ইসলামের দৃষ্টিতে জিহাদ |
লিখেছেন মুহাম্মদ ইসমাইল জাবীহুল্লাহ | |
Wednesday, 21 March 2012 | |
প্রাথমিক কথা
সমস্ত প্রশংসা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের যিনি আমাদেরকে মুসলমান হিসেবে দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন। যিনি আমাদেরকে ইসলামের দিকে হেদায়াত না করলে আমরা সঠিক পথ পেতাম না। অসংখ্য দরুদ ও সালাম বিশ্বমানবতার মুক্তির দিশারী মুহাম্মদ (সাঃ)এর উপর। যিনি অসংখ্য বনী আদমকে ধ্বংসের অতল গহ্বর থেকে টেনে এনে মুক্তির সন্ধান দিয়েছেন। উপহার দিয়েছেন শোষণ ও বঞ্চনাহীন একটি সোনালী সমাজ। ইসলামের অন্যসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের মত জিহাদও একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। জিহাদ নিয়ে পড়াশুনা করলে যে বিষয়টা স্পষ্ট বুঝা যায় তাহল- জিহাদ সমস্ত প্রকার অত্যাচার,অনাচার ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে। আর জিহাদকে অনুমোদনই দেয়া হয়েছে আত্মরক্ষার জন্য। অথচ,রীতিমত আশ্চর্যের বিষয় হল- ৯০% মুসলিম অধ্যুষিত আমাদের এই দেশে জিহাদ ও সন্ত্রাসকে এক করে গুলিয়ে ফেলা হচ্ছে। এটা ইসলাম বিদ্বেষীদের ইসলামের বিরুদ্ধে পরিচালিত একটা নোংরা হাতিয়ার বলে মনে হচ্ছে। ইসলামী বই দেখলেই তাকে জিহাদী বই বলে এক শ্রেণীর মিডিয়া অপপ্রচার চালাচ্ছে। যাদের কাছে সেগুলো পাওয়া যাচ্ছে তাদেরকে জাতির সামনে সন্ত্রাসী বলে চিহ্নিত করছে। এগুলোর পিছনে একমাত্র কারণ যেটা আমি মনে করি তা হল- জিহাদ আসলে কি জিনিস তারা তা জানেনা এমনকি জানারও প্রয়োজনীয়তা বোধ করেনা। তাদের অনেকেই মুসলিম পিতামাতার সন্তান। নিজেও ইসলামকে মনে প্রাণে লালন করে। অথচ,ইসলাম কিংবা ইসলামের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা নিয়ে জ্ঞান অর্জনের গরজ অনুভব করে না। জিহাদও ইসলামের একটি শাখা। শাস্তি তো পাওয়ার উপযুক্ত তারাই যারা জিহাদের নাম ভাংগিয়ে নীরিহ মানুষ মারার খেলায় মেতে উঠেছে। কেননা,ইসলাম নিরীহ মানুষ মারার কোন অনুমোদন দেয় না। আর ইসলামের দৃষ্টিতে যুদ্ধ করতে হলে রাষ্ট্রের ছত্রছায়ায়ই করতে হবে; ব্যক্তি বিশেষের নির্দেশে অস্ত্রধারণ করা ইসলামে নিষিদ্ধ। ইসলামের বিরুদ্ধে সমাজের এ সমস্ত অপপ্রচার প্রতিরোধ ও মানুষকে জিহাদের সঠিক রূপ দেখানোর মানসেই বক্ষমান প্রবন্ধে জিহাদ নিয়ে কিছু লেখার চেষ্টা করেছিলাম। লেখাটা ভালো লাগলে যতবেশী সম্ভব অন্যদের সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল। মানুষের মাঝে ইসলাম অনুমোদিত জিহাদ সম্বন্ধে একটা পরিষ্কার ধারণা থাকা দরকার। সে পরিষ্কার ধারণাটুকু দেয়ার মানসেই আমার এই সামান্য লেখার অবতারণা। অনেকে আমার লেখা আমার বিনা অনুমতিতে শেয়ার করতে চাননা। আমাকে একদিন এক বন্ধু বলেছিলেন আপনার অনুদিত বই আপনার কোন কপিরাইট আছে মনে