ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন প্রিন্ট কর ইমেল
লিখেছেন সাইয়েদ আবুল আ’লা মাওদূদী   
Sunday, 25 May 2008
আর্টিকেল সূচি
ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন
ইসলাম ও জাহেলিয়াতের আদর্শিক ও ঐতিহাসিক দ্বন্দ্ব
মুজাদ্দিদের কাজ কি ?
শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলবীর কার্যাবলী
সাইয়েদ আহমদ বেরিলভী (র)ও শাহ ইসমাঈল শহীদ(র)
পরিশিষ্ট

ইসলাম ও জাহেলিয়াতের আদর্শিক ও ঐতিহাসিক দ্বন্দ্ব

পৃথিবীতে মানুষের জন্যে যে জীবন ব্যবস্থাই রচিত হবে তার অনিবার্য যাত্রারম্ভ হবে অতি-প্রাকৃতিক বা ধর্ম সম্পর্কিত বিষয়াবলী থেকে। মানুষ সম্পর্কে এবং এ পৃথিবী -যার মধ্যে সে বাস করে -তার সম্পর্কে সুস্পষ্প ও দ্ব্যর্থহীন ধারণা সৃষ্টি না করা পর্যন্ত জঅবনের কোনো পরিকল্পনা প্রণীত হতে পারে না। দুনিয়ায় মানুষের আচরণ কেমন হবে এবং এখানে তাকে কিভাবে কাজ করতে হবে, এ প্রশ্ন আসলে এই পরবর্তী প্রশ্নগুলোর সংগে গভীর সম্পর্ক রাখে যে, মানুষ কি? এ দুনিয়ায় তার মর্যাদা কি? এ দুনিয়ার ব্যবস্থা কোন ধরনের, যার সংগে মানুষের জীবন ব্যবস্থাকে সামঞ্জস্যশীল হতে হবে? এ প্রশ্নগুলোর যে সমাধান নির্ণীত হবে,সে পরিপ্রেক্ষিতে নৈতিকতা সম্পর্কে একটি বিশেষ মত স্থিরীকৃত হবে। অতঃপর ঐ মতবাদের প্রকৃতি অনুযায়ী মানব জীবনে বিভিন্ন বিভাগ গড়ে উঠবে। আবার এই কাঠামোর মধ্যে ব্যক্তি চরিত্র ও কর্মকাণ্ড এবং সামষ্টিক সম্পর্ক ও ব্যবহার বিধানাবলী বিস্তারিত রূপ পরিগ্রহ করবে। এভাবে অবশেষে এ সবের পরিপ্রেক্ষিতে তমুদ্দুনের বিরাট প্রাসাদ নির্মীত হবে। দুনিয়ায় আজ পর্যন্ত মানব জীবনের জন্যে যতগুলো ধর্ম এবং মত ও পথ তৈরী হয়েছে, তাদের প্রত্যেককে অবশ্যি নিজের একটি স্বতন্ত্র মৌলিক দর্শন ও মৌলিক নৈতিক মতবাদ প্রণয়ন করতে হয়েছে। এই মৌলিক দর্শন ও নৈতিক দৃষ্টিভংগীই মূলনীতি থেকে নিয়ে খুঁটিনাটি বিষয়েও একটি পদ্ধতিকে অন্যটি থেকে পৃথক করে । কেননা তাদেরই প্রকৃতি অনুযায়ী প্রত্যেকটি জীবন বিধানের প্রকৃতি গড়ে উঠেছে।তারা জীবন বিধানের দেহে প্রাণের ন্যায়।

