রাসায়েল ও মাসায়েল ৬ষ্ঠ খন্ড
লিখেছেন সাইয়্যেদ আবুল আ'লা মওদূদী   
Monday, 28 February 2011

রাসায়েল ও মাসায়েল

৬ষ্ঠ খন্ড

সাইয়্যেদ আবুল আ'লা মওদূদী

অনুবাদ
আকরাম ফারূক
আবদুস শহীদ নাসিম


<h1>গ্রন্থকার পরিচিতি</h1>

ইসলামী জ্ঞান হস্তান্তরের ধারাবাহিকতা
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. কে আল্লাহ তায়ালা কুরআনের ব্যাখ্যা সংক্রান্ত সূক্ষ্ম ও সুগভীর জ্ঞান ও যোগ্যতা দান করেছিলেন। তিনি কুরআনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ও তত্ত্বজ্ঞানের এতো বিপুল ভান্ডার উন্মোচন করেছিলেন যে, তাকে ইসলামের ইতিহাসে প্রথম মুফাসসিরূপে অবিহিত করা হয়। তাঁর এই অমূল্য তত্ত্বজ্ঞান পরবর্তীকালে তাঁর খ্যাতনামা শিষ্য ইকরামা, মুজাহিদ ও কাতাদা প্রমুখ মুসলিম উম্মাহর কাছে হস্তান্তর করেন। এ ক্ষেত্রে উস্তাদ ও শিষ্য উভয়ের অবদানই অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। অনুরূপভাবে মুসলিম সমাজে হযরত ইমাম আবু হানিফা রহ. এর ফিকাহ শাস্ত্রীয় ব্যুৎপত্তির প্রচারণও ব্যাপক প্রসার ঘটান তাঁরই শিষ্য ইমাম আবু ইউসুফ, ইমাম মুহাম্মদ ও ইমাম জুফার রহ.। পরবর্তীকালে ইমাম ইবনে তাইমিয়ার দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি স্বয়ং ইসলামি জ্ঞান ও পাণ্ডিত্যের এক অতলস্পর্শী সমুদ্র তো ছিলেনই। কিন্তু তাঁর সুযোগ্য শিষ্য ইবনে কাইয়েম আল জাউদী রহ. স্বীয় উস্তাদের জ্ঞান প্রদীপকে শুধু প্রজ্জলিত রাখেননি, অধিকন্তু তার ঔজ্জ্বল্য ও সুষমা আরো বর্ধিত করেছিলেন।
উপমহাদেশে ইমাম শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলবী রহ. ইসলামের পুনরুজ্জীবনে যে অসাধারণ ভূমিকা পালন করেন, তা এতদঞ্চলের ইতিহাসের এক অত্যুজ্জ্বল অধ্যায়।
তাঁর সেই কৃতিত্বপূর্ণ ভূমিকার প্রভাবকে অব্যাহত রাখা ও অধিকতর কার্যকর করার ব্যাপারে তাঁর সুযোগ্য শিষ্যগণের প্রচেষ্টাও অত্যন্ত প্রশংসনীয়। নিকট অতীতে মাওলানা শিবলী নোমানীর শিষ্যগণ শিবলীর চিন্তাধারা যেভাবে চালু রেখেছেন তা জ্ঞানীগণের অজানা নয়। মাওলানা সাইয়েদ সুলায়মান নদভী এঁদের অন্যতম।
বর্তমান যুগের চলমান ইসলামি আন্দোলনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এ ধরনের একাধিক দৃষ্টান্ত মেলে। আলজেরিয়ায় শেখ আব্দুল হামিদ বিন বাদীসের পরবর্তীকালে তার ঘনিষ্ঠ সহচর মুহাম্মদ আল বশীর আল ইবরাহিমী তার কাঙ্খিত কাজকে বিদ্যাগত ক্ষেত্রে যেমন, তেমনি দাওয়াতী ময়দানেও অব্যাহত রাখেন। মিসরে ইমাম হাসানুল বান্না শহীদের আদর্শ ও চিন্তাধারার উত্তরাধিকারীদের মধ্যে অধ্যাপক আব্দুল কাদের আওদা, অধ্যাপক আল বাহী আল খাওলী, সাইয়েদ কুতুব শহীদ ডক্টর ইউসুফ আল কারজাভী, ডক্টর আহমদ আল আবছাল, ইউসুফ আল আজম এবং সাঈদ হাওয়া অন্যতম। এই মনীষীগণ যদিও ইমাম হাসানুল বান্নার প্রত্যক্ষ ছাত্র ছিলেন না। তবে তারা ইমাম হাসানুল বান্নার চিন্তাধারা দ্বারা এতো বেশি প্রভাবিত ছিলেন যে, সঠিক অর্থেই তাদেরকে তাঁর আদর্শিক উত্তরাধিকারীরূপে আখ্যায়িত করা যায়।
মাওলানা মওদূদী রহ. এ যুগের চিন্তা ও কর্মের জগতে যে বিপ্লবী আন্দোলনের সূত্রপাত করেন, তার প্রভাবও সীমাহীন। এই উভয় ময়দানে তাঁর উত্তরাধিকারী হয়েছে এক সর্বাত্মক ইসলামি আন্দোলন। এ আন্দোলন ভারতীয় উপমহাদেশে তাঁর প্রত্যক্ষ শিষ্যদের এবং দুনিয়ার অন্যান্য দেশে তাঁর আধ্যাত্মিক শিষ্যদের নেতৃত্বে চালু রয়েছে। প্রত্যক্ষ শিষ্যদের মধ্যে কতিপয় বিশিষ্টি ব্যক্তিত্ব এমনও রয়েছে, যারা বহু বছর যাবত দিবারাত্র মাওলানার তত্ত্বাবধানে থেকেছেন। এদের মধ্যে মিয়া তোফায়েল মুহাম্মদ, জনাব নঈম সিদ্দিকী, মরহুম আব্দুল হামিদ সিদ্দিকী ও মাওলানা মালিক গোলাম আলীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মিয়া তোফায়েল মুহাম্মদ তো পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমীর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং মরহুম মাওলানা এই গুরুত্বপূর্ণ পদের জন্য তাঁকে বাস্তব প্রশিক্ষণও দিয়েছেন। জনাব নঈম সিদ্দিকী এবং অধ্যাপক আব্দুল হামিদ সিদ্দিকী মরহুম মাওলানার দাওয়াত, চিন্তাধারা ও ইসলামি আন্দোলনের দার্শনিক দিক চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন। উভয়ে সাংবাদিকতার জগতেও মাওলানার অনুসৃত নতুন ধারার বিকাশ ঘটিয়েছেন।
মাওলানা মালিক গোলাম আলী সাহেব এঁদের মধ্যে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তিনি ছাত্র জীবন থেকেই মাওলানা মওদূদীর রহ. সাহচর্যে আসেন এবং শেষ মুহূর্ত্ব পর্যন্ত তা অব্যাহত রাখেন। বললে অত্যুক্তি হবেনা যে, মালিক সাহেব মরহুম মাওলানার সাহচর্যে জীবনের সুদীর্ঘ স্বর্ণপ্রসু অংশ অতিবাহিত করে শুধু যে মাওলানার চিন্তাধারা ও অন্তদৃষ্টিকে গভীরভাবে আত্মস্থ করেছেন তাই নয়, বরং ইসলাম সম্পর্কে সুগভীর পাণ্ডিত্যও অর্জন করেছেন। বস্তুত: মালিক সাহেব পরিভাষা অনুসারে যথার্থভাবেই একজন 'ইসামী' অর্থাৎ 'স্বয়ম্ভু' ব্যাক্তিত্ব। তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবন বৃত্তান্ত থেকে এ সত্য স্পষ্ট হয়ে উঠে।


প্রাথমিক জীবন
মালিক সাহেব নিরেট পল্লি সমাজে জন্মগ্রহণ করেছেন, যদিও পল্লি সমাজে শিক্ষা সংস্কৃতির প্রসার সীমিত হয়ে থাকে। তবে সেখানে এমন কিছু গুণাবলীরও বিকাশ ঘটতে দেখা যায়, যা ভবিষ্যত জীবনে শিক্ষা ও সংস্কৃতির উত্তম ভিত্তি হিসেবে পরিগণিত হয়ে থাকে। যেমন, সরল সাদাসিধে ও অনাড়ম্বর জীবনযাপন, অল্পে তুষ্টি, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, জ্ঞানী গুণীদের প্রতি আন্তরিক টান ও ভালবাসা। মালিক সাহেব এসব গুণে সমৃদ্ধ হয়েই শহরে পদার্পণ করেন। তার প্রাথমিক জীবন সম্পর্কে তার নিজের বর্ণনা নিম্নরূপ: "সারগোধা জেলার উত্তরাঞ্চলে সোন সেকসর নামে একটা গ্রাম আছে। সেখানেই আমার জন্ম। আমি একটা ধর্মপ্রাণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করি। আমার পিতা খুবই ধার্মিক ব্যক্তি ছিলেন। তাহাজ্জুদ নামাযে অভ্যস্থ ছিলেন। সাধ্যমত নামায, রোযা ও যাবতীয় সৎ কাজে উৎসাহ দেয়া তাঁর স্বভাব ছিলো। আমি শিশুকাল থেকেই লেখাপড়াই খুবই আগ্রহী ছিলাম। স্কুলে একজন ভালো ছাত্র হিসেবে গণ্য ছিলাম। প্রাইমারীর উর্ধে প্রত্যেক শ্রেনীতে ভালো ফলাফলের জন্য বৃত্তি পেতাম। গ্রামের বয়স্ক লোকেরা বলতেন ঐ গ্রামের ইতিহাসে আমিই প্রথম বৃত্তি পেয়েছি।"
পিতামাতার দেয়া প্রাথমিক শিক্ষা মানুষের স্বভাবে গভীরভাবে রেখাপাত করে থাকে। মালিক সাহেবের ব্যক্তিত্বে এই শিক্ষার প্রভাব ও আলামত তার সাথে দেখা করতে গেলে প্রথম দৃষ্টিতেই চোখে পড়ে। বিশেষত: দুটো গুণ অবশ্যই লক্ষ্য করা যাবে, সাদাসিধে জীবন ও ধর্মভীরুতা। এ দুটো গুণ মানব চরিত্রের শ্রেষ্ঠতম ভূষণ বিবেচিত হয়ে থাকে। ইসলামি জ্ঞান ও ইসলামি দাওয়াতের অঙ্গনে ইপ্সিত স্তর অতিক্রম করার সৌভাগ্য যার প্রাপ্য, সে দুটো উপাদানে ভূষিত না হয়ে ঐ স্তরসমূহ অতিক্রম করতে সক্ষম নয়।

লাহোর আগমন
গ্রামীণ জীবনের সব মহৎ গুণে ভূষিত হয়ে মালিক সাহেব নগর জীবনে পদার্পণ করলেন। তিনি বলেন: "আমাদের এলাকায় 'নও শহরা' একটা ছোট খাট কেন্দ্রীয় শহর। সেখানে হাইস্কুল, থানা ও বেসামরিক হাসপাতাল রয়েছ। আমি এই স্কুলেই শিক্ষা লাভ করেছিলাম। এখানে শিক্ষার ব্যবস্থা ও মান তেমন ভালো ছিলনা। এই স্কুলের জনৈক শিক্ষক আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। তিনি লাহোরের অধিবাসী ছিলেন। তাঁকে আমি বললাম লাহোরে গিয়ে লেখাপড়া করার কোনো সুযোগ যদি পাই, তবে খুবই ভালো হয়। আমার প্রস্তাবটা তাঁরও মনোপূত হলো। বিএবিএড এই শিক্ষকের নাম ছিলো মাওলানা আব্দুল গফুর। তার বাড়ি ছিলো কাবুলি মহল্লায়। তিনি সৎ ও দীনদার ছিলেন। তিনি বললেন: আমি আল্লাহ চাহে তো তোমার এ আকাঙ্খা পূরণের ব্যবস্থা করে দেবো। সত্যিই ব্যবস্থা করে দিলেন। আঞ্জুমানে হেদায়াতে ইসলামের পরিচালনাধীন শেরানওয়ালা হাইস্কুলে আমাকে ভর্তি করিয়ে দিলেন এবং উক্ত স্কুলের সবচেয়ে ভালো সেকশনটির অন্তর্ভুক্ত করে দিলেন।"

এভাবে মালিক সাহেব সোন সেকসর গ্রামের সরল ও সীমিত পরিবেশ থেকে বেরিয়ে আকস্মিকভাবে জীবনের প্রথম প্রহরেই লাহোরের মতো শহরে চলে এলেন। এই নতুন পরিবেশে সব কিছুই তাঁর কাছে অদ্ভুত মনে হওয়ার কথা। শিক্ষাঙ্গনে পারস্পরিক প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হওয়ার কথা। আভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে রকমারি রাজনৈতিক বির্তক প্রত্যক্ষ করে থাকবেন নিশ্চয়ই। সভ্যতার উপকরণসমূহ নিত্য নতুন চমক ও চাকচিক্য নিয়ে তাঁর সামনে প্রতিভাত হয়ে থাকবে। আল্লাহর বিশেষ রহমত না থাকলে এসব উপকরণ মানুষকে সত্য পথ থেকে বিভ্রান্তও করে দিতে পারে। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা মালিক সাহেবকে এখানেও তাঁর সাবেক সৎ গুনাবলী সংরক্ষণ করার ও তাকে আরো উৎকর্ষ দানের সুযোগ করে দিলেন। তিনি বলেন: শেরানওয়ালা ইসলামিয়া হাইস্কুলে সকল শ্রেণীর এবং সকল শিক্ষকের রীতি ছিলো যে, নামাযের সময় হলে আমাদের সকল শিক্ষক নিজ নিজ ছাত্রদেরকে সাথে নিয়ে মসজিদে চলে যেতেন। সেখানে তারা নিজেরাও নামায পড়তেন, আর ছাত্রদেরকেও পড়াতেন। কোনো কোনো ছাত্র বলতো শেরানওয়ালা মসজিদ যখন নিকটেই তখন আমরা ঐ মসজিদেই নামায পড়বো। সতরাং ঐ মসজিদেই নামায পড়তে গিয়ে আমি মাওলানা আহমদ আলী সাহেবের দারস ও খুৎবা শোনার সৌভাগ্য লাভ করতে থাকি এবং তাঁর পেছনে নামায পড়তে থাকি। ঐ মসজিদটিতে দীর্ঘদিনব্যাপী নামায পড়ি। সেখানে তৎকালে প্রচুর দারস ও ওয়ায নসীহত ইত্যাদি হতো এবং সেখানকার পরিবেশ পর্যাপ্ত পরিমাণে ইসলামি ভাবধারা বিরাজ করতে।

কলেজ জীবন
স্কুলের শিক্ষা জীবন শেষে মালিক সাহেব কলেজে ভর্তি হন। সে যুগে কলেজে বৃটিশ শিক্ষা ব্যবস্থা দোর্দণ্ড প্রতাপে চালু ছিলো। এই শিক্ষা ব্যবস্থায় জড়বাদী দর্শনের শিক্ষা এতো বেশি দেয়া হতো যে, ইসলামি আকীদা বিশ্বাস ও নৈতিকতার ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে যেতো। একারণেই বৃটিশ ব্যবস্থার দরুন মুসলিম সমাজে নাস্তিকতা ও ধর্মহীনতা ছড়িয়ে পড়ে এবং তার ফলে মুসলিম যুবসমাজে নানা রকমের অনৈসলামিক মতবাদ ও চিন্তাধারার অনুপ্রবেশ ঘটে। সাহিত্য, ইতিহাস, সমাজ বিজ্ঞান, অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান এককথায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই চিন্তার নৈরাজ্য দেখা দেয়। এখানেও মালিক সাহেব আল্লাহর অসাধারণ অনুগ্রহে সিক্ত থাকেন। তিনি এমন কয়েকজন শিক্ষকের তদারকি লাভ করেন, যারা তাকে মহৎ থেকে মহত্তর হতে সাহায্য করতে থাকেন। মালিক সাহেব ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। এই কলেজে তিনি যেসব অধ্যাপকের সংস্পর্শে আসেন, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মাওলানা আলীমুদ্দীন সালেক মরহুম। তার কাছ থেকে মালিক সাহেব ফার্সি ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষা অর্জন করেন। মরহুম সালেক সাহেবের ধর্মানুরাগী স্বভাব ও মেজাজ সম্পর্কে মালিক সাহেব বলেন: তাঁর শ্রেণীতে কোনো ছাত্র খালি মাথায় বসবে, এটা ছিলো অসম্ভব। প্রত্যেক ছাত্র টুপি নিয়ে আসতো। অন্যান্য পিরিয়ডে তা কোথাও রেখে দিতো ফার্সির পিরিয়ডে টুপি পরতেই হতো। শার্টের বোতাম খোলা থাকলে তিনি আপত্তি জানাতেন এবং বলতন,'বোতাম আটকাও।' কারো মাথা খালি থাকলে তিনি জিজ্ঞেস করতেন:'তোমার নাম কি?' যদি কেউ জবাব দিতো যে, জনাব আমার নাম গোলাম আলী কিংবা গোলাম মুহাম্মদ তাহলে তিনি বলতেন, "না না তোমার অন্নপ্রাসন কোন্ গীর্জায় হয়েছে? তোমার খৃষ্টান নাম কি?"

প্রশিক্ষণের এ পদ্ধতির উপর এ যুগের মনোবিজ্ঞানীরা নানারকম আপত্তি তুলে থাকেন। তবে আমরা মনে করি, মুসলিম যুবকদের প্রশিক্ষণ যেমন তাদের চিন্তাচেতনার সংশোধনের জন্য জরুরি। তেমনি তাদের বাহ্যিক বেশভুষা সংশোধনের জন্যও অপরিহার্য। বাহ্যিক পরিশুদ্ধি আভ্যন্তরীন অবস্থার উপর প্রভাব বিস্তার করে থাকে।

মাওলানা আলীমুদ্দীন সালেক ছাড়া মালিক সাহেব কলেজ জীবনে আরো কয়েকজন মর্যাদাসম্পন্ন শিক্ষকের সান্নিধ্যে আসেন। তাঁরা তার সহজাত প্রতিভা, ইসলামি চেতনা এবং সত্যানুসন্ধানের মনোবৃত্তিকে দমন করার পরিবর্তে আরো উজ্জীবিত করেন। ঘটনাক্রমে এই কলেজেই কিছুদিনের জন্য মাওলানা মওদূদী রহ. শিক্ষক হিসেবে জ্ঞানদান করেন এবং তাঁর সাথে মালিক সাহেবের সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

আমার মতে, পরিস্থিতি ও ঘটনাপ্রবাহের এই ধারাবাহিকতাকে নিছক আকস্মিক ব্যাপার হিসেবে গণ্য করা যায়না। বরঞ্চ সত্যের সন্ধ্যানে ব্যাপৃত মানুষের জন্য সত্যের পথ সুগম করে দেয়ার মানসে আল্লাহর পক্ষ থেকে সহায়তা প্রদান করার যে রীতি প্রচলিত রয়েছে, সেটাই এই পুরো ঘটনা প্রবাহের পেছনে সক্রিয়।

মাওলানা মওদূদীর শিষ্যত্বের যুগ
মাওলানা মওদূদী কিভাবে ইসলামিয়া কলেজের সাথে জড়িত হলেন, সেই পটভূমি বর্ণনা প্রসঙ্গে মালিক সাহেব বলেন:
আমরা জানতে পারলাম এখন থেকে মাওলানা মওদূদী সাহেব ইসলামিয়াত পড়াবেন। মাওলানার আগে এ বিষয়টি পড়াতেন টুনকের মাওলানা ওমর খান। তিনি অত্যন্ত নেককার ও ন্যায়নিষ্ঠ লোক ছিলেন। তিনি অত্যধিক বৃদ্ধ হয়ে যাওয়ায় মাওলানা মওদূদী তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়ে আসেন। কলেজ কর্তৃপক্ষ যখন মাওলানার সাথে আলাপ করেন তখন মাওলানা বলেন : "আমি অবৈতনিক পড়াবো। কোনো পারিশ্রমিক নেবোনা। আমার কাজে তথা শিক্ষাদান পদ্ধতিতে আপনারা কোনো হস্তক্ষেপ করবেন না। আপনারা কোনো বিধিনিষেধ বা কড়াকড়ি আরোপ করবেন না। আমি নিজে খুবই ব্যস্ত মানুষ। তা সত্ত্বেও আপনারা যখন প্রস্তাব দিয়েছেন, তখন এ সুযোগকে কাজে লাগাবো। এভাবে নতুন শিক্ষিত বংশধরের কাছে আমার আহবান পৌঁছে যাবে।"

এই শর্তযুক্ত চুক্তি সম্পাদিত হয়ে যাওয়ার পর মাওলানা মওদূদী রহ. ইসলামিয়া কলেজে ইসলামিয়াত বিষয়ে অধ্যাপনা শুরু করে দেন। মাওলানার হাতে সময় কম থাকতো এবং প্রত্যেক শ্রেণীতে গিয়ে লেকচার দেয়া দুরূহ ছিলো। তাই তাঁর পরামর্শ অনুসারে সকল ছাত্রকে একটি বড় কক্ষে সমবেত করা হতো এবং তিনি একই সময়ে সকলের সামনে ভাষণ দিতেন। মালিক সাহেব বলেন : "এখানেই আমি মাওলানাকে প্রথম দেখলাম। তখন তাঁর চুল একেবারেই কালো ছিলো। কালো টুপি পরতেন। কখনো কখনো রুমী টুপিও পরে আসতেন।"

মাওলানা স্বীয় ভাষণের মধ্য দিয়ে ইসলামের মৌলিক শিক্ষা বিশ্লেষণ করতেন। তিনি বলতেন, ইসলাম কোনো পূজাসর্বস্ব বা নিছক ইবাদত আরাধনার ধর্ম নয়। ইসলামের আনুষ্ঠানিক ইবাদতগুলো আসলে মানুষকে একটা বৃহত্তর ও ব্যপাকতর ইবাদতের জন্য প্রস্তুত করে থাকে এবং এসব ইবাদত সমগ্র জীবনের উপর প্রভাব বিস্তার করে। ইসলামের একটা ব্যাপক সর্বাত্মক সামষ্টিক বিধান রয়েছে, যা জীবনের প্রতিটি অংশের সাথে সম্পৃক্ত। এতে রাজনীতি, অর্থনীতি ও সামাজিক রীতিনীতি রয়েছে। এককথায়, জীবনের সব কিছুই এর অন্তর্ভুক্ত। রাজনীতি এর আওতা বহির্ভুত নয়।

মাওলানার অনুসৃত ইসলামের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের এই ধারা দেখে কলেজ কর্তৃপক্ষ কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন। এ ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ আর কিছু নয়। মানুষকে মানুষের গোলামী থেকে মুক্তি লাভের এবং স্বেচ্ছাচারী খোদাদ্রোহী ব্যবস্থাকে উৎখাত করে পৃথিবীতে আল্লাহর সত্য দীনকে বিজয়ী করার আহবান ছিলো। এ ধরণের আহবান প্রত্যেক যুগেই প্রত্যেকে কর্তৃত্বশীল ও ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীকে উদ্বিগ্ন করেছে। যে সময়ে মাওলানা ইসলামিয়া কলেজে নতুন প্রজন্মের তরুণদের সামনে ইসলামের এই ব্যাখ্যা পেশ করছিলেন, সেটি ছিলো ইংরেজদের যুগ। ঐ কলেজ শাসকদের আর্থিক সাহায্য নিয়েই চলতো। তাই কলেজ কর্তৃপক্ষ মনে করলেন, মাওলানার এই শিক্ষা কার্যক্রমের দরুণ তাদের ক্ষতি হওয়ার আশংকা রয়েছে। তারা মাওলানাকে নিছক ধর্মীয় শিক্ষার ভেতরে আপন অধ্যাপনা সীমিত রাখতে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু এই বিধিনিষেধ ও নিয়ন্ত্রণ মাওলানার মনপূত ছিলোনা। তিনি যখন বুঝতে পারলেন কর্তৃপক্ষ তার অধ্যাপনায় শংকিত হয়ে পড়েছেন, তখন তিনি স্বত:প্রবৃত্ত হয়ই ঐ কার্যক্রম বন্ধ করে দিলেন।

মাওলানা মওদূদীর সাথে ঘনিষ্ঠতা
মাওলানা মওদূদীর সাথে মালিক সাহেবের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ইতিমধ্যেই গড়ে উঠেছিলো। মালিক সাহেব বলেন : "মাওলানার এক আধটা বক্তৃতা শুনেই আমরা তাকে মন উজাড় করে ভালোবেসে ফেলেছিলাম।"

মাওলানা যখন কলেজ ছেড়ে দিলেন, তখন মালিক সাহেব নিজের লেখাপড়া মাঝপথেই বন্ধ করে দিলেন এবং মাওলানার সাহচর্যে থাকতে আরম্ভ করলেন। এই সাহচার্য নেহায়েত আবেগ বা অন্ধ ভক্তিনির্ভর ছিলোনা। তিনি সচেতনভাবে মাওলানার দাওয়াতকে হৃদয়ঙ্গম করেন, তাঁর সাথে বহু বিষয়ে আলোচনা করেন, অত:পর নিজের সকল দ্বিধাদ্বন্দ্বের অবসান ঘটিয়ে পরিপূর্ণ আত্মতৃপ্তি সহকারে মাওলানার সহযাত্রী হয়ে যান। মালিক সাহেবের কতিপয় শিক্ষক তাঁকে এ পদক্ষেপ থেকে বিরত রাখতে চেষ্টা করেন এবং সেটা তারা ভালো মনে করেই করেন। কিন্তু মালিক সাহেব নিজের মন ও চেতনার আলোকে যে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন, তা অপরিবর্তিত থাকে এবং আল্লাহর ইচ্ছাও তার পেছনে সক্রিয় ছিলো।

লেখাপড়া বাদ দেওয়ার পর মালিক সাহেব দীন প্রতিষ্ঠাকে জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেন। তাঁর জীবনে এটা এমন একটা মৌলিক বিপ্লব ছিলো, যাকে ভাসা ভাসা দৃষ্টিতে দেখে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। একজন তরুণ শিক্ষার্থী, যার উপর তার পিতামাতার হাজারো আশা ভরসা এবং পার্থিব দৃষ্টিতে যার নিজের সামনেও উজ্জ্বল ভবিষ্যতের হাতছানি বিদ্যমান, সে যদি এমন সিদ্ধান্ত নেয়, যাতে পিতামাতার আশা ভরসাও পূর্ণ হয়না এবং নিজের ব্যক্তিগত আকাঙ্খা চরিতার্থ হওয়ারও অবকাশ থাকেনা, তা হলে ঐ সিদ্ধান্তকে নিশ্চিতভাবেই কোনো উচ্চতর ঈমানী প্রেরণার অভিব্যক্তি মনে করতে হবে। ইকামতে দীনের সুমহান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে উপলব্ধি করে মালিক সাহেব মাওলানার কাছে উপস্থিত হলেন এবং বলতে লাগলেন : "আমি নিজের পরাজয় স্বীকার করছি। আমি মনে করি, এটাই একজন মুসলমানের প্রকৃত করণীয় কাজ। আল্লাহ অবশ্যই কোনো মুসলমানকে এমন কাজের নির্দেশ দেননি, যা তার পক্ষে অসম্ভব। আমরা সে কাজকে তার চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারি কিনা, সেটা অবশ্য ভিন্ন কথা।"

জবাবে মাওলানা রহ. এই প্রতিভাধর তরুণের কাছে যে বক্তব্য তুলে ধরেন, তা ইসলামের মহান আহবায়ক হিসেবে তাঁর ব্যক্তিত্বের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য উন্মোচন করে : "বস্তুত: মুসলমানের করণীয় কাজ এটাই। মুসলমান হিসেবে ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগতভাবে পৃথিবীতে ইসলামের দাওয়াত ছড়িয়ে দেয়া এবং দীনকে প্রতিষ্ঠিত করাই আমাদের দায়িত্ব। চাই তাতে সফলতা লাভ হোক বা না হোক। ফলাফল তো আল্লাহর হাতেই। বহুসংখ্যক নবী এমন অতিবাহিত হয়েছেন যে, কেউবা একজন অনুসারী পেয়েছেন, কেউবা দু'জন পেয়েছেন। কেয়ামতের দিন কোনো কোনো নবী মাত্র একজন বা দু'জন করে সাথি নিয়ে আসবেন। কোনো কোনো নবীকে তো পরিবারের লোকেরাও মান্য করেনি। কাজেই এ জিনিসের তোয়াক্কা না করা চাই। আল্লাহর মেহেরবানীতে কোটি কোটি মুসলমান রয়েছে। তারা চাইলে আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠা কেন সম্ভব হবে না?"

মাওলানা সাহেব বললেন : "কমুনিজমকে যখন নিছক একটা মতবাদের আকারে পেশ করা হয়, তখন কেউ ভাবতেও পারেনি যে, মানব প্রকৃতির প্রতিকূল এই মতবাদ এমন প্রতিষ্ঠা লাভ করে করে ফেলবে। কিছু লোক ময়দানে নেমে পড়লো, কম্যুনিজমের জন্য তৎপরতা চালালো এবং তারা সফলতা লাভ করলো। যেসব দেশে কম্যুনিজম বাস্তবায়িত হবে বলে তারা ভেবেছিলো, সেখানে হলোনা। সুসভ্য ও উন্নত দেশগুলোতে কম্যুনিজম চালু করা গেলোনা। রাশিয়াতে গিয়ে চালু হয়ে গেলো। সম্ভব আর অসম্ভব কথাটা তো আপেক্ষিক পরিভাষা। যে উদ্দেশ্যের জন্য মানুষ প্রাণপণ সংগ্রাম করে এবং তার পক্ষে আল্লাহর মঞ্জুরী থাকে, তা সফলতা অর্জন করে। ব্যর্থ হলে সে ক্ষেত্রে আমরা আল্লাহর কাছে দায়মুক্ত হয়ে যাবো এবং বলতে পারবো, হে আল্লাহ  আমরা সাধ্যমত চেষ্টা করেছি।"

মাওলানা মওদূদীর রহ. এই আবেগময় ও প্রেরণাদায়ক জবাবের পর মালিক সাহেব যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন তাও চমকপ্রদ বটে। মালিক সাহেব বললেন : "বাতাস অনুকূলই হোক আর প্রতিকূলই হোক, আমরা পানিতে নৌকা ভাসিয়ে দিয়েছি। আমিও আপনার সাথি। আমি বয়সে তরুণ। ইসলামি শিক্ষা আমার তেমন বেশি নেই, তবে একেবারে অকাট মূর্খও নই। যা হোক, আমি আপনার সাথে যুক্ত হলাম। এই মহৎ উদ্দেশ্যে জীবন উৎসর্গ করার অঙ্গীকার করলাম।"

দৃঢ়তা ও অবিচলতা
এই বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত নেয়ার পর মালিক সাহেব লেখাপড়া অসম্পূর্ণ রেখে দিলেন। আগেই বলেছি মালিক সাহেব লেখাপড়া অসম্পূর্ণ রেখে দেয়ার পর তার সুযোগ্য শিক্ষকগণ তাকে অনেক বোঝালেন যে, এটা নিতান্তই আবেগতাড়িত সিদ্ধান্ত। শিক্ষা সম্পূর্ণ না করা কোনো বুদ্ধিমানসুলভ পদক্ষেপ নয়। কিন্তু মালিক সাহেব স্বীয় সিদ্ধান্তে অটল রইলেন এবং ঐসব বিদ্বান ব্যক্তির এ ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো যে, মালিক সাহেব নিছক আবেগের বশবর্তী হয়ে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। মালিক সাহেব এ সিদ্ধান্তটা খুব জেনে বুঝেই নিয়েছিলেন এবং পরবর্তী সময়ে স্পষ্ট হয়ে গেলো যে, যে ফায়সালাকে লোকেরা শিক্ষার অপরিপক্কতা থেকে উদ্ভূত বলে ভেবেছেন, সেটা মালিক সাহেবের জন্য শুধু যে শিক্ষার উন্নতির সোপান সাব্যস্ত হয়েছিল তা নয়, বরং তার কর্মের উৎকর্ষ সাধনে সহায়ক হয়েছিল।

এবার মালিক সাহেব মাওলানার সার্বক্ষণিক সহযোগী ও সহকর্মী হয়ে গেলেন। নিজের দৈনন্দিন প্রয়োজন পূরণে পরিবারের উপর বোঝা চাপানোর পরিবর্তে লাহোরের অভ্যন্তরেই কয়েকটি টিউশন যোগাড় করে নিজের ব্যয় নির্বাহের ব্যবস্থা করে নিলেন। বাদ বাকি সময় মাওলানার সাথে কাটিয়ে তাঁর বিভিন্ন কাজে অংশ নিতে লাগলেন। ক্রমে টিউশনের পেশার প্রতিও তার বিতৃষ্ণা ধরে গেলো। কেননা দেশে বৃটিশ সাম্রাজ্যের শক্তি বৃদ্ধি সহায়ক যে শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলিত ছিলো এ কাজটা তারই এক ধরণের সেবা ছাড়া কিছু নয়। তাই তিনি প্রাইভেট পড়ানোর কাজটাও ছেড়ে দিলেন এবং একেবারেই বেকার হয়ে গেলেন। মালিক সাহেবের এ সিদ্ধান্তে মাওলানা বেশ খানিকটা ভাবনায় পড়ে গেলেন যে, এখন কি হবে। কারণ মাওলানা নিজেও তখন খুবই অনটনের মধ্যে ছিলেন এবং মালিক সাহেবের জন্য জীবিকার সংস্থান হতে পারে এমন কোনো কাজ তাঁর হাতে ছিলনা। মালিক সাহেব নিজেও কাজকর্ম না করে মাওলানার উপর আর্থিক বোঝা হয়ে বসতে চাইছিলেন না। পক্ষান্তরে তিনি এটাও অনুভব করলেন যে,  তিনি মাওলানাকে ভাবনায় ফেলে দিয়েছেন। তবে তিনি মাওলানার উদ্বেগ এই বলে নিরসন করলেন যে, "আল্লাহ একটা না একটা উপায় বের করে দেবেন। তিনিই উপায় উপকরণের সংগ্রাহক ও নিয়ামক।"

কথাটা খুবই সাদামাটা এবং সংক্ষিপ্ত বটে। তবে এর ভেতর দিয়ে সেই শিক্ষারই প্রতিফলন ঘটেছিল, যা মাওলানা মওদূদী রহ. বিংশ শতাব্দীর বস্তুবাদী মানুষকে বিতরণ করেছিলেন।

জলন্ধরে এক'বিরল পণ্যের' আবির্ভাব
মালিক সাহেবের নবোদ্ভুত পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে মাওলানা নিজের এক বন্ধু আব্দুল আযীয শারক্কীকে জলন্ধরে চিঠি লিখে পাঠালেন যে, এই সত্যনিষ্ঠ যুবকটির একটা কিছু কর্মসংস্থান করুন। শারক্কী সাহেব মালিক সাহেবকে জলন্ধর ডেকে নিলেন এবং সেখানে ছোট একটা লাইব্রেরি খুলে সেটি তার দায়িত্বে সমর্পণ করলেন। এই লাইব্রেরির অবস্থা কি ছিলো, তা লাইব্রেরির সাইন বোর্ডে মালিক সাহেবের নিজে লিখে টানানো নিম্নো পংক্তিটি থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় : "একটা বিরল পণ্যের আবির্ভাব ঘটেছে, যদিও অধিকাংশ খরিদ্দার এ সম্পর্কে অজ্ঞ। আমরা এ শহরে সবার চেয়ে ভিন্ন ধরনের দোকান খুলেছি।"

এহেন অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে তার দিনরাত অতিবাহিত হতে থাকে। দোকান থেকে কোনো আয় রোজগার হতো না। জীবিকা উপার্জনের সকল পথ রুদ্ধ ছিলো। এমন অগ্নি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া খুব কম লোকের পক্ষেই সম্ভব হয়ে থাকে। আল্লাহ যাদের বিশেষ অনুগ্রহ বর্ষণ করেন, সেই ভাগ্যবান ব্যক্তিরা ছাড়া এ পরীক্ষায় কেউ উত্তীর্ণ হতে পারে না। বস্তুত মালিক সাহেব এই মুষ্টিমেয় ভাগ্যবানদের মধ্যেই গণ্য।

জামায়াতের প্রতিষ্ঠা সম্মেলনে যোগদান
১৯৪১ সালে যখন মাওলানা মওদূদী রহ. জামায়াত প্রতিষ্ঠার সংকল্প নেন, তখন যেসব সমমনা ব্যক্তিকে চিঠি লিখে লাহোরে ডেকে আনেন, তাদের মধ্যে মালিক সাহেবও ছিলেন। তিনি জলন্ধর থেকে এ সম্মেলনে যোগদান করেন। এই সম্মেলনেই জামায়াতে ইসলামী প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এদিক থেকে বিবেচনা করলে মালিক সাহেব জামায়াতের সেইসব সদস্যের অন্যতম, যাদেরকে জামায়াতে ইসলামীর'আস সাবেকুন আল আউয়ালুন' (সর্বপ্রথম দলভুক্ত) সদস্য উপাধিতে ভূষিত করা যায়।

দারুল ইসলামে অবস্থান
জামায়াত প্রতিষ্ঠার পর মাওলানা রহ. যখন পুনরায় পাঠানকোর্টস্থ দারুল ইসলামে গিয়ে বসবাস করা শুরু করলেন, তখন মালিক সাহেবকে জলন্ধর থেকে নিজের কাছে ডেকে আনেন এবং জামায়াতে ইসলামীর প্রকাশনীর দায়িত্ব তার হাতে সমর্পণ করেন। মালিক সাহেব'মাকতাবায়ে জামায়াতে ইসলামী'র পরিচালক ছিলেন বটে, তবে বইপুস্তকের প্যাকিং করা ও পোস্ট অফিসে পৌঁছানোর কাজ পর্যন্ত তিনি নিজেই করতেন। এক অনাবিল সম্মোহনে তিনি এ কাজ সমাধা করতে থাকেন। এতে তার না ছিলো গৌরবের প্রতি কোনো আগ্রহ, না ছিলো ধন সম্পদের কোনো মোহ আর না ছিলো নিজের দারিদ্র্য নিয়ে কোনো উদ্বেগ।

মালিক সাহব আজন্ম জ্ঞানপিপাসু। দারুল ইসলামে তিনি পেয়েও গেলেন জ্ঞানার্জনের পরিবেশ। এই পরিবেশ সম্পর্কে তিনি নিজের মনোভাব ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেছেন : "এই জায়গায় আমার মন বসে গেলো। এমন পরিবেশ আর কখনো পাইনি। সেখানে আমাদের নিজস্ব একটা বসত ছিলো। নিজস্ব পরিবেশ ছিলো। খুবই নিয়মিতভাবে কুরআন ও হাদিসের শিক্ষাদান করা হতো। মাওলানা আমিন আহসান ইসলাহী দারসে কুরআন এবং মাওলানা মওদূদী রহ. দারসে হাদিস দিতেন। মাওলানা রহ. সেখানে সমগ্র মিশকাত শরিফ পড়িয়েছেন।" "দারুল ইসলামের জীবন ছিলো অত্যন্ত সহজ সরল। সব কাজ আমরা নিজ হাতে করতাম। নিজেরাই পানি উঠাতাম। জ্বালানী কাঠ নিজেরাই কেটে আনতাম এবং রাতে নিজেরাই নিজেদের পাহারা দিতাম।"

এই সময় মালিক সাহেব আরবি ভাষায় নিজের দক্ষতা বৃদ্ধি করেন। বিশ্রাম ও বিনোদনের সময়টায় তিনি দারুল ইসলামের নিকটবর্তী আপারবারী নদীর কিনারে গিয়ে বসতেন এবং আরবি ব্যাকরণ ও রচনা রপ্ত করার সাধনায় নিয়োজিত হতেন। শুরুতে লাহোরে থাকাকালে তিনি ব্যক্তিগতভাবে আরবি ভাষা শেখার সূচনা করেছিলেন। দারুল ইসলামে অবস্থানকালে তাতে উন্নতি সাধন করেন। বর্তমানে মালিক সাহেব পাণ্ডিত্যের যে উঁচু মর্যাদায় আসীন, তা তার সেই নিয়মিত অধ্যবসায়ের বদৌলতেই অর্জিত হয়েছে, যাকে তিনি নিজের অভ্যাসে পরিণত করেছিলেন।

লাহোরে মাওলানা মওদূদীর ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর দারুল ইসলামের গোটা কাফেলা লাহোর চলে আসে। এখানে পৌঁছার পর মাওলানা রহ. আর তাকে প্রকাশনা বিভাগের দায়িত্বে রাখেননি। তার পরিবর্তে এই অসাধারণ প্রতিভাকে তিনি নিজের বিশেষ সহকারী নিযুক্ত করে অধিকতর মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেন। এভাবে মৌলিক গবেষণা ও গ্রন্থ প্রণয়নের দায়িত্ব দিয়ে তাকে সর্বাত্মক জ্ঞান চর্চার অঙ্গনে স্থানান্তরিত করেন। এরপর মালিক সাহেবের জন্য জ্ঞানের ভূবনে ক্রমোন্নতির দুয়ার খুলে যায়। এই দুয়ার খোলার কাজে মাওলানার সযত্ন তত্ত্বাবধান যেমন অবদাব রাখে, তেমনি স্বয়ং মালিক সাহেবের একনিষ্ঠতা, একাগ্রতা এবং দুনিয়ার মোহবর্জিত নিরাসক্ত জীবনও পদে পদে তাকে সহায়তা দেয়। উস্তাদের উদার দান এবং শাগরিদের একনিষ্ঠ সাধনা এ দুই উপাদান মিলিত হয়ে জ্ঞানের সুবিশাল রাজ্যে সন্ধানীর অবাধ পদচারণার পথ সুগম করে তোলে। মালিক সাহেব শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মাওলানার বিশেষ সহকারী হিসেবে কর্মরত থাকেন। "বস্তুত: এটা একমাত্র আল্লাহ প্রদত্ত পরম সৌভাগ্য, যে তিনি নিজের মনোনীত লোকদেরকেই দিয়ে থাকেন।" (আল কুরআন) এই তাত্ত্বিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি মালিক সাহেব একজন কর্মী হিসেবে আন্দোলনের অন্যান্য খিদমত যথারীতি চালিয়ে যান। উদাহরণস্বরূপ, বিভিন্ন মসজিদে জুমার খুৎবা দান, প্রশিক্ষণ শিবিরগুলোতে ভাষণ ও দারস দান ইত্যাদি।

মালিক সাহেবের সাথে আমার প্রত্যক্ষ পরিচয় ও যোগাযোগ ঘটে ১৯৫৫ সালে। আমি জামায়াতের আরবি বিভাগ 'দারুল আরুবাতে' যোগ দিই ১৯৫৫ সালের মার্চ মাসে। সে সময় মালিক সাহেবের পরিচালিত 'প্রশ্নোত্তর বিভাগ' সরাসরি মাওলানার রহ. সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলো। কাজের দিক দিয়েও এই দুই বিভাগের পারস্পরিক সাদৃশ্য ছিলো। একটির সম্পর্ক পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ এবং অপরটির সম্পর্ক পাকিস্তান বহির্ভূত জগতের সাথে ছিলো। এভাবে বহু বছর যাবত এ দুটো বিভাগ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলতে থাকে। কোনো মানুষকে জানা ও চেনার জন্য এতোটুকু ঘনিষ্ঠতা যথেষ্ট হয়ে থাকে। তাছাড়া আমি ও মালিক সাহেব কমপক্ষে চৌদ্দ বছর ইসরাতে প্রতিবেশি হিসেবে বসবাস করেছি। উভয়ের বাসগৃহের সাথে মামুলি একটা দেয়ালের ব্যবধান ছিলো। এই দীর্ঘ প্রতিবেশিত্বের বিবরণ এক কথায় দিতে গেলে বলতে পারি যে, "মালিক সাহেব একজন সহনশীল ও সহানুভূতিশীল প্রতিবেশি।"

মালিক সাহেবের পাণ্ডিত্য ও মনীষা
জ্ঞানগত দিক দিয়ে মালিক সাহেক একজন বর্ণাঢ্য ও বহুমুখী ব্যক্তিত্ব। যদিও তিনি কলেজের পড়াশুনা অসম্পূর্ণ রেখে দিয়েছিলেন, কিন্তু ইংরেজি ভাষায় তার অসাধারণ দখল রয়েছে। ইংরেজি সাহিত্যে তার পড়াশুনা অত্যন্ত ব্যাপক। এ কারণেই বিশ্বের চলমান পরিস্থিতি এবং আদর্শিক ও তাত্ত্বিক আন্দোলনগুলো সম্পর্কে তিনি পূর্ণমাত্রায় ওয়াকিবহাল। মরহুম মাওলানার ইংরেজি পত্রালাপে মালিক সাহেবের যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে মালিক সাহেবের দক্ষতার একটা উদাহরণ এই যে, অধ্যাপক আব্দুল হামিদ সিদ্দিকী ইংরেজি ভাষায় যেসব রচনা লিখে থাকেন, তা তিনি অনেক পীড়াপীড়ি করে মালিক সাহেবকে দিয়ে যাঁচাই বাছাই করিয়ে নেন। বিশেষত 'লাইফ অব মুহাম্মদ' সা. পবিত্র কুরআনের ইংরেজি অনুবাদ এবং সহীহ মুসলিমের ইংরেজি অনুবাদ মালিক সাহেবের নজর বুলানো গ্রন্থ। ইংরেজি থেকে উর্দুতে মালিক সাহেব যে অনুবাদ কর্মগুলো সম্পাদন করেছেন তাতেও তাঁর ভাষাগত দক্ষতা ও পরিপক্কতার প্রতিফলন ঘটে। আরবি ভাষায় তো মালিক সাহেবের দখল তার স্বকীয় চেষ্টারই ফসল। প্রাচীন ও আধুনিক উভয় ধরনের আরবি সাহিত্যে তিনি সুদক্ষ। হাদিস ও ফিকাহ শাস্ত্রের জটিলতম ও সূক্ষ্মতম বিষয়গুলোতে মালিক সাহেবের যে সুগভীর পাণ্ডিত্য, তা পাকিস্তানে অতি অল্প সংখ্যক লোকের মধ্যেই পাওয়া যায়। ফেকাহ শাস্ত্রে সাধারণ মাসয়ালা থেকে শুরু করে পারিবারিক বিধান ও পারস্পরিক লেনদেন সংক্রান্ত বিধি এবং রসূল সা.-এর জীবনেতিহাস ও সমরবৃত্তান্তের যে সব বিষয় মাদরাসাগুলোতেও কদাচিত পড়ানো হয়ে থাকে, সেসব বিষয় মালিক সাহেবের কণ্ঠস্থ। এই জ্ঞান মাওলানার রহ. সাথে দৈনন্দিন মাসয়ালাগুলো নিয়ে আলাপ আলোচনায় অংশগ্রহণের বদৌলতেই অর্জিত হয়েছে। সাধারণভাবে মালিক সাহেবের বেশ কয়েকটা লেখাই অত্যন্ত উঁচু জ্ঞানের গবেষণা ও যুক্তিবুদ্ধি সমৃদ্ধ। তবে তার জ্ঞানের গভীরতার সবচেয়ে বড় স্বাক্ষর হলো তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনা 'খেলাফত ও মুলকিয়াত পর ইতিরাযাত কা এলমী জায়েযা' (খেলাফত ও রাজতন্ত্র সংক্রান্ত প্রশ্নাবলীর তাত্বিক পর্যালোচনা) এ গ্রন্থটি পড়লে বুঝা যাবে তিনি একিদিকে যেমন ফেকাহ ও হাদিস বিশারদ, অপরদিকে তেমনি ইতিহাস ও ইসলামি রাষ্ট্র বিজ্ঞানের একজন অন্যতম বিশেষজ্ঞ।

আধুনিক আরবি সাহিত্যেও তিনি যথেষ্ট ব্যুৎপত্তি সম্পন্ন। এ যুগের বিশিষ্ট সিরিয় আলেম মরহুম ডক্টর মোস্তফা সাব্বায়ীর লেখা হাদিস বিষয়ক নিবন্ধ সমষ্টি, (যা উর্দুতে 'সুন্নাতে রসূল' নামে অনূদিত ও প্রকাশিত হয়েছে) এবং মিসরের ইখওয়ান নেতা শহীদ আব্দুল কাদের আওদীর প্রণীত গ্রন্থ 'আল ইসলাম ওয়া আওযাউনাল কানুনিয়াহ' এর উর্দু অনুবাদ 'ইসলাম কা নিযামে কানুন' (ইসলামের আইন ব্যবস্থা) মালিক সাহেবের আরবি ভাষায় পারদর্শীতার প্রকৃষ্টতম দৃষ্টান্ত।

উর্দুতেও আল্লাহ তায়ালা তাঁকে অত্যন্ত প্রাঞ্জল বাচনভঙ্গীর অধিকারী করেছেন। তাঁর বাচনভঙ্গীতে স্বয়ং মাওলানা মওদূদীর বাকরীতির প্রতিফলন ঘটতে দেখা যায়। মাওলানার রচনার দুটো বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। একটি হলো চমকপ্রদ বর্ণনাভঙ্গী আর অপরটি ক্ষুরধার যুক্তি।