করে কারও সাথে শেয়ার করিনি। সে জন্য এখানেও আমার বলা কর্তব্য বলে মনে করছি যে,আমার যে কোন লেখা অপরিবর্তিত রেখে আমার অনুমতি ছাড়াই যে কেউ যে কোন সময় যে কোন ব্যক্তির সাথে যেভাবে ইচ্ছা শেয়ার করতে পারেন। পরিশেষে সমস্ত ভাইবোনের নিকট আবেদন আল্লাহ তায়ালা যেন বাংলাদেশীসহ মুসলিম উম্মাহকে কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী কিছু দেয়ার মত যোগ্যতা আমাকে দান করেন সেই দুয়া করবেন। আমীন। তারিখ:২৮ শে নভেম্বর,২০১০ ইং দোয়া কামনায়: মুহাম্মদ ইসমাইল জাবীহুল্লাহ অনার্স,ইসলামী আইন বিভাগ আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়,মিশর।
ইসলামের দৃষ্টিতে জিহাদ
ইসলাম চির শান্তির ধর্ম। ইসলাম চায় মানুষের মাঝে পরস্পর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপিত হোক। তারা দুনিয়ায় সুখে শান্তিতে থাকুক। ফিতনা ফাসাদ দাংগা হাংগামা মানুষকে কখনো কল্যাণ দিতে পারেনা। মানুষের জীবন চলার পথকে সুন্দর ও সুশৃংখল করার জন্য ইসলাম তাদেরকে দিয়েছে বিভিন্ন দিক নির্দেশনা। নিশ্চিত করেছে তাদের যথাযথ স্বাধীনতা। আল্লাহ তায়ালা মানুষের উপর বিভিন্ন ধরণের বিধি-বিধান পালনের বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছেন। যেমন-নামাজ, রোজা, যাকাত, হজ্জ ইত্যাদি। সেগুলো যেমন একেকটি ফরজ তথা অত্যাবশ্যকীয় ইবাদাত, তেমনি জিহাদও একটি ফরজ বা আবশ্যক বিধান। মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের বিভিন্ন আয়াত এবং রাসুল (সাঃ) এর বিভিন্ন হাদীসে জিহাদের নির্দেশ এসেছে। মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে জিহাদের আবশ্যকতা সম্পর্কে বলা হয়েছে- كُتِبَ عَلَيْكُمُ الْقِتَالُ وَهُوَ كُرْهٌ لَكُمْ وَعَسَى أَنْ تَكْرَهُوا شَيْئًا وَهُوَ خَيْرٌ لَكُمْ وَعَسَى أَنْ تُحِبُّوا شَيْئًا وَهُوَ شَرٌّ لَكُمْ وَاللَّهُ يَعْلَمُ وَأَنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ (216)
অর্থাৎ, তোমাদেরকে যুদ্ধ করার হুকুম দেয়া হয়েছে এবং অথচ তা তোমাদের কাছে অপছন্দনীয়। হতে পারে তোমরা এমন কিছুকে অপছন্দ কর যা আসলে তোমাদের জন্য কল্যাণকর। আবার এমনও হতে পারে কোন জিনিসকে তোমরা পছন্দ করো অথচ, তা তোমাদের জন্য অকল্যাণকর। আল্লাহ সবকিছু জানেন,কিন্ত তোমরা জানো না। (সুরা বাকারা: ২১৬)
অন্য আয়াতে এসেছে: أُذِنَ لِلَّذِينَ يُقَاتَلُونَ بِأَنَّهُمْ ظُلِمُوا وَإِنَّ اللَّهَ عَلَى نَصْرِهِمْ لَقَدِيرٌ (39) الَّذِينَ أُخْرِجُوا مِنْ دِيَارِهِمْ بِغَيْرِ حَقٍّ إِلَّا أَنْ يَقُولُوا رَبُّنَا اللَّهُ وَلَوْلَا دَفْعُ اللَّهِ النَّاسَ بَعْضَهُمْ بِبَعْضٍ لَهُدِّمَتْ صَوَامِعُ وَبِيَعٌ وَصَلَوَاتٌ وَمَسَاجِدُ يُذْكَرُ فِيهَا اسْمُ اللَّهِ كَثِيرًا وَلَيَنْصُرَنَّ اللَّهُ مَنْ يَنْصُرُهُ إِنَّ اللَّهَ لَقَوِيٌّ عَزِيزٌ (40)
