন সম্পর্কে তার কোন ভয় ছিল না;বরং হযরত(সা:)- এর ওপর না জানি কোন বিপদ এসে যায় এই ছিল তার আশংকা । তার এই অস্থিরতা লক্ষ্য করে হযরত(স)অত্যন্ত প্রশান্ত চিত্তে বললেনঃ‘লা তাহযান ইন্নাল্লাহা মাআনা’ - ঘাবড়িও না,আল্লাহ আমাদের সঙ্গে রয়েছেন। কার্যত তা-ই হলো।

আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহে গুহামুখে এমন কতকগুলো নিদর্শন ফুটে উঠলে যে, তা দেখে কাফিররা বিভ্রান্ত হয়ে পড়লো। তাদের মনে ধারণা জন্মালো যে , এ গুহার ভেতরে কেউ প্রবেশ করে নি।

হযরত আবু বকর(রা:)-এর পুত্র হযরত আব্দুল্লাহ তখন বয়সে নবীন। তিনি রাতের বেলায় হযরত(সা:) ও সিদ্দিক (রা:)-এর কাছে থাকতেন এবং ভোরে মক্কায় এসে কাফিরদের শলা-পরামর্শ সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিয়ে গুহায় ফিরে গিয়ে বুজর্গদ্বয়কে অবহিত করতেন। কয়েক রাত যাবত হযরত আবু বকর(রা:)-এর গোলাম বকরীর দুধ নিয়ে যেত, কখনো বা ঘর থেকে কিছু খাবার নিয়ে পৌঁছতো। এভাবে তিন রাত পর্যন্ত হযরত(সা:) ও সিদ্দিক(রা:) সেখানে অবস্থান করলেন।

চতুর্থ দিন হযরত(সা:) সওর পর্বত গুহা থেকে বেরোলেন এবং পুরো এক রাত এক দিন তারা সমানে পথ চললেন। সফরের জন্যে আবু বকর(রা:) আগে থেকেই দুটি উষ্ট্রী ঠিক করে রেখেছিলেন। পথ বাতলানোর জন্যে একশো জানাশোনা লোকও নির্দিষ্ট করে রেখেছিলেন। পরদিন দুপুর বেলা রোদের তেজ প্রখর হয়ে উঠলে বিশ্রামের জন্যে একটি বৃহদাকার পাথরের ছায়ায় তারা কিছুক্ষণ অবস্থান করলেন। অদূরেই একটি গোয়ালা ছিল ; তার বকরী থেকে হযরত(সা:) দুধ পান করলেন।অতঃপর সেখান থেকে তিনি আবার যাত্রা শুরু করলেন। তিনি সামনে পা বাড়াতেই সোরাকা বিন জাশিম নামক জনৈক্য কুরাইশ হঠাৎ তাকে দেখে ফেললো।এই লোকটি পুরস্কারের লোভে হযরত(সা:) এর সন্ধানে বেরিয়েছিল। সে হযরত(সা:) কে দেখতে পেয়েই ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। কিন্তু ঘোড়াটি হোঁচট খেয়ে মাটিতে পড়ে গেল। সে আবার নিজেকে সামলে নিল এবং হযরত(সা:) এরওপর হামলাকরার জন্যে তৈরি হলো। কিন্তু এবারও সামনে এগুতেই তার ঘোড়া হাঁটু পর্যন্ত মাটিতে বসে গেল। এবার সোরাকা শংকিত হয়ে উঠলো এবং বুঝতে পারলো। ব্যাপারটা মোটেই সুবিধাজনক নয়। তার পক্ষে মুহাম্মদ(সা:) এর ওপর হামলা করা কিছুতেই সম্ভবপর নয়। সে অত্যন্ত ভীত হয়ে পড়লো এবং হযরত(সা:) এর কাছে আত্মসমার্পণ করে ক্ষমা ভিক্ষা চাইলো। হযরত(সা:) তাকে ক্ষমা করে দিলেন। এও ছিল হযরত(সা:) এর একটি মু’জিযা।

মদিনায় শুভাগমন

হযরত(সা:) এর আগমন বার্তা পূর্বেই পৌঁছেছিল গোটা শহরই তার শুভাগমনের জন্যে প্রতিক্ষমান ছিল। ছোট-বড় সবাই প্রতিদিন সকালে শহরের বাইরে গিয়ে জমায়েত হতো এবং দুপুর পর্যন্ত ইন্তেজার করে ফিরে আসতো। অবশেষে একদিন তাদের সেই প্রতিক্ষিত শুভ মুহূর্তটি এসেই পড়লো। দূর থেকে হযরত (সা:) এর আসবার আলামত দেখে গোটা শহরটি তকবীর ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠলো। প্রতিটি প্রতিক্ষাকারী হৃদয় উজার করে তাকে স্বাগত জানালো। মদিনা থেকে তিন মাইল দূরে ‘কুবা’ নামক স্থানে আনসারদের অনেকগুলো খান্দান বসবাস করতো। এদের মধ্যে আমর ইবনে আওফের খান্দান টি ছিল সবচেয়ে শীর্ষস্থানীয়। কুলসুম বিন আল হাদাম ছিলেন এদের প্রধান ব্যক্তি। এর পরম সৌভাগ্য যে, দো-জাহানের নেতা সবার আগে এরই আতিথ্য কবুল করেন এবং কুবাই এর গৃহেই অবস্থান করেন। হযরত (সা:) এর রওয়ানার তিন দিন পর হযরত আলী(রা:) মক্কা থেকে যাত্রা করেছিলেন ; তিনিও এখানে এসে হযরত (সা:) এর সঙ্গে মিলিত হলেন।