ভুমিকা

ইসলামের সর্বাধিক ব্যবহৃত পারিভাষিক শব্দগুলোর মধ্যে ‘মুজাদ্দিদ’ শব্দটি অন্যতম। এ শব্দটির একটি মোটামুটি অর্থ প্রায় প্রত্যেক ব্যক্তিই জানেন। অর্থাৎ যে ব্যক্তি দ্বীনকে নতুন করে সঞ্জীবিত এ সতেজ করেন তিনি মুজাদ্দিদ ।কিন্তু এর বিস্তারিত অর্থের দিকে অতি অল্প লোকেরই দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। দ্বীনের ‘তাজদীদ’-সংস্কারের তাৎপর্য কি, কোন ধরনের কাজকে পূর্ণ ‘তাজদীদ বলা যেতে পারে এ কাজের ক’টি বিভাগ আছে,এবং আংশিক তাজদীদও বা কাকে বলে, এ কথা অল্প লোকেই জানেন। এই অজ্ঞতার কারণেই সাধারণ মানুষ ইসলামের ইতিহাসে মুজাদ্দিদ আখ্যাদান কারী মনীষীদের কর্মকাণ্ডের নিখুঁত পর্যালোচনা করতে অক্ষম । তারা শুধু এতটুকু জানে যে উমর ইবনে আবদুল আযীয, ইমাম গাজ্জালী, ইবনে তাইমিয়া, শায়খ আহমদ সরহিন্দী, শাহ ওয়ালিউল্লাহ এঁরা সবাই মুজাদ্দিদ ।কিন্তু তারা জানে না, এঁদেরকে কোন পর্যায়ের মুজাদ্দিদ বলা যেতে পারেএবং কার সংষ্কারমূলক কার্যাবলী কোন ধরনের এবং কতটুকু মর্যাদার অধিকারী? এই অক্ষমতা ও গাফলতির অন্যতম কারণ হলো, যে সব নামের সাথে ‘হযরত’ ‘ইমাম’ ‘হুজ্জাতুল ইসলাম’,কুতুবুল-আরেফিন,’যুবদাতুস সালেকীন’ এবং এই ধরনের শব্দাবলী সংযোজিত হয়, মন-মস্তিষ্ক তাদের প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধায় এতটা আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে যে,এরপর স্বাধীনভাবে তাদের কার্যাবলী পর্যালোচনা করে তাঁদের মধ্য থেকে কে এই আন্দোলনের জন্য কতটা এবং কোন পর্যায়ের কার্য সম্পাদন করেছেন এবং এ কার্যে তাঁর নিজের অংশ কতটুকু-এই সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানো অসম্ভম হয়ে পড়ে। সাধারণতঃ এই মনীষীগণের কর্মকাণ্ডকে অনুসন্ধানীর মাপাজোকা ভাষার পরিবর্তে ভক্তি-শ্রদ্ধা মিশ্রিত কাব্যিক ভাষায় বর্ণনা করা হয়। ফলে পাঠক ভাবেন এবং সম্ভবতঃ লেখকের মনে এ কথাই থাকে যে, যাঁর কথা উল্লেখ করা হচ্ছে , ‘তিনি কামেল পুরুষ’ ছিলেন এবং তিনি যা কিছু করেছেন , তা যে কোন দিক দিয়েই ‘কামালিয়াত’-পূর্ণতার সর্বোচ্চ স্তরে উপনীত হয়েছিল। অথচ বর্তমানে যদি আমাদেরকে ইসলামী আন্দোলনের সংস্কার ও পুনরুজ্জীবনের জন্য কোন প্রচেষ্টা চালাতে হয়, তা হলে এই ধরনের ভক্তি-শ্রদ্ধা ও অস্পষ্টতার দ্বারা কোন কাজ চলবে না । আমাদেরকে পূর্ণরূপে এই সংস্কারমূলক কাজকে বুঝতে হবে। আমাদেরকে নিজেদের অতীত ইতিহাসের পাতায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দেখতে হবে যে, বিগত শতাব্দীসমূহে আমাদের নেতৃবৃন্দ কতটা কাজ কিভাবে করেছেন, তাঁদের কার্যাবলী থেকে আমরা কতটুকু লাভবান হতে পারি এবং তাঁদের কোন কোন কাজ অসম্পন্ন রয়ে গেছে, সেগুলোর দিকে আমাদেরকে এখন দৃষ্টি দেয়া উচিত।