মালিক সাহেবের লেখাতেও এ দুটো বৈশিষ্ট্য অনেকাংশে বিদ্যমান। প্রকৃত ব্যাপার এই যে, মালিক সাহেব মাওলানার সাহচার্য থেকে তাঁর গুণাবলী আয়ত্ত করার ব্যাপারে এতোটা কৃতিত্ব দেখিয়েছেন যে, কোনো কোনো লেখায় উভয়ের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করাই কঠিন হয়ে পড়ে। এ যেন ফুলের সাহচার্যে মাটির সুরভিত হয়ে যাওয়ার আরেক জ্বলন্ত উদাহরণ।

ব্যক্তিত্ব
মালিক সাহেবের ব্যক্তিগত গুণাবলী ও স্বভাব চরিত্রে অতীতের মহান মনীষীদের ছাপ লক্ষ্যণীয়। তাঁর ব্যক্তিত্ব আপাদমস্তক বিনয়ে মণ্ডিত। আত্ম প্রশংসার প্রবণতা নামমাত্রও নেই। মেজাজের দিক দিয়ে একেবারেই মাটির মানুষ। কথাবার্তায় কোমলতা, প্রয়োজন ছাড়া নীরবতা পালন, বৈঠককাদিতে মাপজোখ কথা বলে ক্ষান্ত থাকা, বেশভূষা ও চালচলনে একেবারেই সাদাসিধে, বিদ্যার অতলান্ত সাগর অথচ বিদ্যার গর্ব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত, জ্ঞানের অন্বেষায় সাহসী ও সংকোচহীন, আর মুখে সব সময় একই কথা যে, আমি একজন শিক্ষার্থী মাত্র।

মালিক সাহেব ১৯৮১ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিগত মনোনয়নক্রমে ফেডারেল ইসলামি আদালতের বিচারপতি নিযুক্ত হন। চার বছর এই পদে বহাল থাকেন। ১৯৮৫ সালে আদালত থেকে অব্যাহতি পান। বর্তমানে তিনি মানসূরায় ইসলামি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে আগের মতই গবেষণা কর্মে নিয়োজিত।

১৯২০ সালে মালিক সাহেবের জন্ম। আল্লাহ তাকে দীর্ঘজীবী করুন। সৎকর্মে নিয়োজিত রাখুন।

বক্ষমান গ্রন্থ রাসায়েল ও মাসায়েল ৬ষ্ঠ খণ্ড মালিক সাহেবের বিভিন্ন সময়ে লেখা প্রশ্নোত্তরের সমষ্টি। এর অধিকাংশ প্রশ্নোত্তর স্বয়ং মাওলানা মওদূদীর রহ. জীবদ্দশায় তিনি লিখেছিলেন। তার উপর মাওলানার এতোটা আস্থা জন্মে গিয়েছিল যে, একসময় তাঁর লেখা জবাবগুলো মাওলানা আর পড়ে দেখারও প্রয়োজন বোধ করতেন না। এ যাবত আমরা কেবল মাওলানা মওদূদীর রহ. রচনাবলীই পাঠকবর্গের সামনে হাজির করেছি। এবার তাঁর এক সুযোগ্য শিষ্যের রচনা পেশ করতে পেরে আমরা আনন্দিত।




খলিল হামেদী
ডাইরেক্টর
ইদারায়ে মা'আরেফে ইসলামি
মানুসূরা, লাহোর
১৫ নভেম্বর ১৯৮৬ ঈসায়ী




বিস্‌মিল্লাহির রাহমানির রাহিম


<h1>১। আল্লাহর অস্তিত্ব সম্পর্কে সংশয় নিরসন</h1>

প্রশ্ন: আমি একজন গুনাহ্‌গার মুসলমান। দীর্ঘকাল অনৈসলামিক জীবন যাপন করেছি। কিছুদিন যাবত আমি ইবাদত ও কুরআন পাঠের আগ্রহ অনুভব করছি। কিন্তু বড়ই পরিতাপের বিষয় যে, এর সাথে সাথেই আমার মনে নানা রকম সন্দেহ সংশয় জন্ম নিচ্ছে। আমি এগুলোকে চাপা দিতে চেষ্টা করছি। কিন্তু আশংকা হয় যে, এ সব সংশয় দূর করা না হলে এই বার্ধক্যে এসেও আবার আমার ইবাদত পরিত্যক্ত হয়ে যেতে পারে এবং পুনরায় আমি গোমরাহীতে লিপ্ত হয়ে বসতে পারি। যে সংশয়টি বারবার আমার মনে জাগে, তা আমি মুখে উচ্চারণ করতে চাইনে। কিন্তু সেটি শুধু এ জন্য আপনার কাছে পেশ করছি, যেন আপনি আমাকে বুঝিয়ে আশ্বস্ত করতে পারেন। যে প্রশ্নটি থেকে থেকে আমার মনে জাগে, তা এই যে, আল্লাহ তায়ালাকে কে সৃষ্টি করেছে? তিনি কিভাবে পয়দা হলেন? আল্লাহর দোহাই, আপনি আমার এই সংশয় দূর করে দিন, যাতে আমি এই দ্বিধাদ্বন্দ্ব থেকে নিষ্কৃতি পাই।

জবাব: আপনি যে প্রশ্ন ও সংশয়ের কথা স্বীয় চিঠিতে উল্লেখ করেছেন, এ ধরনের প্রশ্ন মানুষের মনে জাগা কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়।

আপনি যদি সামান্য একটু  চিন্তাভাবনা করেন, তাহলে বুঝতে পারবেন যে, এ ধরনের সন্দেহ শুধু আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাসীদের মনেই জন্মে না, যে কোনো নাস্তিক সংশয়বাদী ও খোদাদ্রোহীতার মনেও এ ধরনের প্রশ্নাবলী জন্ম নিয়ে থাকে। যে ব্যক্তি দৃশ্যমান বিশ্বজগতের উর্ধে বা বাইরে এর কোনো স্রষ্টার অস্তিত্ব মানে না, অথবা সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ সংশয় বা দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগে, তাকে কয়েকটা প্রশ্ন অত্যন্ত প্রবলভাবে নাড়া দেয় এবং জবাব দেবার দাবি জানায়। যেমন, এই সৃষ্টি জগতের প্রথম উদ্ভব কিভাবে হয়, এর আর্বিভাবের আসল কারণ বা উৎস কি, জীবন, শক্তি, পদার্থ ও বির্বতনের যে অসংখ্য প্রতীক বা বাহন আমাদেরকে চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে, সে সবের সূচনা কবে ও কিভাবে হয়েছিল এবং কে করেছিল? এ ধরনের প্রশ্ন কোনো না কোনোভাবে প্রত্যেক মানুষকেই বিব্রত করে থাকে-তা সে বিশ্বাসীই হোক, সংশয়বাদী হোক অথবা নাস্তিক হোক।

এরপর আরো একটু চিন্তাভাবনা করলে এ ব্যাপারেও সহজেই ধারণা লাভ করা যায় যে, বিশ্ব প্রকৃতির আবির্ভাব ও তার স্রষ্টা সংক্রান্ত এ ধরনের যাবতীয় প্রশ্নের কোনো সন্তোষজনক জবাব নিছক নিজস্ব বুদ্ধিবৃত্তি, প্রজ্ঞা, চেষ্টা সাধনা ও তত্ত্বানুসন্ধান দ্বারা লাভ করা প্রত্যেক মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। বিশ্ব স্রষ্টার সত্তা ও গুণাবলীর কল্পনা করাটা অবশ্য অনেক উর্ধের ব্যাপার। তথাপি আমরা যদি ক্ষণকালের জন্য মহাবিশ্বের বাইরেও তার চেয়ে উচ্চতর ও ক্ষমতাধর কোনো শক্তি বা সত্তা এর স্রষ্টা হিসেবে বিদ্যমান আছে কিনা সে প্রশ্ন এড়িয়ে যাই এবং শুধুমাত্র সৃষ্টিজগতের অস্তিত্ব মেনে নিয়েই ভাবতে শুরু করি, তাহলেও স্থান ও কালের সাথে সংশ্লিষ্ট অনেক বাস্তব ও কাল্পনিক বিষয় এমন রয়েছে, যা পুরোপুরিভাবে আমাদের বোধশক্তির নাগালে আসতে অক্ষম। এ সব জিনিসের ব্যাপকতা ও বিস্তৃতি এতো বেশি যে, তা আয়ত্বে আনা তো দূরের কথা, একটা নির্দিষ্ট সীমার বাইরে তার কল্পনা করতেও আমরা অপারগ। উদাহরণস্বরূপ, কালের আদি অন্ত সম্পর্কে আমরা কি ভাবতে পারি যে, তার সূচনা কিভাবে ও কখন হয়েছে এবং তা কোথায় গিয়ে কিভাবে সমাপ্ত হবে? সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্র,এবং অন্তরীক্ষের অন্যান্য বস্তু যে মহাশূন্যে ভেসে বেড়াচ্ছে, সে মহাশূন্যের সীমা সরহদ কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছে, এই মহাশূন্যের সীমার ওপারে কোন্‌ জগত বিরাজ করছে, কল্পনার চোখ দিয়ে উঁকিঝুঁকি মেরেও কি তা দেখার সাধ্য কারো আছে? এ ধরনের দু'একটা উদাহরণ দ্বারাই এ কথা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, আমাদের চিন্তাশক্তি ও বোধশক্তির ক্ষমতা খুবই সীমিত। আমাদের চিন্তাশক্তি ও বোধশক্তির স্বাভাবিক পরিধিই এতো সংকীর্ণ ও সংকুচিত যে, একটা নির্দিষ্ট স্তর পেরিয়ে কোনো কিছু কল্পনা করাও তার পক্ষে সম্পূর্ণ অসম্ভব। মানবীয় বিবেক বুদ্ধি ও চিন্তাশক্তি যখন এতোই অক্ষম ও সীমাবদ্ধ যে, সে সৃষ্টির রহস্যও পুরোপুরিভাবে বুঝতে পারেনা। তখন সে স্রষ্টার আদি অন্ত কিভাবে উপলব্ধি করতে পারবে?

বিশ্বস্রষ্টা সংক্রান্ত সংশয় যদি নিছুক ব্যাকুলতার কারণে সৃষ্টি হয়ে থাকে যা অনিচ্ছা বশতই অন্তরে অনুপ্রবেশ করে থাকে, তবে তা থেকে কোনো ঈমানদার মুক্ত থাকতে পারে না। বরঞ্চ রসূল সা. একে ঈমানের সুস্পষ্ট আলামত বলে আখ্যায়িত করেছেন। চোর দস্যু সেই গৃহেই হানা দেয়, যেখানে ধনসম্পদ বিদ্যমান। কাজেই ঈমানের সম্পদে সমৃদ্ধ যে হৃদয়, তাকে এ ধরনের আক্রমনের শিকার হতেই হবে। তাই এ ধরণের চিন্তাভাবনা যদি অন্তরে শুধু আসা যাওয়া করে তবে সেটা তেমন উদ্বেগজনক ব্যাপার নয়। ব্যাপারটা উদ্বেগজনক ও শাস্তিযোগ্য হবে তখনই, যখন মুমিন এসব কুপ্ররোচনাকে গুরুত্ব দেবে এবং একে অন্তরে প্রশ্রয় দিয়ে বদ্ধমূল করে লালন করবে ও ফলবান হবার সুযোগ দেবে। অথবা সচেতনভাবে এ প্রশ্নগুলোকে সমাধানযোগ্য মনে করে এর জবাব লাভের ব্যর্থ চেষ্টায় নিয়োজিত হবে এবং তার চর্চা ও প্রচারে আত্মনিয়োগ করবে। শেষোক্ত কর্মপন্থা একজন মুসলমানের পক্ষে মোটেই সঙ্গত নয়। ইসলাম আমাদেরকে আল্লাহর সত্তা ও গুণাবলী সম্পর্কে যে ধারণা দিয়েছে, সেটা মনে বদ্ধমূল রাখলে আমরা এ কর্মপন্থা কখনো অবলম্বন করতে পারিনা। কুরআন ও হাদিসে আল্লাহর যে গুণাবলী বর্ণিত হয়েছে, তা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করলে বুঝা যায় যে, আল্লাহর গুণাবলীকে অনুরূপ মানবীয় গুণাবলীর সাথে তুলনা করা সম্ভব নয়। উভয়ের মাঝে প্রকৃতপক্ষে কোনো সাদৃশ্যও নেই। এ জন্যই কুরআনে বলা হয়েছে যে, ----------------------- 'তাঁর সমতুল্য কিছুই নেই।' মানবীয় গুণাবলী সীমাবদ্ধ এবং বহিরাগত ও বস্তুগত সহায়ের মুখাপেক্ষী। আবার নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে তা বাধাবন্ধনহীন ও বহিরাগত সহায়ের ধার ধারেনা। দৃষ্টিশক্তি আমাদেরও আছে। তবে তা একটা নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ। তাছাড়া আমাদের দৃষ্টিশক্তির এসব সীমা ও বাধার ঊর্ধে। আমরাও শ্রবণ করি। কিন্তু আমাদের শ্রবণের জন্য কান ও বাতাসের সহায়তা প্রয়োজন। অথচ আল্লাহর শ্রবণের জন্য এসব মাধ্যমের কোনো প্রয়োজন নেই। জীবন ও অস্তিত্ব আমাদেরও আছে, তবে তা বহিরাগত সহায়ক শক্তি ও বস্তুর উপর নির্ভরশীল। কিন্তু আল্লাহর জীবন ও অস্তিত্ব সম্পূর্ণ স্বনির্ভর। তিনি এমন চিরঞ্জীব ও চিরস্থায়ী সত্তা, যিনি আপন শক্তিতেই বহাল আছেন এবং সব কিছুতেই বহাল রেখেছেন। এভাবে চিন্তা গবেষণা চালালে দিবালোকের মতো পরিষ্কার হয়ে উঠবে যে, আল্লাহর অস্তিত্ব সঠিক ও প্রকৃত অর্থেই অনাদি ও অনন্ত। চিরস্থায়ী জীবন ও নিরবিচ্ছিন্ন অস্তিত্ব তাঁর অমর, অক্ষয় ও অবিনশ্বর সত্তার মৌলিক বৈশিষ্ট্য। তাঁর জন্ম ও আবির্ভাবের প্রশ্ন তোলা দুটো পরস্পর বিরোধী জিনিসের একত্র সমাবেশ ঘটানোর চেষ্টা ছাড়া আর কিছু নয়। যিনি নিজের অস্তিত্ব লাভের জন্য আরেক স্রষ্টার মুখাপেক্ষী হন, তিনি আবার কেমন স্রষ্টা?

এই দিব্য সত্যকে আল্লাহ তায়ালা এভাবে ব্যক্ত করেছেন :
--------------------------------------------------------
কুরআনের এ উক্তির অত্যন্ত চমকপ্রদ ও মনোজ্ঞ ব্যাখ্যা রসূল সা. এভাবে করেছেন :
------------------------------------------------------------------------
"তিনি প্রথম। তাঁর পূর্বে কিছু নেই, তিনি শেষ তাঁর পরে কিছু নেই। তিনিই প্রকাশ্য। তাঁর ঊর্ধ্বে কিছু নেই। তিনিই গোপন, তাঁর কাছে গোপনীয় কিছু নেই।"

সর্বশেষে, অন্তরে অনুপ্রবেশকারী কু-প্ররোচনা সম্পর্কে রসূল সা.-এর কয়েকটি হাদিস উদ্ধৃত করেছি। আল্লাহ চাহে তো এতে আপনার সকল দুশ্চিন্তা ও সংশয়য়ের অবসান ঘটবে :
---------------------------------------------------------------------------
"আবু হুরায়রা রা, থেকে বর্ণিত যে রসূল সা. বলেছেন : আল্লাহ আমার উম্মতের মনের যাবতীয় কুচিন্তা ও সন্দেহ সংশয়কে মাফ করে দিয়েছেন, যদি না সে তা কার্যে পরিণত করে কিংবা কারো সাথে আলোচনা করে।"
--------------------------------------------------------------------------
"ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত : এক ব্যক্তি রসূর সা.- এর কাছে উপস্থিত হয়ে বলতে লাগলো আমার মনে মাঝে মাঝে এমন সব কুচিন্তা আসে, যা মুখে প্রকাশ করার চেয়ে আমি পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া অধিকতর পছন্দ করি। রসূর সা. বললেন : আল্লাহর শোকর যে, তিনি এ ব্যাপারটিকে কেবল কুচিন্তার পর্যায়েই সীমাবদ্ধ রেখেছেন।"
-------------------------------------------------------------------------
"আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত যে, রসূল সা. বলেছেন : মানুষ নানা রকমের প্রশ্নোত্তর করতে থাকবে। এমনকি এক সময় এ প্রশ্নও তোলা হবে যে, আল্লাহ তো এই গোটা জগতের সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহকে কে সৃষ্টি করেছে? যে ব্যক্তির সামনে এ জাতীয় কথাবার্তা উচ্চারিত হবে সে যেনো বলে আমি শুধু এটুকুই যথেষ্ট মনে করি যে আল্লাহ ও তাঁর রসূলদের উপর ঈমান এনেছি।"

আর একবার রসূল সা. বলেন : এ ধরণের কুচিন্তার উদ্ভবকালে আল্লাহর আশ্রয় চাইবে এবং ওখানেই থেমে থাকবে। যে ব্যক্তি এখানে থামবেনা এবং কল্পনার লাগাম টেনে ধরবেনা, তার গোমরাহীর সীমাহীন প্রান্তরে উদভ্রান্তের মতো ছুটে বেড়ানো ছাড়া আর কোনো লাভ হবেনা। [তরজমানুল কুরআন, এপ্রিল ১৯৫৪]

২. প্রশ্ন : আমি বিজ্ঞানের ছাত্র। এখন আমি জীবনের এমন একটা সময় অতিক্রম করছি, যখন মানসপটে যে ছবিই অংকিত হয়, তা হয় আনন্দ ও তৃপ্তির উৎস, নয় মানসিক যন্ত্রণার কারণ হয়ে চিরস্থায়ী হয়ে যায়। এক সময় ধর্মের প্রতি খুবই অনুরাগী ছিলাম। কিন্তু এখন আমার মনে বিশ্বাসের পরিবর্তে নানা রকমের সন্দেহ সংশয় জন্ম নিতে শুরু করেছে। আমি নামাজও পড়ি। তবে তা নিতান্তই প্রথাসিদ্ধ কাজ হিসেবে। আমার মনে যেসব ধ্যান ধারণার উদ্ভব হয়, তা আপনার কাছে তুলে ধরছি।

আল্লাহর অস্তিত্বকে বিজ্ঞানের সূত্রগুলোর আলোকে কিভাবে প্রমাণ করা যায়? এমনটি হওয়া কি সম্ভব নয় যে, আদিম যুগের মানুষ এ ধারণাটা উদ্ভাবন করে নিয়েছিল এবং তার পর এটা পুরুষানুক্রমে আমাদের পর্যন্ত হস্তান্তরিত হয়েছে? সে সময় মানুষ প্রকৃতির নিয়ম ও বিশ্বজগতের বস্তু নিচয়ের রহস্য জানতো না। কিন্তু আজ সে বিশ্বচরাচরের যাবতীয় রহস্য জেনে ফেলেছে এবং স্রষ্টার বিশ্বাসের প্রয়োজন কি, তা অনেকের বুঝে আসেনা। আল্লাহর অস্তিত্ব মেনে নিলেও কিছু কিছু তত্ত্ব বুদ্ধির অগম্য মনে হয়। রসূল সা.-এর মিরাজ শারীরিকভাবে হয়েছিল এ কথাই এ যাবত শুনে এসেছি। কিন্তু প্রাকৃতিক জগতে মাধ্যাকর্ষণ ও মহাশূন্য সংক্রান্ত অন্য যেসব নিয়ম চালু রয়েছে, তার প্রেক্ষাপটে এ ঘটনা বুঝে আসেনা। অন্যান্য মোযেজা বা অলৌকিক ঘটনার ক্ষেত্রেও একই জটিলতা দেখা দেয় যে, প্রাকৃতিক নিয়ম লংঘন না করে ঐ ঘটনাগুলো ঘটতে পারেনা। অথচ আল্লাহ তাঁর নিয়ম-কানুনে পরিবর্তন ঘটান না। চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হলে কি পৃথিবী ধ্বংস না হয়ে পারে?

জবাব : আপনার মনে যে প্রশ্নগুলোর উদ্ভব হচ্ছে, তা কোনো তাজ্জবের ব্যাপার নয়। যে কোনো চিন্তশীল মানুষের মনে এ ধরণের প্রশ্ন জাগতে পারে। এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চেষ্টা করা কোনো মানুষেরই উচিৎ নয়, যাতে তার লাগামহীন প্রবৃত্তির বাসনা চরিতার্থ হয় এবং যা তাকে জড় পদার্থ, গাছপালা কিংবা পশুপাখির মতো নৈতিক চেতনাহীন ও দায়িত্বজ্ঞানহীন বানিয়ে দেয়। এ ধরণের উত্তর অনুসন্ধান থেকে নিবৃত্ত থাকাতেই তার কল্যাণ ও মুক্তি নিহিত। পৃথিবীতে যারা আল্লাহর অস্তিত্ব অস্বীকার করেছে তাদের অধিকাংশেরই অস্বীকৃতির একমাত্র কারণ এই যে, আল্লাহকে মেনে নিলে তাদেরকে কতিপয় বিধিনিষেধের অধীন জীবনযাপন করতে হয়। তা না হলে আপনি ভেবে দেখুন তো, একজন বিজ্ঞানীর কাছে আল্লাহকে অস্বীকার করার পক্ষে কি যুক্তি প্রমাণ থাকতে পারে? বিজ্ঞান তো শুধু পার্থিব জগত নিয়েই আলোচনা গবেষণা করে, যা বস্তু ও শক্তি নিয়েই গঠিত অথচ এই বিজ্ঞানই স্বীকার করে যে, এই বস্তু জগৎ অনাদিকাল থেকে বিদ্যমান নয়, আপনা আপনিও গঠিত হয়নি এবং তা অনন্তকাল স্থায়ী হতেও সক্ষম নয়, তেমনি কিভাবে নির্জীব পদার্থের জীবনের আবির্ভাব ঘটে এবং কিভাবেই বা তা বিলুপ্ত হয়, সে কথাও বলতে পারে না। মহাবিশ্বের এমন কোনো সীমাপরিসীমা নেই এবং তার সীমানার এমন কোনো প্রথম প্রান্ত ও শেষ প্রান্ত নেই, যা মানুষের নাগালে আসতে পারে। এমতাবস্থায় মহাবিশ্বের এমন একজন সৃষ্টিকর্তা ও নির্মাতার অস্তিত্ব মেনে নেয়া ছাড়া গতান্তর নেই যিনি গোটা বিশ্বের চেয়েও বিরাট ও বিশাল এবং যার অবস্থান বিশ্বজগতের ঊর্ধে ও নেপথ্যে। এছাড়া রহস্যের উন্মেচন আর কোনোভাবেই সম্ভব নয়। অন্তত: এটুকু যুক্তির আওতায় এবং এই ব্যাখ্যার আলোকে আল্লাহর অস্তিত্বকে প্রত্যেক উল্লেখযোগ্য বিজ্ঞানীই স্বীকার করে থাকেন এবং কোনো বিজ্ঞানীই আল্লাহর অস্তিত্বকে অস্বীকার করার ধৃষ্টতা দেখাতে পারেন না।

১. কয়েক বছর আগে আমেরিকায় দুনিয়ার সর্বাপেক্ষা নামকরা চল্লিশজন বিজ্ঞানীর নিবন্ধন সম্বলিত একখানা বই প্রকাশিত হয়েছে। এই বিজ্ঞানীদের প্রত্যেকেই আল্লাহর অস্তিত্ব স্বীকার করেছেন এবং তার স্বপক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করেছেন্ 'খুদা মওজুদ হায়' এই শিরোনামে লাহোরের প্রাংকলিন প্রকাশনী উর্দুতে এবং 'চল্লিশজন সেরা বিজ্ঞানীর দৃষ্টিতে আল্লাহর অস্তিত্ব' এই শিরোনামে ঢাকায় একটি প্রকাশনী বাংলায় পুস্তকটি প্রকাশ করে। এরপর যে প্রশ্ন বাকি থাকে তা হলে, আল্লাহ যদি থেকে থাকেন তবে তিনি কেমন সত্তা ও গুণাবলীর অধিকারি? তাঁর ইচ্ছে ও মর্জি কি এবং মানুষের কাছে তিনি কি চান? এসব প্রশ্নের জবাব কেউ নিজস্ব বুদ্ধি ও যুক্তির উপর নির্ভর করে দিতে পারেন না-তা তিনি বিজ্ঞানীই হোন বা অবিজ্ঞানীই হোন। এর জবাব যে অকাট্য সত্য, সে ব্যাপারে তাঁর নির্মল ও নিষ্কলুষ চরিত্রই সাক্ষী।

২. ধর্ম ও আল্লাহ সংক্রান্ত বিশ্বাস নিছক মানবীয় মস্তিষ্কের আবিষ্কার এ কথা যদিও সঠিক নয়, তবু প্রশ্ন এই যে, একটি ধারণা বিশ্বাস মানবীয় মনমস্তিষ্ক থেকে উদ্ভুত বলেই কি বাস্তবে তার অস্তিত্ব থাকতে পারেনা? মানুষের মস্তিষ্কজাত হওয়াই কি অবাস্তব প্রমাণিত হওয়ার জন্য যথেষ্ট হতে পারে? এমন কি হতে পারেনা যে, আল্লাহর অস্তিত্ব আসলেই একটা জ্বলন্ত সত্য এবং মানুষের মনে তারই প্রতিবিম্ব রেখাপাত করে? মানুষের মনমস্তিষ্ক যে আবহমানকাল ধরে আল্লাহর অস্তিত্বের ধারণা পোষণ করে আসছে, এর দ্বারা কিভাবে প্রমাণিত হয় যে আল্লাহ নেই? এটা তো বরং আল্লাহর অস্তিত্বেরই একটি প্রমাণ।

এই যু্ক্তিটাও সম্পর্ণ ভ্রান্ত যে, প্রকৃতির নিয়ম আগেকার যুগের মানুষের জানা ছিলনা বলেই তারা আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাস স্থাপন করেছিল। প্রশ্ন এই যে, প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক রীতি সংক্রান্ত যাবতীয় গুপ্ত রহস্য ও বিস্তৃত তত্ত্ব তথ্য কি মানুষ ইতিমধ্যে জেনে ফেলেছে, কিংবা কখনো তা জানতে পারবে? আপনি কি আমাকে এ প্রশ্নের জবাব দিতে পারেন যে, অসংখ্য জ্যোতিষ্কপিন্ডে ভরপুর এই মহাবিশ্বের শেষ কোথায় এবং সেই শেষ প্রান্তের ওপারে কি আছে? ধরে নিলাম, সমস্ত প্রাকৃতিক নিয়ম আপনি রপ্ত করে ফেলেছেন। তথাপি আপনি কি আমাকে বলতে পারবেন এই রহস্যঘেরা নীরব নিঝুম প্রকৃতির এসব নিয়ম রীতি কার তৈরি এবং প্রকৃতির এই সব উপাদানকে ঐ নিয়ম রীতি মেনে চলতে কে বাধ্য ও বশীভূত করে রেখেছে?

৩. মিরাজ শারীরিক না আত্মিকভাবে হয়েছিল, তা নিয়ে যদিও পূর্বতন মুসলিম মনীষীদের মধ্যে কিছু মতভেদ হয়েছে, তবে আমাদের মতে, সঠিক তথ্য এই যে, এটা একসাথে শরীরিক ও আত্মিক উভয়ভাবেই সংঘটিত হয়েছিল। মিরাজ, চন্দ্র দ্বিখণ্ডিত এবং এ ধরনের অন্যান্য অলৌকিক ঘটনাবলী সম্পর্কে যাবতীয় প্রশ্ন কেবল তখনই জন্মে যখন মানুষ তার ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক দিয়ে প্রতিটি বিষয় পর্যবেক্ষণ ও তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করে। সে মনে করে, এই বিশ্বপ্রকৃতি যেমন কতিপয় আইন কানুনের অধীন, তেমনি এ বিশ্বজগতের সৃষ্টিকর্তাও এসব আইন কানুনের অনুগত ভৃত্য এবং নিজের তৈরি নিয়মবিধির শৃংখলে তিনি নিজেও বাঁধা। অথচ এ ধারণাটা মূলতই ভুল ও বাতিল। আল্লাহ যখন ইচ্ছে নিজের আইন-কানুন ও নিয়ম রীতিতে রদবদল ঘটাতে পারেন এবং সেই রদবদলও তাঁর আইন অনুসারেই হবে। উদাহরণস্বরূপ, প্রচলিত নিয়ম এই যে, আল্লাহ নর ও নারীর মিলনক্রমে মানুষ সৃষ্টি করে থাকেন। কিন্তু নর ও নারীর এই মিলন মানব সৃষ্টির কোনো চিরন্তন ও অলংঘনীয় বিধান হতে পারেনা। আল্লাহ ইচ্ছে করলে এ ছাড়াও মানুষ সৃষ্টি করে সক্ষম।

অনুরূপভাবে আল্লাহ ইচ্ছে করলে মধ্যাকর্ষণের বিধানকে নিষ্ক্রীয় করে দিতে পারেন এবং স্বীয় বান্দাকে এমন জায়গায় নিয়ে যেতে পারেন, যেখানে তাঁর জ্যোতি বিচ্ছুরিত ও কেন্দ্রিভূত। আল্লাহ ইচ্ছে করলে কিছুক্ষণের জন্য চাঁদকে দু'টুকরো করে দিতে এবং পৃথিবী ও অন্যান্য জ্যোতিষ্ক পিণ্ডকে তার প্রভাব থেকে মুক্ত রাখতে পারেন। একথা নি:সন্দেহে সত্য যে, আল্লাহর বিধান অটল ও তাঁর সিদ্ধান্ত অকাট্য। তিনি এগুলোর রদবদল করেন না। কিন্তু আল্লাহর বিধান কি এবং তাঁর সিদ্ধান্তগুলোই বা কি, সেটা আমরা কেমন করে জানবো। আল্লাহ যে জিনিসকে নিজের বিধান বলে মনে করেন, তা অবশ্যই অপরিবর্তনীয়। কিন্তু যে জিনিসকে আমরা আল্লাহর বিধান বলে মনে করি, তাতে সব সময়ই পরিবর্তন ঘটা সম্ভব। যেমন এক ব্যক্তি মনে করে যে, সূর্য সব সময় পূর্ব দিক থেকে উঠবে বা উঠতে দেখা যাবে এটাই আল্লাহর বিধান। কিন্তু আল্লাহর বিধান এমনও হতে পারে যে, এক দিন তার গতিবিধি পাল্টে দেয়া হবে কিংবা তার অস্তিত্বই বিলুপ্ত করা হবে। এ কথাও মনে রাখা দরকার যে, কুরআনে 'মুন্সায়াতুল্লাহ' বা 'আল্লাহর বিধান' কথাটি দ্বারা সর্বোতভাবে প্রাকৃতিক নিয়ম রীতিকে বুঝানো হয়নি, বরং নৈতিক ও চারিত্রিক বিধানকে বুঝানো হয়েছে, যা পৃথিবীর জাতিসমূহের ও মানব সভ্যতার উত্থান পতন অথবা বিবর্তন প্রক্রিয়া সংক্রান্ত। আর এটাও এমন কোনো ধরাবাধা একক বিধান নয়, বরং অত্যন্ত ব্যাপক ও বিজ্ঞানসম্মত এক নীতিমালা, যা মানব জীবনের বিভিন্ন দিক ও বিভাগে চালু ও কার্যকর রয়েছে। [তরজামানুল কু্রআন, ডিসেম্বর ১৯৭৪]


<h1>২। আল্লাহ ও তাঁর রসুলগণের মধ্যে পার্থক্য করা</h1>
প্রশ্ন : ১৯৫৫ সালের এপ্রিল সংখ্যা তরজমানুল কুরআনে প্রকাশিত মাওলানা আমীন আহসান ইসলহীর প্রবন্ধের একটি অংশ মে ১৯৫৫ সংখ্যা মাসিক তুলুয়ে ইসলাম পত্রিকায় উদ্ধৃত হয়েছে। উদ্ধৃত অংশটি নিম্নে প্রদত্ত হলো : "আল্লাহ ও তাঁর রসূলের মধ্যে যেমন পার্থক্য ও ভেদাভেদ করা চলেনা, তেমনি কুরআন ও সুন্নাহর মধ্যেও ভেদাভেদ করার অবকাশ নেই।"

অতপর উক্ত বক্তব্য সম্পর্কে মাওলানা ইসলাহী সাহেবকে সম্বোধন করে 'তুলুয়ে ইসলাম' লিখেছেন : "এক রসূলের সাথে অন্যান্য রসূলের ভেদাভেদ করা যাবে না- এ কথা তো কুরআনে আছে। কিন্তু এ কথা কোথাও বলা হয়নি যে, আল্লাহ তাঁর রসূলের মধ্যে পার্থক্য করা চলবেনা। ....দাস ও মনিবের মধ্যে পার্থক্য না করা সুস্পষ্ট শিরক। আপনার এ বক্তব্যের পেছনে কোনো প্রমাণ থেকে থাকলে জানাবেন কি?"

এ কথা ঠিক যে, মাওলানার উক্তির পূর্বাপর বিবেচনা করলে স্পষ্টতই বুঝা যায় যে, আল্লাহ ও তাঁর রসূলের মধ্যে বৈষম্য না করার এই নির্দেশ কেবল হুকুমদাতা ও আইন প্রণেতা হিসেবে উভয়ের অস্তিত্ব মর্যাদার ভিত্তিতেই দেয়া হয়েছে। তথাপি তরজমানুল কুরআনের বিষয়টি আরেকটু বুঝিয়ে দিলে ভালো হয়।

জবাব : সোজা কথায় যে ব্যক্তি বক্রতা খোঁজে এবং বক্রতা খুঁজে বের করার চেষ্টায় লেগে থাকে, পৃথিবীতে তার রোগের কোনো চিকিৎসা নেই। স্বয়ং কুরআনে সাক্ষী রয়েছে যে, বিকৃত স্বভাবের লোকেরা আল্লাহর কিতাবের আয়াতগুলোতেও বক্রতার সন্ধান করা ও অবান্তর তর্ক জুড়ে দেয়া থেকে কখনো বিরত থাকতে পারেনি। এ ধরণের লোকেরা কোনো মানুষের কথাবার্তায় সামান্যতম ভাষাগত জটিলতা থাকলে তা থেকে কুফরি এবং শিরক উদঘাটন করবে, তাতে আর অসুবিধা কোথায়? যা হোক, এসব লোকের জবাব দেয়ার জন্য নয়, বরং আপনার পরিতৃপ্তির জন্য একটু অতিরিক্ত ব্যাখ্যা দিচ্ছি।

'আল্লাহ ও রাসূলের মধ্যে প্রভেদ করা।' এক রসূলের সাথে আর এক রসূলের প্রভেদ করা কুরআনের একটা বিশেষ পরিভাষা। কুরআন নিজেই এর ব্যাখ্যা দিয়েছে। কোনো ব্যক্তি যদি আল্লাহ ভীতি সহকারে ও বুঝে শুনে সমগ্র কুরআন জীবনে একবারও পড়ে, তবে সে এই পরিভাষার সঠিক ও কুরআন সমর্থিত তাৎপর্য হৃদয়ঙ্গম না করে পারেনা। আল্লাহ ও তাঁর রসূলের মধ্যে পার্থক্য বা বৈষম্য করার অর্থ হলো, আল্লাহর উপর ঈমান আনা, তাঁর আনুগত্য করা ও তাঁর হুকুমকে ইসলামের উৎস ও অকাট্য দলীল হিসেবে স্বীকার করার দাবি করা হবে। কিন্তু রসূলের উপর ঈমান আনা হবেনা। তাঁর আনুগত্য ও অনুকরণ অনুসরণের অঙ্গীকার করা হবেনা, এবং তাঁর নির্দেশকে ইসলামের উৎস ও অকাট্য মৌল দলীল হিসেবেও মানা হবেনা। উভয়ের মধ্যে পার্থক্য করা বলতে উভয়ের সত্তায় যে বিভিন্নতা রয়েছে তা বুঝানো হয়নি। আল্লাহ ও তাঁর রসূলের মধ্যে প্রভেদ করা যাবেনা বলে কুরআনে যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তার তাৎপর্য এই যে, উভয়ের উপর ঈমান আনতে হবে, উভয়ের আনুগত্য করতে হবে এবং উভয়ের নির্দেশাবলীকে ইসলামের উৎস ও চূড়ান্ত দলীল বলে মানতে হবে। ঐ নির্দেশ দ্বারা একথা বুঝানো হয়নি যে, উভয়ের সত্তাকে অভিন্ন সত্তা মনে করতে হবে এবং আল্লাহ ও তাঁর বান্দার মধ্যে প্রভেদ করা চলবেনা। বস্তুত: এই প্রভেদ করা বা না করা আল্লাহ ও রসূলের সত্তার স্বাতন্ত্র্যের দিক দিয়ে নয়, বরং উভয়ের উপর ঈমান আনা ও উভয়ের আনুগত্যের দিক দিয়ে।

অনুরূপভাবে রসূলদের মধ্যে ভেদাভেদ করার অর্থ হলো নবী ও রসূলগণের মধ্যে কোনো একজন বা কয়েকজনের উপর ঈমান আনার দাবি করা এবং অন্য কোনো রসূল বা রসূলদের উপর ঈমান না আনা। রসূলদের মধ্যে যে ভেদাভেদ ও বৈষম্য করার সমালোচনা করা হয়েছে, তাঁদের ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য ও মর্যাদার তারতম্যকে স্বীকার করা তার আওতায় আসেনা। এধরনের পার্থক্যকে কে অস্বীকার করতে পারে? আল্লাহ তায়ালা নিজেই বলেছেন যে, আমি তাঁদের কাউকে অন্যদের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি। এই শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদাগত তারতম্যটাও মূল রিসালাতের পদের দিক দিয়ে নয়, বরং ব্যক্তিগত গুণ বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়ে নির্ণিত হয়েছে। বস্তুত: এ বিষয়টার ব্যাখ্যা সাথে সাথেই দেয়া হয়েছে। পক্ষান্তরে রসূলদের মধ্যে ভেদাভেদ ও বৈষম্য না করার যে আদেশ দেয়া হয়েছে তার অর্থ এই যে, সকল নবী ও রসূলের উপর ঈমান আনতে হবে। তবে এর দ্বারা ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যকে অস্বীকার করতে হবে এটা কখনো বুঝানো হয়নি।

কুরআন আল্লাহ ও রসূলের মধ্যে ভেদাভেদ এবং রসূলদের মধ্যে ভেদাভেদ না করাকে ঈমানের আলামত ও ভেদাভেদ করাকে কুফরির আলামত বলা হয়েছে। আপনি মাসিক তুলুয়ে ইসলামের এ কথাটিকে এক পাশে রাখুন যে, "কুরআনে এক রসূলের সাথে অন্য রসূলের পার্থক্য করতে তো নিষেধ করা হয়েছে কিন্তু আল্লাহ ও রসূলের মধ্যে পার্থক্য করতে নিষেধ করা হয়নি।" অত:পর নিম্নের আয়াত কয়টি পড়ুন :
---------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
"নিশ্চয় যারা আল্লাহ তাঁর রসূলদের প্রতি কুফরিতে লিপ্ত হয়, আল্লাহ ও তাঁর রসূলদের মধ্যে ভেদাভেদ করতে চায়, কাউকে মানি ও কাউকে মানিনা বলে ঘোষণা করে এবং একটা মধ্যবর্তী পথ অবলম্বন করতে চায়, তারাই আসল কাফির। আমি কাফিরদের জন্য লাঞ্ছনাকর শাস্তি নির্ধারণ করে রেখেছি। আর যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলদের প্রতি ঈমান এনেছে এঁদের কারো মধ্যে ভেদাভেদ করেনি। তাদেরকে আল্লাহ অচিরেই পুরস্কৃত করবেন। আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়ালু।" (সূরা আন নিস, আয়াত : ১৫০-১৫২)

এবার আয়াত ক'টিতে যে বক্তব্য বিধৃত হয়েছে, তা কি মাওলানা ইসলাহীর উদ্ধৃত বক্তব্যকে সুস্পষ্টভাবে সমর্থন করছে না এবং তুলুয়ে ইসলামের উল্লিখিত আপত্তিতে সর্বোতভাবে খণ্ডন করছে না? তুলুয়ে ইসলামের আশ্রয়পুষ্ট হাদিস বিরোধী মহলটির হাদিসের উপর হস্তক্ষেপ করতে করতে এতোই কি ঔদ্ধত্য বেড়ে গেছে এবং এতোটাই কি হাত পেকে গেছে যে, এখন তারা কুরআনের উপরও হাত সাফাই করা শুরু করে দিয়েছে। কুরআনের এ আয়াতগুলোর আয়নায় তুলুয়ে ইসলামের নিজের চেহারা বা তদ্‌সদ্‌শ চেহারা ভেসে ওঠে বলেই কি তারা এ আয়াতগুলোকে উপেক্ষা করতে উদ্যত। (তরজমানুল কুরআন, মে ১৯৫৫)


<h1>৩। জীবজন্তুর উপর দয়া</h1>
প্রশ্ন : আমি পশু চিকিৎসা বিভাগের একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী এবং 'জীবজন্তুর প্রতি নিষ্ঠুরতা প্রতিরোধ' কার্যক্রমে নিবেদিত। ইসলামের সেই সব নির্দেশ ও হেদায়াত আমার প্রয়োজন, যা থেকে বুঝা যায় যে, জীব জানোয়ারের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন ও তাদের অধিকার সংরক্ষণ করা মানুষের কর্তব্য। কুরআনে এ বিষয়ে আভাস ইঙ্গিত তো রয়েছে। যেমন জীব জানোয়ারের কান ছিদ্র করাকে শয়তানি কুকর্ম বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তবে আমি আরো কিছু বিস্তারিত নির্দেশাবলী চাই। সম্ভবত হাদিসেও এ ধরনের নির্দেশ থাকতে পারে। তাই আমাকে সেই হাদিসগুলো জানাবেন। লন্ডনে এ উদ্দেশ্যে একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। আমার ইচ্ছে যে, আমি অন্তত সেখানে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে একটি নিবদ্ধ পেশ করি।

জবাব : জীবজন্তুর ব্যাপারে আপনার আগ্রহ ও সহানুভূতি ইসলামি শিক্ষার সাথে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে আপনি একটি নিবন্ধের মাধ্যমে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরার যে চেষ্টা চালাচ্ছেন, তাও অত্যন্ত মহৎ ও অভিনন্দনযোগ্য উদ্যোগ। এ বিষয়ে বহু হাদিস রয়েছে। স্বল্প অবকাশে বেশি সংখ্যক হাদিস যোগাড় করা ও উদ্ধৃত করা তো সহজ নয়। তথাপি আপাতত: হাদিসের অনুবাদ দিচ্ছি। এই সাথে সূত্রের উল্লেখ করা হলে। প্রয়োজন হলে আপনি মূল হাদিসগ্রন্থ থেকে আরবি হাদিসসমূহও পড়ে দেখতে পারেন:

১. রসূলুল্লাহ সা. বলেছেন যে, তোমরা যখন কোনো পশুর উপর সওয়ার হয়ে শস্য শ্যামল এলাকা দিয়ে যাও তখন উক্ত জানোয়ারকে সেখানকার ঘাসপাতা খেয়ে নিজের অধিকার আদায় করতে দাও। আর যখন ঘাস পানিহীন শুষ্ক জায়গায় উপনীত হও, তখন ঐ জায়গাটা তাড়াতাড়ি অতিক্রম করে যাও। (সহীহ মুসলিম, শাসন সংক্রান্ত অধ্যায়, জীবজন্তুর স্বার্থ ও অধিকার বিষয়ক বিধিসমূহ)।

২. একবার রসুলুল্লাহ সা. ভ্রমণরত ছিলেন। ঐ কাফেলায় এক মহিলাও একটি উষ্ট্রীর আরোহিনী ছিলো। এক জায়গায় উষ্ট্রীটি লাফালাফি করলে মহিলা তাকে অভিসম্পাত দিতে লাগলো। রসূলুল্লাহ সা. তাকে বললেন : তুমি ওর পিঠের উপর থেকে নেমে যাও এবং নিজের জিনিসপত্রও নামিয়ে নাও। কারণ তুমি ওকে অভিশাপ দিয়েছো। (সহীহ মুসলিম, সৌজন্য ও সদাচার সংক্রান্ত অধ্যায়, জীবজন্তুকে অভিসম্পাত করার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা)।

৩. রসূলুল্লাহ সা. বলেন : এক পিপাসার্ত পথচারি একটি কূয়ায় নেমে পানি পান করলো। বেরিয়ে যাওয়ার সময় দেখলো একটি কুকুর ছটফট করছে এবং পিপাসার চোটে কাদা মাটি খাচ্ছে। লোকটি মনে মনে বললো, আমার যে দুর্গতি হয়েছিল এই কুকুরটার তো তাই হয়েছে। তাই সে নিজের জুতায় করে কূয়া থেকে পানি এনে কুকুরকে খাওয়ালো। আল্লাহ তার এই কাজটিকে কবুল করে নিলেন এবং তার গুনাহ মাফ করে দিলেন। সাহাবিগণ বললেন : হে রসূল! জীবজন্তুর উপকার করলেও কি সওয়াব হয়? তিনি বললেন : হৃদপিণ্ড ও কলিজার আর্দ্রতার অধিকারি যে কোনো জীবন্ত সৃষ্টির উপকার করলে সওয়াব পাওয়া যায়। (বুখারি, পান সংক্রান্ত অধ্যায়, পানি পান করনোর ফজিলত)।

৪. একবার স্বপ্নে রসূলু্ল্লাহ সা. এমন এক মহিলাকে দেখতে পান, যাকে একটি বিড়াল আপন নখর দিয়ে আঁচড়াচ্ছিলো। তিনি জিজ্ঞেস করলেন: এই মহিলার কি হয়েছে? তাঁকে জানানো হলো যে, সে ঐ বিড়ালকে বেঁধে রেখেছিলো। ফলে সে ক্ষুধায় মারা গিয়েছিলো। (বুখারি, পান সংক্রান্ত অধ্যায়, পানি পান করনোর ফজিলত )।

৫. একবার কোথাও যাওয়ার সময় রসূলুল্লাহ সা. একটি উটকে দেখলেন, (অনাহারের দরুন) তার পেট ও পিঠ এক সাথে লেগে গেছে। তিনি (সমবেত লোকদেরকে) বললেন : এই অবলা প্রাণীদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় কর। সুস্থ অবস্থায় তাদের উপর আরোহন করো এবং সুস্থ অবস্থায় রেখেই তাদের উপর থেকে নেমে যেও। (আবু দাউদ, জিহাদ সংক্রান্ত অধ্যায়, জন্তুর পিঠে আরোহণকালে যা যা করণীয়)।

৬. একবার রসূলুল্লাহ সা. আনসারদের এক বাগানে প্রবেশ করলেন। সেখানে একটা উট ছিলো। রসূলুল্লাহ সা.-কে দেখে উটটি একটি আক্ষেপসূচক ধ্বনি তুললো এবং তার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। তিনি উটের কাছে গিয়ে তার ঘাড়ে হাত বুলিয়ে দিলেন এবং 'এই উটের মালিক কে, এই উটের মালিক কে বলে, এই উটের মালিক কে' বলে হাকডাক করলেন।

জনৈক আনসার যুবক হাজির হয়ে বললো! 'হে রসূল! এটা আমার।' তিনি বললেন: "এই যে চতুষ্পদ জন্তুগুলো তোমাদের মালিকানায় দেয়া হয়েছে, এদের ব্যাপারে কি তোমরা আল্লাহকে ভয় করোনা? এই জন্তুটি তো আমার কাছে ফরিয়াদ জানাচ্ছে যে, তুমি তাকে ভুখা রাখ এবং কঠোর খাটনি খাটাও।" (আবু দাউদ, উপরোক্ত অধ্যায়)।

৭. রসূলুল্লাহ সা. জীবজন্তুর লড়াই অনুষ্ঠান নিষিদ্ধ করেছেন।

৮. রসূলুল্লাহ সা. একবার পথিপার্শ্বে একটা গাধা দেখলেন, যার মুখমণ্ডলে চিহ্ন খোদিত করা হয়েছে। তিনি বললেন : জানোয়ারের মুখ খোদাইকারি ও মুখে প্রহারকারিকে যে আমি অভিশাপ দিয়েছি, তা তোমরা জান না? (আবু দাউদ, ঐ)।

৯. রসূলুল্লাহ সা. বলেছেন : সাবধান, জীবজন্তুর পিঠকে যাবতীয় কাজকর্মের আখড়া বানিও না। আল্লাহ যে এগুলোকে তোমাদের বশীভূত করেছেন, সেটা শুধু এই উদ্দেশ্যে যে, তোমরা যেনো তোমাদের সেই সব গন্তব্যস্থলে যেতে পারো যেখানে বিনা যানবাহনে পৌঁছাতে তোমাদের ভীষণ কষ্ট হয়। আল্লাহ তায়ালা তোমাদের জন্য যমিন বানিয়েছেন। তোমাদের অন্যান্য কাজ সেই যমিনের উপর বসে সম্পন্ন করো। (আবু দাউদ, ঐ)।

১০. রসূলুল্লাহ সা. পিঁপড়ে ও মৌমাছিকে হত্যা করেত নিষেধ করেছেন। (মুসনদে আহমদ, প্রথম খণ্ড পৃ. ৩৪৭)।