কুবায় হযরত (সা:) শুভাগমন করেন নবুয়্যাতের ত্রয়োদশ বছরের à§® রবিউল আওয়াল (মুতাবেক ২০সেপ্টেম্বর , ৬২২ খ্রিষ্টাব্দ)।এখানে অবস্থানকালে তার পয়লা কাজ ছিল একটি মসজিদ নির্মাণ করা । তিনি তার পবিত্র হস্ত দ্বারা এইমসজিদের ভিত্তি স্থাপন করেন এবং অন্যসাহাবীদের সঙ্গে নিয়ে এর নির্মানকাজ সম্পূর্ণ করেন। কয়েকদিন অবস্থান করে তিনি শহরের দিকে রওয়ানা করলেন। দিনটি ছিল শুক্রবার । পথে বনী সালেমের মহল্লা পর্যন্ত পৌঁছলে জুহর নামাজের সময় হলো। এখানে তিনি সর্বপ্রথম জুম’আর খুতবা প্রদান করেন এবং প্রথম বার জুম’আর নামাজ পড়ালেন।

মদিনায় প্রবেশকালে প্রতিটি আত্মোৎসর্গী মুসলিমের হৃদয়েই তার মেহমানদারীর সৌভাগ্য লাভের আকাঙ্খা জাগলো। তাই প্রত্যেক গোত্রের লোকই তার সামনে এসে আবেদন জানাতে লাগলো :‘হুযুর, এই হচ্ছে আপনার ঘর, অনুগ্রহ করে এখানে আপনি অবস্থান করুন। লোকদের মধ্যে এতখানি আগ্রহ-উদ্দীপনার সঞ্চার হলো যে প্রতিটি হৃদয়ই যেন পথের ফরাশে পরিণত হলো; প্রতিটি হৃদয়ই উৎসর্গীকৃত হবার জন্যে অস্থির হয়ে উঠলো। এমনকি মেয়েরা পর্যন্ত গৃহের ছাদে উঠে গাইতে লাগলোঃ চন্দ্র উদিত হয়েছে,
বিদা পর্বতের ঘাঁটি থেকে, খোদার শোকর আমাদের কর্তব্য, ,
যতক্ষণ প্রার্থনাকারীরা প্রার্থনা করে। ,
কিশোরী বালিকারা দফ বাজিয়ে বাজিয়ে গাইতে লাগলোঃ ,
আমরা নাজ্জার খান্দানের বালিকা ,
(আর) মুহাম্মদ(সা:) আমাদের কত উত্তম পড়োশী! ,
হযরত(সা:) বালিকাদের জিজ্ঞেস করলেন ‘তোমরা কি আমায় ভালোবাস ?তারা বললো ,হ্যাঁ। তিনি বললেনঃ ‘আমিও তোমাদের ভালোবাসি।’

মদিনায় অবস্থান

হযরত(সা:) এর মেহমানদারীর সৌভাগ্য কে লাভ করবে? এমন একটি প্রশ্ন যে এর মিমাংসা মোটেই সহজসাধ্য ছিল না। হযরত বললেন যে, আমার উষ্ট্রী যার গৃহের সামনে দাঁড়াবে , এ খেদমত সেই আজ্ঞাম দিবে। ’ ঘটনাক্রমে এ সৌভাগ্য টুকু হযরত আবু আইয়ুব আনসারী (রা) এর ভাগ্যে পড়লো। বর্তমানে যেখানে মসজিদে নববী অবস্থিত , তার নিকটেই ছিল তার গৃহ। গৃহটি ছিল দ্বিতল বিশিষ্ট । তিনি হযরত (সা:) এর থাকবার জন্যে ওপরের তলাটি পেশ করেন। কিন্তু লোকদের আসা-যাওয়ার সুবিধার্থে হযরত (সা:) নিচের তলায় থাকা পছন্দ করলেন্‌ হযরত আবু আইয়ুব এবং তার স্ত্রী নিচের তলা ছেড়ে ওপরের তলায় চলে গেলেন। এখানে হযরত(সা:) সাত মাস কাল অবস্থান করলেন। এরপর তার বসবাসের জন্যে মসজিদে নববীর নিকটে একটি কোঠা নির্মিত হলো এবং সেখানেই তিনি স্থানান-রিত হলেন। কয়েক দিনের মধ্যে তার খান্দানের অন্যান্য লোকও মদিনায় চলে এলো ।