অর্থাৎ, যুদ্ধের অনুমতি দেয়া হলো তাদেরকে যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হচ্ছে,কেননা তারা মজলুম এবং আল্লাহ তায়ালা অবশ্যই তাদেরকে সাহায্য করার ক্ষমতা রাখেন। তাদেরকে নিজেদের ঘরবাড়ি থেকে অন্যায়ভাবে বের করে দেয়া হয়েছে শুধুমাত্র এ অপরাধে যে, তারা বলেছিল,“আল্লাহ আমাদের রব।” যদি আল্লাহ তায়ালা লোকদেরকে একের মাধ্যমে অন্যকে প্রতিহত করার ব্যবস্থা না রাখতেন,তাহলে যেখানে আল্লাহর নাম বেশী করে উচ্চারণ করা হয় সেসব আশ্রম,গীর্জা,ইবাদাতখানা ও মসজিদ ধ্বংস করে ফেলা হত। আল্লাহ তায়ালা নিশ্চয়ই তাদেরকে সাহায্য করবেন যারা তাঁকে সাহায্য করবে। আল্লাহ তায়ালা বড়ই শক্তিশালী ও পরাক্রান্ত। (সুরা হজ্জ: ৩৯-৪০)
কিন্তু, অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয় হল-জিহাদ নামক পবিত্র শব্দটিকে এখন কলঙ্কৃত করে ফেলা হচ্ছে। কুরআন শরীফের বহু স্থানে এ শব্দটি এসেছে। অথচ, এখন একে কলঙ্কৃত করে এর দ্বারা সন্ত্রাসকে বুঝানো হচ্ছে। বর্তমানে “জিহাদ” শব্দটি সাধারণ মানুষের নিকট আতংকজনক হিসেবে চিত্রিত হয়েছে। এমনভাবে একে উপস্থাপন করা হয় যে, জিহাদ মানেই যেন সন্ত্রাস কিংবা অস্ত্রবাজি ইত্যাদি। অথচ, ইসলাম সন্ত্রাসকে কঠোরভাষায় ঘৃণা করেছে। সন্ত্রাসীর জন্য গুরুতর শাস্তির বিধানও ইসলাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। হয়তবা, ইসলাম বিদ্বেষীরা মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করতে জিহাদকে বিকৃত করে উপস্থাপন করার পথকে বেছে নিয়েছে। আর একে তারা ইসলামের বিরুদ্ধে মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছে।
আসুন! আমরা জিহাদ সম্বন্ধে জেনে নিই। ইসলাম কি আসলেই যুদ্ধ করতে বলেছে? নাকি তা শান্তির ধর্ম সেটা এখান থেকেই স্পষ্ট হয়ে যাবে ইনশাল্লাহ। এ ছাড়া জিহাদ সম্বন্ধে আমাদের মাঝে পরিস্কার একটা ধারণার সৃষ্টি হবে ইনশাল্লাহ। আসুন! তাহলে শুরু করা যাক।
জিহাদের সংজ্ঞা: জিহাদ আরবী শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ হল- ১. কোন বিষয়ের চুড়ান্ত সাফল্যে পৌছানোর লক্ষ্যে কথা ও কাজ দ্বারা প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালানো। ২. কষ্ট স্বীকার করা। ৩. শত্রুকে প্রতিরোধ করতে সাধ্যমত চেষ্টা করা। (তাজুল উরুস,কামুসুল ফিকহী)
জিহাদের পারিভাষিক অর্থঃ বুখারী শরীফের বিখ্যাত ব্যাখ্যাতা আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী (রহঃ) বলেন: بَذْل الْجَهْد فِي قِتَال الْكُفَّار ، وَيُطْلَق أَيْضًا عَلَى مُجَاهَدَة النَّفْس وَالشَّيْطَان وَالْفُسَّاق . فَأَمَّا مُجَاهَدَة النَّفْس فَعَلَى تَعَلُّم أُمُور الدِّين ثُمَّ عَلَى الْعَمَل بِهَا ثُمَّ عَلَى تَعْلِيمهَا ، وَأَمَّا مُجَاهَدَة الشَّيْطَان فَعَلَى دَفْع مَا يَأْتِي