১১. একবার রসূলুল্লাহ সা. সফরে এক জায়গায় যাত্রাবিরতি করেন। জনৈক সাহাবি জঙ্গলে গিয়ে সেখান থেকে একটি পাখির ডিম নিয়ে এলেন। পাখিটি এসে রসূলুল্লাহ সা. ও ঐ সাহাবির মাথার উপর উড়তে ও পাখা ঝাপটাতে লাগলো। তিনি বললেন : তোমরা কেউ ওকে কষ্ট দিয়েছো নাকি? সাহাবি বললেন : আমি ওর ডিম নিয়ে এসেছি। রসূলুল্লাহ সা. বললেন : যাও, ফিরিয়ে দিয়ে এসো। (মুসনদে আহমদ, প্রথম খণ্ড, পৃ. ৪০৪)।

১২. একবার রসূলুল্লাহ সা. এক পিঁপড়ের ঢিবির কাছ দিয়ে যাচ্ছিলেন। ঢিবিটা জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিল। তিনি বললেন : "কাউকে এমন শাস্তি দেয়া কোনো মানুষের পক্ষে বৈধ নয়, যে শাস্তি দেয়ার অধিকার একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট।" (মুসনদে আহমদ, প্রথম খণ্ড, পৃ. ৪২৩) [তরজমানুল কুরআন, জুন ১৯৫৫]


<h1>৪। পাঁচ ওয়াক্ত ও পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায</h1>
প্রশ্ন : মিরাজ সংক্রান্ত যে হাদিসটিতে প্রথমে পঞ্চাশ ওয়াক্ত এবং পরে হযরত মূসার আ. পরামর্শক্রমে সর্বশেষে পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয করার উল্লেখ রয়েছে, হাদিস বিরোধীরা সেই হাদিসটির উপর নানা রকমের বিদ্রূপমিশ্রিত আপত্তি তুলে থাকে। তারা বলে আল্লাহ যখন পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায ফরয করলেন, তখন কি তিনি বুঝতে পারেননি যে, আমি একটা অসাধ্য কাজের হুকুম দিচ্ছি? কেবল হযরত মূসার পরামর্শ এবং হযরত মুহাম্মদ সা.-এর আবেদন পাওয়ার পরই কি তিনি নিজের বাড়াবাড়ি টের পেলেন? হযরত মূসা কি (নাউজুবিল্লাহ) স্বয়ং আল্লাহ ও মুহাম্মদ সা.-এর চেয়েও বেশি জ্ঞানী যে, যে কথা হযরত মূসা আ. তাৎক্ষণিকভাবে বুঝতে পারলেন, তা আল্লাহ ও তাঁর শেষ নবীর মাথায় সময়মত এলোইনা? ইসলামের অকাট্য বিধানগুলো কি আল্লাহ এভাবেই নির্ধারণ করেন যে, পঞ্চাশ থেকে শুরু করেন এবং পাঁচ পর্যন্ত পেয়ে সন্তুষ্ট হয়ে যান? হাদিস বিরোধীদের ধারণা, এ হাদিস কোনো ইহুদির মনগড়া যাতে তাদের নবীর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয়। তারা বলে, নামায যদি প্রথমে পঞ্চাশ ওয়াক্ত ফরয করা হয়েও থাকে, তথাপি পাঁচ ওয়াক্ত নির্ধারিত হয়ে যাওয়ার পর আবার পঞ্চাশ ওয়াক্তের উল্লেখ করার কি দরকার ছিলো। এতে কি অকারণ একটা অন্তর্দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়না এবং এ ধরনের হাদিসগুলো কি অমুসলিমদের হরেক রকম প্রশ্ন তোলার সুযোগ করে দেয়না? কিন্তু তা সত্ত্বেও মুসলমানরা এসব হাদিসকে বুকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। এ হাদিসটি কতখানি শুদ্ধ অনুগ্রহপূর্বক জানাবেন এবং এর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণও করবেন, যাতে হাদিস বিরোধীদের আপত্তি নিরসন হয়ে যায়।

জবাব : এ হাদিস সম্পূর্ণ শুদ্ধ ও নির্ভুল। পাঁচ ওয়াক্ত নামায যে সংখ্যার দিক থেকে বেশি নয়, তাই হাদিস বিরোধীদের মতো পাঁচ ওয়াক্ত নামাযকে একটা প্রাণান্তকর বোঝা মনে করে এর সংখ্যা কমানো, তাৎপর্যকে বিকৃত করা এবং মনগড়াভাবে কিছু রহিত করা ও কিছু রদবদল করার অপচেষ্টা করা উচিত নয়, এটা বুঝানোই এ হাদিসের উদ্দেশ্য। এই হাদিস দ্বারা মুসলমানদেরকে এই ধারণা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে যে, নামায অতি নিম্ন সংখ্যক রাখা হয়েছে এবং তা আসলে পঞ্চাশ ওয়াক্তেরই স্থলাভিষিক্ত। এটা আল্লাহর অনুগ্রহ বিশেষ। নচেত পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাযও যদি ফরয হতে, তবু তা অন্যায় হতোনা।

আমরা যদি হেদায়েত অণ্বেষণের মনোভাব নিয়ে এ হাদিস অধ্যয়ন করি তাহলে তা থেকে উপরোক্ত শিক্ষাই অর্জিত হয়। কিন্তু যদি প্রত্যাখ্যান, অজ্ঞতা ও উপহাসের মনোভাব নিয়ে এ হাদিসকে দেখি, তাহলে আপনি যে সব আপত্তি ও প্রশ্ন উদ্ধৃত করেছেন, সেগুলো অবশ্যই জন্মে। আর শুধু এই হাদিস কেন, এ ধরনের মনগড়া ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা চালানো হলে অন্যান্য বহু সংখ্যক হাদিস, এমনকি বহুসংখ্যক আয়াতের উপরও এ রকম অনেক আপত্তি তোলা যাবে। উদাহরণস্বরূপ, জিহাদের নির্দেশ দিতে গিয়ে সূরা আনফালের এক জায়গায় আল্লাহ বলেন :
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
"হে নবী ! মুমিনদেরকে লড়াইয়ে উদ্বুদ্ধ কর। তোমাদের পক্ষে বিশজন ধৈর্যশীল লোক হলে তারা দু'শ জনের উপর বিজয়ী হবে। আর একশ'জন হলে তারা এক হাজার জন কাফেরের উপর বিজয়ী হবে। কেননা তারা নির্বোধ।" (সূরা আল আনফাল, আয়াত : ৬৫)

এখানে স্পষ্টতই কাফেরদের মোকাবিলায় মুসলমানদের বিজয়ী হবার জন্য আল্লাহ তায়ালা মুসলমান ও কাফেরদের শক্তি অনুপাত যথাক্রমে এক ও দশ উল্লেখ করেছেন। কিন্তু এর অব্যবহিত অন্য আয়াতে বলা হয়েছে :
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

"এখন আল্লাহ তায়ালা তোমদের দায় দায়িত্ব আরো হালকা করে দিলেন এবং তোমাদের মধ্যে যে দুর্বলতা রয়েছে, তা তিনি অবহিত আছেন। অতএব, এখন তোমাদের পক্ষে একশ' জন ধৈর্যশীল লোক হলে তারা দু'শ জনের উপর বিজয়ী হবে। আর তোমাদের পক্ষে এক হাজার জন হলে তারা আল্লাহর ইচ্ছায় দু'হাজার জনের উপর বিজয়ী হবে। বস্তুত: আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে থাকেন।" (সূরা আল আনফাল, আয়াত: ৬৬)

এখানে লক্ষ্য করুন বিজয় নিশ্চিত করার জন্য দু'পক্ষের সংখ্যানুপাতকে ১:১০ থেকে কমিয়ে ১:২ করা হয়েছে। এখন যদি সাময়িকভাবে হাদিস অমান্যকারীদের মানসিকতা অবলম্বন করা হয়, তা হলে পূর্বোল্লিখিত হাদিসটিতে যে ধরণের আপত্তি তোলা হয়েছে, এখানেও তা তোলা যায়। যেমন বলা যায় প্রথম আয়াতটি নাযিল করার সময় কি মুসলমানদের দুর্বলতার কথা আল্লাহর জানা ছিলো না যে, খামোখাই এক ও দশের অনুপাত ঘোষণা করে দিলেন। এ কথাও বলা যেতে পারে যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে যখন আসল অনুপাতটার উল্লেখ বাদই পড়ে গেলো এবং একই নি:শ্বাসে অনুপাতটা পাল্টে দেয়া হলো, তখন পেছনের অনুপাতটা বর্ণনা করে আমাদেরকে অনর্থক ঝামেলায় ফেলা হলো কেন? অনুরূপভাবে সূরা মুযযাম্মিলে প্রথমে বললেন :
---------------------------------------------------------------------------------
"ওহে কম্বল মুড়ি দেয়া ব্যক্তি! রাত জাগো। তবে বেশি রাত জেগোনা। রাতের অর্ধেক কিংবা কিছু কম, অথবা কিছু বাড়িয়ে নাও। আর ধীরে ধীরে কুরআন অধ্যায়ন করো।" সূরা আল মুজ্জাম্মিল, আয়াত : ১-৪ পরক্ষণে আবার বললেন :
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
"তোমার প্রভু জানেন যে, তুমি রাতের দুই তৃতীয়াংশের কিছু কম, অর্ধাংশ এবং এক তৃতীয়াংশ জেগে কাটাও। তোমার সহচরদের একটি দলও এরূপ করে থাকে। দিন ও রাতের পরিমাণ তো আল্লাহ নিজেই নির্ধারণ করেন। আল্লাহ অবগত হয়েছেন যে, তোমরা এ কাজে সক্ষম হবেনা। তাই তিনি তোমাদের প্রতি অনুকম্পাশীল হয়েছেন। কাজেই কুরআনের যতোটা সহজসাধ্য হয় ততোটা পড়। আল্লাহ নিশ্চিত হয়েছেন যে, তোমাদের কেউ কেউ অসুস্থ থাকবে, অন্যরা আল্লাহর অনুগ্রহের সন্ধানে পৃথিবীতে পরিভ্রমণ করবে, আবার কতোক লোক আল্লাহর পক্ষে লড়াই করবে। সুতরাং কুরআন থেকে যতোটুকু হয় পড়।" (সূরা আল মুজ্জাম্মিল, আয়াতাংশ : ২০)

এখানেও আপত্তি তোলার অবকাশ রয়েছে যে, নির্দেশ জারি করার এ-তো ভারি অদ্ভুত নিয়ম! প্রথমে তো রাতের অর্ধেক বা তার চেয়ে কিছু কম বেশি জাগার হুকুম দেয়া হলো। তারপর আবার বলা হলো যে, আল্লাহ অবগত হয়েছেন তোমরা এ নির্দেশ পালন করতে পারবেনা। তিনি এ কথাও জানতে পেরেছেন যে, তোমাদের কারো অসুখ বিসুখ হবে। তাই এখন রাতের অর্ধাংশ, এক তৃতীয়াংশ ও দুই তৃতীয়াংশ সংক্রান্ত কড়াকড়ি রহিত করা হলো। তোমাদেরকে স্বাধীনতা দেয়া হলো যে, সহজে যতোটুকু কুরআন পড়তে পারো পড়। এখানে বলা যেতে পারে যে, আল্লাহ তায়ালার কি পরে হুশ হলো যে, আমি একটা অসম্ভব কাজের হুকুম দিয়ে ফেলেছি (নাউজুবিল্লাহ) এবং এখন বলছেন "তিনি জানতে পেরেছেন যে, তোমরা এ নির্দেশ পালন করতে পারবে না।" আমাদের কতোক অসুখে ভুগবে, সফর করবে, লড়াইও করবে, তা কি তিনি এখন টের পেলেন যে, রাত জাগরণের আগের নির্ধারিত পরিমাণকে একটা বাড়াবাড়ি মনে করে তা পাল্টানো হচ্ছে। আরও একটা উদাহরণ নিন। কুরআনে এক জায়গায় বলা হয়েছে :--------------------------------------------------------------------------------
"যখন আমি মূসার আ. কাছ থেকে চল্লিশ রাত অবস্থানের অঙ্গিকার গ্রহণ করলাম।" (সূরা আল বাকারা, আয়াতংশ : ৫১) অপর জায়গায় বলা হয়েছে :
---------------------------------------------------------------------------------
"আমি মূসার আ. কাছ থেকে ত্রিশ রাত অবস্থানের অঙ্গিকার নিয়েছিলাম এবং আরো দশরাত তাতে যোগ করেছিলাম" (সূরা আল আ'রাফ, আয়াতাংশ : ১৪২)
অর্থাৎ এক জায়গায় বলা হয়েছে আমি চল্লিশ দিন ঠিক করেছিলাম। অন্যত্র বলা হয় আমি প্রথমে ত্রিশ দিন ঠিক করেছিলাম এবং পরে আরো দশ দিন বাড়িয়ে চল্লিশ দিন পূর্ণ করি। একজন বিকৃত মানসিকতা সম্পন্ন লোক এখানেও প্রশ্ন তুলতে পারে যে, এটা কি ধরনের বর্ণনাভঙ্গি যে, এক জায়গায় সুস্পষ্টভাবে চল্লিশ দিনের মেয়াদ উল্লেখ করা হলো, আর অন্যত্র বলা হলো ত্রিশ দিন। অত:পর তার সাথে দশ দিন বাড়িয়ে পূর্ণ করা হলো। এই কৃত্রিমতার কারণ কি?

এই দু'তিনটি উদাহরণ থেকে সহজেই আন্দাজ করা যায় যে, সমালোচনা ও খুঁত ধরার প্রবণতা থাকলে হাদিস দূরে থাক, স্বয়ং কুরআনের এক একটি আয়াতের উপরও আপত্তির স্তূপ লাগিয়ে দেয়া সম্ভব। কিন্তু মানুষ যদি শিক্ষা, উপদেশ, হেদায়েত ও পথনির্দেশ খোঁজে, তবে সে বিভ্রাট ও বিভ্রান্তির অনুসন্ধান ব্যাপৃত হতে পারেনা এবং যা অপেক্ষাকৃত উত্তম ও কল্যাণকর, তাই অনুসরণ করে থাকে। আলোচ্য হাদিসটির ব্যাপারেও এই উভয় দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বনের অবকাশ রয়েছে। এক দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে এ হাদিসটি অধ্যয়ন করলে পাঁচ ও পঞ্চাশের বিভ্রাটে আটকা পড়ে যেতে হবে, অথবা এরূপ অবাঞ্ছিত বিতর্কে লিপ্ত হয়ে যেতে হবে যে, যে নবী পরামর্শ দিলেন, যে নবী পরামর্শ গ্রহণ করলেন এবং যে আল্লাহ পরামর্শ অনুমোদন করলেন, তাঁদের মধ্যে অধিকতর বিজ্ঞ, অধিকতর প্রাজ্ঞ ও ত্বরিৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাসম্পন্ন কে?

পক্ষান্তরে অপর দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে হাদিসটি অধ্যয়ন করলে এত ইসলামের একটি অতীব মহান মূলনীতির মনোজ্ঞ চিত্র পাঠকের সামনে ভেসে উঠবে। এই মূলনীতিটি হলো দায়িত্বের বোঝা অপেক্ষাকৃত হালকা ও সহজতর করা। এতে একদিকে বুঝানো হয়েছে যে, আল্লাহ যদি আমাদেরকে দিনে রাতে পঞ্চাশবার তার আনুগত্যের অঙ্গিকার করা ও তাঁর দরবারে সিজদা করার আদেশ দেন, তবে সেটা আল্লাহর পক্ষ থেকে 'জুলুম' হিসেবে কিছুতেই গণ্য হবেনা। পক্ষান্তরে তিনি যদি নিজের দু'জন প্রিয় রসূলের আবেদন ও সুপারিশক্রমে মাত্র পাঁচবার ঐ কাজ করার নির্দেশ দিয়ে থাকেন, তবে তাঁর অর্থ এ নয় যে, এই মাত্র নতুন একটা তথ্য তাঁর কাছে উদঘাটিত হলো, যা তিনি ইতিপূর্বে টেরও পাননি, জানতেও পারেননি। ব্যাপারটা কক্ষনো তেমন নয়। বরঞ্চ এভাবে তিনি তাঁর বান্দাদেরকে এ কথাই উপলব্ধি করাতে চান যে, তাদের উপর তাঁর করুণা ও অনুগ্রহ কি অপার এবং কি অপরিসীম তার দয়া ও ভালবাসা! নামাযের ওয়াক্ত পঞ্চাশ থেকে পাঁচে নামিয়ে তিনি যে বান্দার দায়িত্ব হালকা করার বিরাট মহানুভবতা দেখালেন, এ জন্য তিনি দু'জন নবীকে উপলক্ষ বা মাধ্যম বানালেন, যাতে তাঁদের সম্মান ও গৌরব বাড়ে, আমাদের মনে তাদের মহব্বত বদ্ধমূল হয় এবং আল্লাহর কাছে তাঁদের কতো কদর ও মর্যাদা, তা আমরা বুঝতে পারি। এ দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে যখন আমরা উল্লেখিত মি'রাজের হদিস বিবেচনা করি, তখন আমাদের মন আপত্তির কন্টকমুক্ত এবং আল্লাহর কৃতজ্ঞতা ও প্রশংসায় ভরে উঠে।

এ হাদিস প্রসঙ্গে এরূপ প্রশ্নও অবান্তর যে, এটি হযরত মূসার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের উদ্দেশ্যে কোনো ইহুদির মনগড়া কিনা। শুধুমাত্র কুটবুদ্ধিসম্পন্ন বিকৃত রুচি ও বিদ্বেষ ভাবাপন্ন লোকের পক্ষেই এরূপ প্রশ্ন তোলা সম্ভব। কুরআন ও হাদিসে সুস্পষ্টভাবে বলে দেয়া হয়েছে যে, আল্লাহর রসূলগণের মধ্যে একজনের চেয়ে আরেকজন শ্রেষ্ঠ। কারো ব্যক্তিত্বে একটা গুণ প্রাধান্য পেয়ে থকলে অপর জনের মধ্যে অন্য বৈশিষ্ট্য উজ্জল। আমরা তাদের ব্যক্তিগত গুণবৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে পারি। কিন্তু আমাদের বর্ণনা এমন হওয়া চাইনা যাতে কোনো বিশেষ নবীকে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়। আলোচ্য হাদিসে কোনো নবীর অবমাননা হতে পারে এমন ভাষায় অন্য কোনা নবীর তুলনা করা বা শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরা হয়নি। হাদিস অমান্যকারিদের চমকপ্রদ যুক্তি প্রদর্শনে প্রভাবিত হয়ে যদি এ কথা মেনেও নেই যে, এই তুখোড় ভাষাবিদরা আলোচ্য হাদিস থেকে পরামর্শ গ্রহীতার চেয়ে পরামর্শ দাতার শ্রেষ্ঠত্ব ও জ্ঞান বুদ্ধির আধিক্য প্রমাণিত হয় বলে যে তত্ত্ব হাজির করেছেন তা সঠিক, তা হলে তো স্বয়ং আল্লাহর চেয়েও হযরত মূসার শ্রেষ্ঠত্ব কুরআন থেকেই প্রমাণ করা যায়। কুরআনে একাধিক জায়গায় বর্ণিত হয়েছে যে, আল্লাহ হযরত মূসা আ. কে ফিরাউন ও তার জাতিকে ইসলামের দাওয়াত দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। হযরত মূসা বললেন যে, আমি ভালো বক্তা নই, আমার আশংকা যে, আমার দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করা হবে। তাই আপনি হারুনকে আমার উপদেষ্টা ও সহকর্মী বানিয়ে দিন। এ ঘটনা থেকে কি এ কথা প্রমাণিত হয় যে, হযরত মূসা আ. আল্লাহর চেয়ে বেশি জ্ঞানী? এ কাজের জন্য মূসা আ. যে একা যথেষ্ট নন, তা আল্লাহ বুঝতেই পারলেন না। বুঝলেন শুধু মূসা আর তার কথা শুনে আল্লাহ বুঝলেন যে, তাই তো, কথাটা তো ঠিকই। একাকী মূসার উপর এ দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়া অন্যায়। আল্লাহ তায়ালা কি এমন একজন 'অবুঝ' সম্রাট যে, অমুক কাজের জন্য কি ধরনের ও কতজন কর্মী দরকার, সে ব্যাপারে তাঁর কোনো জ্ঞানই নেই? হাদিস অমান্যকারী গোষ্ঠি যেমন প্রশ্ন করে থাকে যে, নামাযের ন্যায় মৌলিক গুরুত্বপূর্ণ বিধানও কি এরূপ পারস্পরিক মত বিনিময়ের মাধ্যমে নির্ধারিত হতো? তেমনিভাবে এ ক্ষেত্রে কি এমন প্রশ্ন তোলা যায় না যে, নবুওয়াতের মতো সুমহান দায়িত্বে নিয়োগের জন্যও কি এভাবে পারস্পরিক মতৈক্যের ভিত্তিতে লোক নির্বাচন করা হতো? কুরআনের যে সব আয়াতে আল্লাহর সাথে হযরত মূসার আ. কথোপকথনের বিবরণ দেয়া হয়েছে, তাও কি কোনো ইহুদির মনগড়া?

সব শেষে বলা দরকার মনে করি যে, মিরাজ সংক্রান্ত যে বিস্তৃত বিবরণ কুরআন অথবা হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, তা অনেকাংশেই 'মুতাশাবিহাত' অর্থাৎ 'মানবীয় বুদ্ধির অগম্য' বিষয়সমূহের অন্তর্ভুক্ত। তাই এগুলোকে স্বীকার করে নিতে হবে এবং এর মধ্যে থেকে যা কিছু উপদেশ ও শিক্ষণীয় পাওয়া যায় তার উপরই আমাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখতে হবে। অন্যথায় এর খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে মাথা কুটলে বিভ্রান্তি ও গোমরাহী ছাড়া আর কোনো লাভ হবেনা। যেমন হাদিসে এসেছে যে, রসূল সা.-কে বিভিন্ন আকাশে নিয়ে যাওয়া হয়, ভালো কাজগুলোকে বাঞ্ছিত ও অবাঞ্ছিত আকারে ও ঘটনাবলীর রূপ দিয়ে রূপকভাবে দেখানো হয়। বেহেশত দোজখ এবং আযাব ও সওয়াব দেখানো হয়, সাবেক নবীদের সাথে সাক্ষাত করানো হয়। আলোচ্য হাদিসটিতে এ কথাও বলা হয়েছে যে, রসূল সা.-কে আল্লাহর দরবারে একাধিকবার একান্ত সাক্ষাৎকারে মিলিত হবার গৌরবে ভূষিত করা হয়। কারো যদি মাথা বিগড়ে গিয়ে থাকে তাহলে সে এর প্রতিটি কথা নিয়ে বিপুল সংখ্যক আপত্তি তুলতে পারে। এ জন্যই হাদিস অমান্যকারীরা এইসব হাদিস নিয়ে উপহাস-বিদ্রুপে লিপ্ত হয়ে থাকে। কিছুক্ষণের জন্য এই হাদিসগুলো থেকে দৃষ্টিভঙ্গি সরিয়ে রেখে আমরা যদি মিরাজ সংক্রান্ত কুরআনের আয়াতগুলো পর্যালোচনা করি তাহলে কি দেখতে পাইনা যে, সেখানেও এ ধরণের রহস্য ঘেরা দুর্বোধ্য তথ্য রয়েছে, যার সঠিক ব্যাখ্যা একমাত্র আল্লাহই ভালো জানেন বলে ক্ষান্ত থাকতে হয়। কুরআনে কি একই রাতের মধ্যে আপন বান্দাকে মসজিদে আকসায় নিয়ে যাওয়া এবং স্বীয় নিদর্শনাবলী দেখানোর কথা বলা হয়নি? "দুই ধনুকের জ্যার সমান বা তার চেয়েও ঘনিষ্ঠ হওয়ার" কথা কি কুরআনে বর্ণিত হয়নি? যদি কেউ প্রশ্ন তুলতে চায় তবে তার পক্ষে কি এখানেও এরূপ প্রশ্ন তোলা সম্ভব নয় যে, দুই ধনুকের জ্যার বলতে কি বুঝায় এবং দূরত্ব যদি দুই ধনুকের জ্যার সমানই হয়ে থাকে তা হলে আবার তার চেয়েও ঘনিষ্ঠ বলার তাৎপর্য কি?

তাছাড়া কুরআনে যে, 'সিদরাতুল মুনতাহার' উল্লেখ রয়েছে, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলা যেতে পারে যে, এটা কি সেই সুপরিচিত 'সিদরা' বা কুল গাছ? যদি তাই হয় তা হলে 'সদরাতুল মুনতাহা' অর্থাৎ শেষ প্রান্তের কুল গাছ অর্থ কি? আর এই কুল গাছটাকে যে জিনিস আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো বলা হয়েছে, সে জিনিসটি কি? এসব জিনিস নিয়ে আপত্তি তোলার সুযোগ কি অমুসলিমরা অতীতে কখনো পায়নি বা আজও পেতে পারেনা? তা হলে হাদিস অমান্যকারী কুরআনের এ আয়াতগুলোকে বুকে জড়িয়ে রাখছে কি কারণে? কুরআনের উপর সরাসরি আক্রমণ চালানোর জন্য পরিবেশ এখনো অনুকূল নয় বলে আপাতত: হাদিসের বিরুদ্ধে আক্রমনের ঘাটি তৈরিতে নিয়োজিত থাকাই এর কারণ নয় তো? [তরজমানুল কুরআন, এপ্রিল ১৯৫৬]


<h1>৫। হানাফি মাযহাবে কি কিছু কিছু মাদক দ্রব্য হালাল?</h1>
প্রশ্ন : হেদায়া তৃতীয় ও চতুর্থ খণ্ড অধ্যয়নরত জনৈক ছাত্র কয়েকদিন আগে আমার কাছে আসে এবং ঐ কিতাবের এক জায়গা বুঝিয়ে দেয়ার জন্য আমাকে অনুরোধ জানায়। আমি একটু সময় চেয়ে নিয়ে বললাম, জায়গাটা আমি আগে পড়ে দেখি তারপর বুঝিয়ে দেবো। দু:খের বিষয়, আমি নিজে এখনো ঐ জায়গাটা বুঁঝতে পারিনি। আর সে জন্য আপনার শরণাপন্ন হয়েছি। লক্ষ্য করুণ, মাদক দ্রব্য সংক্রান্ত অধ্যয় :

"উল্লেখিত বক্তব্যটি থেকে সুস্পষ্টভাবে জানা যায় যে, ইমাম আবু হানিফার মতে গম, জব, মধু ও ভুট্টা দিয়ে যে উত্তেজক পানীয় তৈরি করা হয়, তা যদি মাদকতা আনে , তবুও তা হালাল এবং তা পানকারি নেশাগ্রস্ত হলেও মদখোরের জন্য নির্ধারিত দণ্ডে সে দণ্ডিত হবেনা। এবং ঘুমন্ত লোকের তালাক যেমন স্ত্রীর উপর কার্যকর হয়না, এই মাদক সেবির প্রদত্ত তালাকও কার্যকর হবেনা।" অথচ আল্লাহর রসূল সা. বলেছেন :
---------------------------------------------------------------------------------
"প্রত্যেক মাদক দ্রব্যই হারাম। মদ হারাম করা হয়েছে, আর যে জিনিস মাদকতা আনে, সেটাই মদ।"
বস্তুত, এই কারণেই যারা কুরআন ও হাদিসের প্রকাশ্য বক্তব্য অনুসরণের পক্ষপাতি এবং কোনো মাযহাবের ধার ধারেননা, সেই 'আসহাবুজ জাওয়াহের' গোষ্ঠির লেখকগণ লিখেছেন যে, হানাফি মাযহাবে মদ হালাল। (নাউজুবিল্লাহ) অনুগ্রহপূর্বক এ বিষয়টি বুঝিয়ে দেবেন।

জবাব : হেদায়া থেকে আপনি যে অংশটুকু উদ্ধৃত করেছেন তা থেকে পুরো বক্তব্য স্পষ্ট হয়না। বক্তব্যটি শুরু থেকে এ রকম :
"জামে সগির গ্রন্থের মূল বক্তব্য এতোটুকুই যে, ইমাম আবু হানিফার মতে আঙ্গুর ও খেজুর দিয়ে যে মাদক তৈরি করা হয়, তা ছাড়া অন্যান্য পানীয় দ্রব্যে আপত্তি নেই।" এর পরের যে অংশটুকু আপনি উদ্ধৃত ও অনুবাদ করেছেন, তা ইমাম আবু হানিফার বক্তব্য নয়। ওটা অন্যান্য লোকদের নিজস্ব গবেষণাপ্রসূত বক্তব্য। বিশেষত: 'তা পানকারি নেশাগ্রস্ত হ'লেও শাস্তিযোগ্য নয়।'
এই উক্তিটাতো জামে সগিরেও নেই, আর ইমাম সাহেবের বক্তব্যের এরূপ মর্ম উদ্ধার করারও কোনো অবকাশ নেই। কিছু দূরে গিয়ে হেদায়া গ্রন্থে বলা হয়েছে :
---------------------------------------------------------------------------------
অর্থাৎ জামে সগির গ্রন্থের প্রণেতা ইমাম মুহাম্মদ বলেন যে, গম, জব, মধু, চাল ইত্যাদি থেকে যে মাদক পানীয় তৈরি হয়, তাও হারাম এবং তা খেয়ে যে ব্যক্তি মাতাল হবে সেও অন্যান্য হারাম মাদক সেবির মতোই শাস্তিযোগ্য হবে। পররর্তীতে আরো বলা হয়েছে :
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
উপরোক্ত অংশ থেকে বুঝা গেলো বিবিধ রকমের নির্যাসও ইমাম আবু হানিফা ও আবু ইউসুফের মতে কেবল তখনই হালাল, যখন তা কোনো প্রমোদ ফূর্তির উদ্দেশ্যে সেবন করা হবেনা, (বরং কোনো অনিবার্য পরিস্থিতিতে শুধুমাত্র পুষ্টি ও শক্তি আরহণের জন্য সেবন করা হবে)। এখান থেকে এ কথাও জানা গেলো যে, ইমাম মুহাম্মদ সব ধরণের মাদক সেবনকেই শাস্তিযোগ্য বলে বায় দিয়েছেন এবং খাদ্যশস্য থেকে নির্যাসকৃত ও জ্বাল দিয়ে প্রস্তুত করা মাদক পানীয়কেও মদ বলে গণ্য করেছেন। কেননা সুস্পষ্ট ও পথচারী লোকেরা এগুলোর কাছে ব্যাপকভাবে ভিড় জমায়। দুররুল মুখতার গ্রন্থের নিম্মোক্ত উক্তি থেকে এ বক্তব্যের ব্যাখ্যা পাওয়া যায় :
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
"খেজুর ও কিসমিসের নির্যাস সামান্য আঁচে জ্বাল দিলে যদি ঘন হয়ে যায়, তবুও তা সেবন করা বৈধ, যদি তা আমোদ ফূর্তির উদ্দেশ্যে পান না করা হয় এবং যদি তা মাদকতা না আনে। কিন্তু যদি আমোদ ফূর্তির উদ্দেশ্যে খাওয়া হয়, তবে তা কম বা বেশি যা-ই খাওয়া হোক, হারাম। আর যে পরিমাণ খেলে মাদকতা আসবে বলে প্রবল ধারণা জন্মে তা হারাম হবে।"

মধু, গম, জব ইত্যাদির ব্যাপারেও একই মত ব্যক্ত করার পর ঐ গ্রন্থে বলা হয় :
---------------------------------------------------------------------------------
"অর্থাৎ খাদ্য হিসেবে বা ওষুধ হিসেবে ছাড়া নিছক সখের বশে খাওয়া সর্বসম্মতভাবে হারাম।" ইমাম আবু হানিফার এই অভিমত বিশ্লেষণ করার পর এতে আরো বলা হয় :
---------------------------------------------------------------------------------
"এই বক্তব্য থেকে বুঝা যায় যে, এ ধরণের সকল মাদক পানীয় পরিমাণ নির্বিশেষে সম্পর্ণরূপে হারাম।"
এই সমগ্র আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে যে, ইমাম আবু হানিফা বা হানাফি ফকীহগণের মধ্য হতে কেউ কেউ এ ব্যাপারে কোনো তারতম্য করে থাকলেও তার উদ্দেশ্য অকাট্যভাবে নিষিদ্ধ মদের সাথে ইজতিহাদি প্রক্রিয়ায় নিষিদ্ধ ঘোষিত অন্যান্য মাদক দ্রব্যের পার্থক্য ব্যক্ত করা ছাড়া আর কিছু নয়। অন্যান্য মাদক দ্রব্য যতোক্ষণ অনাচার ও দুষ্কর্মের প্ররোচনা না দেয়, ততোক্ষণ তারা তাকে হালাল ও নির্দোষ আখ্যায়িত করেছেন। এটা কেবল একটা আইনগত ব্যবধান ছিলো এবং এটাই তারা তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। নচেত তারা এক বা দু'ধরণের মদ বাদে আর সকল মাদক দ্রব্যকে হালাল করে দেবেন এমন উদ্দেশ্য তাদের কখনো ছিলো না। ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টির একমাত্র কারণ হলো, জামে সগিরের উক্তির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে হেদায়ার গ্রন্থকার ----------- "যদিও তাতে মাদকতা আসে" এই কথাটা লিখে দিয়েছেন। এ কথাটা তিনি কিসের ভিত্তিতে লিখলেন তা অজ্ঞাত। তাছাড়া ------------ ('তারা বলেছেন' এবং 'বলা হয়েছে') কথাটা দ্বারা হেদায়াতে কাদের মতামত লিপিবদ্ধ করা হয়েছে তাও বুঝা যায়না।

সার কথা এই যে, ইমাম আবু হানিফা বা হানাফি ইমামদের বরাত দিয়ে এ কথা বলা কোনোক্রমেই সঠিক নয় যে, তারা শুধু আঙ্গুর বা খেজুরজাত মদকেই হারাম বলে রায় দিতেন আর বাদ বাকী সকল মাদক দ্রব্যকে শর্তহীনভাবে ও সর্বোতভাবে হালাল বলে অভিহিত করতেন। [তরজমানুল কুরআন, মার্চ ১৯৫৮]


<h1>৬। আদালতের রায় কি শুধু জাহেরীভাবেই কার্যকর, নাকি বাতেনীভাবেও কার্যকর?</h1>
প্রশ্ন : শরহে বেকায়া তৃতীয় খণ্ডের 'আদালতের কার্য প্রণালী' এবং হেদায়া তৃতীয় খণ্ডের 'কাযীর নিকট কাযীর পত্র' অধ্যায়ে বলা হয়েছে :
---------------------------------------------------------------------------------
"কাযী কোনো জিনিসকে জাহেরিভাবে অবৈধ ঘোষণা করে রায় দিলে প্রকৃতভাবেও তা অবৈধ। অনুরূপভাবে কোনো কিছুকে বৈধ ঘোষণা করলে সেটা প্রকৃতভাবেও বৈধ।"

কিন্তু কুরআন এক জায়গায় বলা হয়েছে :
---------------------------------------------------------------------------------
"তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অপরের ধনসম্পদ অন্যায়ভাবে আত্মসাৎ করোনা এবং জেনেশুনে মানুষের ধনসম্পদ অন্যায়ভাবে ভোগ দখল করার উদ্দেশ্যে বিচারকদের নিকট মামলা রুজু করোনা।" (সূরা আল বাকার, আয়াত : ১৮৮)
---------------------------------------------------------------------------------
"তোমাদের একজন আরেকজনের চেয়ে অধিকতর বাকপটু হতে পারে। সে ক্ষেত্রে নিশ্চিত হও যে সে সত্য বললো কিনা, অন্যথায় (অসত্য কথা বলে যা অর্জন করবে) তা আগুনের টুকরো মাত্র"।
এভাবে কুরআন ও হাদিস থেকে উপরোক্ত অভিমত ভ্রান্ত প্রমাণিত হয় এবং উল্লেখিত উক্তি স্পষ্টতই কুরআন ও হাদিসের বিপরীত মনে হচ্ছে। কিন্তু আমি নিশ্চিত হতে পারছিনা। উক্ত বক্তব্যের কোনো সঠিক ব্যাখ্যা থাকলে লিখুন।

জবাব : আপনি ইমাম আবু হানিফার রহ. যে উক্তি উদ্ধৃত করেছেন, তার মর্ম উদ্ধারে যে কিছু জটিলতা দেখা দেয়, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এ কারণে ইমাম শাফেয়ী রহ. এবং অন্যান্য ফকীহগণ, এমনকি ইমাম আবু হানিফার দুই শিষ্য (ইমাম মুহাম্মদ ও ইমাম আবু ইউসুফ) কোনো কোনো খুঁটিনাটি বিধি প্রণয়নে স্বীয় উস্তাদের এই মূলনীতির সাথে ভিন্নমত পোষণ করেছেন। তবে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করলে ইমাম আবু হানিফার উক্ত মূলনীতি সম্পূর্ণ নির্ভুল ও গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয় এবং স্থান বিশেষে তার এমন ব্যাখ্যা দেয়া যেতে পারে, যাতে সকল জটিলতার নিরসন ঘটে। ইমাম সাহেবের বক্তব্য, কাযীর বিচারের রায় জাহেরি ও বাতেনি উভয় দিক দিয়েই কার্যকর হয়ে যায়। অর্থাৎ তিনি যে জিনিসকে অবৈধ ও অচল ঘোষণা করবেন, তা অবৈধ গণ্য হবে এবং যে জিনিসকে বৈধ ও ন্যায়সঙ্গত ঘোষণা করবেন, তা বৈধ বা হালাল সাব্যস্ত হবে, চাই মিথ্যা সাক্ষ্যের ভিত্তিতে হওয়ায় তা মূলত ভ্রান্ত রায়ই হোক না কেন। এ উক্তির প্রকৃত মর্ম উপলব্ধি করার জন্য প্রথমে মনে রাখা দরকার হানাফি ফকীহদের সর্বসম্মত বিঘোষিত মূলনীতি অনুসারে, এটা সব রকমের মামলার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, বরং শুধুমাত্র বিয়ে তালাক ও ক্রয় বিক্রয়ের শুদ্ধাশুদ্ধতা অথবা মালিকানা সংক্রান্ত এমন বিরোধের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, যাতে মালিকানা নির্ণয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট কার্যকরণ, যথা ক্রয় বিক্রয় অথবা উত্তরাধিকারের উপর নির্ভরশীল। দ্বিতীয়ত: 'জাহেরী' ও 'বাতেনী' শব্দদ্বয়ের সঠিক মর্ম ও অর্থ চিহ্নিত করতে হবে। কেননা এটা সঠিকভাবে চিহ্নিত করা ছাড়া মূল বক্তব্যের যথাযথ তাৎপর্য বুঝা কঠিন হয়ে পড়ে।

আদালতের রায় জাহেরীভাবে কার্যকর হওয়ার অর্থ তো একেবারেই স্পষ্ট যে, আইন প্রয়োগের মাধ্যমে তা বাস্তবায়িত হবে। উভয় পক্ষ তা মানতে বাধ্য ও জনসাধারণের নিকট তা গ্রহণযোগ্য হবে। কিন্তু বাতেনিভাবে কার্যকর হওয়ার বিষয়টা কিছুটা বিচার বিবেচনা ও বিস্তারিত আলোচনার দাবি রাখে বিশেষত, যখন আদালতের রায় মিথ্যা কিংবা ত্রুটিপূর্ণ সাক্ষের কারণে বাস্তবানুগ হয় না। ইমাম আবু হানিফার অভিমত এই যে, এই বাস্তব ত্রুটিসত্তেও আদালতের রায় জাহেরী ও বাতেনিভাবে কার্যকর হবে। বাতেনিভাবে কার্যকর হওয়ার ব্যাখ্যা কেউ কেউ এভাবে দিয়ে থাকেন যে, এই রায় আল্লাহর কাছেও কার্যকর হয়ে গেছে ধরে নেয়া হবে। ফলে এই ভ্রান্ত রায়ের সুযোগ নিয়ে কেউ যদি নিজের জন্য হারামকে হালাল অথবা হালালকে হারাম করে নিয়ে থাকে, তবে তার কোনো গুণাহ হয়নি এবং আখেরাতেও তার কোনো জবাবদিহির সম্মুখীন হতে হবেনা। কিন্তু ইমাম সাহেবের বক্তব্যের এই ব্যাখ্যা তার সমালোচকরা বা সমর্থকরা যারাই মনগড়াভাবে করে থাকুক না কেন, আমার জানা মতে ও ধারণামতে এ ব্যাখ্যা স্বয়ং ইমাম সাহেবের বরাতে যেমন কোথাও বর্ণিত হয়নি, তেমনি এটা সঠিক এবং সমীচিনও মনে হয়না, আর ইমাম সাহেবের মূল বক্তব্যের আলোকেও এটা অপরিহার্য সাব্যস্ত হয়না। ইমাম আবু হানিফার উপর তার বক্তব্যের এ ব্যাখ্যার কোনো দায়দায়িত্ব বর্তায় না। এতো বড় একজন মর্যাদাবান ধর্মীয় নেতা ও ইমামের ব্যাপারে এরূপ ধারণা করা কিভাবে সমীচীন হতে পারে যে, হালাল হারাম নির্ধারণের যে ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর হাতে নিবদ্ধ, তা তিনি এ অর্থে আদালতের বিচারকের হাতে সোপর্দ করে দেবেন এবং জনসাধারণের বিবেক থেকে গুণাহের অনুভূতি ও হালাল হারাম বাছ বিচারের মনোভাব নির্মূল করার পথ এভাবে খুলে দেবেন?

ব্যাপারটা যদি সে রকম না হয়ে থাকে এবং নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, সে রকম নয়, তাহলে সঙ্গতভাবেই প্রশ্ন উঠে যে, এ উক্তির প্রকৃত মর্ম কি? আমার জ্ঞানমতে এ উক্তির সঠিক মর্ম ও তাৎপর্য নৈতিকভাবে এবং পরকালীন ফলাফল বিবেচনায় না এনে আদালতের রায়ের নিছক পার্থিব ফলাফলও আইনগত দিক যদি বিবেচনা করা হয়, তাহলে আমরা বুঝতে পারি যে, এসব রায়ের কোনো কোনো বক্তব্য আমাদের অন্তর্নিহিত জীবনের অত্যন্ত স্পর্শকাতর অনুভূতি এবং নিরেট ব্যক্তিগত ভাবাবেগ ও ধ্যান ধারণার সাথে জড়িত। এ দিক থেকে পর্যবেক্ষণ করলে নিছক পার্থিব নিয়ম শৃংখলা ও আইনগত দিক দিয়ে আদালতের রায়ের একটা দিক জাহেরি তথা বাহ্যিক ও বস্তুগত এবং আরেকটা দিক বাতেনি তথা আভ্যন্তরীণ ও নৈতিক হয়ে থাকে। আমার মতে, ইমাম আবু হানিফার প্রবর্তিত জাহেরি ও বাতেনি এই দু'প্রকারের কার্যকারিতা উল্লেখিত ব্যাখ্যার আলোকেই বিবেচিত হয়ে থাকে।

আমি একটা উদাহরণ দ্বারা জাহের ও বাতেনের এই সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যাকে স্পষ্ট করে দিতে চাই। মনে করুন, সেলিম ও রোকেয়ার মধ্যে বৈবাহিক দাম্পত্য সম্পর্ক বিদ্যমান কিনা, সেটা বিতর্কিত। ধরে নেয়া যাক আসলে তাদের বৈবাহিক সম্পর্ক বিদ্যমান, কিন্তু রোকেয়া অস্বীকার করছে, অথবা তালাকের মাধ্যমে চিরবিচ্ছেদ ঘটছে বলে দাবি করছে। আর নিজের দাবির সপক্ষে সে মিথ্যা সাক্ষীও হাজির করে দিচ্ছে। অপরদিকে সেলিম বিয়ে বহাল থাকার সপক্ষে কোনো সাক্ষ্য পেশ করতে পারছেনা। আদালত বিয়ে বহাল নেই অথবা তালাক দ্বারা বিচ্ছেদ ঘটে গেছে বলে রায় দিয়ে দিলো। এক্ষণে এ রায়ের একটা দিক তো স্পষ্টতই জাহেরি বা বাহ্যিক, যা বাস্তব জগতের সাথে সম্পক্ত। সেটি এই যে, এখন আর সেলিম রোকেয়ার ভরণ পোষণ ও আবাসনের জন্য দায়ি নয় এবং রোকেয়াও তা দাবি করার অধিকার রাখেনা। কিন্তু এ বিষয়টার আরো একটা দিক রয়েছে, যার সম্পর্ক অন্তর্নিহিত জগতের সাথে এবং যাকে ইমাম সাহেবের ভাষায় বাতেনি দিক বলেও অভিহিত করা চলে। এ দিকটা হলো রোকেয়ার সতীত্বকে স্পর্শ ও হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত রাখার বৈধ্যতা ও অবৈধতার এবং বিয়ে ও দাম্পত্য সম্পর্ক কার্যত বহাল থাকা না থাকার। রোকেয়া তার দাবি প্রতিষ্টার জন্য মিথ্যা সাক্ষ্যকে যেভাবে প্রয়োগ করেছে তা যে মহাপাপ এবং তার জন্য সে যে আখেরাতে আযাব ভোগ করতে বাধ্য, সে ব্যাপারে তো আদৌ কোনো বিতর্কের অবকাশ নেই। এ বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে ইমাম ইবনে হুমাম স্বীয় গ্রন্থ 'ফাতহুল ক্কাদীরে' বলেন :
---------------------------------------------------------------------------------
"একটা অন্যায় দাবি উত্থাপন ও অন্যায়ভাবে তা প্রতিষ্ঠিত করার কাজ যে করে, সে এতো বড় গুণাহ করে, যার চেয়ে বড় আর কোনো গুণাহ হতে পারে না।"

কিন্তু আমি ইতিপূর্বেই বলেছি আখেরাতে কি পরিণতি হবে, না হবে, তা বাদ দিলেও, এখানে ইহলৌকিক বিচার বিবেচনার দিক দিয়েও হালাল হারাম সংক্রান্ত এমন কয়েকটি গুরুতর প্রশ্ন দেখা দেয়, যার সমাধান না করে উপায় থাকেনা। যেমন, সেলিম ও রোকেয়ার বৈবাহিক সম্পর্কচ্ছেদের পক্ষে আদালত যে রায় দিয়েছে চাই বাস্তবে সে রায় ভ্রান্তই হোক না কেন, তার পরে সেলিম রোকেয়ার সাথে স্বামী স্ত্রীর মতো সম্পর্ক বজায় রাখতে পারবে কিনা? যদি রাখে তবে আদালত তাকে ব্যভিচারি সাব্যস্ত করে তাকে ব্যভিচারের জন্য নির্দিষ্ট শাস্তি দিতে পারবে কিনা? সেলিম যদি এখন রোকেয়ার আপন বোনকে বিয়ে করে, তাহলে এক সাথে দুই সহোদরাকে বিয়ে করার দায়ে সে দোষি হবে কিনা? রোকেয়ার অন্য কারো সাথে বা অন্য কারো রোকেয়ার সাথে বৈবাহিক ও দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন আইনত ও শরিয়ত মোতাবেক অনুমোদিত কিনা? যদি অনুমোদিত হয়ে থাকে তবে কেন অনুমোদিত এবং না হয়ে থাকলে কেন নয়? তাছাড়া দ্বিতীয় ব্যক্তির সাথে বিয়ের বৈধতা ও অবৈধতার কোনো প্রভাব পূর্ববর্তী বিয়ের উপর পড়বে কিনা?