এ বিষয়টি আলোচনার জন্য একটি পৃথক পুস্তকের প্রয়োজন। কিন্তু পুস্তক লেখার অবসরই বা কোথায়? শাহ ওয়ালিউল্লাহ সাহেবের প্রসংগ উত্থাপিত হয়েছে, এতটুকুই যথেষ্ট। এ কারনেরও বিষয়টি সামান্য আলোচনা করার সুযোগ পেয়েছি। হয়তো আমার এই সামান্য আলোচনা কোন সুযোগ্য ব্যক্তির জন্য ইসলামের সংস্কার ও পুনরুজ্জীবনের ইতিহাস রচনা করার পথ প্রশস্ত করে দেবে।

এ প্রবন্ধটি বর্তমানে পুস্তকাকারে ছাপা হলেও আসলে এটি বেরিলির ‘আলকোরান’ পত্রিকার শাহ ওয়ালিউল্লাহ সংখ্যার জন্যে লেখা হয়েছিল। তাই এতে শাহ সাহেবের সংস্কারমূলক কার্যাবলীর প্রতি তুলনামূলক ভাবে অধিক বিস্তারিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করা হয়েছে এবং অন্যান্য মুজাদ্দিগণের কার্যাবলী প্রসংগক্রমে বর্ণনা করা হয়েছে। এ প্রবন্ধটি পাঠ করার সময় স্মরণ রাখা উচিত যে, সমস্ত মুজাদ্দিগণের যাবতীয় কার্যাবলী পুরোপুরি বর্ণনা করা এর উদ্দেশ্য নয়, বরং যেসব মুজাদ্দিদ ইসলামের ইতিহাসে বিশিষ্টতার অধিকারী হয়েছেন কেবল তাঁদের কথাই এখানে বর্ণিত। উপরন্তু এ কথাও স্মরণ রাখা উচিত যে, তাজদীদের কাজ অনেক করেছেন এবং প্রতি যুগে অনেক লোক করেন কিন্তু তাঁদের মধ্যে অতি অল্প লোকই ‘মুজাদ্দিদ’ উপাধি লাভের অধিকারী হয়ে থাকেন।

আবুল আ’লা
ফেব্রুয়ারী, ১৯৪০ইং

সাম্প্রতিককালের ফেতনাবাজ লোকেরা এ বইটিকে লক্ষ করে বিশেষভাবে তাঁদের নিশানাবাজী শুরু করেছেন। তাই আমি বইটি দ্বিতীয়বার পর্যালোচনা করে এর যে সব বাক্যাবলী থেকে নানান ফেতনা সৃষ্টি করা হচ্ছিল, সেগুলোকে সুস্পষ্ট করে দিয়েছি। এই সংগে সেই সমস্ত বিবৃতি ও উদ্ধৃতাংশের বরাতও দিয়েছি, সেগুলো সম্পর্কে এই মনে করে প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়েছিল যে, হয়তো এগুলো আমার নিজের মনগড়া। এ ছাড়া পুস্তকের শেষাংশে পরিশিষ্ট হিসাবে বিভিন্ন জবাবও সংযোজিত করেছি। এ জবাবগুলো ‘তর্জমানুল কোরআন’-এর মাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রশ্নকারীকে আমি দিয়েছিলাম। যদিও এর পরও প্রশ্নকারীদের মুখ বন্ধ হবে না। তবুও শ্রোতার কর্ণ প্রতারিত হওয়া থেকে বহুলাংশে নিষ্কৃতি পাবে।

আবুল আ’লা
অক্টোবর, ১৯৬০ইং



সর্বশেষ আপডেট ( Sunday, 08 November 2009 )