بِهِ مِنْ الشُّبُهَات وَمَا يُزَيِّنهُ مِنْ الشَّهَوَات ، وَأَمَّا مُجَاهَدَة الْكُفَّار فَتَقَع بِالْيَدِ وَالْمَال وَاللِّسَان وَالْقَلْب ، وَأَمَّا مُجَاهَدَة الْفُسَّاق فَبِالْيَدِ ثُمَّ اللِّسَان ثُمَّ الْقَلْب অর্থাৎ, কাফেরদের সাথে সংগ্রাম করতে গিয়ে শক্তি ক্ষয় করা। এর (জিহাদ শব্দ) দ্বারা নিজের প্রবৃত্তি, শয়তান এবং দুরাচার সকলের সাথে সংগ্রাম করাকেও বুঝায়।
এখানে প্রবৃত্তির সাথে জিহাদ বলতে দ্বীন শিক্ষাগ্রহণ করা, শিক্ষাদান করা ও নিজের জীবনে তা বাস্তবায়ন করা, শয়তানের সাথে সংগ্রাম বলতে তার আনীত সংশয় ও অযাচিত লোভ লালসা প্রতিরোধ করাকে বুঝায়। আর কাফেরের সাথে জিহাদ হাত (শক্তি প্রয়োগ), সম্পদ, কথা কিংবা অন্তর যে কোনটার মাধ্যমেই হতে পারে। এছাড়া দুরাচারীদের সাথে জিহাদ হাত দ্বারা(শক্তি প্রয়োগ) অতঃপর জবান তারপর অন্তর দ্বারা হতে পারে। (ফাতহুল বারী: জিহাদ ও সিয়ার অধ্যায়)
ইমাম জুরজানী (রহঃ) বলেন: জিহাদ হল-সত্য দ্বীন তথা ইসলামের দিকে মানুষকে আহবান করা। (আত-তা’রীফাত)
আল্লামা কাসানী (রহঃ) বলেন: আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের অর্থ হল- প্রচেষ্টা ও শক্তি ব্যয় করা কিংবা কোন কাজে সফল হওয়ার জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা করা। ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় মুখের কথা, সম্পদ ও জীবন ইত্যাদি ক্ষয় করে সফলতার মানদন্ডে পৌছার জন্য প্রাণান্তকর প্রচেষ্টার নামই জিহাদ। (আল বাদায়েউস সানায়ে)
জিহাদের স্তর: জিহাদের বেশ কিছু স্তর রয়েছে। জিহাদ বললেই অস্ত্র ব্যবহার করা বুঝায় না। জিহাদের স্তর সম্বন্ধে ইমাম ইবনুল কায়্যেম (রহঃ) বলেছেন:
*প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে জিহাদের স্তর চারটি। সেগুলো হল- ১. সত্য দ্বীন (ইসলাম) শিক্ষাগ্রহণ করা। কেননা, সত্য দ্বীন তথা ইসলাম ছাড়া অন্যত্র কোন কল্যাণ নেই। ২. দ্বীন শিক্ষাগ্রহণের পর তা নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করা। কেননা, বাস্তবায়ন ছাড়া শুধুমাত্র শিক্ষাগ্রহণ করলে তাতে ক্ষতি না হলেও কোন লাভ হয় না। ৩. যা শিক্ষাগ্রহণ করেছে তা অপরকে শিক্ষাদান করা। কেননা, দ্বীনের কোন কিছুকে গোপণ করলে আল্লাহ তায়ালার আযাব থেকে সে নিজেকে বাঁচাতে পারবেনা। ৪. ইসলামের বিধানকে তুলে ধরতে গিয়ে কোন বিপদ আসলে ধৈর্যধারণ করা ও কষ্ট স্বীকার করা।
*শয়তানের বিরুদ্ধে জিহাদের রয়েছে দু’টি স্তর: ১. সংশয় দূর করা। ২. কু-প্রবৃত্তিকে প্রতিরোধ করা।
* কাফের ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জিহাদের স্তর চারটি। ১. অন্তর দিয়ে কাজটাকে ঘৃণা করা, ২. মুখের কথা দ্বারা তা প্রতিরোধ করা, ৩. এ পথে সম্পদ ব্যয় করা ও ৪. নিজের জীবন আল্লাহর রাস্তায় উৎসর্গ করা।