সেলিম ও রোকেয়ার মধ্যে বিয়ের বিচ্ছেদ সংঘটনকারি আদালতের রায় সাস্তবিক পক্ষে ভ্রান্ত হলেও যেহেতু সেটা আদালতের সিদ্ধান্ত, তাই অন্তত:পক্ষে বাহ্যিকভাবে তা কার্যকর না হয়ে পরেনা। এখন যদি সংশ্লিষ্ট দুই পক্ষের অথবা জনগণের মধ্য থেকে কেউ এই রায়ের আইনগত ও রাজনৈতিক কার্যকারিতাকেই চ্যালেঞ্জ করে, তাহলে শুধু বিচার বিভাগ নয়, বরং গোটা প্রশাসন ব্যবস্থায় অরাজকতা ও বিশৃংখলা দেখা দেবে এবং এমন বিশৃংখল অবস্থার উদ্ভব ঘটবে, যেখানে কোনো সিদ্ধান্ত, নির্দেশ বা আইনই কার্যকর হওয়া সম্ভব হবেনা।আর যদি কেউ আদালতের সিদ্ধান্তটির বাহ্যিক কার্যকারিতা মেনে নেয়, কিন্তু বাতেনি তথা আভ্যন্তরীণ ও নৈতিক কার্যকারিতা না মানে এবং বিয়ে ভঙ্গের রায় বৃথা ও বাস্তবে অকার্যকর বলে আপন মনে ভাবতে ও প্রচার করতে থাকে, তা হলে সেই ব্যক্তি উপরোক্ত প্রশ্নগুলোর কি সন্তোষজনক জবাব দেবে তা আমার বুঝে আসেনা। এরূপ ব্যক্তি যদি সেলিম হয় বা দ্বিতীয় স্বামীর পর্যায়ে থাকে, তাহলে সে বিবিধ জটিলতা থেকে মুক্ত কোন্‌ কর্মপন্থা অবলম্বন করতে সক্ষম হবে, তাও আমার অজানা। আমার মতে, এই সকল জটিলতার চূড়ান্ত সমাধান এবং সকল বিতর্ক অবসানের সর্বশেষ উপায় হলো ইমাম আবু হানিফার মূলনীতি অনুসরণ করা এবং আদালতের রায়কে বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ-উভয়ভাবে কার্যকর মেনে নেয়া। এরপর আমরা সম্পূর্ণ দ্বিধাহীন চিত্তে বলতে পারবো যে রোকেয়ার বৈবাহিক ও দাম্পত্য সম্পর্ক এখন সেলিমের সাথে সর্বোতভাবে বিচ্ছিন্ন এবং অন্য কোনো ব্যক্তির সাথে তার বিয়ে হওয়া সম্পূর্ণ বৈধ। রোকেয়া যদি গুণাহ করে থাকে তবে তার পরিমাণ সে আখেরাতে অবশ্যই ভোগ করবে। ইমাম সাহেবের উক্তির দরুন তার পাপের বা পারলৌকিক শাস্তির কিছুমাত্র লাঘব হওয়া প্রমাণিত হয়না।
ইমাম আবু হানিফার নীতির যে ব্যাখ্যা আমি করেছি, তার আলোকে দেখলে এই নীতি অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত ও অখণ্ডনীয় বলে মনে হবে। এটি অত্যন্ত প্রাজ্ঞ ও কল্যাণময় মূলনীতি। শরিয়তের আইন বিধি ও নির্দেশমালার বাস্তব প্রয়োগে যেসব জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়, তা বহুলাংশে এর দ্বারা নিরসন করা সম্ভব। তাছাড়া কুরআন ও সুন্নাহর কোনো স্পষ্টোক্তি বা কোনো মূলনীতির সাথে এর কোনো বৈসাদৃশ্য বা বিরোধও নেই। বরঞ্চ হযরত আলীর একটি রায় থেকে এ নীতির পক্ষে অধিকতর সমর্থন পাওয়া যায়। রায়টি নিম্নরূপ :

এক ব্যাক্তি জনৈক মহিলাকে নিজের স্ত্রী দাবি করে আদালতে মামলা দায়ের করলো এবং স্বীয় দাবির সপক্ষে সাক্ষীও পেশ করলো। বিচারক হযরত আলী রা. সাক্ষী সাবুদের উপর নির্ভর করে পুরুষটির পক্ষে রায় দিলেন এবং তার দাবি সঠিক বলে মেনে নিলেন। মহিলাটি বললো : আমি আসলে তো তার স্ত্রী ছিলামনা কিন্তু আপনি যখন রায় দিয়ে দিয়েছেন তখন ঐ পুরুষটির সাথে আমার বিয়েও সম্পন্ন করুন, যাতে আমি তার জন্য বৈধ হয়ে যাই। হযরত আলী রা, বললেন, --------------- অর্থাৎ তোমার বিরুদ্ধে যে দু'ব্যক্তি সাক্ষ্য দিয়েছে, তারাই তো ঐ পুরুষটির সাথে তোমার বিয়ে সম্পন্ন করে দিয়েছে। এখন আর আনুষ্ঠানিক বিয়ের কোনো প্রয়োজন নেই। এই মামলায় হযরত আলীর রা. কথা ও কাজ দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে, আদালতের রায় জাহের ও বাতেন উভয় ক্ষেত্রেই কার্যকর হয়ে যায়। আর এখান থেকেই ইমাম আবু হানিফার 'জাহেরি' ও বাতেনি কার্যকারিতা'র তাৎপর্যও বুঝা যায়।

মোটকথা, এ আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ইমাম আবু হানিফার ঘোষিত নীতিতে বিরোধ ও বৈপরিত্যের প্রশ্ন তোলার কারণ ভুল বুঝাবুঝি ছাড়া আর কিছু নয়। আসলে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করলে ইমাম সাহেবের সূক্ষ্মদর্শিতা এবং তাঁর প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার স্বীকৃতি না দিয়ে পারা যায়না। [তরজমানুল কুরআন, মার্চ ১৯৫৮]


<h1>৭। সুন্নাহর আইনগত মর্যাদা</h1>
প্রশ্ন : মুসলমানদের সর্বসম্মত বিশ্বাস হলো, রসূল সা.-এর উপর কুরআন ছাড়াও ওহী নাযিল হতো। সেই ওহীই আমাদের কাছে রসূলের সা. হুকুম ও বাণী হিসেবে বিদ্যমান। কিন্তু আজকাল কেউ কেউ বলছেন, কুরআন ছাড়া আর কোনো ওহী আসতোনা। তাদের সবচেয়ে বড় যুক্তি এই যে, রসূল সা.-এর প্রত্যেকটি কথাই যদি ওহীভিত্তিক হতো, তা হলে তাঁর কোনো কোনো কথায় কুরআনের সমালোচনা করা হয়েছে কেন এবং অন্যদের কথায় তিনি নিজের কোনো কোনো মত পরিবর্তন করেছেন কেন? কোনো কোনো হাদিসে তো এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে। 'মাকামে সুন্নাত' (সুন্নাহর আইনগত মর্যাদা নামক একখানা পুস্তক প্রকাশিত হয়েছে। ঐ পুস্তকে কুরআন ছাড়া আর কোনো ওহী আসতো না- এই মতের পক্ষে বিপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন ও তার তুলনামূলক পর্যালোচনা করে উল্লেখিত যুক্তির পুনরুল্লেখ করা হয়েছে। অধিকন্তু গ্রন্থকার এটিকে একটি অকাট্য যুক্তি হিসেবে পেশ করার পর এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, হাদিসে কুদসী (যে হাদিসে স্বয়ং আল্লাহর উক্তি উদ্ধৃত করা হয়েছে) এবং ভবিষ্যদ্বাণীগুলো ছাড়া অন্যান্য বিষয়ে রসূল সা.-এর কথা ও কাজ ওহী নয়। তাই ওগুলোতে রদবদল চলতে পারে। অনুগ্রহপূর্বক ব্যাখ্যা করুণ যে, ওহীকে কুরআনের মধ্যে এবং নবী জীবনের একটা ক্ষুদ্র অংশে সীমাবদ্ধ মনে করার এই মতবাদ কতখানি সঠিক?

'মাকামে সুন্নাত' নামক বইটির আরো কয়েকটি বিষয় গভীর বিচার বিবেচনার দাবি রাখে। জানিনা আপনি ওটা পড়ে দেখেছেন কিনা। এক জায়গায় তিনি 'হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা' গ্রন্থের বরাত দিয়ে লিখেছেন বুখারি ও মুসলিম শরিফে এই মর্মে একটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে যে, পানির অভাব দেখা দিলে সহবাসজনিত অপবিত্রতা দুরিকরণে তায়াম্মুম গোসলের স্থলাভিষিক্ত হতে পারে কিনা সে ব্যাপারে হযরত ওমর রা. ও হযরত আম্মার রা.-এর মধ্যে আজীবন মতবিরোধ চলছিলো। অথচ কুরআনে দুই জায়গায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে এরূপ ক্ষেত্রে তায়াম্মুম করে নাও। এ দ্বারা কি বুঝা যায় যে, উভয় সাহাবি কুরআন সম্পর্কে অজ্ঞ ছিলেন এবং তাঁদেরকে কুরআনের উক্ত বক্তব্য অবহিত করারও কেউ ছিলোনা? অথবা কুরআন সাহাবাদের নিকট চূড়ান্ত দলিল ছিলোনা? আরো আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, হযরত আম্মার তায়াম্মুমের পক্ষে এই বলে যুক্তি প্রদর্শন করতেন যে, রসূল সা.-এর  অনুমতি দিয়েছেন। অথচ তাতেও হযরত ওমর রা. আশ্বস্ত হতে পারেননি। তবে পরবর্তী কালের লোকেরা আশ্বস্ত হয়ে গেছে এবং তাও হয়েছে কুরআন দ্বারা নয় বরং এই হাদিস দ্বারা। কারণ তাদের কাছেও কুরআনের চেয়ে হাদিস অগ্রগণ্য। মোটকথা, এই সর্বসম্মত হাদিসের উপর অনেক লম্বা চওড়া আপত্তি তোলা হয়েছে এবং ইচ্ছেমত উপহাস করা হয়েছে। এতে আমার মন নিদারুণভাবে ক্ষুব্ধ। প্রশ্ন হলো, এ হাদিসটি কি শুদ্ধ? এর তাৎপর্য কি?

জবাব : রিসালতের পদটির মর্যাদা ও সম্মান ক্ষুন্ন করা, রসূলের সুন্নাহর সাথে উম্মাতের সম্পর্ক ছিন্ন করা এবং সুন্নাহর আইনগত মর্যাদাকে জনসাধারণের চোখে সংশয়পূর্ণ ও গুরুত্বহীন করে তোলার দুরভিসন্ধি নিয়ে এ যাবত যে কয়টি মতবাদ রচিত হয়েছে, তার মধ্যে একটি মতবাদ এই যে, রসূল সা.-এর নিকট মাত্র এক ধরনের ওহী নাযিল হয়েছে, যা কুরআনের অন্তর্ভুক্ত। এর বাইরে আর কোনো ওহীর কথা স্বীকার করা ইহুদীদের কুসংস্কার, যার সাথে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই। সুন্নাহর অতীব মহান ও পবিত্র ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করা ছাড়াও এই মতবাদ দ্বারা আরো একটি যুক্তি খাড়া করার চেষ্টা করা হয়ে থাকে। সেটি হলো সুন্নাহ যেহেতু ওহীভিত্তিক নয়, তাই ওটা কেবল রসূল সা.-এর ব্যক্তিগত চিন্তা গবেষণা প্রসূত অভিমত মাত্র। এটি কোনো সর্বজন মান্য আইনের মর্যাদা রাখেনা। বরঞ্চ মুসলমানরা নিজস্ব চিন্তা গবেষণার ভিত্তিতে এর বিপরীত সিদ্ধান্তও নিতে পারে। এটা যে কতদূর ভ্রান্ত মতবাদ, তা বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখেনা। কেননা খোদ কুরআন থেকেই প্রমাণিত যা কুরআনের অন্তর্ভুক্ত পঠিত ও লিখিত ওহী ছাড়াও এমন বহু ওহী শুধু মুহাম্মদ সা. নয় বরং আল্লাহর প্রত্যেক নবীর কাছেই নাযিল হতো, যার উপর নিজের আমল করা এবং গোটা উম্মতকে দিয়ে আমল করানো সকল নবীর নবুওয়াতের উদ্দেশ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিলো। সব ওহীকে এরূপ মনে করারও অবকাশ ছিলোনা যে, তা হয়তো মৌমাছির নিকট অবচেতনভাবে বা প্রাকৃতিকভাবে প্রেরিত প্রত্যাদেশের মতো হবে। অথবা আকাশ ও পৃথিবীর নিষ্প্রাণ পদার্থের নিকট অবতীর্ণ প্রাকৃতিক ওহীর মতো হবে। তথাপি হাদিস বিরোধীদের কর্মপন্থা এই যে, যে জিনিস তাদের কাছে ভালে লাগে ও তাদের স্বার্থের অনুকূল হয়, সেটা উদ্ধারের পথে অন্তরায় হয়, তা কুরআনে যে অকাট্য প্রমাণ রয়েছে, এই গোষ্ঠি ভুলেও তার কথা মুখে আনেনা। কিন্তু কুরআন ছাড়া রসূল সা.-এর নিকট আর কোনো ওহী আসতোনা এই মর্মে কোনো যুক্তি প্রমাণ কোথাও পাওয়া যায় কিনা, তার অন্বেষণে তারা হাদিস কুরআন দুটোই চষে ফেলতে ভীষণ তৎপর। এ ধরণের কোনো প্রমাণ উদ্ধার করা তো তাদের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তবে কুরআন ও হাদিসে এরূপ মুষ্ঠিমেয় কয়েকটি ঘটনা তাদের হস্তগত হয়েছে।, যা দ্বারা বুঝা যায় যে, রসূল সা.-এর কোনো কাজে ওহী দ্বারা সাবধান করা হয়েছে, অথবা রসূল সা. কারো পরামর্শে নিজের মত পরিবর্তন করেছেন। আর এইটুকু মাল-মশলা হাতে পেয়েই তা দিয়ে তারা নিজেদের মনগড়া মতবাদের সপক্ষে যুক্তিতর্কের এক বিরাট প্রাসাদ গড়ে তুলেছে।

এই যুক্তিতর্ক নিয়ে যদি সামান্যতম চিন্তাভাবনাও করা হয়, তা হলে পরিষ্কার বুঝা যাবে যে, এতে যে ঘটনাগুলোকে যুক্তি হিসেবে দাঁড় করানো হয়েছে, তা দ্বারা কু্রআন বহির্ভুত ওহীর অস্তিত্ব অস্বীকারকারীদের বক্তব্য যেমন প্রতিষ্ঠিত হয়না, তেমনি তা দ্বারা সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগণের দাবিও অসত্য প্রমাণিত হয়না। অস্বীকারকারীদের বক্তব্য হলে রসূল সা.-এর উপর কুরআন ব্যতীত আর কোনো ওহী কোনো ব্যাপারেই নাযিল হয়নি। উল্লেখিত ঘটনাবলী দ্বারা শুধু এতোটুকুই প্রমাণিত হয় যে, কিছু কিছু ব্যাপারে এমনও রয়েছে যাতে ওহী অবতীর্ণ হয়নি কিংবা যাতে ওহী অবতীর্ণ হওয়ার কিছুটা বিরতি ঘটেছিলো। অস্বীকারকারীদের বক্তব্যের যথার্থতা প্রমাণের জন্য এটা যথেষ্ট নয়। পক্ষান্তরে সাধারণ মুসলিম জনতার বক্তব্য ও বিশ্বাস হলো, রসূল সা.-এর কথা ও কাজ হয় অবিকল ওহীভিত্তিক, নতুবা ওহীর নির্দেশে সম্পাদিত হয়েছে। তাই তা আল্লাহর ইচ্ছে ও সন্তোষের সর্বোত্তম প্রতীক। আর যদি কোনো কাজ ওহীর নির্দেশিত পথ থেকে সামান্য পরিমাণেও সরে গিয়ে থাকে, তবে ওহীর মাধ্যমেই তৎক্ষনাৎ তা শুধরে দেয়া হয়েছে। কুরআন ও সুন্নাহ থেকে নবীদের নিষ্প্রাণ হওয়ার যে তত্ত্ব প্রমাণিত তা এটাই। কেবল গুটিকয়েক ঘটনা ও কার্যকলাপ ছাড়া বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ ঘটনা ও কার্যকলাপ এমনি ধরনের যে, তাতে রসূল সা.-এর কর্মপদ্ধতি হয় হুবুহু ওহীভিত্তিক, নচেত তা ওহীর দাবি ও আল্লাহর ইচ্ছেকে এমন নিখুঁতভাবে ও ইপ্সিত মানে পূর্ণ করতো যে, তাতে আর ওহীর মাধ্যমে সংশোধনের প্রয়োজনই থাকতোনা। সে ক্ষেত্রে ওহীর নিরবতা বা নাযিল না হওয়াটাও মূলত সম্মতি ও অনুমোদনেরই পর্যায়ভুক্ত। অন্যথায় যে নবীর উপর ওহীর এমন কঠোর তদারকী বিরাজ করতো যে, তিনি শুধু ঠোঁট নাড়লেই ------------------ (তুমি জিভ নেড়ো না) বলে সতর্ক করে দেয়া হতো, এবং যিনি একটু বিরক্তি প্রকাশ করলেই সূরা নাযিল হয়ে যেতো, সেই নবী নবুওয়াতের দায়িত্ব পালনে আল্লাহর সন্তুষ্টি চুল পরিমাণ লংঘন করবেন অথচ ওহী এসে তৎক্ষণাৎ তাঁকে শুধরে দেবেন না, এটা কিভাবে কল্পনা করা যেতে পারে? কাজেই গুটিকয়েক ঘটনাকে বেছে বেছে দেখালেই আমাদের এ বক্তব্য খণ্ডিত হয়না যে, মোটামুটিভাবে এবং সামগ্রিকভাবে গোটা নবী জীবন ওহীর পথনির্দেশনার উপর প্রতিষ্ঠিত। বরঞ্চ সতর্কীকরণ ও সংশোধনের উদ্দেশ্যে ওহী নাযিল হওয়ার মাত্র গুটিকয় ঘটনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকা আমাদের বক্তব্যকে আরো মজবুত করে।

বিরোধী পক্ষ এখানে এই বলে আপত্তি জানাতে পারে যে, রসূল সা.-এর নির্মল জীবন ও মহৎ চরিত্রের অধিকাংশ ওহীভিত্তিক বলে সাধারণ মুসলমানগণ বিশ্বাস পোষণ করে এ কথা ঠিক নয়। কেননা তাদের অনেকেই মনে করে রসূলের প্রতিটি তৎপরতাই ওহী। এ দাবির সপক্ষে তারা -------------------------------------------- (তিনি মনগড়াভাবে কোনো কথাই বলেন না। তিনি যাই বলেন তা ওহী ছাড়া আর কিছু নয়।) এই আয়াতকে প্রমাণ হিসেবে পেশ করে থাকে। আমি এর জবাবে বলতে চাই, আসলে এই দু'টো বক্তব্যের মধ্যে কোনো বৈপরিত্য নেই নবুওয়াতের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে রসূল সা.-এর পক্ষ থেকে যে হাজারো কথা, কাজ, আদেশ ও নিষেধ জারি হয়েছে তার মধ্যে অতি নগণ্য ও বিরল সংখ্যকই এমন রয়েছে, যা ওহীভিত্তিক নয়। এগুলো সংখ্যায় এতো অল্প যে তা হিসেবে ধরার মতোই নয় এবং তাতে -------------------------------- "তিনি যাই বলেন তা ওহী ছাড়া কিছু নয়" উক্তিটি থেকে যে মূলনীতি উদ্ভাবন করা হয়েছে, (অর্থাৎ রসূলের জীবন ও কর্ম সামগ্রিকভাবে ওহীভিত্তিক) তাতে কোনো ব্যাঘাত ঘটেনা। যে বক্তব্য শতকরা ৯৯ বা তার চেয়েও বেশি অংশের ব্যাপারে সঠিক ও প্রযোজ্য, তাকে যদি মূলনীতির আকারে বর্ণনা করা হয়, তবে এই বচনভঙ্গিটি মোটেই অসত্য এ অশুদ্ধ নয়। সামগ্রিক সিদ্ধান্ত ঘোষণার বেলায় অধিকাংশের বা সংখ্যাগরিষ্ঠের অবস্থাটাই সব সময় প্রধান বিবেচ্য বিষয় হয়ে থাকে। এ সত্যটাই একটি ইংরেজি প্রবাদে এই বলে ব্যক্ত করা হয়েছে যে, কিছু কিছু ব্যতিক্রমি ব্যাপার এমন হয়ে থাকে যে, তাতে সংশিষ্ট মূলনীতির খণ্ডন তো হয়ই না, অধিকন্তু তা আরো সংহত অকাট্য হয়।

"There are some exceptions which prove the Rule."

যাহোক, প্রকৃত ব্যাপার হলো, কুরআন ছাড়াও রসূল সা.-এর উপর বহু ওহী অবতীর্ন হয়েছে। আর সেসব ক্ষেত্রে ওহী আসেনি, অথচ ব্যাপারটি রিসালাত বা নবুওয়াতের দায়িত্বের সাথে সংশিষ্ট, সে ক্ষেত্রে ওহী নাযিল না হওয়াটাই প্রমাণ করে যে, ঘটনা ও কার্যকলাপ যাই ঘটে থাকুক না কেন, হুবুহু আল্লাহর ইচ্ছে ও সম্মতি অনুযায়ীই সংঘটিত হয়েছে। অবশ্য পালনীয় ও অবশ্য কর্তব্য হবার ব্যাপারে ওহীভিত্তিক নির্দেশের সাথে তার কোনোই পার্থক্য নেই। সুতরাং সেইসব ক্ষেত্রে কোনো মুসলমানেরাই নবীর হুকুমের আনুগত্য পরিত্যাগ করার জন্য এই ওজুহাত দাঁড় করানো বৈধ নয় যে, নবীর কোনো বিশেষ নির্দেশ ওহীভিত্তিক নয় বা তা ওহীভিত্তিক হবার কোনো প্রমাণ সে পায়নি।

এবার 'এদারায়ে সাকাফাতে ইসলামিয়া' কর্তৃক প্রকাশিত 'মাকামে সুন্নাত' নামক গ্রন্থটির প্রসঙ্গে আসা যাক। এ বই আমিও পড়ে ফেলেছি। বইটা পড়লে মনে হয়, লেখক 'মানিও না অমান্যও করি না' ধরনের নীতির অনুসারী। প্রথমে তো তিনি স্বকল্পিতভাবে হাদিসপন্থী ও হাদিস বিরোধীদের শিবির থেকে সরে গিয়ে উভয় শিবির থেকে সম দূরত্বে অবস্থিত সত্যাশ্রয়ী তৃতীয় পক্ষ হিসেবে নিজের একটি আলাদা শিবির স্থাপন করেছেন। কিন্তু পাঠক যখন বইটি অধ্যয়ন করতে করতে ক্রমশ সামনে অগ্রসর হয়, তখন দেখা যায়, তিনি হদিস বিরোধীদের শিবিরের দিকে ঘনিষ্ঠতর হতে যাচ্ছেন। এমনকি কোথাও কোথাও আমাদের মতো হাদিসপন্থীদের দৃষ্টিতে এমনও মনে হয় যে, লেখকের সাথে হাদিস বিরোধীদের অতি সামান্যই দূরত্ব বজায় রয়েছে। আবার কোথাও কোথাও তাকে হাদিস বিরোধীদের অস্ত্র ধার করে হাদিসপন্থীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেও দেখা যায়। তার যে উক্তিগুলোর আপনি উদ্ধৃতি দিয়েছেন তাতেই দেখা যায়, তিনি সূচনা করেছেন এই বলে যে, রসূল সা.-এর সকল কার্যকলাপ ও কথাবার্তা ওহীর সাথে সামঞ্জস্যশীল, কিন্তু অবিকল ওহী নয়। তবে তার অল্প কিছু অংশ ইল্‌হাম। (অবচেতনভাবে অন্তরে আবির্ভূত ঐশী আভাস ইঙ্গিত, ধ্যান-ধারণা বা প্রজ্ঞা, যা নবীদের বেলায় ওহীর পর্যায়ভুক্ত-অনুবাদক) কিন্তু আলোচনার সমাপ্তি টানেন এই বলে যে, বড়জোর দু'তিনটি ক্ষেত্রে রসূলের হাদিসের ইল্‌হামভিত্তিক বলে মেনে নেয়া যেতে পারে। তবে যেহেতু প্রেক্ষাপটটি পরিবর্তনশীল, তাই নবীর আমলের অনেক ব্যাপার অন্য যুগে রদবদলের যোগ্যও হতে পারে।

বুখারি ও মুসলিম শরিফের তায়াম্মুম সংক্রান্ত হাদিস প্রসঙ্গে যে বক্তব্য বিশ্লেষণ বইটিতে লিপিবদ্ধ হয়েছে তাও পড়ে দেখার সুযোগ পেয়েছি। আমি নিদারুণভাবে বিস্মিত ও বেদনাহত হয়েছি এই ভেবে যে লেখক নিজে বিভ্রান্তির শিকার হয়েছেন হোন, তা বলে অন্যকেও বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হলেন কেন, আর কিছুমাত্র চিন্তাভাবনা ও বিচারবিবেচনা ছাড়াই সাহাবা ও হাদিসবেত্তাগণ সমেত সকল আধুনিক ও প্রাচীন মনীষীকে উপহাস ও ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করার ঔদ্ধত্য কিভাবে দেখালেন?

এ বিষয়ে প্রকৃত তথ্য হলো, গোসল ও তায়াম্মুম সংক্রান্ত আলোচনা কুরআনে দু'জায়গায় এসেছে। একটি সূরা আন নেসায়, অপরটি সূরা মায়েদায়। যথা :
---------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
"হে ঈমানদারগণ! নেশাগ্রস্ত অবস্থায় নামাযের ধারে কাছে যেয়ো না, যতোক্ষণ না মুখে কি বলছো টের পাও। প্রবাসে থাকা অবস্থায় ছাড়া বীর্যপাতজনিত অপবিত্রতা নিয়েও নামাযের কাছে যেয়ো না যতোক্ষণ না গোসল করে নাও। তবে আমরা রুগ্ন ও সফররত থাকলে কিংবা পেশাব পায়খানা ও স্ত্রীর সাথে মেলামেশা করার পর পানি না পেলে তায়াম্মুম করে নিও।" [সূরা আন নিসা, আয়াত : ৪৩]
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
"আর যদি তোমরা বীর্যপাতজনিত কারণে অপবিত্র হয়ে থাক তবে পবিত্র হয়ে নাও। যদি রুগ্ন কিংবা সফররত থাক, অথবা যদি তোমাদের কেউ পেশাব পায়খানা কিংবা স্ত্রীর সাথে মেলামেশা করার পর পানি না পায়, তাহলে তায়াম্মুম করে নাও।" [সূরা আল মায়দা, আয়াত : ০৬]

উভয় স্থানে যেখানে, প্রথমে 'জুনুবান' (বীর্যপাতজনিত অপবিত্রাবস্থার) উল্লেখ রয়েছে সেখানে 'গোসল কর' বা 'পবিত্র হওয়া'র নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পরবর্তীকালে যেখানে পানি না পাওয়া যায়, সেখানে তায়াম্মুমের অনুমতি দেয়া হয়েছে, সেখানে ---------- (স্ত্রীর সাথে মেলামেশার) শব্দটি উল্লেখিত হয়েছে। এ শব্দটি যদিও প্রতীকী অর্থে সঙ্গম বুঝাতে ব্যবহৃত হতে পারে, তবে এর প্রত্যক্ষ অর্থ তা নয়। 'লাম্‌স' শব্দের আসল অর্থ যে 'স্পর্শ করা' তা অস্বীকার করা সম্ভব নয়। তাই এ আয়াতের মর্ম ও তাৎপর্য নিরূপণে সাহাবা, তাবেঈন ও মুজতাহিদ ইমামদের মধ্যে মতভেদ হয়েছে।------------- এর অর্থ কারো মতে স্ত্রীদেরকে নিছক স্পর্শ করা, কারো মতে কামভাব সহকারে স্পর্শ করা আবার কারো মতে সঙ্গম। সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে হযরত ওমর, হযরত ইবনে ওমর, হযরত ইবনে আব্বাস এবং হযরত ইবনে মাসউদের মতে এ আয়াতে সঙ্গম নয় শুধু স্পর্শ করার কথা বলা হয়েছে। এই মত গ্রহণ করেছেন ইমাম শাফেয়ী, ইমাম মালেক, ইমাম জুহরী, ইমাম নাখয়ী এবং আরো কয়েকজন ইমাম। পক্ষান্তরে হযরত আলী এবং আরো কয়েকজন সাহাবির মতে এখানে স্পর্শ দ্বারা সঙ্গমই বুঝানো হয়েছে। ইমাম আবু হানিফা ও অন্য কয়েকজন ফেকাহবিদ এই মতের অনুসারী। এখন আয়াতটিতে দু'রকম অর্থেরই অবকাশ যখন রয়েছে, তখন হযরত ওমর ও অন্য কতিপয় সাহাবি ---------- শব্দটিকে সঙ্গম অর্থে গ্রহণ না করলে তাদেরকে এ আয়াতের ভিত্তিতে দোষারোপ করা যায় কিভাবে? তারা যদি মনে করেন, এ আয়াত থেকে সঙ্গমজনিত অপবিত্রতা দূর করার জন্য তায়াম্মুমের বৈধতা প্রমাণিত হয়না, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কুরআনের বিরুদ্ধাচরণ বা কুরআন সম্পর্কে অজ্ঞতার মতো ভয়ংকর অভিযোগ আরোপ করা কিভাবে সমীচীন হয়? অনুরূপভাবে যে মনীষীগণ এই মতের অনুসারি, তাদের কাছে সঙ্গমজনিত অপবিত্রতা দূর করতে তায়াম্মুম জায়েয- এই মর্মে কোনো হাদিস যদি না পৌঁছে থাকে কিংবা  তারা তেমন কোনো হাদিসকে গ্রহণযোগ্য মনে না করে থাকেন, তাহলে সেজন্য তাদেরকে দোষারোপ করাই বা হবে কেন?

হযরত ওমরের উপর যেহেতু হযরত আম্মারের বর্ণিত হাদিস অগ্রাহ্য করার অভিযোগ তোলা হয়েছে, তাই এ হাদিসটির বিশদ বিবরণ দিচ্ছি।

আসল ব্যাপার হলো, সফরে থাকা অবস্থায় হযরত আম্মারের যখন গোসলের প্রয়োজন দেখা দিলো এবং পানি না পাওয়ায় কি করা যায় তা জিজ্ঞেস করলে রসূল সা. তাঁকে বললেন যে, তায়াম্মুম করলেই চলবে, কিন্তু হযরত ওমর এই সমগ্র ঘটনা ভুলে যান। এমনকি পরে হযরত আম্মার তাঁকে মনে করিয়ে দেয়া সত্ত্বেও তাঁর মনে পড়েনি। এখন বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, হযরত আম্মার যখন হযরত ওমরকে বললেন যে, এ ঘটনা আপনার সামনেই ঘটেছিলো, তখন হযরত ওমর হয়তো আরো অবাক হয়েছেন এবং ভেবেছেন যে, যে ঘটনায় তিনি নিজেও উপস্থিত ছিলেন, তা যদি হযরত আম্মারের মনে থেকে থাকে, তাহলে তিনি ভুলে যেতে পারলেন কিভাবে? সম্ভবত, এজন্যই তিনি হযরত আম্মারের কথা মেনে নিতে ইতস্তত করেছেন এবং নিজের এই মতে অটল থেকেছেন যে, তায়াম্মুম দ্বারা গোসলের কাজ হয়না এবং বীর্যপাতজনিত অপবিত্রতা থেকে গোসল ছাড়া পবিত্র হওয়া যায়না।

প্রশ্ন উঠতে পারে, হযরত ওমর যে হাদিস গ্রহণ করেননি তা অন্যেরা কিভাবে গ্রহণ করলো! এর দুটো জবাব রয়েছে। প্রথমত: হযরত ওমর স্বভাবতই মনে করে থাকতে পারেন যে, একই ঘটনাকে তিনি নিজে ভুলে যাবেন অথচ আম্মার ভুলবেননা, তা হতে পারেনা। কিন্তু হযরত আম্মারের বর্ণনাকে মেনে নেয়ার ব্যাপারে হযরত ওমরের সামনে যেসব মনস্তাত্ত্বিক বাঁধা ছিলো, অন্যদের সামনে তা থাকার কথা নয়। দ্বিতীয় জবাব এই যে, পানি না পাওয়া গেলে যে গোসলের পরিবর্তে তায়াম্মুম করা চলে সে মর্মে রসূল সা.-এর অনুমতি অন্য কয়েকজন সাহাবি থেকেও বর্ণিত হয়েছে। (উদাহরণস্বরূপ, বুখারি ও মুসলিম শরিফেই হযরত ইমরানের হাদিস দ্রষ্টব্য)। সুতরাং এটা অস্বাভাবিক নয় যে, হাদিসবেত্তাগণ যখন এ বিষয়ে বিভিন্ন সনদের হাদিস সংগ্রহ করেছেন, তখন তাদের দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছে যে, এ ব্যাপারে হযরত ওমর হয়তো মানসিক দুর্বলতাবশত বিস্মৃতির শিকার হয়েছেন। আসলে হযরত আম্মার ও অন্যান্য সাহাবির বর্ণনাই সঠিক।

পরিতাপের বিষয়, বুখারি ও মুসলিমের উল্লেখিত হাদিসের বিরুদ্ধে এতো সব আপত্তি উত্থাপন ও এমন আজগুবি ও উদ্ভট তত্ত্ব উদ্ভাবনের আগে কুরআনের সংশ্লিষ্ট আয়াতের শব্দগুলোর প্রতি যেমন খেয়াল করা হয়নি, তেমনি তাফসির, হাদিস ও ফেকাহর গ্রন্থাবলীতে এ বিষয়ের যে বিস্তৃত বিবরণ রয়েছে, তা পড়ে দেখার কষ্টটুকুও স্বীকার করা হয়নি। কেবল 'হুজ্জাতুল্লাহ' গ্রন্থের একটি উক্তি দেখেই লেখক টিটকারি উপহাস ও ব্যাঙ্গ বিদ্রুপের উদ্যম উচ্ছ্বাসে মেতে উঠেছেন এবং হযরত ওমর থেকে শুরু করে শাহ ওয়ালিউল্লাহ পর্যন্ত সকলেরই সমালোচনায় সোচ্চার হয়েছেন। কিন্তু ভাব দেখে মনে হয় তিনি হুজ্জাতুল্লাহ গ্রন্থখানিও পুরোপুরি পড়ে দেখেননি। নচেত এই গ্রন্থেই বলা হয়েছে যে, --------- এর অর্থ ও মর্ম নিয়ে মতভেদ রয়েছে। এই গ্রন্থে একথাও বলা হয়েছে যে, এ আয়াত হযরত ওমরের অজানা ছিলো না। বরং তিনি এর শাব্দিক অর্থের উপরই নির্ভর করেছেন। হুজ্জাতুল্লাহ প্রথম খণ্ডের তায়াম্মুম সংক্রান্ত অধ্যায়ে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে :
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
"হযরত ওমর ও হযরত ইবনে মাসউদ রা. বীর্যপাতজনিত অপবিত্রতা থেকে পবিত্র হবার জন্য তায়াম্মুমকে যথেষ্ট মনে করতেন না। তারা এ সংক্রান্ত আয়াতের --------- শব্দটিকে নিছক স্পর্শ অর্থেই গ্রহণ করতেন। তবে এ দ্বারা তারা নারীকে স্পর্শ করতেই ওজু ভেঙ্গে যায় মনে করতেন।"

ভাবতে অবাক লাগে, ইসলামি বিধান সংক্রান্ত জ্ঞান অর্জন ও তত্ত্বানুসন্ধানের দায়িত্ব পালনে যারা এমন দু:খজনক শৈথিল্যে আক্রান্ত, তারা আবার 'সুন্নাহর আইনগত মর্যাদা' নিরূপণের কাজেও আত্মনিয়োগ করে। [তরজমানুল কুরআন, জানুয়ারি ১৯৫৯]


<h1>৮। সাহরির শেষ সময় কোনটি?</h1>
প্রশ্ন: কিছু লোক অভিযোগ করে বেড়াচ্ছে মাওলানা মওদূদী রা. সাহরির শেষ সময় সম্পর্কে যে মতামত দিয়েছেন, তা কুরআন হাদিসের বক্তব্যের খেলাফ। বলা হয়, তিনি একটি হাদিসের আলোকে আযানের পরও কিছু পানাহার করে নেয়াকে বৈধ বলেছেন। কিন্তু শাহ ওয়ালীউল্লাহ এই হাদিসে উল্লেখিত আযানকে বেলালের রা. আযান বলেআযানের পরও কিছু পানাহার করে নেয়াকে বৈধ বলেছেন। কিন্তু শাহ ওয়ালীউল্লাহ এই হাদিসে উল্লেখিত আযানকে বেলালের রা. আযান বলেছেন। তিনি ফজরের সময় হবার আগে রাত থাকতেই আযান দিতেন। বিষয়টির সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দেয়া প্রয়োজন।

জবাব : আসলে এ বিষয়ে যারা অভিযোগ করেছেন, তাদের অভিযোগ মূলত তাফহিমুল কুরআন সূরা আল বাকারা ১৯৪ টীকার নিম্নোক্ত বাক্যগুলো সম্পর্কে :

"আজকাল লোকেরা সাহরি ও ইফতার উভয় ব্যাপারে অত্যাধিক সতর্কতার কারণে কিছু অযথা কড়াকড়ি শুরু করেছে। কিন্তু শরিয়ত এ দু'টি সময়ের এমন কোনো সীমানা নির্ধারণ করে দেয়নি যে, তা থেকে কয়েক সেকেণ্ড বা কয়েক মিনিট এদিক ওদিক হয়ে গেলে রোযা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। প্রভাতকালে রাত্রির বুক চিরে সাদা রেখা ফুটে উঠার মধ্যে যথেষ্ট সময়ের অবকাশ রয়েছে। ঠিক প্রভাতের উদয়মুহূর্তে যদি কোনো ব্যক্তির ঘুম ভাঙ্গে তাহলে সঙ্গতভাবেই সে উঠে তাড়াহুড়া করে কিছু পানাহার করে নিতে পারে। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রসূলুল্লাহ সা. বলেছেন : যদি তোমাদের কেউ সাহরি খাচ্ছে এমন সময় আযানের আওয়াজ কানে এসে গিয়ে থাকে, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে সে যেন আহার ছেড়ে না দেয়, বরং সে যেনো পেট ভরে পানাহার করে নেয়।"

এ বাক্য কয়টির উপরই বিভিন্ন অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে। অভিযোগসমূহের সারকথা হলো, এ বাক্যগুলোতে যে বক্তব্য দেয়া হয়েছে, তা এই আয়াতাংশের সাথে সাংঘার্ষিক: "আর পানাহার করো, যতোক্ষণ না রাত্রির কালো রেখার বুক চিরে প্রভাতের সাদা রেখা পরিষ্কার দৃষ্টিগোচর হয়।" (সূরা আল বাকারাহ, আয়াত: ১৮৭) আর উপরোল্লেখিত হাদিসে মূলত বেলালের রা. আযানের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। তিনি প্রভাত শুরু হবার অনেক আগে লোকদেরকে সাহরির জন্যে উঠাতে আযান দিতেন।

রাতের কালো রেখার বুক চিরে প্রভাতের সাদা রেখা পরিষ্কার হয়ে না উঠা পর্যন্ত পানাহার করা যে জায়েয, কুরআন মজিদের এ বক্তব্য সম্পর্কে কোনো মুসলমানই অজ্ঞাত নয়। কিন্তু সন্ধ্যার লাল রেখার মতোই সাহরির শেষ সময় সম্পর্কে প্রাচীন আলিমগণের মধ্যে বিভিন্ন মতের লোক ছিলেন। তাঁদের মতামতসমূহ প্রসিদ্ধ এবং অধিকাংশ কিতাবে লিপিবদ্ধ আছে।

তাঁদের কারো মতে প্রভাতের একেবারে প্রাথমিক রেখা সূচিত হবার সাথে সাথেই পানাহার নিষিদ্ধ হয়ে যায়। আবার কেউ মনে করেন, প্রভাতের সাদা রেখা উজ্জ্বল হয়ে না উঠা পর্যন্ত পানাহারের অবকাশ থাকে। এই মতভেদ স্বয়ং হানাফি ফকীহগণের মধ্যেও রয়েছে। শাহ ওয়ালীউল্লাহ র. নিজেও তাঁর 'আল মুসাবভা' গ্রন্থে ফতোয়ায়ে আলমগীরীর সূত্রে লিখেছেন:

ফতোয়ায়ে আলমগীরীতে উল্লেখ হয়েছে, (রোযার ব্যাপারে সাহরির শেষ সময়) প্রভাতের সূচনালগ্ন থেকে ধরা হবে, নাকি চতুর্দিকে আলোর আভা ছড়িয়ে পড়লে, এ বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। এর মধ্যে প্রথম মতটি সতর্কতামূলক আর দ্বিতীয় মতটি প্রশস্ত ও সহজ। অধিকাংশ ওলামা দ্বিতীয় মতের সমর্থক।

বিভিন্ন হাদিস থেকে দ্বিতীয় মতটির সমর্থন পাওয়া যায়। যেমন, সুনানে নাসায়ির 'সাহরি' অধ্যায়ে এই হাদিসটি বর্ণিত হয়েছে :

যায়িদ থেকে বর্ণিত। "আমরা হুযাইফা রা. কে জিজ্ঞেস করলাম, রসূলুল্লাহর সাথে আপনি কোন্‌ সময় খেতেন? তিনি বললেন : আমরা যখন সাহরি খেতাম, তখন দিনের আলো ছড়িয়ে পড়তো, কেবল সূর্য উঠার বাকি থাকতো।"

আবু দাউদের সেই হাদিসটির কথাই ধরুন, যেটি তাফহিমুল কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে। হাদিসটির বিভিন্ন ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন, এই হাদিসে বর্ণিত আযানের অর্থ মাগরিবের আযান। কেউ কেউ বলেছেন, ফজর সূচনার আযান। কিন্তু হাদিসটিতে পানাহার বিষয়ক যে আলোচনা হয়েছে, তা কেবল তখনই অর্থবহ হতে পারে, যখন রোযাদারের নিজের ভোর হয়ে গেছে বলে একিন না হবে। তা না হলে এ প্রসঙ্গে এ হাদিস অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়।

শাহ ওয়ালীউল্লাহ তাঁর হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগায় যে ব্যাখ্যা করেছেন, সেটা হাদিসের আরেকটি ব্যাখ্যা। তার বিবরণ হলো : রমযানে হযরত বেলাল লোকদের ঘুম থেকে উঠানোর জন্য একটি আযান দিতেন প্রভাত সূচনার পূর্বে আর প্রভাত সূচনার সময় আরেকটি আযান দিতেন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম রা. শাহ ওয়ালীউল্লাহর রা. বক্তব্য হলো, আবু দাউদের হাদিসে যে আযানের পর পানাহারের অনুমতি দেয়া হয়েছে, সেটি বেলালের রা. এই আযান বা প্রভাত হবার পূর্বেই তিনি রাত থাকতে দিতেন।

শাহ্‌ সাহেবের ব্যাখ্যার ব্যাপারে কেউ যেনো এই ভ্রান্তিতে নিমজ্জিত না হন যে, তিনি যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন সেটাই একমাত্র সঠিক ব্যাখ্যা, অথবা সেটাই অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য ব্যাখ্যা, কিংবা সেই ব্যাখ্যার সপক্ষে কোনো মজবুত সমর্থন আছে।

আসল ব্যাপার 'মুযালিমুস্‌ সুনান' এবং 'মিরকাত' প্রভৃতি গ্রন্থে উপরোক্ত তিনটি ব্যাখ্যাই বর্তমান আছে। কিন্তু সবগুলো মতই 'বলা হয়েছে' অথবা 'এরূপ হতে পারে' এর সাথে বলা হয়েছে। কোনো একটি মতকেও অকাট্যভাবে এবং আস্থার সাথে গ্রহণ করা হয়নি। প্রকৃতপক্ষে, এইসব ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ কিছু না কিছু সন্দেহ সংশয় থেকে মুক্ত নয়। পক্ষান্তরে এইসব ব্যাখ্যার পরিবর্তে মাওলানা মওদূদী যে সরল সোজা ব্যাখ্যা করেছেন, তা কেবল সন্দেহ সংশয় থেকেই মুক্ত নয়, বরঞ্চ অপর একটি হাদিস সরাসরি এ ব্যাখ্যাকে সমর্থন করে। সে হাদিসটি ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল মুসনাদে আবু হুরাইরায় বিশুদ্ধ এবং মুত্তাসিল সনদের সাথে উদ্ধৃত করেছেন। হাদিসটি নিম্নরূপ :

"তোমাদের কেউ যখন (সাহরি) খাবার অবস্থায় আযান শুনে, তখন সে যেনো খাবার শেষ না করে বরতন (প্লেট) রেখে না দেয়। মুয়াযযিন এই আযান তখন দিতো যখন প্রভাত সূচিত হয়ে যেতো।"

আবু দাউদ এবং মুসনাদে আহমদের এই দু্'টি হাদিসেরই রাবী হলেন আবু হুরাইয়া রা. উভয় হাদিসই একই শিরোনামের অধিনে বর্ণিত হয়েছে। এ থেকে পরিষ্কার বুঝা যায়, শেষোক্ত হাদিসটি প্রথমোক্ত হাদিসটির ব্যাখ্যা বর্ণনা করছে। এ শেষোক্ত হাদিসটির বিবরণ থেকে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হলো যে, হাদিসে যে আযানের সময় পানাহার শেষ করার কথা আলোচিত হয়েছে, তা রাতের আযান নয়, বরং প্রভাত সূচনার আযান। সে আযান দিতেন সাধারণত ইবনে উম্মে মাকতুম রা. এখানে একথাও প্রমাণ হলো যে, মাওলানা মওদূদীর এই বক্তব্য হুবুহু হাদিসের অনুরূপ যে : "ঠিক প্রভাতের উদয় মুহূত্বে যদি কোনো ব্যাক্তির ঘুম ভাঙ্গে তাহলে সঙ্গতভাবেই সে উঠে তাড়াহুড়া করে কিছু পানাহার করে নিতে পারে।" এটা আল্লাহর এবং তাঁর রসূলের পক্ষ থেকে একটি সহজতর বিধান। আল্লাহর কোনো বান্দাহ যদি এর সুবিধা গ্রহণ করে, তবে অপর কারো থলে থেকে কিছু কমে যায় না। সুতরাং এ ব্যাপারে মনে সংকীর্ণতা বোধ করার কি প্রয়োজন আছে?