মসজিদে নববীর নির্মাণ

মদিনায় আগমনের পর সবচেয়ে প্রথম ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল একটি মসজিদ নির্মাণ করা। হযরত (সা:) যেখানে অবস্থান করছিলেন, তার নিকটেই দুই ইয়াতিমের কিছু অনাবাদী জমি ছিল। নগদ মূল্যে তাদের কাছ থেকে এই জমিটি খরিদ করা হলো। তারই ওপর মসজিদের নির্মাণ কাজ শুরু হলো। এবারও হযরত(সা:) সাধারণ মজুরের ন্যায় সবার সাথে মিলে কাজ করলেন। স্বহস্থে তিনি ইট-পাথর বয়ে আনলেন। মসজিদটি অত্যন্ত সাদাসাদি ভাবে নির্মিত হলো। কাঁচা ইটের দেয়াল, খেজুর গাছের খুঁটি এবং খেজুর পাতার ছাদ - এই ছিল এর উপকরণ। মসজিদের কিবলা হলো বায়তুল মুকাদ্দিসের দিকে। কেননা, তখন পর্যন্ত মুসলমানদের কিবলা ছিল ‌ঐ দিকে। অতঃপর কিবলা কা’বামুখী হলে তদনুযায়ী মসজিদের সংস্কার করা হলো। মসজিদের একপাশে একটি উঁচু চত্বর নির্মিত হলো। এর নাম রাখা হলো ‘ সুফফা’। যে সব নও মুসলিমের কোন বাড়ি-ঘর ছিলো না। এটি ছিল তাদের থাকবার জায়গা।

মসজিদের নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হলে তার নিকটেই হযরত (সা:) তার স্ত্রীদের জন্যে কয়েকটি কোঠা তৈরি করে নিলেন। এগুলো কাঁচা ইট এবং খেজুর গাছ দ্বারা নির্মিত হলো। এই ঘরগুলো ছয়-সাত হাত করে চওড়া এবং দশ হাত করে লম্বা ছিল। এর ছাদ এতোটা উঁচু ছিল যে, একজন লোক দাঁড়ালে তা স্পর্শ করতে পারতো। দরজায় ঝুলানো ছিল কম্বলের পর্দা।

হযরত(সা:) এর গৃহের নিকটে যে সব আনসার বাস করতো, তাদের ভিতরকার স্বচ্ছল লোকেরা তার খেদমতে কখনো তরকারী , কখনো বা অন্য কিছু পাঠাতো। এর দ্বারাই তার দিন গুজরান হতো; অর্থাৎ সংকটের ভেতর দিয়েই তার জীবন-যাত্রা নির্বাহ হতো।

ভাই ভাই সম্বন্ধ

মক্কা থেকে যে সব মুসলমান ঘর-বাড়ি ত্যাগ করে মদিনায় চলে এসেছিল, তাদের প্রায় সবাই ছিল সহায় সম্বলহীন। তাদের মধ্যে যারা স্বচ্ছল ছিল, তারাও নিজেদের মাল-পত্র মক্কা থেকে আনতে পারেন নি। তাদের সবকিছু ছেড়ে-ছুঁড়ে একদম রিক্ত হস্তেই আসতে হয়েছিল। এই সব মুহাজির যদিও মুসলমানদের (আনসার) মেহমান ছিলো, তথাপি এদের স্থায়ী বসবাসের ব্যবস্থা করার প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভূত হচ্ছিল । তাছাড়া এরা নিজেরাও স্বহস্থে পরিশ্রম করে জীবিকা নির্বাহ করতে ভালবাসতো। তাই মসজিদে নববীর নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হলে একদিন হযরত (সা:) আনসারদের মধ্যে থেকে এক ব্যক্তি এবং মুহাজিরদের ভেতর থেকে এক ব্যক্তিকে ডেকে বললেন, ‘আজ থেকে তোমরা পরস্পর ভাই ।’ এভাবে সমস- মুহাজিরকে তিনি আনসারদের ভাই বানিয়ে দিলেন। তার ফলেই আল্লাহর এই খাঁটি বান্দাগণ শুধু ভাই-ই নয়, পরস্পরে ভাইয়ের চেয়েও ঘনিষ্ঠ বন্ধুতে পরিণত হলেন। আনসারগণ মুহাজিরদেরকে নিজ নিজ বাড়িতে নিয়ে গেল এবং তাদের সামনে নিজেদের সমস্ত সম্পত্তি ও সামান-পত্রের হিসাব করে বললো : ‘এর অর্ধেক তোমাদের আর অর্ধেক আমাদের।’ এভাবে বাগানের ফল, ঘরের সামান, বাসগৃহ, সম্পত্তি - মোটকথা, প্রতিটি জিনিসই সহোদর ভাইদের মতো বিভক্ত হলো। ফলে আশ্রয়হীন মুহাজিরগণ সব দিক থেকে নিশ্চিন্ত হলো। তারা যথারীতি ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করলো, দোকান-পাট খুললো এবং অন্যান্য কাজে নিযুক্ত হলো। এভাবে মুহাজির পুনর্বাসনের কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদিত হলো এবং এদিক দিয়ে সবাই নিশ্চিন্ত হলো।



সর্বশেষ আপডেট ( Sunday, 08 November 2009 )