এবার দেখা যাক, কোনো কোনো বুযর্গ এখানে আযানের অর্থ যে বেলালের আযান করেছেন, তার হেতু কি? তাদের প্রতি শ্রদ্ধা অন্তরে রেখেই বলছি, তাঁদের এ ব্যাখ্যা কিছুতেই আমরা গ্রহণ করতে পারিনা। কারণ বেলাল তা লোকদেরকে সাহরি খাবার জন্যে উঠাতেই আযান দিতেন। সুতরাং তাঁর আযানের সময় খাবার অবস্থায় থাকা এবং আযান শুনে তাড়াহুড়া করে খেয়ে নেয়ার অনুমতি একেবারেই অবান্তর। তাঁর আযানের পর ঘুম থেকে উঠে তো লোকেরা ধীরে সুস্থে সাহরি খেতো। তাড়াহুড়া করে কিছু খেয়ে নেবার অনুমতির প্রশ্ন তো কেবল তখনই সৃষ্টি হতে পারে যখন দ্বিতীয় আযানের সময় কারো ঘুম ভাঙ্গবে, কিংবা এটা ঐ ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে যে খুব দেরিতে সাহরি খেতে শুরু করেছে এবং তার খাবার শেষ না হতেই দ্বিতীয় আযান পড়েছে। [তরজমানুল কুরআন, ডিসেম্বর ১৯৬২]


<h1>৯। একটি হাদিস থেকে সুদের বৈধতা প্রমাণের অপচেষ্টা</h1>
প্রশ্ন : সরকার যে প্রভিডেন্ট ফান্ড কেটে রাখে, সংশ্লিষ্ট কর্মচারীকে ঐ ফান্ড থেকে সুদ গ্রহণ করা ও না করার এখতিয়ার দেয়া হয়। সেভিং সার্টিফিকেটের ব্যাপারেও তদ্রুপ। জনৈক আলেম আমাকে বলেছেন, সরকার যদি নিজের পক্ষ থেকে কিছু দিতে চায়, চাই তা সুদের নামে হোক বা অন্য কোনো নামে হোক এবং তার হার নির্ধারিত হোক বা না হোক, তা গ্রহণ করা জায়েয। এটা সুদ নয়। তিনি একটা হাদিসের উল্লেখ করেছেন যে, রসূল সা. এক যুদ্ধের সময় প্রতিটি উটের বদলায় দুটো করে উট দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এ ঘটনা থেকে নাকি ইজতিহাদ করা চলে যে, সরকার ইচ্ছে করলে প্রয়োজনের সময় নিজের পক্ষ থেকে কিছু বাড়তি টাকা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে জনগণের কাছ থেকে টাকা ধার নিতে পারে। এভাবে যে বাড়তি টাকা দেয়া হয়, তা জায়েয। প্রমাণ চাইলে তিনি বুলুগুল মুরাম গ্রন্থের কিতাবুল বুয়ূ (ক্রয়-বিক্রয় অধ্যায়) এর একটি হাদিসের উল্লেখ করেন। হাদিসটি হলো, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আ'স বর্ণনা করেন যে :
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
অনুগ্রহপূর্বক উক্ত আলেম এই হাদিস থেকে যেভাবে যুক্তি প্রদর্শন করেছেন, সে সম্পর্কে আলোকপাত করুন। উল্লেখিত মাসয়ালাটি সঠিক কিনা জানাবেন।

জবাব : আপনার উদ্ধৃত হাদিস দ্বারা যদি কোনো আলেম অনুরূপ যুক্তি প্রদর্শন করে থাকেন, যা আপনার প্রশ্নে উল্লেখ করেছেন, তাহলে তার সাথে একমত হওয়া সম্ভব নয়। তার যুক্তিতর্ক একাধিক ত্রুটি ও ভুল বুঝাবুঝিতে পরিপূর্ণ। সতর্কভাবে হাদিসটির শাব্দিক অনুবাদ করলে এ রকম দাঁড়ায় :

"হযরত আমর ইবনে আ'স থেকে বর্ণিত, রসূল সা. তাঁকে একটা যুদ্ধের জন্য যাবতীয় সাজসরঞ্জাম তৈরির নির্দেশ দেন। অত:পর উট শেষ হয়ে গেলে রসূল সা. যাকাতের উষ্ট্রীসমূহের বিনিময়ে উট সংগ্রহ করতে বলেন। অত:পর আমি দুই উটের বিনিময়ে একটা উট নিচ্ছিলাম যতোক্ষণ না যাকাতের উট আদায় হয়ে যায়।"

এখানে প্রথম যে ব্যাপারটি লক্ষ্যণীয়, তা হলো, এক উটের বদলে দুই উট পাওয়া যাবে-এই মর্মে কোনো শর্ত স্বয়ং রসূল সা. আরোপ বা গ্রহণ করেছেন বলে এ হাদিস থেকে প্রমাণিত হয়না। এটা হযরত আমর ইবনুল আ'সের নিজস্ব উক্তি। রসূল সা, তাঁর এ কার্যক্রমের কথা জানতেন কিনা এবং তিনি বহাল রেখেছেন কিনা, সে সম্পর্কে এতে কোনো সুস্পষ্ট বর্ণনা নেই। এমনকি স্বয়ং হযরত আমর যাকাতের উট সংগৃহীত হবার পর এক উটের বদলে দুই উট দিয়েছিলেন কিনা সে কথাও স্পষ্ট নয়।

দ্বিতীয়ত: রেওয়ায়েতটির ভাষা থেকে সুস্পষ্টভাবে এ কথাও জানা যায়না যে, এ ঘটনটা ক্রয় বিক্রয় সংক্রান্ত ছিলো, না ঋণ সংক্রান্ত। টীকাকারদের কেউ কেউ এটাকে ক্রয় বিক্রয় অর্থে গ্রহণ করেছেন এবং কেউ কেউ গ্রহণ করেছেন ঋণ অর্থে। অর্থাৎ কারো ধারণা, উটগুলোকে কিনে নেয়া হয়েছিলো এবং তার দাম হিসেবে অন্য উট দেয়ার কথা ছিলো। আর অন্যদের মতে উটগুলো ঋণ হিসেবে নেয়া হয়েছিলো।

'বুলুগুল মুরাম'-এর গ্রন্থকার এ হাদিসকে হাকেম ও বায়হাকীর বরাতে উদ্ধৃত করে এর বর্ণনাকারীদের বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য বলে আখ্যায়িত করেছেন, সে কথা সত্য, তবে ইমাম বায়হাকী ও ইমাম হাকেমের বর্ণিত প্রত্যেক হাদিস এমন নয় যে, একটা সাধারণ বিশ্বস্ততার সার্টিফিকেটের উপর নির্ভর করেই তা নির্দ্বিধায় গ্রহণ করা যায়। বিশেষত, যখন তার মূল ভাষ্যে জটিলতা ও অস্পষ্টতা বিদ্যমান এবং তার প্রতিপাদ্য বিষয় বিপুল সংখ্যক বিশ্বস্ত হাদিসের পরিপন্থী। বুলগুল মুরামের বিশিষ্ট টীকাকার নওয়াব সিদ্দীক হাসান খান স্বীয় গ্রন্থ 'মিসকুল খিতামে' এই হাদিসকে দুর্বল প্রতিপন্নকারী একাধিক মনীষীর উক্তি উদ্ধৃত করেছেন এবং নিজের অভিমত নিম্নরূপ ব্যক্ত করেছেন :

"আমার মতে এ হাদিসের দুর্বলতার কারণ, এর বর্ণনাকারীদের মধ্যে মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক রয়েছেন, যিনি বিতর্কিত।"

তাছাড়া এ হাদিসে কোন্‌ যুদ্ধের কথা বল হয়েছে, তা যেমন হাদিসটির মূল ভাষ্য থেকে জানা যায়না, তেমনি টীকাকারদের বক্তব্য থেকেও তার সন্ধান মেলেনা। সুদ ও তদসংশ্লিষ্ট বিষয়টি সংক্রান্ত বিস্তৃত ও চূড়ান্ত বিধিমালা নবুওয়াতের শেষদিকে প্রবর্তিত হয়েছিলো। হয়তো বা এ ঘটনা তার আগেকার। তা যদি হয়ে থাকে তা হলে এ ধরনের লেনদেন বাতিল বলেই সাব্যস্ত হবার কথা।

এ প্রসঙ্গে সর্বশেষ ও সবচাইতে লক্ষণীয় কথা এই যে, এ হাদিস জীবজন্তুর লেনদেন ও বিনিময় সংক্রান্ত। আর এ ব্যাপারটা নগদ টাকাকড়ি ও জিনিসপত্রের লেনদেন থেকে একেবারেই আলাদা। গাবাদিপশুর কোনো নির্ধারিত বাজার দর বা রেট নেই। এগুলোকে মাপা ও ওজন করা যায়না এবং বয়স প্রজাতি কর্মক্ষমতা উপকারিতার বিচারে একই শ্রেণীর এক জানোয়ারের সাথে আরেক জানোয়ারের অনেক পার্থক্য থাকে। এজন্য বিশেষভাবে জীবজন্তুর ক্ষেত্রে শরিয়তের বিধি তেমন কড়া ও চূড়ান্ত নয়। এ কারণেই ফেকাহবিদ ও হাদিসবেত্তাদের এ বিষয়ে বিস্তর মতান্তর ঘটেছে যে, যখন নগদে অথবা বাকিতে জীবজন্তুর বিনময় করা হবে, অথবা জীবজন্তু ঋণ হিসেবে দিয়ে জীবজন্তুই ফেরত নেয়া হবে, তখন সেক্ষেত্রে কমবেশি করা জায়েয কিনা। কারো কারো মতে, জীবজন্তর বয়স ও সংখ্যা ইত্যাদির দিক দিয়ে কমবেশি করলেও ব্যাপারটা যদি বেচাকেনা সংক্রান্ত হয় ও নগদ বিনিময় হয়, তাহলে সেটা জায়েয। কিন্তু জীবজন্তুর বিনিময়ে জীবজন্তুর ঋণের আদান প্রদান জায়েয নেই। এ মতের পক্ষে একটি হাদিস বুলুগুল মুরামের এই অধ্যায়েই রয়েছে :
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
"হযরত সামুরা বিন জুনদুব থেকে বর্ণিত, রসূল সা. জীবজন্তুর বিনিময়ে জীবজন্তুর বাকি বেচাবেকা নিষিদ্ধ করেছেন।"

এই মতেরই অনুসারিদের দৃষ্টিতে হযরত আমর ইবনুল আ'সের বর্ণিত হাদিস দলিল হিসেবে গ্রহণযোগ্য হতে পারেনা। কেননা জীবজন্তুর বিনিময়ে জীবজন্তুর বাকি কেনাবেচা যদি নিষিদ্ধ হয়ে থাকে, তাহলে জীবজন্তুর ঋণ হিসেবে দিয়ে পরে আবার জীবজন্তুর আদায় করা কিভাবে জায়েয হয়?

কোনো কোনো ফেকাহবিদ জীবজন্তুর বিনিময় আদৌ জায়েয মনে করেননা। চাই তা নগদে হোক বা বাকিতে হোক, কিংবা লেনদেনটা ঋণের হোক বা কেনাবেচার হোক।

কিন্তু আপনার ও উক্ত আলেম সাহেবের যিনি, প্রভিডেন্ট ফান্ড ও সেভিং সার্টিফিকেট (অথবা অন্যান্য ঋণ) এর ক্ষেত্রে সুদকে নিছক একটি দুর্বল হাদিসের ভিত্তিতে হালাল করার চেষ্টা চালিয়েছেন- উভয়েরই এ কথা পুনরায় ভালোভাবে বুঝে নেয়া উচিত যে, বিনিময়ে কমবেশি করা জায়েয কি নাজায়েয, তা নিয়ে যে মতভেদের কথা একটু আগেই উল্লেখ করা হলো, সেটা সোনারূপা বা টাকাকড়ির সাথে আদৌ সংশ্লিষ্ট নয়। ওটার সম্পর্ক শুধুমাত্র জীবজন্তু কিংবা অন্য কিছু দ্রব্যাদির সাথে। নচেত ১৪০০ বছরব্যাপী প্রাচীন ও আধুনিক মুসলিম আলেমদের সকলে এ ব্যাপারে পূর্ণ একমত যে, টাকা পয়সার নগদ অথবা ঋণ আদান-প্রদানে বাড়তি প্রদানের অগ্রিম শর্ত আরোপ করা নি:সন্দেহে সুদ এবং অকাট্যভাবে হারাম। এই সর্বসম্মত নীতির ভিত্তি কুরআন ও সুন্নাহর দ্ব্যর্থহীন ও চিরন্তন ঘোষণার উপর প্রতিষ্ঠিত। দুর্বল অস্ত্র দিয়ে এই ভিত্তিকে বিধ্বত্ব বা নড়বড়ে করার সাধ্য কারো নেই। [তরজমানুল কুরআন, আগস্ট ১৯৬৩]


<h1>১০। মুসলিম উম্মাহর বহু গোষ্ঠিতে বিভক্তি এবং মুক্তি লাভকারি গোষ্ঠি</h1>
প্রশ্ন : একটি হাদিসে আছে, মুসলিম উম্মাহ বাহাত্তর গোষ্ঠিতে বিভক্ত হবে, তন্মধ্যে একটি মাত্র গোষ্ঠি বা ফের্কা পরকালে মুক্তি লাভ করবে। আর বাদ বাকি সকল গোষ্ঠি হবে দোযখবাসি। আমি এই হাদিসটি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানতে ইচ্ছুক। এ হাদিসটি কি সহীহ ও  প্রামাণ্য, না দুর্বল ও মনগড়া? যদি হাদিসটি সহীহ হয় তাহলে মুক্তি লাভকারী ফের্কা কোন্‌টি? সেই ফের্কাটি ছাড়া সকল ফের্কা কি স্থায়ীভাবে বা সাময়িকভাবে দোযখে যাবে? বাহ্যত এ ব্যাপারটা বড়ই উদ্বেগজনক ও ভয়াবহ যে, উম্মতের বেশিরভাগ লোকই আগুনের শাস্তি থেকে নিস্তার পাবেনা এবং দোযখের যোগ্য হবে।

জবাব : মুসলিম উম্মাহর বহুধা বিভক্তির ব্যাপারে যে হাদিস সম্পর্কে আপনি জানতে চেয়েছেন, ওটা সহীহ বুখারি ও সহীহ মুসলিমে নেই। তবে আবু দাউদ, তিরমিযী ও ইবনে মাজাতে আছে। আবু দাউদের 'কিতাবুস সুন্নাহ' (সুন্নাহ সংক্রান্ত অধ্যায়) তে বর্ণিত একটি হাদিসের ভাষা নিম্নরূপ:
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
অন্য একটি বর্ণনায় নিম্নের কথাটি সংযোজিত হয়েছে :
-----------------------------------------------------------------------
এর অনুবাদ হলো, "ইহুদী ও খৃষ্টানদের মধ্যে à§­à§§ বা ৭২ ফের্কা জন্মেছে। আর আমার উম্মাতের ৭৩টি ফের্কা জন্ম নেবে, তন্মধ্যে ৭২টি ফের্কা দোযখে যাবে আর একটি ফের্কা বেহেশতে যাবে। বেহেশতে যে ফের্কাটি যাবে সেটি হলো 'আল-জামায়াত' তিরমিযীর হাদিসে আল জামায়াত শব্দটির পরিবর্তে ------------- কথাটি রয়েছ্‌ অর্থাৎ আমি ও আমার সাহাবিগণ যে আদর্শের অনুসারি।"

ইমাম তিরমিযী এ হাদিসকে 'হাসান গরিব' বলে আখ্যায়িত করেছেন, যার তাৎপর্য হলো এটি পুরোপুরি সহীহর পর্যায়ে পড়েনা। কারণ এ হাদিস একজন একক বর্ণনাকারীর সূত্রে প্রাপ্ত। তথাপি অন্যান্য শর্তাবলীর বিচারে হাদিসটি মোটামুটি নির্ভরযোগ্য এবং এর সম্পর্কে ভালো ধারণা পোষণ করা চলে। হাদিস শাস্ত্রবিদগণ কর্তৃক কোনো হাদিসকে 'সহীহ নয়' বলে মন্তব্য করা একটা বিশেষ পারিভাষিক ও কৌশলগত তাৎপর্য বহন করে। এর দ্বারা শুধু এতোটুকুই বুঝায় যে, হাদিসটির সনদ বা বর্ণনাসূত্র বিশুদ্ধতার সর্বোচ্চ মানে উত্তীর্ণ নয়। কিন্তু এতে হাদিসটি দুর্বল বা মনগড়া হতেই হবে তা বুঝায়না।

হাদিসটির মূল ভাষ্যের প্রথমাংশে কোনো জটিলতা নেই। কুরআন, হাদিস ও প্রচলিত আরবি বাকরীতিতে এরূপ অনেক দৃষ্টান্ত আছে যা দ্বারা বুঝা যায় যে, সত্তর বা তার সামান্য উচ্চতর সংখ্যা আসলে সংখ্যাধিক্য বুঝানোর জন্য প্রচলিত বাকধারা বা প্রচলন হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এর দ্বারা সুনির্দিষ্ট কোনো সংখ্যা বুঝায়না। রসূল সা.-এর বক্তব্যের মর্ম ছিলো এই যে, ইহুদী ও খৃষ্টানরা বহু ফের্কা ও গোষ্ঠিতে বিভক্ত হয়েছে। কিন্তু তোমরা মুসলিম জাতি তাদেরকেও হার মানাবে। বলাবাহুল্য, যে জাতি পৃথিবীর সর্বশেষ উম্মাহ এবং কেয়ামত পর্যন্ত যার বংশধর টিকে থাকবে, তাতে যদি পূর্বতন জাতিগুলোর চেয়ে কিছু বেশি ফের্কার আবির্ভাব ঘটে। তবে সেটা কোনো অসম্ভব বা বিস্ময়কর ব্যাপার নয়। তবে তার অর্থ এও নয় যে, প্রত্যেক যুগেই এতোগুলো ফের্কার অস্তিত্ব থাকবে। আসলে এর তাৎপর্য হলো, বিপুল সংখ্যক ফের্কার আবির্ভাব ও তীরোভাব ঘটতেই থাকবে।

হাদিসের দ্বিতীয় অংশ নিয়ে অবশ্য দুটো প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক। প্রথমত যে ফের্কার জন্য বেহেশ্‌তের সুসংবাদ দেয়া হয়েছে সেটি কোন্‌ ফের্কা? দ্বিতীয়ত উম্মাতে মুহম্মাদির অবশিষ্টাংশ যা বাহ্যত বিরাট অংশ, এ সুসংবাদের অধিকারী হবে না কেন? এ দুটো প্রশ্নের জবাব হলো, যে ফের্কাকে হাদিসে বেহেশ্‌তবাসী বলা হয়েছে, তা কোনো বিশেষ পরিচিত নামে আখ্যায়িত ও বর্তমানের বা অতীতের কোন্‌ যুগে বিদ্যমান তা কোনো বিশেষ ফের্কার ব্যাপারে একচেটিয়াভাবে প্রযোজ্য নয় এবং গুনমান নির্বিশেষে কোনো ফের্কার সকল সদস্যের জন্যও নয়। এসব ফের্কার কোনো একটি ফের্কাও স্বীয় যাবতীয় বৈশিষ্ট্য সহকারে রসূল সা. জীবদ্দশায় বিদ্যমান ছিলোনা। কেননা সেই সৌভাগ্যমণ্ডিত যুগে সেই সব রাজনৈতিক, চিন্তাগত ও ইজতিহাদ প্রসূত মতবিরোধের সূত্রপাতই হয়নি, যার দরুন পরবর্তীকালে রকমারি ফের্কা ও গোষ্ঠির উদ্ভব ঘটেছে। তাই সাহাবায়ে কেরাম এবং স্বয়ং রসূল সা. পূতপবিত্র সত্তা সম্পর্কেও এ কথা বলা যে, তাঁরাও একটি বিশেষ ফের্কার অন্তর্ভুক্ত ছিলেন, সম্পূর্ণ অসঙ্গত ও অনভিপ্রেত।

এ ব্যাপারে একেবারে নিরেট ও নিখুঁত সত্য তো একমাত্র আল্লাহই অবগত আছেন। তবে আমার ধারণা, মুক্তি লাভকারী এই গোষ্ঠিতে উম্মাতে মুহম্মাদীর সকল ফের্কা ও শ্রেণীর লোক অন্তর্ভুক্ত হবে এবং এটি কেয়ামতের দিনই গঠন করা হবে। এই জান্নাতবাসী গোষ্ঠির নির্দিষ্টি গুণ বৈশিষ্ট্য হাদিসে বর্ণনা করা হয়েছে। সেই গুণ বৈশিষ্ট্য হলো, যে মহান আদর্শ ও পদ্ধতিকে 'আল জামায়াত' নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে এবং যার কেয়ামত পর্যন্ত সগৌরবে ও বিজয়ীর বেশে টিকে থাকার ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে, এই গোষ্ঠির লোকেরা সেই 'আল জামায়াত' এর নীতি ও আদর্শের আনুগত্য ও অনুসরণে অটল থাকবে এবং তার প্রতিষ্ঠার ও স্থিতির জন্য সদা সচেষ্ট থাকবে। আল্লাহ তায়ালা স্বীয় নির্ভুল জ্ঞান ও ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে হাশরের দিন সমগ্র উম্মত থেকে বাছাই করে এই জান্নাতি গোষ্ঠি সংগঠিত করবেন। এই গোষ্ঠিতে আল্লাহর নবীগণ, নবীসহচরগণ, এই উম্মতের সকল নিষ্ঠাবান অনুসারি, সকল সত্যনিষ্ঠ ও নেককার বান্দা এবং উম্মাতের সংস্কার ও সংশোধনের কাজে নিয়োজিত সকল ব্যক্তি অন্তর্ভুক্ত হবে, চাই সে দু্নিয়াতে হানাফি, শাফেয়ী, আহলে হাদিস প্রভৃতি নামে আখ্যায়িত হোক কিংবা কোনো পরিচিত গোষ্ঠির অন্তর্ভুক্ত না হোক। প্রত্যেক মুমিনের এরূপ দোয়া করা উচিত যেনো আল্লাহ তাকে এই গোষ্ঠির মধ্যে শামিল হবার সৌভাগ্য দান করেন।

একাত্তর বা বাহাত্তর গোষ্ঠি দোযখে যাবে বলে সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকেরাই দোযখবাসী হবে মনে করা ঠিক নয়। মনে করুন, মুসলমানদের সংখাগুরু অংশ সত্যাশ্রয়ী হলে এবং অসংখ্য ছোট ছোট ফের্কা বাতিল ও গোমরাহীর ভিত্তিতে গড়তে ও ভাঙ্গতে থাকলে এইসব বাতিল সামগ্রিক লোকসংখ্যা সংখ্যাগুরু সত্যনিষ্ঠ গোষ্ঠির লোকসংখ্যার চেয়ে অনেক কম থাকবে। তাই কেবল ফের্কার সংখ্যা দেখে সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু সম্পর্কে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া স্পষ্টতই ভুল। কোটি কোটি মানুষের সত্যনিষ্ঠ দল যদি একদিকে থাকে, আর অনেকগুলো গোমরাহ ফের্কা-যার লোকসংখ্যা কয়েক লাখের বেশি নয়-অপরদিকে থাকে, তাহলে মুক্তিপ্রাপ্তরা যে সংখ্যালঘু নয় বরং সংখ্যাগরিষ্ঠ হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। [তরজমানুল কুরআন, আগস্ট ১৯৬৩]


<h1>১১। কালো খেজাব লাগানো কি বৈধ?-১</h1>
প্রশ্ন : শরয়ি দৃষ্টিকোন থেকে খেজাব বা অনুরূপ অন্যকিছু দ্বারা দাড়ি কিংবা মাথার চুল রং করা কি বৈধ? যদি বৈধ হয়ে থাকে তবে তার প্রমাণ কি? আর যদি নাজায়েয হয়ে থাকে, তবে তারই বা প্রমাণ কি? বিষয়টি নিয়ে আমাদের এখানে বেশ বাহাছ চলছে। কেউ বলছে। বৈধ। কেউ বলছে অবৈধ। এ বিষয়ে আপনার মতামত জানতে চাচ্ছি।

জবাব : আপনার প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত জবাব দিচ্ছি। দাড়ি বা চুলে কালো ছাড়া অন্য যে কোনো রং লাগানো বৈধ হবার ব্যাপারে উলামায়ে কিরামের মধ্যে ঐক্যমত্য রয়েছে। কারণ, এর বৈধতা সম্পর্কে রসূলুল্লাহ সা.-এর বক্তব্য রয়েছে। অবশ্য কালো রং এর খেজাব লাগানোর বিষয়ে বিভিন্ন মত রয়েছে।

খেজাব সম্পর্কে ইমাম মুসলিম প্রমুখ একটি সহীহ হাদিস বর্ণনা করেছেন। সে হাদিসে আবু বকর রা. এর পিতা আবু কোহাফা সম্পর্কে রসূলুল্লাহ সা.-এর এই কথাটি বর্ণিত হয়েছে যে, তার চুলে রং লাগাও, তবে কালো রং লাগাবেনা। খেজাব সংক্রান্ত এছাড়াও কয়েকটি হাদিস পাওয়া যায়। তবে সনদের দিক থেকে সেগুলোর মর্যাদা এই হাদিসটির সমতুল্য নয়। তাছাড়া সেগুলোর বক্তব্যেও বিরোধপূর্ণ। কোনোটিতে কালো খেজাব ব্যবহারকারীদের কঠিন শাস্তির কথা উল্লেখ হয়েছে। আবার কোনো কোনোটি থেকে কালো খেজাবের বৈধতার প্রমাণ পাওয়া যায়। [যেমন, ইবনে মাজহা'র পোশাক অধ্যায়ে উদ্ধৃত এ সংক্রান্ত হাদিসটি।]

মুসলিমের হাদিসটিতে যে কালো খেজাব লাগাতে নিষেধ করা হয়েছে, সেই নিষেধাজ্ঞাকে যদি মাক্‌রূহ্‌ তাহরীমীর পরিবর্তে মাক্‌রূহ্‌ তানযীহী ধরা হয়, তবে ইবনে মাজাহর হাদিসের সাথে সে হাদিসের আর কোনো বিরোধ থাকবেনা। এরূপ সামঞ্জস্য বিধানের সপক্ষে যুক্তি সহীহ মুসলিমেই পাওয়া যায়। তাহলো : চুল রং করার হুকুমটিও ওয়াজিব কিংবা তাকীদ নয়, বরং মুস্তাহাব বলেই প্রমাণ হয়। কারণ, তা না হলে চুল বা দাড়ি সাদা রাখাটাও মাক্‌রূহ্‌ তাহ্‌রীমীর পর্যায়ে পড়তে বাধ্য। অথচ কেউই এরূপ মত ব্যক্ত করেননি।

একদল ইমাম ও ফকীহ কালো খেজাবকে মাকরূহ তাহরীমী বলেছেন। কালো খেজাব ব্যবহার না করতে তাকীদ করেছেন। অপরদল কালো খেজাবকে মাকরূহ তানযীহী বলেছেন। এর ব্যবহার না করাকে অপরিহার্য মনে করেননি। বিখ্যাত মুহাদ্দিস ইমাম যুহরী কালো খেজাবের ব্যবহারকে জায়েয মনে করতেন। নিজেও ব্যবহার করতেন।

যাই হোক, কালো খেজাবের ব্যাপারে অতীতে আলিমগণের মধ্যে মতভেদ ছিলো। উভয়পক্ষের মতই দলিল প্রমাণ ও যুক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। তাই, এ ব্যাপারে কোনো একটি মতের ব্যাপারে কঠোরতা অবলম্বন না করাই ভালো। [তরজমানুল কুরআন, সেপ্টেম্বর ১৯৬৪]


<h1>১২। কালো খেজাব কি বৈধ?-২</h1>
প্রশ্ন : সেপ্টেম্বর ১৯৬৪ সালের 'তরজমানুল কুরআনে' খেজাবের বৈধতা অবৈধতা সম্পর্কে একটি প্রশ্নের জবাব দেয়া হয়েছে। কিন্তু এ বিষয়ে জটিলতা নিরসন হয়নি। হাদিসে কালো খেজাবের ব্যবহার নিষেধ থাকা সত্ত্বেও কেমন করে তা বৈধ হবার অবকাশ থাকতে পারে? হানাফি ফকীহ্‌গণ ও তা ব্যবহার করতে নিষেধ করেছেন। সহীহ হাদিসে চুল কালো করার বিপক্ষে নির্দেশ রয়েছে এবং মেহেদী লাগানোর সপক্ষে নির্দেশ রয়েছে। এ হাদিসের ভিত্তিতেই হযরত আবু বকরের রা. পিতাকে মেহেদী লাগানো হয়েছিলো। আমাদেরও হাদিসের উপরই আমল করা উচিত।

জবাব : খেজাব সংক্রান্ত হাদিসগুলোর মধ্যে নি:সন্দেহে সনদগত দিক থেকে সেটিই সহীহ হাদিস, যেটি মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে। হাদিসটি হলো, হযরত আবু কোহাফাকে যখন নবী করীম সা.-এর সম্মুখে আনা হলো, তখন তিনি তার সাদা দাড়ি দেখে বলেছিলেন : "গাইয়িরু হাযা বিশাইয়িন ওয়া জান্নিবুহুস সাওয়াদ" "তার চুল (দাড়ি) গুলোকে রং করে দাও। তবে কালে রং লাগাবেনা।"

এ হাদেসে মেহেন্দী লাগানোর কথা উল্লেখ নেই। অবশ্য অন্যান্য বর্ণনা থেকে জানা যায়, আবু কোহাফাকে রা. লাল খেজাব লাগানো হয়েছিলো।

ইবনে মাযাহর 'পোশাক অধ্যায়ে' বর্ণিত একটি হাদিসের বক্তব্য এর বিপরীত। তাতে বলা হয়েছে : "তোমরা যে খেজাব ব্যবহার করো তন্মধ্যে কালো রং সবচেয়ে সুন্দর।"

এ হাদিস কালো খেজাবের ব্যবহার বৈধ হবার প্রতি ইঙ্গিত করে। কিন্তু কোনো কোনো মুহাদ্দিস এ হাদিসটির সনদকে জয়ীফ বলেছেন। পূর্বে প্রকাশিত জবাবে আমি উভয় মতকেই অপরিহার্য ধরে নেয়ার পরিবর্তে তানযীহী বা মুস্তাহাব পর্যায়ে ধরে উভয় মতের সামঞ্জস্য বিধানের চেষ্টা করেছিলাম। মুসলিমের হাদিসে অবশ্যি কালো রং এর খেজাব ব্যবহার না করার নির্দেশ রয়েছে। কিন্তু আমি সেই নিষেধকে তাহরীমীর পরিবর্তে তানযীহী মনে করাকে অগ্রাধিকার দিয়েছি। কারণ এই নিষেধকে যদি অপরিহার্য (ফরয) পর্যায়ের ধরে নেয়া হয়, তবে সাদা চুল বা দাড়িতে খেজাব লাগানোর নির্দেশকেও অপরিহার্য ধরে নিতে হয় এবং সে অবস্থায় চুল বা দাড়ি সাদা রাখাও নিষেধ হয়ে পড়ে। অথচ কেউই এ ধরণের মত পোষণ করেননা। এমনটি কিছুতেই সঠিক হতে পারেনা। এ উদাহরণের ভিত্তিতে মুসলিমের হাদিসে কালো খেজাবের ব্যবহার সম্পর্কে যে নিষেধ এসেছে, সেটাকে অকাট্য নিষেধ (হারাম) মনে না করাই উচিত।

অতীত মুহাদ্দিসগণের কেউ কেউ এভাবেই এ বিষয়টির জটিলতা নিরসন করেছেন। ইমাম নববী সহীহ মুসলিমের উক্ত হাদিসের ব্যাখ্যায় তাবরানীর এ মতটি উল্লেখ করেছেন :
"এখানে নির্দেশ এবং নিষেধাজ্ঞার অপরিহার্যতা বুঝায় না। এটাই সর্বসম্মত মত। এ কারণেই এ বিষয়ে ভিন্নমত পোষণকারীর একে অপরের সমালোচনা করেননি।"

ইমাম নববী আরো বলেছেন, ইমাম যুহরী ছাড়াও অতীতের অনেক বুযুর্গই কালো খেজাব লাগিয়েছেন। যেমন আবু হুরাইয়া বা. উসমান রা. হাসান রা. হুসাইন রা. উকবা ইবনে আমের রা. ইবনে সীরান রা. এবং অন্যান্য বুযুর্গ। হানাফিগণের দৃষ্টিভঙ্গি নি:সন্দেহে নিষেধাজ্ঞার দিকে। কিন্তু তারা কোনো কোনো ক্ষেত্রে কালো খেজাবের ব্যবহার বৈধ হবার সপক্ষে ফতোয়া দিয়েছেন যেমন, সৈনিকদের জন্যে। অথচ অকাট্য হারাম জিনিস তো কেবল তখনই বৈধ হতে পারে, যখন তা অকাট্য দলিল দ্বারা অনুমতিপ্রাপ্ত হবে, কিংবা বাধ্য হবার পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে, অথবা সহজতরটি গ্রহণের প্রশ্ন দেখা দেবে। এ কারণে এ বিষয়ে হানাফি ফকীহগণের না জায়েযের দৃষ্টিভঙ্গি মাকরূহ তানযীহি পর্যায়ের বলেই প্রমাণিত হয়।

আপনি যদি কালো খেজাবের ব্যবহারকে নিষেধ বলে মনে করেন, তবে নিজে অবশ্যি সে অনুযায়ী আমল করুন। আমি নিজেও এটা ব্যবহার করিনা। প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করিনা। কিন্তু শরিয়ত যে বিষয়ে প্রশস্ত মতামতের অবকাশ রেখেছে, সে বিষয়ে অন্যদের মতকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা এবং তা নিয়ে ঝগড়া বিবাদ করা ঠিক নয়। [তরজমানুল কুরআন, জানুয়ারি ১৯৬৭]


<h1>১৩। তাকদীর প্রসঙ্গ</h1>
প্রশ্ন : জনৈক ব্যক্তি এক অদ্ভুত আপত্তি তুলেছে। তার বক্তব্য হলো, ধর্মীয় শিক্ষা অনুসারে প্রত্যেক মানুষের মৃত্যুর সময় নির্দিষ্ট রয়েছে। সেই সময়ের আগ-পাছ হওয়া কোনো প্রকারেই সম্ভব নয়। অথচ আমরা দেখতে পাই, পাশ্চাত্যের জাতিগুলো স্বাস্থ্য রক্ষার নীতিমালা মেনে চলা ও রোগ প্রতিরোধের মাধ্যমে নিজেদের গড় আয়ু বৃদ্ধি ও মৃত্যুর হার হ্রাস করে ফেলেছে। এর দ্বারা বুঝা যায়, আয়ু কমানো বাড়ানো যায় এবং মৃত্যুকে বিলম্বিত করা মানুষের আয়ত্বের ভেতরে। এই দুটো বক্তব্যের মধ্যে কোন্‌টি সঠিক জানাবেন। আয়ুষ্কালও মৃত্যুর সময় কি নির্দিষ্ট, তাতে রদবদল করার ক্ষমতা মানুষের আছে?

জবাব : আপনি যে প্রশ্ন করেছেন তা আসলে একটা বৃহৎ মৌলিক প্রশ্নের অংশবিশেষ। মৌলিক প্রশ্নটি হলো, আল্লাহর ইচ্ছা ও অদৃষ্টের অধীন মানুষ কতোখানি অক্ষম ও অসহায়, কোন্‌ সীমানা পর্যন্ত তাকে ইচ্ছা ও কর্মের স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে এবং চেষ্টার দ্বারা ইপ্সিত ফলাফল অর্জন করা কতোদুর তার ক্ষমতা ও সাধ্যের আওতাধীন? এ প্রশ্নটি এমন নয় যে, সংক্ষেপে ও অনায়াসে তার জবাব ইতিবাচক বা নেতিবাচক পন্থায় দেয়া যেতে পারে। জবাবে যদি বলা হয়, মানুষ নিজেই নিজের ভাগ্য গড়তে সক্ষম এবং কোনো উচ্চতর শক্তি তার কার্যকলাপ ও তার ফলাফলের উপর প্রভাবশালী ও আধিপত্যশীল নয়, তাহলে এ বক্তব্য হবে স্পষ্টতই ভ্রান্ত। মানুষ যখন নিজেকে সৃষ্টি করতে সক্ষম নয়, তখন তার কৃতকর্মের স্রষ্টা ও নিয়ন্তা সে কি করে হতে পারে? আবার যদি বলা হয়, সে একেবারেই অক্ষম ও অসহায় এবং তার কোনোই ক্ষমতা ও স্বাধীনতা নেই, তবে সে কথাও স্পষ্টতই অসত্য, বিবেক ও বাস্তব অভিজ্ঞতার পরিপন্থী এবং ইসলামি শিক্ষারও বিপরীত।

প্রকৃত সত্য এই উভয় প্রন্তিক বক্তব্যের মাঝখানে অবস্থিত। একটি নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় মানুষ সীমিত স্বাধীনতার অধিকারী এবং এ স্বাধীনতা মানুষ ও বিশ্বজগতের স্রষ্টারই দান। সেই গণ্ডির বাইরে যাওয়ামাত্র মানুষের সকল স্বাধীনতা বিলুপ্ত ও নি:শেষ হয়ে যায় এবং তার যাবতীয় কর্মতৎপরতা ও তার ফলাফল শেষ পর্যন্ত আল্লাহর ইচ্ছার অধীন হয়ে যায়। নিজের স্বাধীনতা ও অধীনতার সীমানা কতোদুর তা মাপার চেষ্টা করা এবং এই ক্ষমতা ও অক্ষমতার সমন্বয় কিভাবে করা যায় তা নিয়ে মাথাত ঘামানো মানুষের কর্তব্য নয়। মানুষ যতোক্ষণ আপন মানবীয় বলয়ে আবদ্ধ এবং যতোক্ষণ সে সৃষ্টির স্থলে স্রষ্টায় পরিণত হতে না পারছে, ততোক্ষণ সে এই জটিল সমস্যার গভীরতম প্রকোষ্ঠ ও নিগুঢ়তম সমাধানে উপনীত হতে সক্ষম নয়। তার কর্তব্য শুধু এতোটুকুই, যে সীমানা পর্যন্ত তাকে স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে, সেই সীমানার ভেতরে থেকে তার স্বাধীনতা স্বীয় স্রষ্টার ইচ্ছে ও অভিলাষ মোতাবেক প্রয়োগ করতে হবে। আর যে সীমারেখার ওপারে স্বাধীনতা নেই, সেখানে সে স্বাধীন ও স্বয়ম্ভর হবার দাবি করতে পারবেনা।

এই মৌলিক তত্ত্ব বুঝে নেয়ার পর আপনি আয়ুষ্কালের হ্রাস বৃদ্ধির বিষয়টা নিজেই ভেবে দেখুন। আল্লাহ কার মৃত্যুর জন্য কোন্‌ সময়টা নির্ধারণ করে রেখেছিলেন এবং একটা বিশেষ যুগে ও সময়ে কোনো বিশেষ জাতির জন্য কি হারে গড় আয়ু নির্ধারণ করেছিলেন, তা কে জানে? এটা যদি কারো জানা না-ই থাকে, তবে অমুক ব্যক্তি আল্লাহর নির্ধারিত সময়ে মরার হাত থেকে নিস্তার পেয়েছে, কিংবা সে নিজে বা অন্য কেউ তার আয়ু বাড়িয়ে দিয়েছে এমন দাবি করাটা আপনা থেকেই নিরর্থক হয়ে যায়। এসব আসলে কাণ্ডজ্ঞানহীন কথাবার্তা। অনেকে না বুঝেসুজেই এ ধরনের কথাবার্তা বলে থাকে। আল্লাহ আমাদেরকে যে জ্ঞানবুদ্ধি দিয়েছেন তা কাজে লাগিয়ে যতোদুর সম্ভব রোগ নিরাময় ও স্বাস্থ্য রক্ষার সর্বোত্তম উপায় উপকরণ সংগ্রহ করাই আমাদের একমাত্র করণীয়। সেটা সংগৃহীত হলে আল্লাহর শোকর করা কর্তব্য। এর চেয়ে বেশি কোনো কিছু আমাদের এখতিয়ারে নেই। তা যদি থাকতো, তাহলে আমরা কাউকে রোগে ভুগতেও দিতামনা, মরতেও দিতামনা। কিন্তু রোগ মৃত্যু সম্পূর্ণরূপে রোধ করা আদিম যুগের মানুষেরও সাধ্য ছিলোনা, আজকের কোনো মানুষের পক্ষেও সম্ভব নয়, তা সে যতোবড় চিকিৎসক বা বৈজ্ঞানিকই হোক না কেন। [তরজমানুল কুরআন, সেপ্টেম্বর ১৯৬৪]


<h1>১৪। গোমরাহী ও হেদায়েত</h1>
প্রশ্ন : সতের বছর বয়স থেকেই আপনার লেখা বইপুস্তক পড়তে শুরু করি। ১৯৫২ সাল নাগাদ প্রায় সকল বই কিনে পড়ে ফেলি। ১৯৫১ সালে করাচিতে জামায়াতের যে বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় তাতেও যোগদান করি। তারপর জামায়াতের সহযোগী সদস্য হয়ে যাই এবং যথাসাধ্য আল্লাহর হুকুম মেনে চলতে চেষ্টা করি।

কিন্তু ১৯৫৩ বা ১৯৫৪ সালে মাসিক পত্রিকার বর্ষপূর্তি সংখ্যা পড়ে এমন গোমরাহ হয়ে যাই যে, প্রায় কুফরির পর্যায়ে গিয়ে উপনীত হই। কয়েকবার আপনার পুস্তক তাফহীমাত (নির্বাচিত রচনাবলী) পড়া সত্ত্ব্বেও সংশয় দুর হয়নি। শেষ পর্যন্ত সকল ইসলামি বই পুস্তক ছেড়ে দেই।

১৯৬৫ সালের ডিসেম্বরে আপনার লেখা 'সুন্নাত কি আইনী হাইসিয়ত' (সুন্নাতে রসূলের আইনগত মর্যাদা) বইখানা হস্তগত হয়। ওটি পড়ার পর অনেক সন্দেহ সংশয় দুর হয়ে যায়। এখন আল্লাহর মেহেরবাণীতে ইসলামি বিধান অনুসরণ করার চেষ্টা শুরু করে দিয়েছি। এখন আমার জানতে ইচ্ছে করে :
১. জীবনের যে অংশটি আমি প্রথমে ইসলামি বিধান অনুসারে অতিবাহিত করেছি, আমি কি তার কোনো প্রতিদান পাবো, না কুফরিতে লিপ্ত হওয়ার কারণে তা বৃথা যাবে?
২. মানুষ যখন বিপদগামী হয়, তখন সময় সময় সদুদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়েও তেমনটি হয়ে থাকে। এমতাবস্থায় একজন সাধারণ মানুষ কিভাবে বুঝবে যে, সে সঠিক পথে আছে কি নেই? সত্য ও ন্যায়ের পথে অবিচল থাকার সঠিক পন্থা কি?
৩. ইসলামের কোনো কোনো বিষয় যদি বিবেক গ্রহণ না করে, তা হলে কি করা উচিত? আমরা ঈমান তো আনতে পারি এবং সে অনুসারে আমলও করতে পারি। কিন্তু মন যুদি তাতে সন্তুষ্ট ও পরিতৃপ্ত না হয় তাহলে কি করা যাবে?

জবাব : হাদিস অমান্য করার মতো কুফরি মতবাদের দিকে আকৃষ্ট হয়ে যাওয়ার পরও যে আল্লাহ আপনাকে সঠিক পথে ফিরে আসার সুযোগ দিয়েছেন, সে কথা জেনে খুবই খুশি হলাম। দোয়া করছি, যেনো আল্লাহ আপনাকে সত্য দীনের উপর অবিচল রাখেন এবং ভবিষ্যতে আর কখনো আপনি পদস্খলনের শিকার না হন। আপনার প্রশ্ন কয়টির সংক্ষিপ্ত জবাব নিম্নে দেয়া হলো :
১. আপনি যদি হাদিস অমান্য করার কুফরি মতবাদে বহাল থাকতেন তাহলে তো নি:সন্দেহে আপনার অতীত ইসলামি জীবনের যাবতীয কার্যকলাপ বৃথা হয়ে যেতো। কিন্তু এখন যেহেতু গোমরাহীর অবস্থাটা স্থায়ী হয়নি বরং আপনি ইসলামের দিকে ফিরে এসেছেন, তাই আল্লাহ আপনাকে পূর্ববর্তী সৎকর্মের পুরষ্কারও দেবেন। খোদার কুরআন থেকেই এ কথার প্রমাণ পাওয়া যায়। সূরা হাদিদের শেষাংশে একদল লোককে ঈমান আনার জন্য দ্বিগুণ পুরস্কার দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। কোনো কোনো তফসিরকারের মতে এ দলটি দ্বারা আহলে কিতাব তথা ইহুদী ও খুষ্টানদেরকে বুঝানো হয়েছে। তারা হযরত মুহাম্মদ সা.-এর নবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্ব পর্যন্ত তো মুসলমানই ছিলো। কিন্তু তাঁর নবুওয়ত ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে তার উপর ঈমান না আনায় তারা কাফের হয়ে যায়। এতদসত্ত্বেও আল্লাহ তাদেরকে সুসংবাদ দিয়েছেন যে, তোমরা যদি এখনও মুসলমান হয়ে যাও, তাহলে তোমরা প্রথমে যে ইসলামি জীবনযাপন করেছো, তার প্রতিদান বাতিল হবেনা। কতিপয় সহীহ হাদিস থেকেও জানা যায় যে, এ ধরনের আহলে কিতাব দ্বিগুণ পুরস্কার পাবে।

২. মানুষ যে কখনো কখনো সদুদ্দেশ্য নিয়েও গোমরাহীর পথে চলে যায় তা অস্বীকার করা যায়না। তবে এরূপ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মধ্যে তিনটি বৈশিষ্ট্য বজায় থাকলে সাধারণ স্বীয় গোমরাহী উপলব্ধি করতে তার বিলম্ব ঘটেনা। প্রথমত, নিজের চোখ কান ও মনমগজকে অর্গলবদ্ধ করে না রাখা, যাতে তার সামনে যা-ই আসুক সে যেনো তা খোলা চোখ ও মুক্ত মন নিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে পারে, চাই সে জিনিস তার রুচি ও মেজাজ মর্জির পরিপন্থীই হোক না কেনো। দ্বিতীয়ত, মানুষ যে মতই নির্ধারণ করে, তা যেনো সে সততা ও নিরপেক্ষতার সাথে এবং নি:স্বার্থভাবে করে, আর বিবেকের স্বতস্ফূর্ত দাবিকে দমিয়ে দেয়ার চেষ্টা না করে। অনেক সময় এমন হয় যে, অন্যায় পথে চলাটা প্রবৃত্তির খায়েশ চরিতার্থ করার সহায়ক এবং তার সাথে নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থ জড়িত বলেই মানুষ তা ভালোবাসে এবং সত্য ও ন্যায়ের উপর তাকে অগ্রাধিকার দেয়। তৃতীয়ত, সব সময় আল্লাহর কাছে দোয়া করতে থাকা যেনো তিনি তাকে সরল ও সঠিক পথ দেখান ও গোমরাহী থেকে বাঁচিয়ে রাখেন। এটা খুবই জরুরি জিনিস। নামাযে সূরা ফাতেহা পড়ার সময় আমরা এই দোয়াই করে থাকি। বস্তুত: গোমরাহী ও সুপথ প্রাপ্তির আসল উৎস আল্লাহ তায়ালাই। তাই তাঁর কাছে প্রেরণা ও শক্তি প্রার্থনা করা সর্বাবস্থায় অপরিহার্য।

৩. ইসলাম যে আল্লাহরই প্রেরিত দীন এবং তার যাবতীয় শিক্ষা ও বিধান যে সর্বোতভাবে হীতকর বিজ্ঞানসম্মত, সে সম্পর্কে সামগ্রিকভাবে পরিপূর্ণ আস্থা ও সন্তোষ লাভ করাই যথেষ্ট। এর পর ইসলামের প্রতিটি বিধি ও প্রতিটি বিষয় সম্পর্কে বিবেকের পূর্ণ তৃপ্তি অর্জন করা জরুরিও নয়, সম্ভবও নয়। [তরজমানুল কুরআন, মে ১৯৬৬]


<h1>১৫। সূরা আন নাজমের প্রাথমিক আয়াত কয়টির ব্যাখ্যা</h1>
প্রশ্ন : সূরা আন্‌ নাজমের নিম্নের আয়াত দু'টির প্রতি দু'টি আকর্ষণ করছি :
            ---------------------------------------------------------------
"অত:পর সে নিকটে এলো এবং ঝুঁকে পড়লো, এমনকি দুই ধনুকের সমান কিংবা তার চেয়েও কিছু কম দুরত্ব থেকে গেলো।" (সূরা আন্‌ নাজম, আয়াত : à§®-৯)

এখানে ------------- নিকটে এলো এবং উপরে ঝুলে রইলো এই ক্রিয়া দু'টির কর্তা জিবরাঈল, এই ধারণাই সাধারণভাবে প্রচলিত। অথচ বুখারি শরিফের মিরাজ সংক্রান্ত হাদিসে বলা হয়েছে :
---------------------------------------------------------------------------------
"অবশেষে রসূল সা, 'সিদরাতুল মুনতাহা'তে গিয়ে পৌঁছলেন। তখন মহাপরাক্রান্ত প্রভু রসূল সা,-এর কাছে এগিয়ে এলেন, অত:পর এরা ঘনিষ্ঠ হলেন। শেষ পর্যন্ত আল্লাহ রসূল সা.-এর দুই ধনুক পরিমাণ বা তার চেয়েও নিকটবর্তী হলেন।"

এ হাদিসের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে আল্লামা আইনী ও আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী লিখেছেন, রসূল সা. পবিত্র চেহারা চর্মচক্ষু দিয়েই দেখেছেন। রসূল সা. বলেছেন:
                    ---------------------------------------------------
"আমি আমার প্রভুকে সর্বোত্তম আকৃতিতে দেখেছি।"
এর পরবর্তী আয়াতে বলা রয়েছে:---------------------------------
"অত:পর তিনি স্বীয় বান্দার নিকট যা ওহী করার ছিলো করলেন।" (সূরা আন্‌ নাজম, আয়াত : ১০)

এর দ্বারা স্পষ্টতই প্রমাণিত হয়, নিকটে আসা, ঝুলে থাকা, দুই ধনুক বা তার চেয়ে নিকটে আসা-এসব ক্রিয়ার কর্তার জিবরাঈল নয় বরং আল্লাহ তায়ালা। নচেত রসূল সা, জিবরাঈলের বান্দাহ সাব্যস্ত হন (নাউযুবিল্লাহ)।

আমার বুঝে আসেনা, বুখারি এই বিশুদ্ধ ও সুস্পষ্ট হাদিস থাকা সত্ত্বেও এরূপ ব্যাখ্যা করা কিভাবে সঙ্গত হতে পারে, যাতে আল্লাহর পরিবর্তে জিবরাঈলের সাথে সাক্ষাত ও জিবরাঈলের ঘনিষ্ঠ হওয়া বুঝায়? রসূল সা. যে চর্মচক্ষু দিয়েই আল্লাহর সত্তাকে দেখেছেন এবং অতি নিকট থেকেই দেখেছেন, সে কথা অস্বীকার করার কি যুক্তি থাকতে পারে?

জবাব : সূরা আন্‌ নাজম, বিশেষত তার প্রথম রুকু কুরআনের জটির স্থানসমূহের অন্যতম। এর বেশির ভাগ আয়াত 'মুতাশাবিহাত' (রূপক অর্থবোধক) এর অন্তর্ভুক্ত, যার সঠিক মর্ম একমাত্র আল্লাহই ভালো জানেন। তথাপি সুদক্ষ আলেমগণ নিজ নিজ প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিমত্তার সাহায্য নিয়ে সাধ্যমত তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন।

এ সূরাটি সম্পর্কে সর্বপ্রথম যে প্রশ্ন জাগে তা হলো, এটি কখন নাযিল হয় এবং এতে যে গুরুত্বপূর্ণ ও রোমাঞ্চকর ঘটনাবলীর বিবরণ রয়েছে, রসূল সা.-এর জীবনের কোন্‌ পর্যায়ে সংঘটিত হয়? সূরা আন নাজমের সাধারণত মক্কী জীবনের প্রাথমিক যুগের সূরা হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ এবং অন্য কয়েকজন সাহাবি থেকে বুখারি ও অন্যান্য সহীহ হাদিসগ্রন্থে বর্ণিত বহু সংখ্যক হাদিস থেকে জানা যায় যে, সূরা নাজমই সেই প্রথম সূরা, যার শেষ আয়াত থেকে তেলাওয়াত সিজদার সূচনা হয়। এখন সমগ্র সূরাটি যদি মক্কী যুগের প্রথম দিকে নাযিল হয়ে থাকে, তাহলে তার প্রথম রুকু সূরা বনী ইসরাইলে বর্ণিত মিরাজের ঘটনার সাথে কিভাবে সংশ্লিষ্ট হতে পারে? মি'রাজ তো প্রামান্যতম হাদিস অনুসারে হিজরতের মাত্র এক বা দেড় বছর আগের ঘটনা।

এই জটিলতা নিরসনের জন্য নানাভাবে চেষ্টা করা হয়েছে। যেমন কেউ কেউ বলেছেন, মিরাজের ঘটনা একাধিকবার সংঘটিত হয়েছে। আবার কারো কারো মতে, এ সূরার প্রথমাংশ মক্কী যুগের প্রথম দিকে এবং পরবর্তী অংশ মক্কী যুগের শেষ ভাগে নাযিল হয়েছে। অন্য কথায় বলা যায় :
              ---------------------------------------------------
'তখন সে ঊর্ধ্ব দিগন্তে; অত:পর সে এগিয়ে এলো এবং ঘনিষ্ঠতর হলো।' এ আয়াতে যে ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে, সেটা মি'রাজের আগের ঘটনা। আর --------------------- 'নিশ্চয়ই তিনি তাঁকে আরো একবার দেখেছেন।' এবং এর পরবর্তী আয়াতগুলোতে যা বর্ণিত হয়েছে তা মি'রাজ রজনীর ঘটনা। এ প্রসঙ্গে কয়েকটি হাদিস থেকেও এরূপ তথ্য পেশ করা হয় যে, মি'রাজের আগেও হেরা গুহায়, আবতাহ উপত্যকায় বা অন্য কোনো স্থানে রসূল সা. কর্তৃক জিবরাঈলের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য লাভের ঘটনা ঘটেছিলো যা --------------------- বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু মি'রাজের চাঞ্চল্যকর ঘটনার সাথে সূরা নাজমের কোনো একটি অংশ জুড়ে দিলে যে জটিলতার উদ্ভব হয়, এসব মতামত ও ব্যাখ্যা দ্বারা তা পুরোপুরি নিরসন হয়না। সবচেয়ে নিরাপদ ও নির্ভুল অভিমত সম্ভবত এই যে, এই সূরার কোনো অংশকেই মি'রাজের সাথে জড়িত করা ঠিক নয়। এর প্রথম রুকুতে যা কিছু বর্ণিত হয়েছে তাকে নবুওয়াতের সূচনাকালে রসূল সা. -কে যে প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হয়েছে, তারই কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ ধাপ বলে গণ্য করতে হবে। রসূল সা.-এর মধ্যে ওহীর গুরুভার গ্রহণ ও বহনের ক্ষমতা এবং জিবরাঈল ও ফেরেশতা জগতের সাথে ঘনিষ্ঠতা ও একাত্মতার মানসিকতা গড়ে তোলাই এই প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের লক্ষ্য ছিলো। কুরআন ও হাদিসে এ সম্পর্কে আরো কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। এখানে সেগুলোর বিস্তারিত বিবরণ দেয়ার অবকাশ নেই।

তথাপি যদি নাযিলের পটভূমির ব্যাপারটা বাদ দিয়ে এ সূরার সম্পর্ক মি'রাজের সাথে মেনেও নেয়া হয়, তাহলেও আরেকটা প্রশ্ন মাথা তুলে দাড়ায়। সেটি হলো, এর প্রথম আয়াত কয়টির নিগুঢ় মর্ম কি? 'শক্তিধর শিক্ষক' কে ছিলেন, ঊর্ধ্ব দিগন্তে বিরাজমান সত্তাটির পরিচয় কি, কে কার কাছে ঘনিষ্ঠ হলো, কে ঝুঁকে পড়লো, কে ওহী করলো এবং কে কাকে পুনরায় সিদরাতুল মুন্তাহাতে আবির্ভূত হতে দেখলো? প্রাচীন ইমামদের কেউ কেউ বলেন, পুরো ঘটনাটিই স্বয়ং আল্লাহ ও রসূল সা.-এর মধ্যে সংঘটিত হয়েছে। তাদের বক্তব্য হলো, উর্ধ্ব দিগন্তে স্বয়ং আল্লাহই বিরাজিত হয়েছিলেন, আল্লাহই স্বীয় নবীর অথবা নবী আল্লাহর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে এসেছিলেন। এই ঘনিষ্ঠতা ও নৈকট্য তাঁদের মতে স্থানভিত্তিক ব্যাপার ছিলনা। ওটা ছিলো আত্মিক নৈকট্য। তাঁদের ব্যাখ্যা অনুসারে :
                   --------------------------------------------------------
"তিনি চক্ষু দিয়ে যা দেখেছেন, তাঁর অন্ত:করণ তা অস্বীকার করেনি তিনি তাঁকে সিদরাতুল মুন্তাহাতে আরো একবার দেখেছেন।"

এসব উক্তিতে যে দর্শকের কথা বলা হয়েছে, তা দ্বারা রসূল সা. কর্তৃক আল্লাহকে সরাসরিভাবে দশনের সৌভাগ্য অর্জন বুঝানো হয়েছে। তবে এই দর্শন চর্মচক্ষুর দর্শন, না অন্তর দিয়ে দর্শন এবং স্বয়ং আল্লাহর সত্তার দর্শন, না শুধু তাঁর জ্যোতি দর্শন, সে ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে।

এ মতের সপক্ষে যেসব প্রমাণ দর্শানো হয়, বুখারি শরিফের আলোচ্য হাদিসটি তার অন্যতম। কিন্তু এ হাদিস থেকে প্রমাণ দর্শানো জটিলতা থেকে মুক্ত নয়। এ প্রসঙ্গে সূরা আন নাজমের সংশ্লিষ্ট আয়াতগুলোর ব্যাখ্যার জন্য আলোচ্য হাদিসটির উপর নির্ভর করাও সঙ্গত নয়। প্রথমত, এ হাদিসে 'মহা পরাক্রান্ত মহিমান্বিত প্রভু এগিয়ে এলেন এবং এতো ঘনিষ্ঠ হলেন যে, তাঁর (রসূলের) কাছ থেকে তার ব্যবধান দুই ধনুকের সমান বা তার চেয়েও কম রইলো' এ কথাগুলো রয়েছে। ইমাম বুখারি এটি কিতাবুত তাওহীদে 'হযরত মূসার সাথে আল্লাহর প্রত্যক্ষ কথোপকথন' শীর্ষক অধ্যায়ের বিশদভাবে তুলে ধরেছেন। হাদিসটির সূত্র পরম্পরা হযরত আনাস পর্যন্ত গিয়ে শেষ হয়েছে। বুখারির অন্য কয়েকটি অধ্যায়ে মি'রাজ সম্পর্কে একাধিক 'মারফু' (অর্থাৎ যা উপরোক্ত হাদিসের ন্যায় কোনো সাহাবি পর্যন্ত গিয়ে শেষ হয়নি বরং তার সূত্র পরম্পরা খোদ রসূলুল্লাহ সা. পর্যন্ত উপনীত হয়েছে। এরূপ হাদিস উপরোক্ত হাদিসের চেয়ে উন্নতমানের ও বিশ্বস্ততর অনুবাদক) হাদিস রয়েছে, যা হযরত আনাস ও অন্যান্য সাহাবি কর্তৃক সরাসরি রসূল সা. থেকে বর্ণিত। সে সব হাদিসে সূরা আন নাজমের এ শব্দগুলো এরূপ ব্যাখ্যা সমেত বর্ণিত হয়নি। বরঞ্চ এ হাদিসটি একাধিক দিক দিয়ে ঐসব মারফু হাদিসের সাথে সাংঘর্ষিক।

আলোচ্য হাদিসটি সম্পর্কে দ্বিতীয় উল্লেখযোগ্য কথা হলো, এর সনদ বা বর্ণনাসূত্র এবং মূল হাদিসের ভাষা সম্পর্কে হাদিস বিশেষজ্ঞগণ তত্ত্ব ও তথ্যগতভাবে একাধিক আপত্তি তুলেছেন। এর বর্ণনাকারীদের মধ্যে শরিক বিন আব্দুল্লাহ নামে এক বিতর্কিত ব্যক্তি বিদ্যমান। বুখারি শরিফের একাধিক টীকাগ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে যে, কোনো কোনো মুহাদ্দিস এই ব্যক্তির বিরুদ্ধে অত্যন্ত ক্ষুরধার সমালোচনা চালিয়েছেন। সম্ভবত এ কারণেই ইমাম মুসলিম স্বীয় গ্রন্থে কিতাবুল ঈমানের মি'রাজ অধ্যায়ে শরিকের এই রেওয়ায়েতটি সনদ বর্ণনা করার পর মূল হাদিসের একটিমাত্র অংশ উল্লেখ করেই ক্ষান্ত থেকেছেন। অত:পর এই বর্ণনাকারীর সমালোচনা ও তার সম্পর্কে পাঠককে সতর্ক করার লক্ষ্যে নিজস্ব মন্তব্য হিসেবে নিম্নোক্ত বাক্যটি লিপিবদ্ধ করে দিয়েছেন।
                 ---------------------------------------------------
"এই ব্যক্তি এ হাদিসটির কিছু বক্তব্যকে আগ-পাছ করে দিয়েছেন। এবং কিছু কম বেশিও করেছেন।"
বুখারি ও মুসলিম উভয় গ্রন্থের তাফসির সংক্রান্ত অংশে (কিতাবুত তাফসির) এ হাদিসে বর্ণনা করা হয়নি।

উল্লেখিত হাদিসটির ভাষা, বক্তব্য ও বিষয়ের উপর তত্ত্বগতভাবেও বহু বিরূপ মন্তব্য করা হয়েছে। ইমাম খাত্তাবিও যে ভাষায় সমালোচনা করেছেন, তা ফাতহুল বারী ও উমদাতুল ক্কারী উভয় গ্রন্থে লক্ষণীয়। ---------------------------- "মহাপরাক্রান্ত মহিমান্বিত প্রভু কাছে এগিয়ে গেলেন এবং ঘনিষ্ঠতর হলেন", (বা ঝুঁকে পড়লেন) এই ব্যাখ্যাসূচক বক্তব্যে সম্ভাব্য আপত্তি ও তার জবাব খোদ ইমাম খাত্তাবীর ভাষায় আল্লামা ইবনে হাজর বর্ণনা করেছেন। ইমাম খাত্তাবি এবং স্বয়ং ইবনে হাজর এ আপত্তি নিরসনের উদ্দেশ্যে এরূপ ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেছেন যে, আসলে এটা ছিলো একটা স্বপ্ন। কেউ যদি স্বপ্নযোগে দেখতে পায় যে আল্লাহ তার কাছে এগিয়ে গেলেন, ঘনিষ্ঠতর হলেন অথবা কোনো বিশেষ জায়গায় হঠাৎ আবির্ভূত বা অবতীর্ণ হলেন তাহলে সেটা তেমন আপত্তিকরণ বা অভাবনীয় ব্যাপার নয়। তথাপি উল্লেখিত বাচনভঙ্গির আলোকে অর্থাৎ ------------------------ (মহাপরাক্রান্ত মহিমান্বিত প্রভু এগিয়ে গেলেন ও ঘনিষ্ঠতর হলেন) সমগ্র আয়াত সমষ্টির যে ব্যাখ্যা দাঁড়ায় এবং মহান স্রষ্টা আল্লাহর সত্তার যে ভাবমূর্তি ও চিত্রকল্প প্রকাশ পায় তা কোনো অতি প্রাকৃতিক জগতে বা স্বপ্নে সংঘটিত হওয়াও আপত্তিজনক অযৌক্তিক।

আসলে শরীকের বর্ণিত এই হাদিসটিতে আরো বহু আপত্তির বিষয় রয়েছে। সে সবের বিশত বিবরণ দেয়া এখানে নিস্প্রয়োজন এবং তাতে অযথা আলোচনার কলেরব বৃদ্ধি পাবে। হাফেয ইবনে হাজর (বুখারির ব্যাখ্যা ফাতহুল বারীর রচয়িতা) স্বয়ং এগারোটা বা তার চেয়েও বেশি আপত্তির উল্লেখ করেছেন এবং তা নিরসনের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কয়েকটি জবাব পুরোপুরি সন্তোষজনক হয়নি। উদাহরণস্বরপ আলোচ্য হাদিসটির সূচনা এভাবে হয়েছে :
-------------------------------------------------------------------------------------------------------
"এক রজনীতে রসূর সা.-কে কা'বা শরিফ সংলগ্ন মসজিদ থেকে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁর নিকট ওহী আসার আগে তাঁর কাছে তিনজন আগন্তুক এসেছিলো।"

এখানে উল্লেখিত রাত্রিকালীন ভ্রমণ দৃশ্যত ওহী শুরুর আগেকার ঘটনা। আর এর অব্যবহিত পরেই হাদিসের মূল ভাষ্যে যে বিবরণ তা থেকে মনে হয়, তিনি মসজিদে হারামে ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায় তিনজন ফেরেশতা আসেন। তাদের একজন বলেন : এই তিনজনের মধ্যে মুহাম্মদ সা.-কে? দ্বিতীয়জন তাঁকে দেখিয়ে দিলে তৃতীয়জন বললেন : তাঁকে নিয়ে চলো। ঐ রাতে আর কোনো ঘটনা ঘটেনি। এমনকি রসূল সা. আগন্তুক ফেরেশতাদেরকেও দেখেননি। হাদিসের পরবর্তী অংশে অন্য ঘটনাবলীর বিবরণ রয়েছে, তা অন্য কোনো রাতে সংঘটিত হয়েছে। এখন মাত্র তিনজন ফেরেশতার আগমনকে 'ইসরা' (রাত্রিকালীন ভ্রমণ, নামে আখ্যায়িত করা উপরন্তু তাকে প্রাক্‌-ওহীর ঘটনা বলে অভিহিত করা একটা জটিল ধাঁধা ছাড়া কিছু নয়।) এই জট খোলার জন্য ইমাম ইবনে হাজর বলেন
              -------------------------------------------------------------------
"হাদিসটির বর্ণনাকারী হয়তো বলতে চেয়েছেন, এটা ওহীর পরের ঘটনা কিন্তু বলে ফেলেছেন ওহীর আগের ঘটনা।"

যাই হোক, একদিকে রয়েছে এই হাদিস। অপরদিকে বুখারি ও মুসলিমের অন্যান্য অধ্যায়ে, বিশেষত বুখারির কিতাবুত তাফসিরের সূরা আন নাজমে বর্ণিত একাধিক হাদিস থেকে জানা যায় যে, সূরা আন নাজমে সাক্ষাত ও সান্নিধ্য লাভের যে বিবরণ রয়েছে, তা মুহাম্মদ সা. ও জিবরাঈলের মধ্যে সংঘটিত হয়। ইমাম বুখারি যে সূরা আন নাজমের তাফসিরে এই শেষোক্ত হাদিসসমূহের উল্লেখ করলেন এবং শরিকের বর্ণিত হাদিসের উল্লেখ করলেননা, তা থেকেই বুঝা যায় যে, তার ব্যক্তিগত মতে এই সূরায় বর্ণিত ঘটনাবলীতে দ্বিতীয়পক্ষ আল্লাহ নন, জিবরাঈল।
যেমন 'দুই ধনুকের সমান ব্যবধান বা তার চেয়েও কম' এই কথাটির তাফসির সংক্রান্ত অধ্যায়ে তিনি হযরত ইবনে মাসউদের বর্ণিত এ হাদিসটি উদ্ধৃত করেছেন :
                      --------------------------------------------------
"রসূল সা. ছয়শো ডানা বিশিষ্ট জিবরাঈলকে দেখতে পেলেন।" মুসলিম শরিফেও কিতাবুল ঈমানে "তিনি তাকে আরো একবার সিদরাতুল মুনতাহার নিকট আবির্ভুত হতে দেখেছেন" এ আয়াতের ব্যাখ্যা সংক্রান্ত অধ্যায়ে ইবনে মাসউদের এই হাদিসটি উল্লেখ করা হয়েছে। একই অধ্যায়ে আরো কিছু পরে মাসরুক কর্তৃক বর্ণিত হাদিসে বলা হয়েছে, হযরত আয়েশা বলেন : 'তিনটি জিনিস এমন রয়েছে, যার একটিও কেউ বললে আল্লাহর প্রতি অপবাদ আরোপকারী হিসেবে গণ্য হবে।' বর্ণনাকারী জিজ্ঞেস করলেন: সেই তিনটি জিনিস কি কি? হযরত আয়েশা বললেন: যে ব্যক্তি বলবে যে মুহাম্মদ সা.স্বীয় প্রভুকে দেখেছেন, সে আল্লাহর প্রতি অপবাদ আরোপকারী। বর্ণনাকারী বলেন : এই সময় আমি হেলান দিয়ে বসেছিলাম। তৎক্ষণাৎ উঠে সোজা হয়ে বসলামঠ। বললাম: "উম্মুল মুমিনীন! একটু থামুন। তাড়াহুড়া করবেননা।"
               ---------------------------------------
"নিশ্চয় তিনি তাঁকে দেখেছেন মুক্ত দিগন্তে।"
              ---------------------------------------
"নিশ্চয় তিনি তাকে আরো একবার দেখেছেন।"

এ কথা দু্টো কি আল্লাহ বলেননি? হযরত আয়েশা বললেন : এই উম্মতের মধ্যে আমিই প্রথম এ দুটো আয়াত সম্পর্কে রসূল সা. -কে জিজ্ঞেস করেছি। তিনি বলেছেন : "সে তো জিবরাঈল আমি তাকে তার আসল আকৃতিতে ঐ দুবার দেখেছি।" অত:পর হযরত আয়েশা রা. বললেন : তুমি আল্লাহর এ উক্তি শোনোনি?
               -------------------------------------------------
"আল্লাহকে চোখ দিয়ে দেখা যায়না, অথচ সকল চোখ তার দৃষ্টির আওতাধীন।"(সূরা আল আনয়াম, আয়াতাংশ : ১০৩) এবং
---------------------------------------------------------------------------------
"কোনো মানুষ আল্লাহর সাথে কথা বলতে পারেনা পর্দার অন্তরালে থেকে ব্যতীত অথবা তিনি নিজে যে প্রতিনিধি পাঠান তার মাধ্যমে ব্যতীত।" (সূরা আল শূরা, আয়াতাংশ : ৫১)

উল্লেখিত হাদিসে হযরত আয়েশা রা. নিজের পক্ষ থেকে যা কিছু বলেছেন তা নিয়ে কোনো দ্বিমতের অবকাশ থাক বা না থাক, তিনি রসূল সা.-এর যে উক্তি উদ্ধৃত করেছেন তা মারফু (প্রত্যক্ষভাবে রসূল সা. থেকে শ্রুত) হাদিসের মর্যাদা রাখে। তাই এই ব্যাপারে কোনো বিতর্কের অবকাশ নেই। এ হাদিস থেকে অকাট্যভাবে প্রমাণিত যে, সূরা আন নাজমের আয়াতগুলোতে রসূল সা. ছাড়া দ্বিতীয় যে সত্তার উল্লেখ রয়েছে, তিনি জিবরাঈল ছাড়া আর কেউ নন।

বুখারির ব্যাখ্যাতা হাফেয ইবনে হাজর বা আল্লামা আইনীর এমন কোনো উক্তি আমি তাদের প্রণীত গ্রন্থ দু'টির কোথাও দেখিনি যে, রসূল সা. মি'রাজের সময় বা অন্য কোনো সময় চর্মচক্ষু দিয়ে আল্লাহকে দেখেছেন। বরঞ্চ এর বিপরীত উক্তি অনেক রয়েছে। বুখারির কিতাবুত তাফসিরের সূরা আন নাজমের আয়াত ------------------------- এর তাফসির সম্বলিত অধ্যায়ে টীকাকার ইবনে হাজর বলেন: রসূলুল্লাহ সা. যাকে দেখেছেন তিনি যে জিবরাঈল, আয়াতগুলো থেকে সেটাই অধিকতর স্পষ্ট। কিতাবুত তাওহীদেও তিনি ইমাম মালেক ও ইমাম আহমদের উক্তি উদ্ধৃত করেছেন যে, নশ্বর জগতে আল্লাহকে দেখা সম্ভব নয়। ---------------------------------- "আমার প্রভুকে আমি সুন্দরতম আকৃতিতে দেখেছি" এ উক্তি সম্বলিত হাদিসের মূল ভাষ্যটি থেকে সামগ্রিকভাবে এ কথাই প্রতীয়মান হয় যে, এখানে স্বপ্নযোগে দেখার কথা বলা হয়েছে। কাজেই এ হাদিস থেকে চাক্ষুস দর্শন বুঝা ঠিক নয়। এ হাদিসটি আহমাদ এ তিরমিযির বরাত দিয়ে মিশকাতের নামায ও নামাযের স্থান সংক্রান্ত অধ্যায়ে বর্ণিত হয়েছে। অন্য কয়েকটি হাদিসেও আল্লাহর দর্শন লাভের উল্লেখ পাওয়া যায়। কিন্তু সেগুলোতেও চাক্ষুস দর্শনের স্পষ্টোক্তি নেই।

সর্বশেষে যে আপত্তিটি মীমাংসার অপেক্ষায়, তাহলো এই যে : ------------------  (তিনি দুই ধনুকের সমান বা তার চেয়েও কম ব্যবধানে রইলেন) এ আয়াতে ক্রিয়ার কর্তা যদি আল্লাহ না হয়ে জিবরাঈল হন, তা হলে এর ঠিক পরবর্তী আয়াতে শব্দটির সর্বনাম দ্বারা যাকে বুঝানো হবে, পূর্ববর্তী বাক্যে তার উল্লেখ থাকা চাই। পক্ষান্তরে সর্বনাম দ্বারা জিবরাঈলকে বুঝালে মুহাম্মদ সা. -কে জিবরাঈলকে বান্দাহ ধরা হয় -অনুবাদক। এ আপত্তিটা খুব গুরুতর নয়। কারণ সর্বনামের অভিষ্ট ব্যক্তির নাম পূর্ববর্তী বাক্যেই থাকা সব সময় জরুরি নয়। কুরআন এবং প্রচলিত আরব বাকরীতিতে তা পরবর্তী বা দুরবর্তী কোনো বাক্যে বিদ্যমান থাকা বা উহ্য থাকার দৃষ্টান্ত থাকে। যে সকল আলেম ও তাফসিরকারের মতে সূরা আন নাজমের আলোচ্য আয়াতগুলোকে বর্ণিত দ্বিতীয় পক্ষ হচ্ছেন জিবরাঈল, তারা সকলেই ---------- শব্দের সর্বনামের অর্থ আল্লাহ বলেই স্বীকার করেছেন। তাদের বক্তব্য এই যে, ----------- এবং ------------ শব্দ দুটির উপস্থিতিই এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট সাক্ষ্য। [তরজমানুল কুরআন, মে ১৯৬৬]


<h1>১৬। যাকাতকে প্রচলিত করের সাথে যুক্ত করা যায় না</h1>
দৈনিক পাকিস্তান টাইমসের ৭ই জুন ১৯৬৬ এবং দৈনিক মাশরিকের ৮ই জুন ১৯৬৬ সংখ্যায় ইসলামিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. ফজলুর রহমানের একটি চিঠি ছাপা হয়েছে। চিঠিটিতে বেশ কয়েকটি বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। আমি সংক্ষেপে সেগুলোর স্বরূপ উন্মোচন করা জরুরি মনে করছি।

ডক্টর সাহেব বলেন : "কুরআন কিংবা রসূল সা. যাকাত ছাড়া আর কোনো কর আরোপ করেননি। এছাড়া কোনো কর আরোপ করতে হলে তা যাকাতের সাথেই যুক্ত করতে হবে। এর প্রমাণ হলো, রসূল সা.-এর ঘোড়ার বাবদে যাকাত আদায় করা হতোনা। কিন্তু হযরত ওমর সে বাবদে যাকাত আদায় করেন অর্থাৎ তিনি কিনা একটা নতুন জিনিসকে যাকাতের আওতাভুক্ত করলেন।"

ডক্টর সাহেব এখানে মূল আলোচ্য বিষয়ের সাথে অন্য অবান্তর বিষয়ের অবতারণা করতে গিয়ে এমন তিনটি উদ্ভট তত্ত্বের জগাখিচুড়ি হাজির করেছেন, যার প্রত্যেকটিই সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ও অবাস্তব। ডক্টর সাহেবের প্রথম মনগড়া তত্ত্বটি হলো, যাকাত এক ধরনের কর। এ বক্তব্য সঠিক নয়। কারণ কর তো এমন একটি সরকারি রাজস্ব, যা সকল ধর্মমতের লোকের কাছ থেকে আদায় করা যায় এবং প্রত্যেক ধনী ও নির্ধন নাগরিক তার সুফল ভোগ করার সমান অধিকারি। এর সম্পূর্ণ বিপরীত যাকাত একটা ইবাদত বিশেষ। শুধুমাত্র মুসলমানদের উপরই যাকাত ফরয। তারা এটা নামাযের মতোই ধর্মীয় আবেগ ও উদ্দীপনা নিয়ে সম্পাদন করে থাকেন। অমুসলিমরা যেমন নামায আদায় করতে বাধ্য নয়, তেমনি যাকাত দিতেও বাধ্য নয়। যাকাত ও করে যদি পার্থক্য না থাকে, তাহলে অমুসলিমদের তো আনন্দে বগল বাজানোর কথা। ইসলামি সরকার যেই তাদের উপর কোনো কর আরোপ করবে, অমুনি তারা এই বলে তা প্রত্যাখ্যান করতে পারবে যে, এটা তো যাকাত। এটা আমাদের উপর নয় মুসলমানদের উপর আরোপিত।

ডক্টর সাহেবের দ্বিতীয় উদ্ভট তত্ত্ব হলো, ইসলাম যাকাত ছাড়া আর কোনো কর আরোপের অনুমতি দেয়না। এ তত্ত্বটিও ভুল যেহেতু যাকাত সাধারণ কর থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস, তাই যাকাত অন্যান্য করের অন্তরায় নয়। হাদিসে বলা হয়েছে :
                                --------------------------------------
অর্থাৎ 'তোমার সম্পদে যাকাত ছাড়াও প্রাপ্য রয়েছে।'

হযরত ওমরের আমলে আমদানীকৃত দ্রব্যাদির উপর কর বসানো হয়েছিল এবং তাকে যাকাত থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে 'ফায়' তথা সরকারি তহবিলের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। কুরআন ও সুন্নাহর কোনো ভাষ্য থেকে এ কথা প্রমাণ করা যাবেনা যে, সরকার রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে বা জনস্বার্থে কোনো কর আরোপ করতে পারবেনা, আর যদি পারে তবে তাকে যাকাতের সাথে যুক্ত করতে হবে। বিগত চৌদ্দশ বছরে কোনো একজন উল্লেখযোগ্য ফেকাহবিদ বা মুজতাহিদও ডক্টর সাহেবের এই উদ্ভট তত্ত্ব মেনে নেননি। কোনো কোনো ফেকাহবিদ যদি কখনো কর আরোপের বিরোধিতা করে থাকেন তবে সেটা শুধু নিপীড়নমূলক করের ক্ষেত্রেই করেছেন। নচেৎ রাজস্ব বিভাগ সব সময় সরকারের রাষ্ট্রীয় অর্থ বিভাগের একটা অংশ হিসেবেই পরিগণিত হয়েছে।

ডক্টর সাহেবের তৃতীয় দাবি এই যে, রসূল সা.-এর যেসব দ্রব্যসামগ্রীর উপর যাকাত আরোপিত হয়েছিল, পরবর্তীকালে তার তালিকায় আরো সংযোজন ঘটে। যেমন হযরত ওমর নতুন করে ঘোড়ার উপর যাকাত বসিয়েছিলেন। ডক্টর সাহেবের এ বক্তব্যটিও সঠিক নয়। তিনি যে উদাহরণ দিয়েছেন, তা দ্বারাও এ তত্ত্ব সমর্থিত হয়না। রসূল সা.-এর পরে যদি অতিরিক্ত দু'একটা জিনিসের উপর যাকাত আরোপিত হয়েও থাকে, তবে পূর্বতন তালিকার সাথে সেই অতিরিক্ত জিনিসের কোনো মৌলিক পার্থক্য নেই। রসূল সা. যেসব জিনিসকে যাকাতযোগ্য বলে ঘোষণা করেছিলেন, তারই কোনো একটির সাথে কোনো ধরণের সাদৃশ্য থাকার কারণে কিয়াসের মাধ্যমে আরেকটি জিনিসের উপর যাকাত ধার্য করা হয়েছে। এমন নয় যে, খেয়াল খুশি মতোই এক একটা জিনিসের উপর যাকাত ধার্য করা হয়েছে। জীবজন্তুর ক্ষেত্রে আসলে যেসব পালিত জন্তু সাধারণভাবে চারণভূমিতে চরে জীবন ধারণ করে এবং বিপুলভাবে বংশ বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে বিরাট বিরাট পালের আকারে লালন পালন করা হয়, সেগুলোর উপরই যাকাত ধার্য করা হয়। যেমন উট, গরু, ছাগল, ভেড়া। এসব জন্তুর সাথে সাদৃশ্য থাকার ভিত্তিতেই হযরত ওমর কিয়াসের রীতি প্রয়োগ করে ঘোড়ার উপর যাকাত ধার্য করেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও হযরত আলী রা. বলেছিলেন এটা পরবর্তী বংশধরদের জন্য কোনো বাধ্যতামূলক নজির নয়। বস্তুত হানাফি মযহাবের সাধারণ ফতোয়া অনুসারে ঘোড়া কোনো যাকাতযোগ্য জন্তু নয়।

ডক্টর সাহেব কিছুদুর অগ্রসর হয়ে বলেন : কুরআনে বর্ণিত যাকাতের খাতগুলো নিষ্ঠার সাথে ও পক্ষপাতমুক্ত দৃষ্টিতে অধ্যয়ন করলে বুঝা যায়, মুসলমানদের যাবতীয় অর্থনৈতিক প্রয়োজন এর আওতাধীন।

তিনি কুরআনের এই খাতগুলোর যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা লক্ষণীয়। 'আমিলীনা আলাইহা' দ্বারা আসলে তো যাকাত আদায় ও বন্টনকার্যে নিয়োজিত লোকজনকে বুঝায়। কিন্তু ডক্টর সাহেবের মতে এর দ্বারা সকল সরকারি কর্মচারি ও কর্মকর্তাকে বুঝায়। 'মুয়াল্লাফাতুল কুলুব' দ্বারা মূলত সেইসব নবদীক্ষিত মুসলমানদেরকে বুঝানো হয়, যাদের মনে মুসলমান সমাজের প্রতি প্রীতি মুহব্বত জন্মানো কাঙ্খিত। অথচ ডক্টর ফজলুর রহমান সাহেব এটিকে 'রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধির তহবিল' বলে আখ্যায়িত করেন। আজকাল রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বলতে কি কি জিনিস বুঝায় তা কারো অজানা নেই। তিনি 'গরিমীন' ও 'রিক্কাব' এর অনুবাদ করেছেন ঋণগ্রস্তদের সাহায্য করা ও দাসমুক্ত করা। কিন্তু ব্রাকেটের মধ্যে তার ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে: (জাতীয় অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করা)। ইংরেজিতে তিনি এর ব্যাখ্যা করেছেন জাতীয় ঋণ পরিশোধ বলে। এর অর্থ দাঁড়ায় এই যে, কোনো দুর্নীতি পরায়ণ ও স্বৈরচারী শাসক যেমন খুশি ঋণ গ্রহণ করতে ও যতো খুশি তার উপর সুদ দিতে পারবে আর এসব যাকাত তহবিল থেকে দিতে পারবে। 'ইবনুস সাবীল' শব্দটি দ্বারা আসলে এমন পর্যটককে বুঝানো হয়েছে, যে প্রবাসে আর্থিক সংকটে পতিত। কিন্তু ডক্টর সাহেব গোটা 'পরিবহন ব্যবস্থা' কে এর আওতাধীন করার পক্ষপাতী। এর অর্থ দাঁড়ায় এই যে, উচ্চ সরকারি কর্মকর্তাদের প্রথম শ্রেণী ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে যাতায়াতও যাকাতের অর্থ দ্বারা নির্বাহ করা যাবে। শুধু হেঁটে চলা ও খালি পায়ে চলা পথিক এই সুবিধা ভোগ করবে তা নয়। কুরআনের এরূপ 'নিষ্ঠাবান ও পক্ষপাতমুক্ত' ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ সম্পর্কেই আল্লামা ইকবাল মন্তব্য করেছিলেন "এদের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দেখে আল্লাহ, রসূল সা. ও জিবরীল পর্যন্ত হতবাক।"

ফেকাহ বিশেষজ্ঞগণ ইবাদত ও সাধারণ আর্থ সামাজিক তৎপরতার মধ্যে যে পার্থক্য করেছেন, ডক্টর সাহেব তাতেও আপত্তি তুলেছেন এবং বলেছেন, মুসলমানদের সমগ্র জীবনই ইবাদত। এখানে তিনি অনাবশ্যকভাবে মাওলানা মওদূদীর প্রসঙ্গ টেনে বলেছেন যে, আগে তিনিও এই বিভেদের পক্ষপাতী ছিলেননা। এটাও একটা তাত্ত্বিক বিভ্রাট। এ কথা নি:সন্দেহে সত্য যে, ব্যাপক ও সাধারণ অর্থে একজন খাঁটি মুসলসমানের সমগ্র জীবনই ইবাদতের শামিল। কিন্তু তাই বলে ইসলামের মূল স্তম্ভসমূহ যথা-নামায, রোযা, হজ্জ ও যাকাত যে বিশেষ অর্থে ইবাদত নামে পরিচিত এবং এগুলোর শরিয়ত নির্ধারিত নিয়মাবলী ও কাঠামো যে অকাট্য ও অপরিবর্তনীয়। সেই চিরস্বীকৃত মূলনীতি মাওলানা মওদূদী বা অন্য কোনো মুসলমান অস্বীকার করেননা, কখনো করেননি। যাকাত সম্পর্কে হযরত আবু বকরের দ্ব্যর্থহীন ফরমান হাদিস গ্রন্থসমূহে লিপিবদ্ধ রয়েছে। তাতে বলা হয়েছে যাকাতের যে হার আল্লাহর রসূল সা. ধার্য করেছেন, তার চেয়ে বেশি কেউ দাবি করলে তার দাবি মানা যাবেনা। ডক্টর ফজলুর রহমান এই মৌলিক পার্থক্য বিলোপ করে এ যুগের শাসকদেরকে নামায, রোযা, হজ্জ ও যাকাতের মতো ইবাদতগুলো বিকৃত করার অবাধ অধিকার দিতে চান। ইসলামের মূল স্তম্ভসমূহে সামান্যতম পরিবর্তন সাধনের ক্ষমতা যদি রসূল সা.-এর প্রথম খলিফার না থেকে থাকে, তাহলে এখন এগুলোতে রদবদল ঘটানো এবং এর অর্থ ও তাৎপর্য বিকৃত করার অধিকার অন্য কাউকে কিভাবে দেয়া যেতে পারে?

ডক্টর সাহেব সবশেষে ফেকাহ শাস্ত্রকারদের মতভেদের উল্লেখ করেছেন। এ মতভেদের উল্লেখ করে তিনি প্রমাণ করতে চান যে, এ বিষয়ে চিন্তাগবেষণার দ্বার রুদ্ধ করা হয়নি। মতভেদের কথা তো আমরাও স্বীকার করি। কিন্তু প্রথমত, এই মতভেদের তুলনায় মত্যৈকের দিকটা অনেক বেশি লক্ষ্যণীয় ও বলিষ্ঠ। দ্বিতীয়ত, এই মতবিরোধের কোনো না কোনো ভিত্তি কুরআন ও সুন্নাহতে বিদ্যমান। যে বিষয়ে কুরআন ও সুন্নাহতে সুস্পষ্ট ও অকাট্য সিদ্ধান্ত ঘোষিত হয়েছে, সে বিষয়ে ভিন্ন মতের দৃষ্টান্ত অত্যন্ত বিরল। উদাহরণস্বরূপ, কোনো কোনো জিনিসের নিসাব অর্থাৎ যাকাতযোগ্য নূন্যতম ধার্যকৃত পরিমাণে মতভেদ রয়েছে। তার কারণ হলো ঐ ব্যাপারে যে হাদিস রয়েছে, তার বিশুদ্ধতা ও প্রামান্যতা বিতর্কিত। কিন্তু যাকাতের হার নিসাবের চেয়েও অধিকতর মৌলিক গুরুত্বসম্পন্ন ব্যাপার। এই হার সম্পর্কে কোনো দ্বিমত নেই। বিভিন্ন দ্রব্যে যাকাতের যে হার রসূল সা. কর্তৃক নির্ধারিত বলে হাদিসে প্রমাণ পাওয়া যায়, তাতে কোনো হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটানোর পক্ষে কোনো একজন ফেকাহ শাস্ত্রবিদের অভিমতও কি ডক্টর সাহেব তুলে ধরতে পারবেন? যেমন, যেসব দ্রব্যে রসূল সা. শতকরা আড়াই ভাগ হারে যাকাত ধার্য করেছেন, কোনো একজন ফকীহও কি বলেছেন যে, ঐ সব দ্রব্যে এর  চেয়ে কম বা বেশি যাকাত আরোপ করা যায়?

[ ২ ]
ডক্টর ফজলুর রহমান সাহেবের বক্তব্যের জবাবে ১৯৬৬ সালের ১২ জুন তারিখের দৈনিক মাশরিকে আমার যে চিঠিখানা ছাপা হয়, ২২ জুনের মাশরিকে সেই চিঠির উপর জনৈক আব্দুর রশিদের একটি পর্যালোচনা প্রকাশিত হয়। সেই পর্যালোচনার আলোকে আমি আরো কিছু বক্তব্য পেশ করতে চাই।

আমি লিখেছিলাম : "সকল ধর্মাবলম্বীর কাছ থেকে আদায় করা যায় এমন রাজস্বকেই কর বলা হয়।"

এ ব্যাপারে আব্দুর রশিদ সাহেবের মন্তব্য হলো : "এতে করে তো একই দেশে দুটো অর্থনৈতিক কার্যক্রম এবং দুটো সরকার চালু হওয়া অবধারিত হয়ে যাবে। একটা সরকার কর ধার্য করবে, আর ঐ সরকারের অধীন আর একটা সরকার ব্যাপৃত থাকবে যাকাত আদায়ের কাজে।"

আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে এটা বোধগম্য হয়নি যে, আব্দুর রশিদ সাহেব আমার বক্তব্য থেকে যে সিদ্ধান্ত নিতে চাইছেন, তা কিভাবে যুক্তিসিদ্ধ হয়। আমি তো আমার চিঠিতে বা আর কোথাও বলিনি যে, ইসলামি সরকার তো কর আদায় করবে, কিন্তু যাকাত আদায় করবে ঐ সরকারের অধীন আরেক সরকার। ইসলামি সরকার করও ধার্য করবে, যাকাতও আদায় করবে, এতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। রসূল সা.-এর নির্দেশ অনুযায়ী যাকাত শুধু মুসলিম বিত্তশালীদের কাছ থেকে আদায় করা হবে এবং দুস্থ মুসলমানদের উপর নির্দিষ্ট খাতে ব্যয় করা হবে। এ জন্য তার হিসাব-নিকাশ এবং আদায় ও বন্টনের ব্যবস্থা 'বায়তুলমাল' বা সরকারি কোষাগারের অন্যান্য তহবিল থেকে সম্পূর্ণ পৃথক হবে।

তবে কোনো ইসলামি সরকার যদি বিদ্যমান না থাকে, কিংবা থাকলেও কোনো কারণে যাকাত আদায়ের ব্যবস্থা না করে, কিংবা শরিয়তের বিধান মোতবেক তা আদায় বন্টনের ব্যবস্থা না করে, অথবা মুসলমানরা কোনো অনৈসলামিক সরকারের অধীন বসবাস করে, তাহলে যাকাত মাফ হয়ে যাবেনা। কেননা, তা সরকারি কর নয়, নামাযের মতো একটা ফরয ইবাদত। এ ধরনের সকল পরিস্থিতিতে জাগ্রত ঈমানী চেতনাসম্পন্ন মুসলমানরা কোনো আদেশ বা অনুরোধ ছাড়াই স্বেচ্ছায় ও স্বতস্ফূর্তভাবে ব্যক্তিগত পর্যায়ে যাকাত দিয়ে থাকে এবং সম্ভব হলে যাকাতের আদায় ও বন্টনের জন্য কোনো বেসরকারি সংঘবদ্ধ ব্যবস্থা গড়ে তোলে। যাকাতের ফরয ইবাদত বাস্তবায়িত করার এসব স্বতস্ফূর্ত উদ্যোগ কার্যক্রমে আনন্দবোধ করা অভিনন্দন জানানোর পরিবর্তে একে 'সরকারের অধীন সরকার ও দ্বৈত তৎপরতা' বলে যে টিপ্পনী কাটা হয়েছে, বিবেক, প্রজ্ঞা এবং ইসলামি চেতনা ও মর্যাদাবোধের প্রতি এর চেয়ে নিষ্ঠুর পরিহাস আর কি হতে পারে?

আব্দুর রশিদ সাহেব বলেন, "যাকাত যদি সরকারি করই না হয় তবে যারা যাকাত দিতে অস্বীকার করেছে হযরত আবু রকর রা. তাদের বিরুদ্ধে জেহাদ করলেন কেন? কই কোনো বেনামাযীর বিরুদ্ধে তো জেহাদ করার আদেশ দেয়া হয়নি?" এ প্রশ্নের জবাবে শুধু এতোটুকুই বলবো যে, যে গৌরবময় যুগের কথা এখানে আলোচিত হচ্ছে, সে যুগের বাস্তব নমুনা আমাদের জন্য চূড়ান্ত দলিল ও সনদস্বরূপ। সে যুগে মুসলমানদের কোনো দল বা গোষ্ঠির নামায বা রোযা নীতিগতভাবে অস্কীকার করা বা কার্যত বর্জন করা একেবারেই অকল্পনীয় ব্যাপার ছিলো আর বাস্তবেও তা কখনো সংঘটিত হয়নি। সে যুগে মুনাফিকরাও নামায পড়তো এবং রোযা রাখতো। হযরত আবু বকর সিদ্দীকের আমলে সর্বপ্রথম এরূপ পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে যে একটি গোষ্ঠি যাকাত দিতে অস্বীকার করলো এবং ব্যাপারটা সাহাবাদের গোচরে আনা হলো। এ বিষয়ে যথেষ্ট পরামর্শ হয়, মতভেদও ঘটে। অবশেষে একটা সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং তা কার্যকরও করা হয়। যাকাত ছাড়া ইসলামের অন্যান্য স্তম্ভগুলোর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এগুলো যে ফরয, এ কথা যে ব্যক্তি মনে ও মুখে অবিশ্বাস ও অস্বীকার করবে, সে নিশ্চিতভাবে মুরতাদ তথা ধর্মচ্যুত ও কাফের হয়ে যাবে।
কিন্তু যে ব্যক্তি এগুলোকে ফরয বলে মানবে এবং কার্যত বর্জন করবে, তাকে ধর্মচ্যুতির শাস্তি দেয়া চলেনা। তবে ইসলামি সরকার তাকে বুঝিয়ে সুজিয়ে, জ্ঞান ও শিক্ষা দান করে এমনকি তিরস্কার ও ভৎসনা করে পথে আনার চেষ্টা কতে পারে এবং সর্বশেষ উপায় হিসেবে তাকে শাস্তিও দিতে পারে।

আব্দুর রশিদ সাহেব আরো লিখেছেন : "যাকাত আর্থিক ও সামাজিক ইবাদতের পর্যায়ভুক্ত। কাজেই হজ্জের মতো এটা রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীন। পাকিস্তান রাষ্ট্রের আর্থিক অবস্থা অধিক সংখ্যক লোককে হজ্জের অনুমতি দেয়ার অনুকূল ছিলোনা বলে সংখ্যা কমিয়ে দেয়া হয়েছে।"

এখানে যে যুক্তির অবতারণা করা হয়েছে, তা এতো নির্বোধসুলভ ও নিম্নমানের এবং সেই সাথে এতো বেদনাদায়ক ও শিক্ষাপ্রদ যে, এ যুগের সরকারগুলো এবং তাদের তৈরি করা ও পোষা তথাকথিত ইসলামি গবেষক ও চিন্তাবিদদের হাতে ইসলামের যে মৌলিক ইবাদতসমূহের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ও রদবদলের ক্ষমতা ন্যাস্ত হলে ইসলামকে যে কিভাবে বিকৃত করা হবে, এ থেকে তা সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এ ব্যাপারে আমি ইতিপূর্বে যে আশংকা প্রকাশ করেছিলাম, আলোচ্য যুক্তিতর্ক দেখে তা সত্য বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। প্রশ্ন হলো-কুরআনের আলোকে আল্লাহর ঘর পর্যন্ত যাওয়ার সুযোগ ও সামর্থ্য সৃষ্টি হলেই যখন হজ্জ ফরয হয়ে যায়, তখন সরকার তাকে বিধিনিষেধ আরোপের অধিকার পায় কোথেকে? বিশেষত, শুধুমাত্র গত দু'বছরেই নয় লাখ গ্যালন দেশি মদ উৎপাদন এবং তিন লাখ একচল্লিশ হাজার দু'শ সতেরো গ্যালন বিদেশি মদ আমদানি করতে যে সরকারের টাকার অভাব হয়নি, কয়েক হাজার হাজীর হজ্জের বন্দোবস্ত করতে সে সরকারের অর্থাভাব হবে কেন?

হযরত ওমরের খেলাফত আমলে ঘোড়ার যাকাত আদায়ের বিষয়টি আমি সংক্ষেপে বর্ণনা করেছিলাম। সেই বর্ণনা থেকেই আব্দুর রশিদ সাহেব 'যাকাতের কিছু না কিছু কেয়াসের সুযোগ আছে' বলার অজুহাত পেয়ে গেছেন। "কিছু না কিছু সুযোগ কথাটা দ্বারা আসলে তিনি এই দরজা পুরোপুরি খুলে দেয়ার ইচ্ছেই ব্যক্ত করেছেন, যাতে সরকার খেয়াল খুশি মতো যে কোনো জিনিসের উপর যে কোনো সময় যে কোনো পরিমাণে যাকাতের নাম দিয়ে কর বসাতে পারে এবং কেউ তাতে টুশব্দটি না করতে পারে। তাই আমি ঘোড়ার যাকাতের ব্যাপারটি আরো একটু খোলাসা করে দিচ্ছি।"

'মুসনদে ইবনে আবি শায়বা' নামক হাদিস গ্রন্থে সুস্পষ্টভাবে বলা আছে যে, হযরত ওমর রা. স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে ঘোড়ার উপর যাকাত আরোপ করেননি। সিরিয়ার একশ্রেণীর মানুষ অত্যাধিক সংখ্যক ঘোড়া পুষতো। তারা নিজেরাই প্রথমে হযরত আবু ওবায়দাকে অনুরোধ করে তাদের কাছ থেকে যাকাত নিতো। তিনি অস্বীকার করেন। তারপর তারা হযরত ওমর রা. কে চিঠি লিখে একই অনুরোধ জানালো। তিনিও এড়িয়ে গেলেন। অবশেষে নাছোড়বান্দা হয়ে তারা সশরীরে হযরত ওমরের কাছে হাজির হলো এবং যাকাত আরোপ করার দাবি জানালো। তিনি বললেন :
                       ------------------------------------------
"এ যাকাত আরোপ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।"

তিনি সিরিয়ায় ফিরে গিয়ে আবার লিখলো, "ঘোড়ার উপর যাকাত দিয়ে আমাদের সম্পদকে পবিত্র করি, এটাই আমাদের কাম্য।" অগত্যা হযরত ওমর সিরিয়ার গভর্নরকে লিখলেন : "ওখানকার ঘোড়ার মালিকরা চাইলে ওদের কাছ থেকে যাকাত নিয়ে নাও এবং ওখানকার গরিবদের মধ্যেই তা বন্টন করে দাও।" এ বিষয়ে অন্যান্য সাহাবিরাও দ্বিধান্বিত ছিলেন। হযরত আলীর রা. বক্তব্য তো আগেই উল্লেখ করেছি। সাহাবিদের এই দ্বিধাদ্বন্দ্বের একমাত্র কারণ ছিলো এই যে, রসূল সা. স্বয়ং সুস্পষ্টভাবে ঘোড়ার উপর যাকাত আরোপের কোনো নির্দেশ দেননি। এ জন্যই হযরত ওমরের রা. এই বাস্তব উদাহরণ সত্ত্বেও হাম্বলি, শাফেয়ি, হানাফি ও মালেকি এই চারটি মযহাবেরই অনুসৃত নীতি এই যে, বংশবৃদ্ধির উদ্দেশ্যে যে ঘোড়া পালন করা হয় এবং যে ঘোড়া মাঠে চরে বেড়ায়, তাতে যাকাত দেওয়ার প্রয়োজন নেই। সুবিখ্যাত গ্রন্থ 'আলফিকহু আলাল মাযাহিবিল আরবায়া' (চার মাযহাবের ফেকাহ) তে বলা হয়েছে : --------------------------- ঘোড়ার কোনো যাকাত নেই এবং এটা সকল মযহাবের সর্বসম্মত রায়।

ইমাম আবু উবাইদ স্বীয় গ্রন্থ 'কিতাবুল আমওয়ালে' লিখেছেন যে, ইরাক, হেযায ও সিরিয়ার মুসলমানগণের সর্বসম্মত রায় হলো, ঘোড়ার যাকাত নেই। অত:পর তিনি বলেন :
                        -----------------------------------------------
"এ ব্যাপারে তাদের মধ্যে আদৌ কোনো মতভেদ আছে বলে আমার জানা নেই।"
আব্দুর রশিদ সাহেব যুক্তির তুবড়ি ছুটিয়েছেন এই বলে যে মক্কী যুগে যাকাতের কোনো ধরাবাধা হার ছিলোনা। তাই যাকাতের হার ও ধরন কোনো চূড়ান্ত ও অপরিবর্তনীয় কিছু নয়। আব্দুর রশিদ সাহেবের যদি জানা না থাকে বা ভুলে গিয়ে থাকেন, তবে আমি তার গোচরে আনতে ও তাকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, শুধু যাকাত নয়, বরং নামায, রোযা এবং ইসলামের বহু বিধানও নির্দেশ পর্যায়ক্রমেই নাযিল ও কার্যকরি হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, নামায আগে মাত্র দু'রাকাত ছিলো আর রোযাও মাত্র কয়েকদিন ছিলো। বর্তমান আকারে নামায মি'রাজের পর এবং রমযানের রোযা বদর যুদ্ধের সময় ফরয হয়। এই সকল বিধানের সর্বশেষ প্রবর্তিত রীতিই চূড়ান্ত বলে গৃহীত হয়। এখন জানতে ইচ্ছে করে, আব্দুর রশিদ সাহেব মক্কী যুগের অজুহাত তুলে নামায রোযার মতো অকাট্য ফরয কাজকেও নিষ্প্রয়োজন সাব্যস্ত করার দুরভিসন্ধি পোষণ করেন কিনা?

প্রথমে যাকাতের কথাই আসা যাক। এ কথা সবার জানা যে, মক্কায় ইসলামি সরকার থাকা তো দুরের কথা, নিরাপদ জীবনাযাপনই অসম্ভব ছিলো। সেখানে যাকাতের নিসাব ও হার নির্ধারণ করা যেমন নিরর্থক ছিলো, তেমনি তা হতো অসময়োপযোগী পদক্ষেপ। যেখানে জীবনেরই নিরাপত্তা ছিলোনা। সেখানে যাকাতের হার ও পরিমাণ ধার্য করার প্রশ্ন ওঠে কি করে? কেইবা যাকাত আদায় করতো, কোথায়ই বা তা রাখা হতো, আর কিভাবেই বা তা বন্টন করা যেতো? এরূপ পরিস্থিতিতে যাকাতের বিস্তৃত বিধিবিধান প্রবর্তিত হয়নি বলে আল্লাহর অনুগ্রহের পূর্ণতা ও পরিপূর্ণ শরিয়ত বিধিবদ্ধ হওয়ার পরও কি ইসলামি ইবাদতগুলোতে কাটছাট এবং নামায,রোযা, হজ্জ এবং যাকাত সব কিছুরই বিকৃতি সাধনের চেষ্টা চলতে থাকবে?

উপসংহারে আব্দুর রশিদ সাহেব এই অভিমতও ব্যক্ত করেছেন যে, যাকাতের মূল বিধান তো অকাট্য ও চিরন্তন, তবে এর বাস্তব খুঁটিনাটি ব্যাপারে বেশি করে উদ্ভাবনী প্রক্রিয়া (কিয়াস) প্রয়োগ করতে হবে।

আমি আব্দুর রশিদ সাহেবকে আবেদন জানাই, গোলকধাঁধা সৃষ্টি করার পরিবর্তে সহজবোধ্য ভাষায় খোলাখুলিভাবে কথা বলুন, যাতে আমরাও বুঝতে পারি, যাকাতের সেই মূল বিধানটি কি জিনিস, যাকে তিনি দয়া করে অকাট্য ও চিরন্তন বলে মেনে নিয়েছেন এবং যাতে তাঁর কেয়াসের বা খুব বেশি কেয়াসের প্রয়োজন হবেনা। [মাশরিক, ২৭ জুন ১৯৬৬]

[ à§© ]
দৈনিক মাশরিকের বিতর্কিকা শীর্ষক কলামে যাকাত সম্পর্কে রফীউল্লাহ সাহেবের যে চিঠি প্রকাশিত হয়েছে, তাতে কোনো কোনো গ্রন্থের পূর্বাপর অসংলগ্ন ও অসম্পূর্ণ উদ্ধৃতি দিয়ে তা থেকে নানা তথ্য প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয়েছে। যেমন ইমাম জাসসাস কৃত আহকামুল কুরআনের ৩য় খণ্ডের ১৩০ পৃষ্ঠার বরাত দিয়ে নিম্নোক্ত উক্তি উদ্ধৃত করা হয়েছে :

"একটি সহীহ হাদিস অনুযায়ী যাকাতের হার কেবল উট ও অন্যান্য জিনিসের জন্য। টাকাকড়ি সোনা রূপার পুরোটাই যাকাত হিসেবে দিয়ে দিতে হবে।"

উক্ত গ্রন্থের এই পৃষ্ঠায় এমন কোনো হাদিস নেই, যার শাব্দিক অনুবাদ উপরোক্ত কথাটা হতে পারে। তবে এই পৃষ্ঠায় হযরত আবুজর গিফারীর বর্ণিত একটি হাদিস রয়েছে। এ হাদিসটির অনুবাদ এ রকম।
"আমি রসূল সা. -কে বলতে শুনেছি যে, উটের বাবদে যাকাত দিতে হবে। আর যে ব্যক্তি দিনার, দিরহাম বা সোনারূপা ঋণ শোধ বা আল্লাহর পথে ব্যয়ের উদ্দেশ্য ব্যতীত জমা করে রাখবে, কেয়ামতের দিন ঐ সম্পদ আগুনে পুড়িয়ে তা দিয়ে তাকে সেক দেয়া হবে।"

হযরত আবুজর গিফারী সম্পর্কে এ কথা সুবিদিত যে, রসূর সা.-এর এ জাতীয় বক্তব্য এবং কুরআনের আয়াত -------------------- এর ব্যাখ্যা ব্যাপারে তাঁর একটা নিজস্ব স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো। তাঁর মতে এর অর্থ এই যে, কোনো মুসলমানের আদৌ কোনো সঞ্চিত সম্পদ থাকা উচিত নয়। কিন্তু সাধারণ সাহাবিগণ ও অন্যান্য বড় বড় ইমামগণ হযরত আবুজরের এই অভিমতকে সঠিক মনে করেননি। হযরত আবুজরের এ অভিমত মেনে নিলে ওসিয়ত, উত্তরাধিকার, হজ্জ, যাকাত প্রভৃতি সংক্রান্ত কুরআনের বহু সংখ্যক নির্দেশ নিস্ক্রীয় ও অকার্যকর হয়ে পড়ে। প্রকৃতপক্ষে উপরোক্ত আয়াত ও হাদিসের মর্ম এই যে, ধন সম্পদ উপার্জন ও সঞ্চয়কে জীবনের লক্ষ্য বানিয়ে নেয়া এবং আল্লাহ এ তাঁর বান্দাদের প্রাপ্য দেয়াকে এড়িয়ে চলা কোনো মুসলমানের উচিত নয়।

বিস্ময়ের ব্যাপার, রফীউল্লাহ সাহেব উল্লেখিত গ্রন্থের ১৩০ পৃষ্ঠা থেকে নিজের গরজ মোতাবেক একটা বক্তব্য উদ্ধার করেছেন বটে। কিন্তু একই পৃষ্ঠার শেষভাগে বিদ্যমান আর একটি বক্তব্য থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়েছেন। সে বক্তব্যটির অনুবাদ এরূপ :

"রসূল সা.-এর বহুল প্রচলিত হাদিসসমূহ থেকে জানা যায় যে, প্রতি দুই'শ দিরহামে পাঁচ দিরহাম এবং প্রতি ২০ দিনারে আধা দিনার যাকাত অবশ্যই দিতে হয়। গবাদি পশুতেও যাকাত দিতে হয়। তবে পুরো সম্পদ দান করে দেয়া জরুরি নয়।"

সোনারূপার সবটাই যদি দান করা আবশ্যিক হতো, তাহলে যাকাতের হার নির্ধারণের কি অর্থ থাকতো? সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে হযরত উসমান রা. এবং হযরত আব্দুর রহমান বিন আওফের রা. ন্যায় কেউ কেউ বেশ স্বচ্ছল ও বিত্তশালী ছিলেন। রসূল সা. তাঁদের অবস্থা জানতেন। কিন্তু তিনি তাদের সমস্ত সম্পদ দান করার নির্দেশ দেননি। কাজেই প্রমাণিত হলো যে, সমস্ত টাকা কড়ি ও সোনারূপা দান করা জরুরি নয়।

একটি আলোচনার শুরু থেকে একটা উক্তি পৃথকভাবে নিয়ে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে তার ব্যাখ্যা করা হবে, অথচ ঐ আলোচনার উপসংহারে লেখক সকল দিককে সামনে রেখে যে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন, তা পেশ করা হবেনা, এটা জ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে একটা মারাত্মক অসাধু পন্থা।

পরবর্তীতে একই গ্রন্থে ১৯১ পৃষ্ঠার বরাত দিয়ে পত্র লেখক লিখেছেন :
"হযরত ওমর রা. বাণিজ্যিক পণ্যে অনৈসলামিক দেশের অধিবাসীদের উপর শতকরা দশভাগ যাকাত ধার্য করেছিলেন, চাই তারা মুসলমানই হোক না কেন।"
এখানে আবার তিনি জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে গ্রন্থকারের বক্তব্যের অপব্যাখ্যা করেছেন। বক্তব্যের সঠিক অনুবাদ হলো :

"হযরত ওমর রা. স্বীয় কর্মচারীদেরকে লিখিত নির্দেশ দেন, তারা কোনো বাণিজ্যিক পণ্যের ক্ষেত্রে মুসলমানেদর কাছ থেকে শতকরা আড়াই ভাগ, অমুসলিম সংখ্যালঘুদের কাছ থেকে শতকরা পাঁচ ভাগ এবং অমুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলের অধিবাসীদের কাছ থেকে শতকরা দশভাগ আদায় করে। মুসলমানদের কাছ থেকে আদায়কৃত অংশ আবশ্যিক যাকাত হিসেবে গণ্য হবে এবং সে ক্ষেত্রে বর্ষপূর্তি, নিসাবপূর্তি এবং মালিকানা প্রমাণিত হওয়া সংক্রান্ত অপরিহার্য শর্তাবলীর দিকে অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে।"

এখানে অমুসলিম অঞ্চলের অধিবাসী বলতে অমুসলিমদেরকেই বুঝানো হয়েছে। সেখানকার মুসলমানদের প্রসঙ্গ এখানে আলোচিতই হয়নি। কেননা সেখানকার মুসলমানেদর নিসাবপূর্তি, বর্ষপূর্তি প্রভৃতি শর্তের দিকে লক্ষ্য রাখা এবং সে ব্যাপারে যথাযথ তদন্ত চালানো ইসলামি সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই এ উক্তিটির এরূপ ব্যাখ্যা করা মোটেই ঠিক নয় যে, হযরত ওমর রা. অমুসলিম অঞ্চলের মুসলিম অধিবাসীদের কাছ থেকেও যাকাত নিতেন এবং নির্ধারিত শতকরা আড়াই ভাগের পরিবর্তে দশ ভাগ ধার্য করতেন।

এরপরে রফীউল্লাহ সাহেব উট, ছাগল, ভেড়া ও গরুর যাকাতের প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন এবং সূক্ষ্ম হিসাব কষে আমাদেরকে জানাচ্ছেন যে, এগুলোর হার শতকরা আড়াই ভাগ থেকে ভিন্নতর হয়। এভাবে তিনি অনাহ্‌তভাবে একটি বিষয়ের সাথে আর একটি বিষয়ের তালগোল পাকিয়ে ফেলেছেন। যাকাত সংক্রান্ত ইসলামি বিধানের একজন প্রাথমিক শিক্ষার্থীও জানে যে, গাবাদিপশু, কৃষি ফসল, খনিজ দ্রব্য এসব জিনিসের যাকাতের হার আলাদা আলাদা। প্র্রত্যেক জিনিসের যাকাত শতকরা আড়াই ভাগ-এ কথা কে বলেছে? ফলমূল ও কৃষি ফসলের দশ বা বিশ ভাগের এক ভাগ এবং খনিজ দ্রব্য ও প্রোথিত সম্পদে পাঁচ ভাগের এক ভাগ যাকাত স্বয়ং রসূল সা. কর্তৃক নির্ধারিত। খোলাফায়ে রাশেদিন বা অন্য কেউ এটা নতুন করে ধার্য করেননি। এ থেকে এটাও প্রমাণিত হয়না যে, নগদ টাকাকড়ি, সোনারূপা, বাণিজ্যিক ও শিল্প পণ্যে শতকরা আড়াই ভাগের চেয়ে কম বা বেশি যাকাত হতে পারে।

রফীউল্লাহ সাহেব শাহ ওয়ালীউল্লাহ সাহেবের একটি উক্তিও উদ্ধৃত করেছেন, যাতে দেখা যায়, হযরত ওমর রা, জিযিয়ার হার পরিবর্তন করেছিলেন। কথাটা যদি সঠিকও ধরে নেয়া যায়, তবুও এটা একটা আলাদা ব্যাপার। আলোচ্য বিষয়ের সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। জিযিয়া মুসলমানদের উপর নয় বরং অমুসলিমদের উপর আরোপ করা হয়। এর বিনিময় সরকার তাদের জান মাল ও সম্ভ্রমের রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকে এবং তারা দেশ রক্ষার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পায়। তবে অনিবার্য প্রয়োজনের তাগিদে এবং আনুগত্য ও বিশ্বস্ততার ভিত্তিতে যদি তাদের কাছ থেকে দেশ রক্ষার কাজ নেয়া হয়, তাহলে তাদেরকে জিযিয়া থেকে অব্যাহতিও দেয়া যেতে পারে। অথচ সক্ষম মুসলমানদের উপর থেকে যাকাত কোনো অবস্থায় রহিত হয়না। কোনো সরকার এটা মাফ করা বা রদবদল করার অধিকারী নয়। মোটকথা, রফীউল্লাহ সাহেবের এ কথা কোনোভাবেই সঠিক প্রমাণিত হয়না যে, খোলাফায়ে রাশেদিন যাকাতের হার পরিবর্তন করতেন।

আমি বলেছিলাম, অমুসলিমদের উপর যাকাত আরোপিত হয়নি। এর জবাবে আব্দুর রশিদ সাহেব নামক অপর এক পত্রলেখক লিখেছেন, হযরত ওমরের রা. আমলে একটি খৃষ্টান গোত্র জিযিয়াকে অপমানজনক মনে করে তা দিতে অস্বীকার করলে তাকে যাকাত দিতে বাধ্য করা হয়। তবে প্রচলিত হারের দ্বিগুণ যাকাত ধার্য করা হয়। এই ঘটনার আসল বহস্যটাও আমি সংক্ষেপে বর্ণনা করছি।

ঘটনাটি পেশাদার শিকারী যাযাবর গোত্র বনু তাগলাবের। এরা সিরিয়া ও রোমের সীমান্তে বসবাস করতো। হযরত ওমর যখন তাদের উপর জিযিয়া আরোপ করার ইচ্ছে ব্যক্ত করলেন, তখন তারা ওটা দেয়াকে নিজেদের জন্য কষ্টকর ও গ্লানিকর মনে করলো। কেননা দুনিয়ার অন্যান্য স্বাধীনচেতা যাযাবর গোত্রের মতো তারা নগদ জিযিয়া প্রদান করাকে পরাধীনতার প্রতীক মনে করতো। তাই তারা সীমান্ত অতিক্রম করে রোম সাম্রাজ্যে চলে যাওয়ার সংকল্প করলো।

যেহেতু তারা আরব বংশোদ্ভুত গোত্র ছিলো। তাই মুসলমানদের বৈরী একটা শক্তির সাথে তাদের যুক্ত হওয়া সমীচীন ছিলনা। এ ব্যাপারে তাদের সাথে আলাপ আলোচনা করলে তারা বললো, আমাদের উপর মুসলমানদের মতো যাকাত আরোপ করা হলে আমরা সেটা দিতে রাজি। এর জবাবে হযরত ওমর যে উক্তি করেন, তা সুনানে বায়হাকীতে উদ্ধুত হয়েছে। তিনি বললেন : --------------------------------- "না, এটা তো মুসলমানদের উপর ফরয।" তারা বললো, "আপনি আমাদের গবাদিপশু ও সহায় সম্পদের উপর যে হারে ইচ্ছে কর আরোপ করতে পারেন। তবে তাকে জিযিয়া নামে অভিহিত করবেন না।" অবশেষে তাদের উপর মুসলমানদের যাকাতের দ্বিগুণ কর বসানো হলো। তবে তাকে জিযিয়া নামে আখ্যায়িত করা হয়নি। সেই সাথে তাদেরকে এই শর্তেও রাজি করা হয় যে, তারা তাদের বংশধরকে খৃষ্টান করবেনা। সকল ফেকাহবিদের সর্বসম্মত রায় এই যে, এটি একটি ব্যতিক্রমধর্মী ব্যাপার ছিলো এবং এ ঘটনা থেকে জিযিয়া বা যাকাতের কোনো সাধারণ বিধি প্রণয়ন করার অবকাশ নেই।

[ ৪ ]
ডক্টর ফজলুর রহমান ও তার সতীর্থদের যেসব চিঠিপত্র এ যাবত দৈনিক মাশরিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলোতে একটি মৌলিক বক্তব্য সমস্বরে ক্রমাগত উচ্চারিত হয়ে আসছে। সেই বক্তব্যটি হলো যাকাত একটা কর বিশেষ। সরকার ইচ্ছেমত যে কোনো জিনিসের উপর তা আরোপ এবং যে কোনো খাতে তা ব্যয় করতে পারে। যাকাত ছাড়া আর কোনো কর ইসলামে বৈধ নয়। তাই যে করই আরোপ হোক, তা যাকাত হিসেবেই গণ্য হবে। অন্য কথায় ব্যাপারটা দাঁড়ায় এই যে, যাবতীয় সরকারি রাজস্বের উপর ছাপ তো পড়বে যাকাতেরই, কিন্তু নীতিগতভাবে বা কার্যত যাকাত ও করে আদৌ কোনো ব্যবধানই থাকবেনা। যাকাত যে কতকগুলো নির্দিষ্ট জিনিসের উপর নির্দিষ্ট হারে আরোপ ও কতকগুলো বিধিবদ্ধ খাতে ব্যয় করা বাধ্যতামূলক, সেই প্রাচীন ধারণা বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এ বক্তব্য খণ্ডন করার জন্য যখন যাকাত ও করের মূল পার্থক্য তুলে ধরা হয় এবং বলা হয় যে, সরকার যাকাত এবং তার আদায় ও বন্টনের সুনির্দিষ্ট ও শরিয়ত নির্ধারিত কাঠামোকে বহাল ও অক্ষুন্ন রেখে, অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে অন্যান্য জরুরি কর বসাতে পারে, তখন বলা হয় যে, এভাবে তো দুটো স্বতন্ত্র আর্থিক ব্যবস্থা চালু হয়ে যাবে। অথচ ইসলাম রাষ্ট্রের প্রাপ্য ও আল্লাহর প্রাপ্য ভিন্ন ভিন্ন রকম ধার্য করেনা।

বস্তুত, কোনো যুক্তিনির্ভর ও মনোজ্ঞ আলোচনায় এ ধরণের আসারও স্থুল জবাব আশা করা যায়না। সুনির্দিষ্ট ও বিধিবদ্ধ আয়ের উৎস ও ব্যয়ের খাত রয়েছে এমন একাধিক আর্থিক কার্যক্রমে কি কোনো রাষ্ট্রীয় কোষাগার বায়তুলমাল বা অর্থব্যবস্থায় থাকতে পারেনা? এতোটুকু ভিন্নমুখী দু'টো ধারা থাকলেই দুটো স্বতন্ত্র অর্থব্যবস্থা এবং আল্লাহর ও রাষ্ট্রের দু'রকম অধিকার কোথা থেকে বেরিয়ে আসে, তা আমার বুঝে আসেনা। তবে হ্যাঁদ, যদি আসল উদ্দেশ্য এই হয় যে, যাকাতকে নামে মাত্র বহাল রাখা হবে এবং ইবাদত ও ইসলামের স্তম্ভ হিসেবে তার অস্তিত্ব বিলোপ করা হবে, তাহলে অবশ্য ভিন্ন কথা। সে ক্ষেত্রে কোনো আলোচনার স্বার্থকতা থাকেনা। তেমন হবে ব্যাপারটা যে শুধু যাকাতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবেনা, তা সুস্পষ্ট। বর্তমান বিতর্কের মাঝে এক ব্যক্তি হজ্জের উপর বিধিনিষেধ আরোপের ফতোয়া দিয়েই ফেলেছেন। অনুরূপভাবে নামেযের ব্যাপারেও হয়তোবা কেউ বলে বসবে যে, নামাযের 'মৌল তত্ত্ব' শ্রদ্ধাভরে মেনে নিচ্ছি। তবে তা কোন্‌ কোন্‌  সময়ে দিনে কতবার, কতো রাকাত করে পড়তে হবে এবং তাতে কি কি দোয়া কালাম পাঠ করতে হবে, সে ব্যাপারে ইসলামি সরকারের হাতে রদবদলের ক্ষমতা আছে। আর এই নয়া ফতোয়ার পক্ষেও ভুল বিকৃত দলিল প্রমাণ খোঁজাখুঁজি শুরু হয়ে যাবে।

করাচির ইসলামি গবেষণা সংস্থার (ইদারায়ে তাহকিকাতে ইসলামি) সদস্য মুহাম্মদ খালেদ মাসউদ সাহেবের এক চিঠি দৈনিক মাশরিকের ৬ই জুলায়, ১৯৬৬ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। এতেও পুনরায় কতিপয় হাদিস ও ফেকাহ শাস্ত্রীয় উক্তির কদর্থ করে পাঠকদেরকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা চালানো হয়েছে। আমি আপাতত ঐ বিধির বক্তব্য খণ্ডনে কালক্ষেপণের পরিবর্তে কয়েকটি মৌলিক বিষয় ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরছি এবং এই বিতর্কের সাথে সংশ্লিষ্ট সকলকে এ বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তাভাবনা করার আহবান জানাচ্ছি।

১. একটি ইসলামি রাষ্ট্র যদি যাকাত ছাড়া আর কোনো কর আরোপ করতে না পারে, এমনকি অমুসলিমদের কাছ থেকে আদায় করা করকেও যাকাত নামে অভিহিত করা স্থির হয়, তাহলে এ প্রশ্ন না উঠে পারেনা যে, ইসলামে যাকাত ও জিযিয়া নামে দুটো আলাদা আলাদা পরিভাষা কেন তৈরি হয়েছে? এ পরিভাষা দুটো হাদিস বা ফেকাহ শাস্ত্র থেকে উদ্ভুত হয়নি, বরং খোদ কুরআনেই তা উল্লেখিত হয়েছে। কুরআনে এ পরিভাষা দুটো ব্যবহৃতও হয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন স্থানে ও স্বতন্ত্র আঙ্গিকে। কুরআনে যাকাতের উল্লেখ বেশিরভাগ নামাযের সাথেই হয়েছে এবং স্পষ্টই সে নির্দেশ নামাযের নির্দেশের মতো মুসলমানদের প্রতিই জারি হয়েছে। সদকার নির্দেশও যেখানেই এসেছে, পূর্বাপর প্রসঙ্গ দেখলে বুঝা যায় যে, সেখানে রসূল সা.-কে মুসলমানদের পাপ স্খলন ও সংশোধনের উদ্দেশ্যে তাদের কাছ থেকে সদকা গ্রহণ করতে ও তাদের সান্ত্বনার উদ্দেশ্যে তাদের কল্যাণের জন্য দোয়া করতে বলা হয়েছে। অপরদিকে যেখানে জিযিয়ার প্রসঙ্গ আলোচিত হয়েছে, সেখানে পাশাপাশি ইহুদি ও খৃষ্টানদের উল্লেখ রয়েছে। সুতরাং যে ব্যক্তি সচেতনভাবে কুরআন পড়ে, তার পক্ষে এ কথা বিশ্বাস করা সম্ভব নয় যে, সরকার জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকল নাগরিকের উপর যে করই আরোপ করবে তা যাকাতে পর্যবসিত হবে এবং তা যে কোনো মুসলমানের উপর ইচ্ছেমত ব্যয় করা যাবে।

২. 'বাধ্যতামূলক সদকা' তথা যাকাতের অর্থ ব্যয়ের ৮টি খাত কুরআনে বর্ণিত হয়েছে। প্রত্যেক সরকারি কর যদি যাকাত হয়, তাহলে সরকারকে তা প্রত্যেক খাতেই ব্যয় করতে হবে। সরকার যেখানেই তা ব্যয় করবে, তা আপনা আপনি যাকাতের বৈধ খাত হিসেবেই গণ্য হবে। প্রকৃত ব্যাপার যদি তাই হয়, তাহলে তো আল্লাহ তায়ালার যাকাত ব্যয়ের খাত নির্ধারণ করাটি সম্পূর্ণ বৃথা ও পণ্ডশ্রম হয়ে গেছে (নাউজুবিল্লাহ) এর ফলে এই সব খাতের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে অনেককে ভীষণ বিড়ম্বনার মধ্যে পড়তে হচ্ছে। 'পথিকের' খাত ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কেউবা বিমানযোগে ভ্রমণকেও এর আওতায় এনে দিচ্ছে। আবার কেউবা 'যাকাত কর্মীর' ব্যাখ্যা এমনভাবে করেছে যে, বেসামরিক সরকারি কর্মচারীদের বেতনও এই খাত থেকে দেয়া বৈধ সাব্যস্ত করা হচ্ছে। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে, সামরিক কর্মচারীদের এই খাতের আওতায় আনার কথা তাদের মনে থাকেনা। অথচ বেসামরিক সরকারি কর্মচারী যদি 'যাকাত কর্মী' খাতের আওতায় আসতে পারে, তাহলে সামরিক কমীচারীদের কি দোষ, তারা এ খাত থেকে কেন বঞ্চিত হবে?

৩. পবিত্র কুরআনে যাকাত ব্যয়ের খাতসমূহের মধ্যে দরিদ্র ও নি:স্ব লোকদেরকে সর্বাগ্রে উল্লেখ করা হয়েছে। একাধিক হাদিস থেকেও জানা যায় যে, যাকাত ধনীদের কাছ থেকে নিয়ে দরিদ্রদের মধ্যে বন্টন করতে হবে। ছয়খানা প্রখ্যাত বিশুদ্ধ হাদিস গ্রন্থে হযরত ইবনে ওমরের বর্ণিত হাদিসে বলা হয়েছে, জীবিকা উপার্জনে সক্ষম কোনো সুস্থ সবল লোক এবং কোনো স্বচ্ছল লোকের জন্য যাকাত গ্রহণ বৈধ নয়। কয়েকটি হদিসে শুধুমাত্র কতিপয় ব্যতিক্রমধর্মী পরিস্থিতিতে ধনী লোককেও যাকাত গ্রহণের অনুমতি দেয়া হয়েছে। নচেৎ সাধারণ স্বীকৃত মূলনীতি এটাই যে, ধনী লোকদের জন্য যাকাত গ্রহণ জায়েয নয়।

যাকাত ও সাধারণ করের মধ্যে আরো একটা মৌলিক পার্থক্য হলো, যাকাত শুধু নিসাবধারী (নির্দিষ্ট ন্যূনতম বার্ষিক সঞ্চয়ের অধিকারী) ধনী ব্যক্তিদের কাছ থেকে আদায় ও গরিবদের মধ্যে বন্টন করতে হয়। পক্ষান্তরে করের বোঝা ধনী গরিব নির্বিশেষে সকল নাগরিকের উপর পড়ে। আর কর আদায় বাবদ যে রাজস্ব সরকারি কোষাগারে জমা হয়, তা দ্বারা অনেক সময় ধনীরা বেশি এবং গরিবেরা কম উপকৃত হয়ে থাকে। এ জন্য আল্লাহ এ তার রসূল সা. গরিবদের স্বার্থ রক্ষার্থে যাকাতের একটা বিশেষ তহবিল গঠন করেছেন, যাতে ধন সম্পদ একতরফাভাবে ধনীদের কাছ থেকে শুধুমাত্র গরিবদের দিকেই আবর্তিত হয়ে থাকে। অন্য কোনো সরকারি করে এ ব্যবস্থা নেই। কিন্তু এ যুগের এক ধরনের পণ্ডিত মহারথী প্রয়োজনের চেয়ে বেশি উদারতা ও মহানুভবতার পরাকাষ্ঠা দেখাতে গিয়ে যাকাত ও প্রচলিত করের পার্থক্য একেবারেই বিলোপ করতে ইচ্ছুক, যার পরিণামে আল্লাহ ও রসূলের আদেশও লংঘন করা হবে গরিবদের হকও নষ্ট হবে। অর্থাৎ দুনিয়া ও আখিরাতে দুটোই গোল্লায় যাবে।

৪. যাকাত সম্পর্কে রসূল সা.-এর  আরো একটা ফরমান একাধিক হাদিসে ঘোষিত হয়েছে। এ ফরমানে জানা যায় যে, রসূল সা.-এর বংশধরের জন্য যাকাত হালাল নয়। রসূল সা. নিজে রাষ্ট্রের কর্ণধার ছিলেন এবং সরকারি কর্মচারীদেরকে 'যাকাত কর্মীর' আওতাধীন করার নতুন উদ্যোগ রাষ্ট্র প্রধানের যাকাতের অংশ পাওয়ার কথা। কিন্তু রসূল সা. নিজে কখনো যাকাত বা 'বাধ্যতামূলক সদকা' দ্বারা উপকৃত হননি।

এমনকি হযরত হাসান রা. শিশুকালে সদকার একটা খেজুর মুখে দিলে রসূল সা.  তৎক্ষণাৎ জোরপূর্বক তা মুখ থেকে বের করে দেন এবং বলেন, এটা আমাদের জন্য হারাম।

ফেকাহ শাস্ত্রকারগণ সুস্পষ্টভাবে বলেছেন যে, বনু হাশেম গোত্রের লোকদের জন্য যাকাত গ্রহণ করা জায়েয নয়। এখন যারা সকল সরকারি কর্মচারীর জন্য যাকাত হালাল করে দিতে চান, তাদের কাছে আমি জানতে চাই যে, রসূল সা. এই দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা থাকা অবস্থায় তারা সৈয়দ, আলভী, ও আব্বাসী বংশোদ্ভুত কর্মচারীদের উপর কিভাবে যাকাত ব্যয় করবেন? আল্লাহর নবী সা. যখন অসাধারণ ত্যাগের মনোভাব দেখিয়ে নিজেকে ও নিজের বংশধরকে যাকাত থেকে বঞ্চিত করেছেন, তখন এই নিষেধাজ্ঞাকে অবজ্ঞা করার অধিকার কার আছে? আর এই নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকা অবস্থায় সরকারি কোষাগারে যাকাত ছাড়া আর কোনো অর্থ না থাকলে এই সব কর্মচারীর বেতন কোথা থেকে আসবে?

শরিয়তের নির্ধারিত যাকাত ব্যবস্থায় রদবদল করলে এবং যাকাতের সাথে সাধারণ করকে মিলিয়ে মিশিয়ে একাকার করে ফেললে যে জটিল ও কুৎসিত পরিস্থিতির সৃষ্টি হবার সম্ভাবনা রয়েছে, তার কয়েকটি দিক সম্পর্কে আমি সংক্ষেপে আভাস দিলাম। প্রতিটি বক্তব্যের সপক্ষে যুক্তি ও কুরআন হাদিসের সুস্পষ্ট উক্তির আলোকে প্রমাণাদিও উল্লেখ করেছি। অধিকাংশ প্রমাণই কুরআন ও হাদিসের সুস্পষ্ট উক্তি থেকে সংগৃহীত, অপরিচিত ও বিরল ফেকাহ শাস্ত্রিয় বিধির উপর নির্ভরশীল নয়। যারা সত্যনিষ্ঠ ও ইনসাফপ্রিয় এবং যারা ইসলামের বিকৃতি সাধনের বাতিকে ভোগেননা, তাদের কাছে আমার অনুরোধ, আমার কথাগুলো ঠাণ্ডা মাথায় পুনরায় বিবেচনা করুন এবং হঠকারীতার নীতি পরিহার করে চলুন। [তরজমানুল কুরআন, জুন ১৯৬৬]


<h1>১৭। পিতামাতার অধিকার</h1>
প্রশ্ন : আমাদের বন্ধু বান্ধব মহলে কয়েকটি বিষয়ে বিতর্ক ও মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। অনুগ্রহপূর্বক এগুলোর সঠিক সমাধান কি জানাবেন। বিতর্কিত বিষয়গুলো নিম্নরূপ :

১. হাদিসে কি বলা হয়েছে, কেয়ামতের দিন মানুষ মায়ের নামে পরিচিত হবে? মায়ের ফযিলত ও অধিকার প্রসঙ্গে কেউ কেউ এ হাদিস বর্ণনা করে থাকেন।
২. এ কথা কি সত্য যে,  পিতা নিজের পুত্র বা কন্যাকে হত্যা করলে তিনি মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হননা? এর কারণ কি এই যে, হত্যাকারি নিহত ব্যক্তির উত্তরাধিকারী বিধায় তিনি নিজেই ক্ষমা করার অধিকারী? যেসব অপরাধ বান্দার অধিকারের সাথে সংশ্লিষ্ট, সেগুলোর ব্যাপারে ইসলামের মূলনীতি কি এই যে, শারীরিক বা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তি ক্ষমা করে দিলে অধিকার হরণকারীর শাস্তি হবেনা?
à§©. সন্তানের উপর পিতামাতার আনুগত্য কোন্‌ কোন্‌ ব্যাপারে জায়েয এবং কোন্‌ কোন্‌ ব্যাপারে ফরয? পিতামাতার আদেশ দিলে পুত্র কি শরিয়ত মতে স্বীয় স্ত্রীকে তালাক দিতে বাধ্য?

জবাব : ১. আল্লাহ ও তাঁর রসূল সা. যে পিতামাতার অধিকারের ব্যাপারে অত্যধিক জোর দিয়েছেন, তাঁদের উভয়ের সাথে প্রীতিকর আচরণের কড়া নির্দেশ দিয়েছেন এবং নিজের অধিকারের সাথে সাথে পিতামাতার অধিকার বর্ণনা করেছেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এ কথাও সত্য যে, কোনো কোনো সহীহ হাদিসে যেখানে পিতামাতার প্রতি সদাচরণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে, সেখানে প্রথমে দু'তিন বার মাতার কথা উল্লেখ করে তারপর পিতার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্নে যে কথা জিজ্ঞেস করা হয়েছে, তা কোনো বিশুদ্ধ ও প্রামাণ্য হাদিসে নেই। কোনো কোনো গ্রন্থে এ ধরণের একটি হাদিস বর্ণিত হলেও হাদিস শাস্ত্রিয় বিশেষজ্ঞগণ ও হাদিস বর্ণনাকারীদের জীবনী সংক্রান্ত 'রিজাল শাস্ত্র' বিশারদগণের মতে ওটা সহীহ হাদিস নয়। হাদিসটির মূল ভাষ্য হলো :
                      -----------------------------------------------------
"কেয়ামতের দিন মানুষকে নিজ নিজ মায়ের সাথে সম্পর্কযুক্ত করে ডাকা হবে, যাতে আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের গোপনীয়তা রক্ষা পায়।"

ইমাম ইবনে জাওযী এটিকে জাল বা মনগড়া হাদিস বলে আখ্যায়িত করেছেন। ইমাম সুয়ুতী যদিও স্বীয় 'আত্‌-তায়াক্কুবাত আলাল মাউযুরাত' (মনগড়া হাদিস পর্যালোচনা) নামক গ্রন্থে ইমাম ইবনে জাওযী কর্তৃক কিছু কিছু হাদিসকে কৃত্রিম সাব্যস্তকরণের রায় খণ্ডন করেছেন, কিন্তু এ হাদিসকে তিনি ঐ গ্রন্থের কেয়ামত সংক্রান্ত অধ্যায়ে ইমাম ইবনে আদীর বরাত দিয়ে 'মুনকার' আখ্যায়িত করেছেন। মুনকার বলা হয় সেই যয়িফ হাদিসকে, যার বর্ণনাকারী মারাত্মক ভুল, নিদারুণ শৈথিল্য অথবা পাপাচারের দায়ে দোষি সাব্যস্ত হন।

পিতামাতার বিশেষত মাতার সম্মান ও মর্যাদা সম্পর্কে কুরআন ও হাদিসে সুস্পষ্ট বক্তব্য থাকার পর এ ধরণের মনগড়া বা মারাত্মক যয়িফ হাদিসের আশ্রয় নেয়ার কি দরকার, যাতে মাতার শ্রেষ্ঠত্বের কোনো বিশেষ দিক নির্দেশ করা হয়নি। অধিকন্তু তা কুরআনের সূরা আহযাবের যে আয়াতে মানুষকে স্বীয় পিতার পরিচয়ে পরিচিত করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে তারও বিপরীত।

২. এ কথা সত্য যে, অধিকাংশ ফেকাহ শাস্ত্রবিদ সন্তান হত্যার দায়ে পিতাকে মৃত্যুদণ্ড না দেয়ার পক্ষপাতি। তবে সেটা এ জন্য নয় যে, পিতা স্বীয় সন্তানের উত্তরাধিকারী এবং খুনের বদলার আইনগত দাবিদার, আর তিনি ইচ্ছে করলে নিজেই নিজেকে ক্ষমা করতে পারেন। নিজের অপরাধের জন্য নিজেই নিজেকে ক্ষমার যোগ্য সাব্যস্ত করা যেতে পারে এটা একেবারেই একটা বাজে ও ভিত্তিহীন ধারণা। নিহত ব্যক্তির উত্তরাধিকার বা তার খুনের বদলার আইনগত দাবিদার হলেই যে সে স্বয়ং খুনি হয়েও মৃত্যুদণ্ড থেকে অব্যাহতি পাবে- এ কথাও ভুল। পিতাকে সন্তান হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ড থেকে অব্যাহতি দেয়া একটা ব্যতিক্রমী ব্যবস্থামাত্র। এক সাহাবির সাথে তাঁর পুত্রের অবনিবণার কথা জানতে পেরে রসূল সা. তাঁর পুত্রকে বলেছিলেন, ---------------------------- "তুমি ও তোমার যাবতীয় সহায় সম্পদ তোমার পিতার সম্পদ।" এ ঘটনা থেকে বুঝা যায়, সন্তানের উপর পিতার অধিকার কতো বেশি ও নিরংকুশ। অপর এক হাদিসে সন্তান সন্ততিকে পিতার উপার্জন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সন্তানের মোকাবেলায় পিতার এই অসাধারণ গুরুত্ব ও মর্যাদার পরিপেক্ষিতেই এই বিধি প্রণয়ন করা হয়েছে যে, পিতামাতাকে সন্তান হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবেনা। তবে তার অর্থ এটা নয় যে, পিতা সন্তানকে অন্যায়ভাবে হত্যা করলে তাকে আল্লাহর কাছেও জবাবদিহি করতে হবেনা।

পিতামাতা ছাড়া অন্য যেসব উত্তরাধিকার এবং খুনের বদলা আদায়ের আইনসঙ্গত হকদার, তাদের কেউ কেউ নিহত আত্মীয়ের খুনি হলে উত্তরাধিকারী হওয়া সত্ত্বেও তাদেরকে মৃত্যুদণ্ড দণ্ডিত করা যায়। আর যদি উত্তরাধকার লাভের উদ্দেশ্যে হত্যা করে থাকে তবে সে উত্তরাধিকার থেকেও বঞ্চিত হবে।

ইসলামি শরিয়ত এরূপ বিধানও দেয়নি যে, বান্দার অধিকার লংঘনজনিত অপরাধের ক্ষেত্রে মজলুম ব্যক্তি বা তার অভিভাবক ক্ষমা করে দিলে রাষ্ট্র উক্ত অপরাধি বা জুলুমকারীকে শাস্তি দিতে পারবেনা। মানুষের জানমাল ও সম্ভ্রম হানিজনিত বহু অপরাধ সরকারের হস্তক্ষেপ ও বিচার বিবেচনার যোগ্য এবং তা দ্বিপক্ষীয় সম্মতি দ্বারা আইনসিদ্ধ হয়ে যায়না। উদাহরণস্বরূপ, ব্যভিচার, চুরি ও ডাকাতি এমন অপরাধ, যাকে রাষ্ট্র সব সময় প্রতিরোধ করবে এবং শাস্তি দেবে। কেননা বিচ্ছিন্ন হত্যাকাণ্ড অনেক সময় ব্যক্তিগত আক্রোশ ও শত্রুতা বা সাময়িক উস্কানির বশে সংঘটিত হতে পারে। নিহতের উত্তরাধিকারীরা যদি দিয়াত (আর্থিক ক্ষতিপূরণ) নিয়ে ক্ষমা করতে রাজি হয়ে যায়, তাহলে পরবর্তী প্রতিশোধমূলক তৎপরতা, রক্তপাত ও গোলাযোগের পথ বন্ধ হতে পারে। কিন্তু উপরোক্ত সামাজিক অপরাধগুলো এমন ধরণের যে, এগুলোর ব্যাপারে নমনীয়তা ও শৈথিল্য দেখালে আরো অনাচার ও দুষ্কৃতি ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা প্রবল হয়ে উঠে। হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রেও নিহত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীরা আর্থিক ক্ষতিপূরণ গ্রহণ করে ক্ষমা করে দিলে মৃত্যুদণ্ড তো রহিত হয়ে যাবে, কিন্তু কোনো কোনো ফেকাহ শাস্ত্রকারের মতে উত্তরাধিকারীরা ক্ষমা করতে রাজি হয়ে যাওয়ার পরও ইসলামি সরকার যদি মনে করে যে গোলযোগ ও দুষ্কৃতির উৎসগুলোকে পুরোপুরি নির্মুল করার জন্য হত্যাকারীর কিছু শাস্তি হওয়া দরকার, তবে তার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

৩. যে সমস্ত কার্যকলাপ আল্লাহ ও রসূলের নিকট নিন্দনীয় ও নিষিদ্ধ, সেসব কাজে কারো আনুগত্য করা জায়েয নেই। এ ছাড়া অন্যসব ব্যাপারে মাতাপিতার আনুগত্য করা জায়েয, মুস্তাহাব, এমনকি অধিকাংশ ক্ষেত্রে অবশ্য কর্তব্য। পিতার কথামত স্ত্রীকে তালাক দেয়া যাবে কিনা, এ প্রশ্নের জবাব এই যে, শুধুমাত্র সেই ক্ষেত্রেই তালাক দেয়া যাবে যখন পিতার আদেশ শরিয়তের দৃষ্টিতে কল্যাণকর হয়। নচেত তালাক আল্লাহর দৃষ্টিতে সর্বাবস্থায় ঘৃণিত ও অপছন্দণীয় কাজ।

আসলে এ প্রশ্নটির সূচনা হয়েছিল এভাবে যে, একবার হযরত ওমর রা. স্বীয় পুত্রকে বলেছিলেন, তোমার স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দাও। পুত্র সেই আদেশ অনুসারে তালাক দিয়ে দিয়েছিলেন। তবে বলাই বাহুল্য যে, সব পিতা হযরত ওমরের মতো হ'তে পারেনা। তিনি রসূল সা.-এর একজন উঁচু দরের সাহাবি এবং খোদাভীরু মানুষ ছিলেন। তাঁর পবিত্র জীবন ও অতুলনীয় চরিত্রের পরিপেক্ষিতে স্বভাবতই প্রত্যাশা করা চলে যে, তিনি কোনো যুক্তিসঙ্গত ও শরিয়তসম্মত কারণটি ব্যাখ্যা করা হয়তো আবশ্যক ছিলনা বা সমীচীন ছিলনা। আর হযরত ইবনে ওমর এই বিশ্বাস ও আস্থার ভিত্তিতেই তাঁর আদেশ মেনে নিয়েছিলেন। এমনও হতে পারে যে, হযরত ওমর কারণ ব্যাখ্যা করেছিলেন কিন্তু সেটি পরবর্তী সময়ের বর্ণনা থেকে বাদ গেছে। তাই বলে একজন পিতা যখন খুশি পুত্রের কাছে তার স্ত্রীকে তালাক দেয়ার আবদার করবেন, আর পুত্রের তা না মেনে উপায়ান্তর থাকবেনা, এমন কথা এই ঘটনা থেকে বুঝা যায়না। [তরজমানুল কুরআন, ডিসেম্বর ১৯৬৬]


<h1>১৮। লোহার আংটি পরা কি জায়েয?</h1>
প্রশ্ন : লোহার আংটি পরা  বৈধ কি অবৈধ- এ সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে সাপ্তাহিক 'আইন' পত্রিকার ৩০শে সেপ্টেম্বর, ১৯৬৬ সংখ্যায় বলা হয়েছে, কুরআন ও হাদিসের কোথাও এটি নিষিদ্ধ হয়নি। উপরন্তু রসূল সা. যে আংটি পরতেন তা লোহার তৈরি এবং তার উপর রূপা দিয়ে মোড়নো ছিলো। এ জবাব আমার কাছে সন্তোষজনক মনে হয়নি। কারণ মিশকাত শরিফের আংটি সংক্রান্ত অধ্যায়ে হযরত বারীদা রা. থেকে বর্ণিত হাদিসে বলা হয়েছে :
---------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
পিতলেন আংটি পরা এক ব্যক্তিকে রসূল সা. বললেন :
"ব্যাপার কি? তোমার কাছ থেকে মুর্তির ঘ্রাণ পাচ্ছি কেন? সে আংটিটি ফেলে দিয়ে চলে গেলো। পরে আবার লোহার আংটি পরে এলো। তখন রসূল সা. বললেন : ব্যাপার কি? তুমি দেখছি দোজখিদের অলংকার পরেছো। সে তৎক্ষণাৎ সেটি ছুঁড়ে ফেললো। অত:পর বললো : ইয়া রসূলুল্লাহ! কিসের আংটি পরবো? রসূল সা. বললেন রূপার।" (তিরমিযি, আবু দাউদ)

মুয়াত্তায়ে ইমাম মুহাম্মদ গ্রন্থের ১৭০ পৃষ্ঠায় হযরত ইবনে ওমরের বর্ণিত হাদিসের পরে ইমাম মুহাম্মদের মন্তব্য লক্ষ্যণীয় :
---------------------------------------------------------------------------------------------------------
"মুহাম্মদ বলেন, আমরা এই হাদিসই অনুসরণ করি। পুরুষের পক্ষে সোনা, লোহা বা পিতলের আংটি পরা উচিত নয়। কেবলমাত্র রূপার আংটি পরা উচিত।"

আমার মতে, হাদিসের আলোকে যদিও কেবল, সোনার আংটিই কড়াকড়িভাবে হারাম, তথাপি লোহা, তামা, পিতল প্রভৃতি ধাতুর তৈরি আংটির নাজায়েয এবং মাকরূহ বটে। পুরুষের জন্য শুধুমাত্র রূপার আংটিরই অনুমতি রয়েছে। ইমাম মুহাম্মদের অভিমত এ কথারই সাক্ষ্য দেয়।

জবাব : রূপার আংটি যে নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্য এবং সোনার আংটি কেবল নারীর জন্য বৈধ, সে ব্যাপারে সকল ফকীহ ও মুহাদ্দিস একমত। লোহা ও অন্যান্য ধাতুর ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে। তবে সবচেয়ে বিশুদ্ধ মত, পুরুষের জন্য একমাত্র সোনার অলংকারই হারাম। লোহার আংটির নির্দ্বিধায় জায়েয এবং কোনো রকম মাকরূহ নয়। আপনি তিরমিযি ও আবু দাউদের যে হাদিস উদ্ধৃত করেছেন, তাতে যদিও লোহার আংটিকে দোযখবাসীর অলংকার বলা হয়েছে, কিন্তু ঐ হাদিসটির সূত্র দুর্বল। বুখারি ও মুসলিম এই মর্মে সহীহ হাদিস রয়েছে যে এক সাহাবি যখন বিয়ে করার ইচ্ছে ব্যক্ত করলেন তখন রসূল সা. তাকে মোহর প্রদানের নির্দেশ দিয়ে বললেন : "একটা লোহার আংটি দিয়েও যদি পারো মোহরের ব্যবস্থা কর।" মুসলিম শরিফের বিয়ে সংক্রান্ত অধ্যায়ে মোহর প্রসঙ্গে উদ্ধৃত হাদিসের ভাষা এরকম।
                                 ----------------------------------
"একটা লোহার আংটি হলেও যোগাড় কর।"
ইমাম বুখারি বিয়ে সংক্রান্ত অধ্যায়ে একাধিক জায়গায় এ হাদিসটি উদ্ধৃত করেছেন। মুয়াত্তায়ে ইমাম মালেকে হাদিসটির ভাষা এরকম :
                          -----------------------------------------
"একটা লোহার আংটি হলেও সংগ্রহ কর।"

বস্তুত : লোহার আংটির বৈধতা প্রতিপন্নকারী হাদিসগুলো বিশুদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য। এর বিপরীতগুলো দুর্বল। ইমাম তিরমিযি স্বীয় গ্রন্থভুক্ত হাদিসকে 'গরিব' অর্থাৎ বিরল বলে অভিহিত করেছেন। এ হাদিসের একজন বর্ণনাকারী আব্দুল্লাহ ইবনে মুসলিম মারওয়ারী সম্পর্কে হাদিসবেত্তাগণ নানা রকম আপত্তি তুলেছেন। ইমাম খাত্তাবী আবু দাউদের টীকাগ্রন্থ 'মায়ালেমুস সুনানে' ঐ বর্ণনাকারী সম্পর্কে আবু হাতেম রাযীর নিম্নোক্ত মন্তব্য উদ্ধৃত করেছেন : -------------------------- তাঁর বর্ণিত হাদিস লিপিবদ্ধ করা যেতে পারে, তবে প্রমাণ হিসেবে পেশ করা যায়না। বুখারি ও মুসলিমে লোহার আংটি সংক্রান্ত যে হাদিস রয়েছে তার ব্যাখ্যা প্রসেঙ্গে ইমাম নববী বলেন :
"আলোচ্য হাদিসের আলোকে লোহার আংটি পরা জায়েয। অবশ্য এ ব্যাপারে প্রাচীন ইমামদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। এটি মাকরূহ কিনা সে ব্যাপারে হাদিস বিশারদদের দু'রকম মতামত রয়েছে। বিশুদ্ধতর মত হলো, লোহার আংটি মাকরূহ নয়। কেননা যে হাদিসে এটি নিষিদ্ধ করা হয়েছে তা দুর্বল। আমি এ বিষয়টি আমার গ্রন্থ মুহাযযাবে সবিস্তারে আলোচনা করেছি।"

মুয়াত্তায়ে ইমাম মুহাম্মদের যে হাদিসের উল্লেখ আপনি করেছেন, তার বক্তব্য থেকে পুরুষের জন্য রূপা ছাড়া অন্য সকল ধাতুর ব্যবহার নিষিদ্ধ বুঝা যায়না। এতে  হযরত ইবনে ওমরের রা. বর্ণিত হাদিস থেকে শুধু এতোটুকু জানা যায় যে, রসূল সা. সোনার আংটি খুলে ছুঁড়ে ফেলে দেন এবং সাহাবায়ে কেরামও নিজ নিজ আংটি ফেলে দেন। সাহাবায়ে কেরাম যেসব আংটি খুলে ফেলে দেন তা সোনার আংটি ছিলো, এ ধারণাই অধিকতর যুক্তিসঙ্গত বলে মনে হয়। কারণ হযরত ইবনে ওমরের বর্ণিত অন্যান্য হাদিস থেকে এর সমর্থন পাওয়া যায়। ঐসব হাদিস থেকে জানা যায় যে, রসূল সা. কিছুদিন সোনার আংটি পরেছিলেন এবং তাঁর দেখাদেখি সাহাবিগণ সোনার আংটি পরা শুরু করে দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি যখন ওটা খুলে ফেললেন, তখন সাহাবিগণও তা খুলে ফেলেন। মুসনাদে আহমাদে এ ধরণের একাধিক হাদিস রয়েছে। তার একটি এরূপ :
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
"রসূল সা. একটি সোনার আংটি পরতে লাগলেন আর অন্যরাও সোনার আংটি পরতে লাগলেন। রসূল সা. বললেন : আমি এই আংটি পরে আসছিলাম। এখন আর পরবোনা। এই বলে ছুঁড়ে ফেললেন। লোকেরাও তৎক্ষণাৎ তা ছুঁড়ে ফেললেন।"

লোহার আংটি সম্পর্কে বলা যেতে পারে যে, অন্য কয়েকটি হাদিস থেকেও সুস্পষ্টভাবে তার জায়েয হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়। আবু দাউদের লোহার আংটি সংক্রান্ত অধ্যায়ে রসূল সা.-এর আংটির বিবরণ দিতে গিয়ে বলা হয়েছে :
---------------------------------------------------------------------------------
অর্থাৎ রসূল সা.-এর আংটি রূপায় মোড়ানো লোহা দিয়ে তৈরি ছিলো। এ হাদিসটি নাসায়ি শরিফেও রয়েছে। প্রসঙ্গত: এ বিষয়টাও লক্ষণীয় এবং উল্লেখযোগ্য যে, বর্তমানকালে সাধারণত, যে লোহা দিয়ে আংটি বানানো হয় তা হচ্ছে ইস্পাত এবং এটা বিভিন্ন উপাদানের মিশ্রণ বিশেষ। সুতরাং নিরেট লোহার আংটি যদি মাকরূহ সাব্যস্ত হয়ও, তবু যেসব আংটি সোনা ব্যতীত লোহা ও অন্যান্য উপাদানের মিশ্রণে তৈরি হয়, তার ব্যবহারে বিধিনিষেধ আরোপের পক্ষে কোনো বলিষ্ঠ প্রমাণ দেখা যায়না।[তরজমানুল কুরআন, ডিসেম্বর ১৯৬৬]


<h1>১৯। উশর ও খারাজের কয়েকটি সমস্যা</h1>
প্রশ্ন : উশর (ফসলের যাকাত হিসেবে দেয় দশভাগের একভাগ) ও খারাজ (ইসলামি বিধান অনুসারে ভূমিকর) সংক্রান্ত কয়েকটি সমস্যার সমাধান প্রয়োজন, বিস্তারিত জানিয়ে উদ্বেগ নিরসনের অনুরোধ জানাচ্ছি।

আমার মতে উপমহাদেশের ভূমি উশরযোগ্য নয় বরং খারাজযোগ্য। বর্তমান সরকার আমাদের কাছ থেকে যে রাজস্ব আদায় করে থাকে তা খারাজের পর্যায়ে পড়ে। ইতিহাসের গ্রন্থাবলী থেকেও তারই আভাস পাওয়া যায়। ইবনে আসীর আল কামিল গ্রন্থের ২০৫ পৃষ্ঠায় মুহাম্মদ বিন কাসেমের সিন্ধু বিজয় সম্পর্কে বলেছেন, বিজিত এলাকার অধিবাসীদের জানমাল ও ভূ-সম্পত্তি যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছিল। কেবল ভূমির উপর শরিয়তের বিধান মোতাবেক খারাজ আরোপ করা হয়েছিল। অত:পর ৩৯২ হি. সনে জয়পাল সুলতান মাহমুদের কাছে গিয়ে বলে : "আমার অপরাধ ক্ষমা করুন এবং আমাকে ছেড়ে দিন। এখন থেকে আমি যত দিন বেঁচে থাকবো আর কখনো আনুগত্য থেকে বিচ্যুত হবোনা এবং বার্ষিক খারাজ নিয়মিতভাবে দিতে থাকবো। এতে কোনো রকম ওজর আপত্তি ও টালবাহানা করবোনা।" বস্তুত এই খারাজই সকল মুসলিম শাসনামলে চালু ছিলো। আইনে আকবরি গ্রন্থের সাক্ষ্য এই যে, মোগল শাসনামলেও এই রীতি প্রচলিত ছিলো। আমাদের এতোদঞ্চলের ভূমিতে কখনো উশর চালু ছিলো বলে কোনো ইতিহাস গ্রন্থেই তথ্য পাওয়া যায়না। সুতরাং আমাদের দেশের ভূমির বাবদে উশরের বদলে খারাজ প্রদানই অধিকতর যুক্তিসঙ্গত বলে মনে হয়। আর সেই খারাজও প্রচলিত খাজনার আকারেই আদায় হয়ে যাচ্ছে। কেননা শরিয়তের সর্বস্বীকৃত বিধান হলো, মুসলমানদের উপর একই সাথে খারাজ ও উশর দুটোই আরোপিত হতে পারেনা। ----------------------------------------
(আল কামিল, ইবনে আদী কর্তৃক বর্ণিত, ফাতহুল কাদীর ৪র্থ খণ্ড)

পক্ষান্তরে আমাদের জমি যদি উশরযোগ্য হয়, তাহলে যেসব জমিকে নদীর পানি দ্বারা সিঞ্চিত করা হয়, তার উপর সরকার দু'ধরণের কর আরোপ করে থাকে। একটি হচ্ছে সেচ কর, অন্যটি খাজনা। এ ধরণের জমিতে এক দশমাংশ দিতে হবে, না এক বিংশতি অংশ? আর সেটা খাজনা বাদে, না খাজনা সমেত?

অধিকাংশ ভূমি মালিক বর্গাচাষীদের দ্বারা চাষ করিয়ে থাকেন, যাদের সাথে ফসলের অর্ধাংশ দেয়ার চুক্তি নির্ধারিত থাকে। কোনো কোনো ভূমি মালিক কৃষি শ্রমিক নিয়োগ করে থাকে। তাদের নির্ধারিত মজুরি ঐ জমির উৎপন্ন ফসল থেকে ফসল কিংবা নগদ টাকার আকারে দেয়া হয়। কোনো কোনো ভূমি মালিক আবার নিজেও চাষ করে থাকে। এখন উশর কি উভয়ের উপর আরোপিত হবে, না শুধু ভূমি মালিকের উপর? যদি উভয়ের উপর হয়, তবে ফসল ভাগ বাটোয়ারা হওয়ার পর, না আগে? আর এতে পাঁচ ওয়াসাক ন্যূনতম নিসাব নির্ধারিত, না যে কোনো পরিমাণের উপর উশর ধার্য হবে?

ফসল ছাড়া যে পশুখাদ্য উৎপন্ন হয়,  তার বেশিরভাগ কৃষিকাজে ব্যবহৃত পশুই খেয়ে ফেলে। একটা অংশ বিক্রি হয়। এই অংশের উপর উশর দিতে হবে কিনা?

জবাব : উপমহাদেশীয় ভূমি উশরযোগ্য, না খারাজযোগ্য, তা নিয়ে অনেক আলোচনা ও বাদানুবাদ চলে আসছে। তবে এতদঞ্চলের হানাফি ও আহলে হাদিসসহ সকল মাযহাবের মান্যগণ্য আলেমদের ফতোয়া অনুসারে মুসলমানদের মালিকানাধীন জমিতে উশর দেয়াই সঠিক ও সাবধানী পন্থা। নিজ ভূমি থেকে ফসল অর্জনকারী মুসলমান মাত্রই কুরআনের নির্দেশ ----------------------- "ফসল ঘরে তোলার দিন ফসলের প্রাপ্য পরিশোধ কের দাও" অনুসারে উশর দিতে সর্বাবস্থায় বাধ্য। আপনি যে কয়টি উক্তির উদ্ধৃতি দিয়েছেন তা এ ব্যাপারে কোনো সঠিক ও কার্যকর দিক নির্দেশনা দিতে সক্ষম নয়।

প্রথমত, প্রত্যেক মুসলমান সরকার যে কোনো ভূমি রাজস্ব আদায় করলেই তাকে খারাজ বা উশর নামে অভিহিত করা যায়না। শরিয়তে খারাজ ও উশরের জন্য যে উদ্দেশ্য ও নিয়মবিধি নির্ধারিত রয়েছে, ঠিক সেই উদ্দেশ্যে ও সেই নিয়মবিধি অনুসারে একটি ইসলামি সরকারের অধীনে যে ভূমি রাজস্ব লেনদেন করা হয়, তাকেই খারাজ বা উশর নামে আখ্যায়িত করা যায়। জমির আজকাল যে কর ধার্য করা হয়ে থাকে, তার পেছনে খারাজ বা উশরের চেতনা বিন্দুমাত্রও কার্যকরি নেই। এই করকে উশর বা খারাজ নাম দিয়ে কোনো ভূ-স্বামী যদি উশর দিতে অস্বীকার করতে পারে, তাহলে একই পন্থায় একজন পুঁজিপতি এবং শিল্পপতিও বলতে পারে যে, আমি আমার পুঁজি বা সম্পদের উপর যে বিভিন্ন ধরণের কর দিয়ে থাকি, তাতেই আমার যাকাত আদায় হয়ে যায়। এর ফল দাঁড়াবে এই যে, সরকারের প্রাপ্য সরকার ঠিকই পেয়ে যাবে, কেবল আল্লাহর প্রাপ্যটাই বাকি থেকে যাবে।

"কোনো মুসলমানের উপর একই সাথে খারাজ ও উশর দুটোই আরোপিত হয়না।" -এই মর্মে যে রেওয়ায়েতটি আপনি উদ্ধৃত করেছেন, তা সূত্রের দিক দিয়ে অত্যন্ত দুর্বল। ইমাম ইবনে হুমামও এ কথা স্বীকার করেছেন। দেরায়া নামক গ্রন্থে ইবনে হাজার দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন, এর একাধিক বর্ণনাকারীর বিশ্বস্ততা বিতর্কিত। ইমাম মালেক, শাফেয়ি ও আহমদ ও বর্ণনাকে অগ্রহণযোগ্য আখ্যায়িত করে মুসলিম ভূ-স্বামীর খারাজযোগ্য জমিতেও উশর দিতে হবে বলে রায় দিয়েছেন। তথাপি এই রেওয়ায়েত যদি সঠিক ও গ্রহণযোগ্য ধরে নেয়াও হয়, তবু হানাফি ফেকাহবেত্তাগণ এ রেওয়ায়েত থেকে এরূপ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেননি যে, কোনো জমি থেকে খারাজ ও উশরের একটি আদায় হয়ে গেলে তা থেকে অপরটি আদায় করা যাবেনা। বরঞ্চ তারা বলেন, জমি যদি মূলত উশরযোগ্য হয়ে থাকে, তবে তা থেকে খারাজ আদায় হওয়ার পরও উশর দিতে হবে। তবে জমি যদি সনিশ্চিতভাবে খারাজযোগ্য হয়, তবে তা থেকে খারাজ বা উশরের যে কোনো একটি আদায় হয়ে গেলে অপরটি আর দিতে হবেনা। এখন আমাদের ভূমিগুলোকে বিতর্কিত ধরে নিলেও আসলে তা যদি উশরযোগ্য হয়ে থাকে, তবে হানাফি মতানুসারে ঐসব জমিতে উশর পাওনা থেকে যাবে, চাই তা থেকে খারাজ আদায় করা হোক বা না হোক। তাই সতর্কতা ও খোদাভীতির দাবি হলো, আল্লাহর কাছে জবাবদিহির হাত থেকে অব্যাহতি লাভের খাতিরে ফসলি জমির মালিক মুসলমান মাত্রই যেনো উশর দিয়ে দেয়।

সেচ করের ব্যাপারে বলা চলে যে, এটাও উশরের স্থলাভিষিক্ত হতে পারেনা। তবে এর কারণে উশর অর্ধেকে নেমে আসবে। (অর্থাৎ এক দশমাংশের পরিবর্তে এক বিংশতি অংশ দিতে হবে।) অবশ্য হিসাব করার সময় মোট উৎপন্ন ফসল থেকে সেচ কর বাদ দেয়া যাবেনা। কারণ কৃত্রিম সেচের কায়িক ও আর্থিক ব্যয়ের ব্যাপারটা বিবেচনা করে শরিয়ত নিজেই উশরের অর্ধেক রেয়াত দিয়েছে। এখন একদিকে উশরও অর্ধেক দেয়া হবে। আবার উশর হিসাব করতে গিয়ে সেচ করও বাদ দেয়া হবে, এটা ঠিক নয়। তবে উশর দেয়ার আগে খাজনা কর্তন করা যেতে পারে।

হানাফি মতে উশর হিসাব করার সময় উৎপন্ন ফসল থেকে কৃষিব্যয় কর্তন করা যায়না। স্বাভাবিক অবস্থায় এই বিধি অনুসরণ করা কর্তব্য। ভাগ বাটোয়ারার ক্ষেত্রে উভয় পক্ষকে নিজ নিজ প্রাপ্য অংশ থেকে উশর দিতে হবে। হানাফি মাযহাবের ফতোয়া হলো, উশরে কোনো নিসাব তথা নূন্যতম পরিমাণ নির্ধারিত নেই। তবে একাধিক সহীহ হাদিস থেকে জানা যায়, মোট ফসলের নূন্যতম পরিমাণ পাঁচ ওয়াসাক অর্থাৎ প্রায় ১৯ মণ হওয়া চাই। ইমাম আবু হানিফার প্রবীণতম দুই শিষ্য ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মদ এ কথা মেনে নিয়েছেন। তাই কোনো অস্বচ্ছল কৃষক যদি উক্ত নিসাবের চেয়ে কম ফসল পেয়ে উশর না দেয় তা হলে ক্ষতি নেই।

ভূমিতে উৎপন্ন পশুখাদ্য- যা কেটে বিক্রিও করা যায়. সঞ্চিত করেও রাখা যায়, তারও এক দশমাংশ পরিমাণ উশর দেয়া উচিত। হানাফি মাযহাব অনুসারে প্রত্যেক কৃষিজাত দ্রব্যের উপর উশর দিতে হয়। তবে যেসব জিনিস ইচ্ছা করে বোনা বা রোপণ করা হয়না। কিংবা যার কোনোই মূল্য নেই, যেমন বিভিন্ন রকমের আত্মজ ঘাস, লতাপাতা ইত্যাদি এসবের উপর কোনো উশর নেই। [তরজমানুল কুরআন, জানুয়ারি ১৯৬৭]

[ ২ ]
প্রশ্ন : তরজমানুল কুরআন জানুয়ারি, ১৯৬৭ সংখ্যায় 'উশর ও খারাজের কয়েকটি সমস্যা' শীর্ষক প্রশ্নোত্তর পুরোপুরি আশ্বস্ত হতে পারলাম না। জবাবে এক জায়গায় বলা হয়েছে, "উপমহাদেশে জমি উশরযোগ্য না খারাজযোগ্য তা নিয়ে বাদানুবাদ চলে আসছে। তবে হানাফি ও আহলে হাদিস সমেত সকল মাযহাবের মান্যগণ্য আলেমগণের ফতোয়া হলো, মুলসমানদের জমি থেকে উশর আদায় করাই অধিকতর নির্ভুল ও সাবধানী পন্থা।"

উপরোক্ত বক্তব্যটি সম্পূর্ণ অস্পষ্ট ও দুর্বোধ্য। কোনো সুনির্দিষ্ট আলেমের ফতোয়া উদ্ধৃত করা হয়নি। দেশ বিভাগের পর সমগ্র উপমহাদেশের জমিগুলোকে জমির মালিকানা ও ভোগদখলের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণরূপে পাল্টে গেছে। তাই পরিস্থিতি সংক্রান্ত মতবাদকে উপেক্ষা করা যায়না।

দ্বিতীয়ত: আলেমদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে বলেই আপনার মতামত জানতে চাওয়া হয়েছে। একটা সুস্পষ্ট ও তৃপ্তিকর জবাব প্রত্যাশা করা হয়েছে।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে শরিয়তের বিধি বিশ্লেষণে খানিকটা স্ববিরোধিতাও পাওয়া যায়, যা নিরসন করা একান্ত আবশ্যক। এক জায়গায় বলা হয়েছে, "প্রত্যেক মুসলমান সরকারের আদায়কৃত যে কোনো ভূমি রাজস্বকে শরিয়তের দৃষ্টিতে উশর বা খারাজ নামে আখ্যায়িত করা যায় না। শরিয়তে উশর ও খারাজের জন্য যে উদ্দেশ্য ও নিয়মবিধি নির্ধারিত রয়েছে সেই উদ্দেশ্যে ও নিয়মবিধি অনুসারে একটি ইসলামি সরকারের অধীন যে কর লেনদেন করা হয়, তাকেই উশর বা খারাজ নামে অভিহিত করা যায়। বর্তমানে জমির উপর যে খাজনা আদায় করা হয় তার পেছনে উশর বা খারাজের চেতনা বিন্দুমাত্রও কার্যকর নেই।"

একই আলোচনায় অন্যত্র উশর আদায়ের পদ্ধতি সম্পর্কে পর্যালোচনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে "তবে উশর দেয়ার আগে মোট উৎপন্ন ফসল থেকে খাজনা কর্তন করা যেতে পারে।" সেই সাথে হানাফি মাযহাবের অনুসৃত নীতি অনুসারে উশর দেয়ার সময় কৃষিব্যয়কে মোট কৃষি উৎপাদন থেকে বাদ না দেয়ারও পরামর্শ দেয়া যায়, তাহলে কৃষি ব্যয় বাদ দেয়া যাবেনা কেন?
এক জায়গায় খোদাভীতি ও সাবধানতার স্বার্থে মুসলমান চাষীর পক্ষে সর্বাবস্থায় উশর দেয়া কর্তব্য বলা হয়েছে।
আশা করি এ বিষয়ে গভীর চিন্তাভাবনা করে সঠিক পথনির্দেশনা দান করবেন।

জবাব : আপনি তরজমানুল কুরআনে প্রকাশিত জবাবে, কয়টি স্ববিরোধিতা চিহ্নিত করেছেন, সে সম্পর্কে নিম্নে আমার বক্তব্য উপস্থাপিত করছি :
আপনি লিখেছেন, দেশ বিভাগের পর উভয় অংশের জমিকে এক পর্যায়ে দাঁড় করিয়ে আলোচনা করা ঠিক নয়। কেননা উভয় অংশের প্রেক্ষাপট পাল্টে গেছে। তবে বিভাগোত্তর কালে মুসলমানরা যেসব জমির মালিক হয়েছে, তাতে উশরের বিধি পাল্টে যাওয়ার কারণ হতে পারে এমন কি পরিবর্তন দেখা দিয়েছে, সেটা আপনি উল্লেখ করেননি। আমি উপমহাদেশ শব্দটা শুধু এ জন্যই ব্যবহার করেছি যে,  দেশ বিভাগের আগে এটা অবশ্যই একদেশ ছিলো এবং সেই সব সমস্যার শরিয়তসম্মত সমাধানের জন্য তারা সাধারণত সমগ্র উপমহাদেশে মান্যগণ্য ও নির্ভরযোগ্য এমন আলেমদেরই শরাণাপন্ন হতো। দেশ বিভাগের পরেও এ ধরণের আলেমদের মতামত গ্রহণ করা যেতে পারে, যদি তা এমন সমস্যা সংক্রান্ত না হয় যার প্রকৃতি ও ধরণ এখন মৌলিকভাবেই পাল্টে গেছে।  পাকিস্তান হওয়ার পর যেসব জমি মুসলমানদের মালিকানাভুক্ত হয়েছে, আমার মতে তাতে উশরের অপরিহার্যতা আগের চেয়েও সন্দেহতীত। কেননা কোনো অঞলে একটা স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর সেখানকার মুসলিম মালিকানাভুক্ত জমিতে উশর অবশ্যই ওয়াজিব হয়ে যায়।

মুসলমানদের কৃষি জমিতে উশর সম্পর্কে যে বিতর্ক ও মত বিরোধের উল্লেখ আমি করেছি, তা থেকে এ কথা বুঝা যায়না এবং আমিও বুঝাইনি যে, যার ইচ্ছে উশর দিতে পারবে, আর যার ইচ্ছে মতভেদের ওজুহাত দিয়ে উশর দিতে অস্বীকার করতে পারবে। একটু-আধটু মতভেদ সব ব্যাপারেই হতে পারে। কিন্তু চূড়ান্ত মত প্রতিষ্ঠার বেলায় সব সময়ই নির্ভরযোগ্য আলেমদের অধিকাংশের অভিমত কি এবং কোন পক্ষের যুক্তি প্রমাণ অধিকতর বলিষ্ঠ ও অগ্রগণ্য, সেটাই অগ্রগণ্য, সেটাই বিবেচনা করতে হয়। আমার পূর্ববর্তী জবাবে সংক্ষিপ্তভাবে হলেও এসব তথ্য সন্নিবেশিত হওয়া থেকে বাদ পড়েনি। তথাপি আপনি সুনির্দিষ্ট মতামত জানতে চাওয়ায় আমি কয়েকজন বিশিষ্ট আলেমের অভিমত তুলে ধরছি।

মাওলানা মুফতি মুহাম্মদ শফী সাহেবের 'ইসলাম কা নিযামে আরাযী' (ইসলামের ভূমি ব্যবস্থা) নামক একখানা গ্রন্থ সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। এর ১৬৩ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন :
"পাকিস্তান সরকার অমুসলিমদের পরিত্যক্ত যেসব জমি মুসলিম মুহাজিরদের মধ্যে বন্টন করেছে, সেগুলো সব উশরযোগ্য জমি। পাকিস্তান হওয়ার আগে এসব জমির অবস্থা যে রকমই থাক না কেন, তাতে কিছু আসে যায়না। কেননা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা ও উভয় দেশের সরকারের ভূসম্পত্তি বিনিময় সংক্রান্ত চুক্তির ফলে এসব জমি প্রথমত, বায়তুলমালের আওতাভুক্ত হয়েছে। অত:পর সরকার কর্তৃক ভাগ-বাটোয়ারা হয়ে তা মুসলমানদের প্রাথমিক মালিকানাভুক্ত জমিতেই পরিণত হয়েছে আর মুসলমানদের জমিতে তো উশরই আরোপ করতে হয়। কাজেই এগুলো সব উশরযোগ্য জমি। অনুরূপভাবে যে সব জমি পাকিস্তান হওয়ার আগে অনাবাদী ছিলো, কারো ব্যক্তিগত মালিকানার অন্তর্ভুক্ত হয়নি, অত:পর সরকার তাতে সেচের ব্যবস্থা করে আবাদযোগ্য করেছে এবং মুসলমানদের মধ্যে মূল্যের বিনিময়ে কিংবা বিনামূল্যে বিতরণ করেছে। সেসব জমিও যেহেতু মুসলমানদেরই প্রাথমিক মালিকানাভুক্ত বলে বিবেচিত হবে, কাজেই তা উশরযোগ্যই সাব্যস্ত হবে।"

আবার ১৬৯ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন :
"কোনো অঞ্চলে যেসব জমি পুরুষানুক্রমিকভাবে মুসলিম ভূ-স্বামীদের মালিকানাভুক্ত চলে আসছে, সেসব জমির মালিকানা সম্পর্কে এই বলে সন্দেহ সৃষ্টি করা যাবেনা যে,  ঐ অঞ্চল যখন প্রথম বিজিত হয়, তখন অমুসলিম মালিকদের মালিকানা স্বত্ব যথাযথ বহাল রাখা হয়েছিল।"

১৭০ পৃষ্ঠায় দেওবন্দের প্রধান মুফতি হযরত মাওলানা আযীযুর রহমান সাহেবের দুটি ফতোয়া উদ্ধৃত করা হয়েছে। প্রথমটি হলো :
"ভারতে যেসব জমি মুসলমানদের মালিকানায় রয়েছে, তা উশরযোগ্য। কেননা মুসলিম ভূ-সম্পত্তিতে উশরই মূল কথা। কোনো সন্দেহ দেখা দিলেও উশর দেয়াই নিরাপদ।"

দ্বিতীয় ফতোয়াটি এরূপ :
"ভারতের সকল জমিতে একই বিধি প্রযোজ্য নয়। তবে যে জমি মুসলিম মালিকানাভুক্ত, তাতে উশর দিতে হবে। মুসলমানদের উশর দেয়া উচিত।"

এরপর ১৮২ পৃষ্ঠায় মুফতি মুহাম্মদ শফী সাহেব "সরকারি রাজস্ব প্রদানে উশর আদায় হবেনা।" শিরোনামের অধীন লিখেছেন :
"সরকার যদি মুসলিম জনগণের কাছ থেকে যাকাত ও উশর ঠিক যাকাত ও উশরের নামেই এবং যাকাত ও উশর সংক্রান্ত ইসলামি বিধান অনুসারেই আদায় করে আর সেই অনুসারেই তা ব্যয় করার সংকল্প ঘোষণা করে তাহলে ইসলামি সরকারকে প্রদত্ত এই যাকাত ও উশর শরিয়ত অনুযায়ী যাকাত ও উশর বলেই গণ্য হবে। কিন্তু পাকিস্তান সরকার এখন পর্যন্ত যে আয়কর আদায় করে থাকে, তা যাকাতের নামেও আদায় করা হয়না, যাকাতের বিধান অনুসারেও নেয়া হয়না। যাকাতের নির্ধারিত খাতসমূহে ব্যয় করার অঙ্গীকারও সরকার দেয়না। অনুরূপভাবে সরকার যে ভূমি রাজস্ব আদায় করে থাকে, তাও উশর ও খারাজের শরিয়তি বিধি অনুসারে আদায় করেনা। ওটাকে নির্ধারিত খাতে ব্যয় করার জন্যও সরকার কোনো অঙ্গীকার ঘোষণা করেনা। তাই মুসলিম সরকারের আরোপিত আয়কর  অথবা সরকারি ভূমি রাজস্ব দিলেও যাকাত ও উশরের ফরয থেকে অব্যাহতি লাভ করা যায়না।"

এরপর মাওলানা আশরাফ আলী থানবী র. এরও একটা ফতোয়া উদ্ধৃত করা হয়েছে। মাওলানা থানবীকে জানানো হয়েছিল যে, কোনো কোনো আলেম সরকারি খাজনা দিলে উশর আদায় হয়ে যায় বলে অভিমত দিয়েছেন। অত:পর তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়,  আপনার দৃষ্টিতে সঠিক মত কোনটি? মাওলানা থানবী র. জবাবে বলেন : আমিতো এটাই জানি যে, এতে আদায় হয়না, যেমন আয়কর দিয়ে যাকাত আদায় হয়না। উক্ত আলেমগণ কিসের ভিত্তিতে এ কথা বলেছেন আমার জানা নেই। এই  গ্রন্থের পরবর্তী এক স্থানে মুফতি আযীযুর রহমানেরও একই অভিমত তুলে ধরা হয়েছে।

'ইলমুল ফিকাহ' নামক গ্রন্থের  চতুর্থ খণ্ডের ৩৯ পৃষ্ঠায় গ্রন্থকার মাওলানা আব্দুশ শাকুর লাখনবী বলেন :
সরকারি ভূমি রাজস্ব বাবদ যা দেয়া হয় তা উশর বলে গণ্য হতে পারেনা। কেননা তা উশরের নির্ধারিত খাতে ব্যয় হয়না। কাজেই এটা দিলে উশর থেকে অব্যাহতি পাওয়া যাবে না।
মাওলানা মুহাম্মদ আমজাদ আলী কাদেরী স্বীয় গ্রন্থ 'বাহারে শরিয়ত' পঞ্চম খণ্ডে ৪০ পৃষ্ঠায় বলেন :
"জমি তিন রকমের : (১) উশরযোগ্য (২) খারাজযোগ্য (৩) উশরযোগ্য ও নয়, খারাজযোগ্য নয়। প্রথম ও তৃতীয় প্রকারের জমিতে উশর দিতে হবে। উপমহাদেশের মুসলমানদের জমি খারাজযোগ্য সাব্যস্ত হবেনা। যতোক্ষণ না কোনো সুনির্দিষ্ট জমির খারাজযোগ্য হওয়া শরিয়তসম্মত দলিল দ্বারা প্রমাণিত হয়।" অত:পর ৫৪ পৃষ্ঠায় বলেন :
"সরকারকে যে খাজনা দেয়া হয়, তা দ্বারা শরিয়ত আরোপিত খারাজ আদায় হয়না। বরং এটা ভূ-স্বামীর দায় হিসেবে থেকে যাবে এবং তাকে খারাজ দিতে হবে।"

সর্বশেষ মাওলানা সাইয়েদ মুহাম্মদ নাযীর হোসাইন দেহলভীর গ্রন্থ 'ফাতোওয়ায়ে নাযীরিয়া' প্রথম খণ্ডের ৪৯৪ পৃষ্ঠা থেকে একটা উক্তি উদ্ধৃত করবো। ইনি আহলে হাদিস গোষ্ঠির কাছে সবচেয়ে বড় আলেম গণ্য হয়ে থাকেন। উক্তিটি হলো :

"উল্লেখ থাকে যে, প্রত্যেক জমির উৎপন্ন ফসলে উশর কিংবা অর্ধ উশর (ক্ষেত্র বিশেষে) দেয়অ বাধ্যতামূলক যদি মালিক মুসলমান হয় এবং উৎপন্ন ফসল নিসাব পরিমাণ হয়। জমি খারাজযোগ্য হোক বা উশরযোগ্য হোক এবং জমি ফসলের মালিকের মালিকানাভুক্ত হোক বা না হোক, সর্বাবস্থায় উশর অথবা অর্থ উশর বাধ্যতামূলক। কারণ উশর বাধ্যতামূলক হওয়ার পক্ষে শরিয়তের যেসব দলিল রয়েছে তা উল্লেখিত সর্ব প্রকারের জমির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।" [লেখক : মুহাম্মদ আব্দুর রহমান মুবারকপুরী]

আপনি আমার আলোচনায় স্ববিরোধিতার যে অভিযোগ তুলেছেন, তা আমার কাছে পুরোপুরি বোধগম্য হয়নি। খাজনা বা ভূমিকর সম্পর্কে আমি এ কথাই বলেছি যে, তা খারাজ বা উশরের স্থলাভিষিক্ত হতে পারেনা। খাজনা বা ভূমিকর দিয়ে কেউ বলতে পারেনা যে, আমি খাজনা বা ভূমিকরের মাধ্যমে উশর বা খারাজ পরিশোধ করে দিয়েছি। হানাফি ফেকাহবেত্তাদের এ অভিমত আমি বর্ণনা করেছি যে, তারা উশর প্রদানের আগে ফসল থেকে কৃষি ব্যয় কর্তন করা সঠিক মনে করেননা। তবে খাজনা বা ভূমিকরের ব্যাপারটা কৃষি ব্যয় থেকে ভিন্ন। কারণ এটা সেই আমলে বিদ্যমান ছিলনা যখন ফকীহগণ কৃষি ব্যয় কর্তন না করার পক্ষে রায় দিয়েছিলেন। তাছাড়া এক হিসেবে খাজনা বা ভূমিকর কৃষি ব্যয়ের পরিবর্তে একটা কৃষিকর বিশেষ। কেননা কৃষি ব্যয় বলতে ভূমি উন্নয়ন ও ফসল উৎপাদন বাবদ যে ব্যয় হয় তাকেই বুঝায়। তাই উশর হিসেব করার আগে যদি কেউ ফসলের মূল্য থেকে খাজনা ও ভূমিকর দিয়ে দেয়, তাতে দোষের কিছু নেই। এটা আমার একার মত নয়, আলেম সমাজও এরূপ ফতোয়া দিয়েছেন। তবুও আপনি ইচ্ছে করলে এ বক্তব্য অগ্রাহ্য করতে পারেন এবং সমগ্র ফসলের উপর খাজনা ও ভূমিকর কর্তন না করেই উশর দেয়া উত্তম। এতে গরিবদের উপকার আরো বেশি হবে এবং শরিয়তের বিধানের ব্যাপারে যতো বেশি সাবধানতা অবলম্বন করা যায় ততোই ভালো। [তরজমানুল কুরআন, আগস্ট ১৯৬৭]

[ à§© ]
প্রশ্ন : আগস্ট সংখ্যা তরজমানুল কুরআনে আপনার  জবাব পড়ে মোটামুটি আশ্বস্ত হয়েছি। আমি বিগত বছরের উপার্জন হিসেব করে অর্থ উশর আলাদা করে ফেলেছি। তবে একটি বিষয় এখনো বিশ্লেষণের অপেক্ষায় রয়েছি। এ ব্যাপারে যদি আরো একটু পথনির্দেশনা পাই, তাহলে অধিকতর মানসিক তৃপ্তি পাবো এবং সংশয় ও বিভ্রান্তির পুরোপুরি অবসান ঘটবে। আমি লিখেছিলাম, "উপমহাদেশে বিভাগোত্তরকালে জমির মালিকানার পরিস্থিতি একেবারেই পাল্টে যাবে।" এ কথা দ্বারা আমি বুঝাতে চেয়েছিলাম, পাকিস্তানে ভূমি মালিকানা তিন প্রকারের (à§§) যে জমি পাকিস্তান হবার আগেও মুসলমানদের ছিলো, এখনো তাদেরই অধিকারেই রয়েছে। (২) যে জমি পাকিস্তান হবার আগে অমুসলিমদের দখলে ছিলো, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরে সরকারের দখলে এসেছে এবং ক্ষতিপূরণ হিসেবে মুহাজিরদের মধ্যে বন্টন করা হয়েছে। এসব জমি একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ সেলামি কিংবা খারাজের বিনিময়ে মুহাজিরদেরকে দেয়া হয়েছে। সেলামি সরকারি বিধি মোতাবেক প্রত্যেক জিনিসের জন্য ভিন্ন ভিন্ন পরিমাণে নির্দিষ্ট রয়েছে। (আখের জন্য  এক রকম, গমের জন্য এক রকম, ঘাসের জন্য এক রকম, ধানের জন্য এক রকম ইত্যাদি ইত্যাদি।) এই বিধিতে সরকার প্রয়োজন মোতাবেক রদবদল ঘটিয়ে থাকে। কতিপয় জিনিসের ক্ষেত্রে এই সেলামি বা খারাজ প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। তাছাড়াও জমি বরাদ্দের সময় এ কথা জানা থাকে যে,  এর মালিকানা কি প্রত্যেক ছয় মাস অন্তর সেলামি বা খারাজের আকারে দিতে হবে? (à§©) যে জমি সরকারের মালিকানাভুক্ত ছিলো, বর্তমান সরকার সাবেক সরকারের উত্তরাধিকার হিসেবে পেয়েছে এবং কতিপয় ব্যক্তিকে নির্দিষ্ট মূল্যের বিনিময়ে পুরস্কার কিংবা কৃতিত্বের প্রতিদান হিসেবে দেয়া হয়েছে। এর বাবদেও নির্দিষ্ট নিয়মে সেলামি বা খারাজ দিতে হয়। স্মরণযোগ্য, বিজিত দেশসমূহে ইসলামি কৃতিত্বের প্রতিদান হিসেবে এ জাতীয় পুরস্কারাদি দেয়ার রেওয়াজ ছিলো এবং এ ধরণের ভূমি সম্ভবত খারাজযোগ্য গণ্য হতো। এ থেকে এই মর্মে সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে যে, যেসব পরিত্যক্ত জমির বাবদে সরকার ভূমিকরের আকারে খারাজ পেয়ে থাকে, সেই কর সরকারি কোষাগারে জমা হয় এবং সরকারি কোষাগারে থেকে জনহিতকর কাজে ব্যয় হয়, তাকে খারাজযোগ্য জমিরূপে গণ্য করা চলে।

দেশ বিভাগের আগে ইংরেজ সরকার সমগ্র ভারতবর্ষ জয় করে জমির সর্বোচ্চ মালিক হয়ে বসেছিল। এখন মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর এই রাষ্ট্রের মুসলিম সরকার জমির সর্বোচ্চ মালিক। সরকার সব সময় এই ক্ষমতার অধিকারি যে, জনকল্যাণের স্বার্থে যে কোনো প্রয়োজনে যে কোনো জমি হুকুম দখল করতে পারে কিংবা মূল্য দিয়ে করায়ত্ত করতে পারে। এ ধরণের ক্ষমতা অবশ্যই খারাজযোগ্য জমিতেই হয়ে থাকে।

হযরত ওমরের রা. ইরান প্রভৃতি দেশের যেসব জমি মুসলমানদের অধিকারে এসেছিল, তা যদি ইতোপূর্বে অমুসলিমদের অধিকারে থাকাকালে প্রাচীন নদনদী, খাল, নালা বা জলাশয় থেকে সিঞ্চিত হয়ে থাকতো, তা হলে তার উপর খারাজ আরোপ করা হতো। এ ধরণের কিছু জমি কোনো কোনো সাহাবির দখলে ছিলো এবং তাদের কাছ থেকে খারাজ নেয়া হতো। যদি স্বয়ং মুসলমানরা নতুন খাল বা পুস্করনী খনন করে সেচকার্য চালাতো তাহলে তাদের উপর খারাজ আরোপ করা হতো। (দেখুন: আল ফারুখ, রচনা-শিবলী নুমানী, রাজস্ব অধ্যায়, পৃ. ১৭৪ -১৭৫) উল্লেখ্য, তৎকালে খারাজের তুলনায় উশর অনেক কম আদায় হতো এবং অপেক্ষাকৃত রেয়াত দেয়া হতো। ইরাকে কোথাও কোথাও জমির উৎপাদন ক্ষমতা রাজস্বের হারে পার্থক্যও হতো। [আল ফারুক, ২য় খণ্ড, রাজস্ব অধ্যায়, পৃ. ১৬৮]

প্রসঙ্গত, এ কথাও বিবেচনার দাবি রাখে যে, প্রথম প্রথম যখন মুসলিম সরকার এ ধরণের রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা করতো, তখন আদায়কারিদের ব্যয় এই রাজস্ব থেকেই নির্বাহ করা হতো। এখন যেহেতু জমির ফসল একত্রিত করে উশর দেয়ার দায়িত্ব ফসলের মালিকের উপর বর্তেছে, সেহেতু তার যাবতীয় ব্যয় উশর থেকে কর্তন করা ন্যায়সঙ্গত হবে।

জবাব : আপনি আমার জবাবের উপর  যে সব নতুন প্রশ্ন তুলেছেন, তা নিয়ে যদি বিস্তারিত আলোচনা করি, তাহলে একটা নিবদ্ধ লিখতে হবে। আপাতত: আমি সংক্ষিপ্ত জবাব দিয়েই ক্ষান্ত থাকছি :
প্রথমত: আমি প্রথম জবাবেই বলেছি যে, উশর ও খারাজ দুটোই একই জমিতে আরোপিত না হওয়া শুধুমাত্র হানাফি মাযহাবের নীতি। অন্যথায় অন্যান্য ইমামদের মতে, মুসলমানেরা যে জমি থেকেই ফসল পাক, তা থেকে তাকে উশর দিতে হবে। হানাফিদের নীতি যে হাদিসের ভিত্তিতে প্রণীত, হাদিসবেত্তাদের নিকট তার সনদ দুর্বল। এমন কি বিশিষ্ট হানাফি ইমাম আল্লামা মুহাম্মদ তাহির স্বীয় গ্রন্থ 'তাযকিরাতুল মাউযুয়াত' (মনগড়া হাদিসের বিবরণ)-এ ঐ হাদিসকে বাতিল বলে আখ্যায়িত করেছেন। খুলাফায়ে রাশেদিন যেসব জমিকে খারাজযোগ্য ঘোষণা করে তাতে খারাজ আরোপ করেছিলেন, সেগুলো সম্পর্কেও রসূল স. বা কোনো সাহাবির এমন কোনো উক্তি চোখে পড়েনা যে, এসব খারাজযোগ্য জমি মুসলমানদের মালিকানাভুক্ত হলে তাতে উশর দিতে মুসলমানদের উপর তা ইবাদাত হিসেবে ফরজ করা হয়েছে। কুরআনের নির্দেশ ------------------------ (যাকাত দাও) এবং ---------------
(ফসল ঘরে তোলার পর তার প্রাপ্য দিয়ে দাও।) সকল ভূমির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। সহীহ হাদিসসমূহে উশরের যে নির্দেশ এসেছে, তাও সকল জমির উপরই প্রযোজ্য। উশর সংক্রান্ত বিশ্বস্ততম হাদিসগুলো কোথাও খারাজযোগ্য জমিকে উশর বহির্ভূত করা হয়নি।  এ জন্য অন্যান্য ফেকাহবেত্তাগণ এ কথাই বুঝেছেন যে, খুলাফায়ে রাশেদীন কেবল মালিকানা স্বত্ত্ব ভোগদখলের অধিকারের বিনিময় হিসেবেই খারাজ আরোপ করতেন। উশরের পরিবর্তে নয়। এটা উশরের স্থলাভিষিক্তও ছিলোনা, উশর থেকে অব্যহতি পাওয়ার ছাড়পত্রও ছিলোনা। এ জন্য হানাফি মাযহাবও স্বীকার করেছে যে, কোনো জমি যদি প্রকৃতপক্ষে উশরযোগ্য হয়ে থাকে এবং ভুলক্রমে তাকে খারাজযোগ্য মনে করে খারাজ আরোপ করা হয়ে থাকে তবে তা সত্বেও উশর দেয়া বাধ্যতামূলক থাকবে। যে জমি সরকারের মালিকানায়  থাকে এবং তা প্রথমবারের মতো কোনো মুসলমানের ভোগদখল দেয়া হয় তবে তা সর্বসম্মতভাবে উশরযোগ্য-চাই মুসলমানের মালিকানা বা ভোগদখল যে ধরণেরই হোকনা কেন।

এ বিধিটাও কোনো চিরস্বীকৃত ও সার্বজনীন বিধি নয় যে, ইসলামি সরকারের করায়ত্ত হওয়ার সময় যে জমি কোনো অমুসলিমের ছিলো, তা চিরকাল খারাজযোগ্যই থাকবে- কখনো তাতে উশর আরোপিত হবেনা। কা'বা শরিফ ও মসজিদে নববীর আশপাশ একাধিক জমি এরূপ ছিলো, যা যাকাত ও উশরের হুকুম নাযিল হবার পর মক্কা বিজয়ের সময় অমুসলিমদের সম্পত্তি ছিলো। কিন্তু রসূল সা. তাকে খারাজযোগ্য বলেননি। এসব জমি মুসলমানদের অধিকারে আসার পর তাদের কাছ থেকে উশর আদায় করা হয়।

অমুসলিমদের পরিত্যক্ত যেসব জমি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর মুসলমানদেরকে দেয়া হয়েছে, তার সেলামি প্রভৃতির যে বিবরণ আপনি দিয়েছেন, তা আমার কাছে আলোচ্য বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত মনে হয়না। যেসব মুহাজিব এখন এসব জমির মালিক হয়ে গেছে,  সরকারি রাজস্বের ব্যাপারে তাদের ও স্থানীয় লোকদের মধ্যে কোনো পার্থক্য বা বৈষম্য রয়েছে কিনা আমার জানা নেই। যদি থেকেও থাকে, তবে আমি আগেই বলেছি, ভূমির মালিক ফসল থেকে খাজনা, সেলামি ইত্যাদি কেটে রেখে বাদবাকী ফসলের উপর উশর দিতে পারে। কিন্তু এই সব সেলামি ইত্যাদিকে খারাজ আখ্যায়িত করে তাকে উশরের স্থলাভিষিক্ত করার যুক্তিকে আমি মোটিই সঠিক মনে করিনা। এবং এর ভিত্তিতে উশর না দেয়াকে বৈধ বলে স্বীকার করিনা।

আপনার এ যুক্তিটাও অদ্ভুত যে, প্রাথমিক যুগের মুসলিম সরকার রাজস্ব আদয়ের যাবতীয় খরচ নিজেই বহন করতো, কিন্তু এখন উশরের দায়িত্ব ফসল মালিকের উপর বর্তানোর কারণে তার পক্ষে উশর থেকে কৃষি ব্যয় কর্তন করা সঙ্গত হবে। মুসলিম সরকার যাকাত, উশর ও খারাজ আদায়কারিদের উপর যা ব্যয় করতো, তা এই সব রাজস্বের একটা নগণ্য অংশ ছিলো। আসল রাজস্ব অনেক বেশি আদায় হতো এবং কর্মচারীদের মজুরি দেয়ার পর তা অন্যান্য খাতে ব্যয় হতো। আজকের যুগে একজন ভূ-স্বামী ব্যক্তিগতভাবে যে উশর দেয়, তা দিতে তার বাড়িতে কি খরচ বহন করতে হয় এবং তাকে কিভাবে আপনি আদায়কারি ও কর্মচারীদের মজুরি স্থলাভিষিক্ত করে উশরের মধ্যে গণ্য করতে চান, তা আমার বুঝে আসেনা। আর যদি এই খরচ দ্বারা আপনি কৃষি খরচ, ফসল রক্ষণাবেক্ষণ, ফসল কাটা ইত্যাদির খরচ বুঝিয়ে থাকেন, তাহলে কর্মচারীদের মজুরির সাথে এর কোনো সাদৃশ্য নেই। এসব ব্যয়কে কর্মচারীদের ব্যয়ের নাম দিয়ে উশর থেকে কর্তন করা কিভাবে জায়েয হবে?

অনারব দেশগুলোতে বিজিত ভূমি এবং ইংরেজ শাসনের অবসান ইত্যাদির ভিত্তিতে আপনি যে যুক্তি দাঁড় করেছেন, তাও আমার কাছে দুর্বোধ্য। কোনো বহিরাগত ইসলামি রাষ্ট্রের অন্তর্ভূক্ত করার প্রক্রিয়ায় পাকিস্তান হয়নি বা ইংরেজ শাসনের অবসান ঘটেনি। বরং যেসব এলাকার মুসলমানরা পরাধীন অথবা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলো। সেসব এলাকার স্বাধীনতা লাভ এবং কিছু অমুসলিমদের বহিষ্কারের মাধ্যমেই এটা হয়েছে। এ জন্য আমার মতে শরিয়তের বিধানের কার্যকারিতার কোনো পরিবর্তন যদি এসেই থাকে তবে সেটা হলো, মুসলমানদের দখলে আসা অমুসলিমদের পরিত্যক্ত ভূমিগুলোও উশরযোগ্য হয়ে গেছে। [তরজমানুল কুরআন, নভেম্বর ১৯৬৭]


<h1>২০। উশরযোগ্য ফল ফসল কি কি?</h1>
প্রশ্ন : উশরের যেসব বিধিতে হানাফি মাযহাব ও অন্যান্য মাযহাবের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে, তার মধ্যে একটি হলো উশরযোগ্য ফসল বা ফলমূল কি কি সেই সংক্রান্ত। কিছু কিছু ফসল রয়েছে, যা পাকতে দেয়া হয়না, বরং কাঁচা বা তরতাজা অবস্থায় বিক্রি করা হয়। শাক সবজির  অবস্থাও তাই। এই সব ফসল দ্বারা প্রচুর অর্থ উপার্জিত হয়। কোনো কোনো আহলে হাদিস আলেম বলেন, রসূল সা.-এর আমলে শুধু গম, যব, খেজুর ও কিসমিস প্রভৃতির বাবদে উশর নেয়া হতো। শাক সবজির বাবদে উশর নেয়া হতোনা। ইমাম মালেক রহ. ও ইমাম শাফেয়ী রহ. এর মতে যেসব খাদ্যদ্রব্য শুকিয়ে গুদামজাত করে রাখা যায়, কেবল সেগুলোই উশরযোগ্য। এ কারণে ইক্ষু, সবজি তরকারি ইত্যাদিতে উশর আরোপিত হবেনা।

অনুরূপভাবে কৃষি খরচ, কৃত্রিম সার প্রয়ো