* অত্যাচারী যালিম ও অবাধ্যদের বিরুদ্ধে জিহাদের স্তর তিনটি। ১. সক্ষম হলে(ক্ষমতাবান) শক্তি প্রয়োগ করে তা রুখে দেয়া। ২. শক্তি প্রয়োগে অক্ষম হলে মুখের কথা দিয়ে তা রুখবে। ৩. তাতেও সক্ষম না হলে অন্তর দিয়ে তাকে (কাজকে) ঘৃণা করবে এবং তা প্রতিহত করার চিন্তায় ব্যাপৃত থাকবে।
এই হল জিহাদের ১৩ টি স্তর। কেউ যদি জিহাদ না করে কিংবা অন্ততঃপক্ষে জিহাদের কল্পনা মনের ভিতর না রেখে মারা যায় তাহলে, যেন সে মুনাফিকের একটা গুণাবলী নিয়েই মৃত্যুবরণ করল। (যাদুল মাআদ দ্রষ্টব্য)
জিহাদের স্তরগুলো নিয়ে কেউ গবেষণা করলে সে দেখতে পাবে, যে সমস্ত নবীদেরকে যুদ্ধের নির্দেশ দেয়া হয়েছে তাদেরকে প্রথমে ইসলামের দাওয়াত (ইসলামের দিকে আহবান) দিতে বলা হয়েছে। তাদের অবর্তমানে তাদের উম্মতের মধ্যকার যোগ্য ব্যক্তিদেরকে এই দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তারা যদি তাদের বাণীকে গ্রহণ না করে এবং এতে বাধা দেয় তবেই যুদ্ধের অনুমতি দেয়া হয়েছে। প্রথমেই যুদ্ধের নির্দেশ বা অনুমতি দেয়া হয়নি।
বড় জিহাদ কোনটি? স্বভাবতই প্রশ্ন আসতে পারে কোন জিহাদ বড়? নাফস তথা প্রবৃত্তির সাথে জিহাদ নাকি কাফেরদের সাথে জিহাদ? আসুন দেখি হাদীসে এ সম্বন্ধে কি বলা হয়েছে-রাসুল (সাঃ) বলেছেন: الْمُجَاهِدُ مَنْ جَاهَدَ نَفْسَهُ لِلَّهِ أَوْ قَالَ فِي اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ
অর্থাৎ, (সত্যিকার) মুজাহিদ তথা জিহাদকারী ঐ ব্যক্তি যে তার নাফস তথা প্রবৃত্তির সাথে জিহাদ তথা সংগ্রাম করে। (মুসনাদে আহমাদ)
নিজের প্রবৃত্তির সাথে জিহাদ করার পরই ব্যক্তি শত্রুর সাথে জিহাদ করার যোগ্যতা লাভ করে। কেননা, আল্লাহ তায়ালার আদেশ নিষেধকে পালন না করে কেউ শত্রুর সাথে যুদ্ধ করতে সক্ষম হয় না। (যাদুল মাআ’দ)
অপর এক হাদীসে এসেছে- রাসুল (সাঃ) বলেছেন: إِنَّ أَفْضَلَ الْجِهَادِ كَلِمَةُ حَقٍّ عِنْدَ سُلْطَانٍ جَائِرٍ
অর্থাৎ, সর্বোত্তম জিহাদ হচ্ছে অত্যাচারী শাসকের সামনে হক কথা বলা। (তিরমীজি, নাসায়ী, ইবনে মাজাহ, আবু দাউদ, মুসনাদে আহমাদ, দারেমী)
জিহাদের একটা অংশ হল যুদ্ধ। জিহাদ বলতে প্রথমেই যুদ্ধকে বুঝানো হয়না। বরং, যুদ্ধ হচ্ছে এর চুড়ান্ত স্তর। এখানে আমরা জিহাদের চুড়ান্ত স্তর “যুদ্ধ” নিয়ে আলোচনা করব ইনশাল্লাহ। যুদ্ধ জিহাদের একটিমাত্র অংশ হলেও এখানে আলোচনার খাতিরে আমরা যুদ্ধকে “জিহাদ” নামেই অভিহিত করব।
আয়েশা (রাঃ) বর্ণিত,এক হাদীসে এসেছে- روت عائشة رضي الله عنها قالت : يا رسول الله هل على النساء جهاد ؟ فقال : "جهاد لا قتال فيه الحج والعمرة"
হযরত আয়েশা (রাঃ)হতে বর্ণিত,তিনি বলেন:হে আল্লাহর রাসুল (সাঃ)!মহিলাদের কি কোন জিহাদ আছে?রাসুল (সাঃ)বললেন:মহিলাদের জন্য জিহাদ আছে কিন্তু,তাতে কোন যুদ্ধ নেই। আর তা হল- হজ্জ ও ওমরাহ আদায় করা। (ইবনে মাজাহ,দারে কুতনী,মুসনাদে আহমাদ)
জিহাদের আবশ্যকতা: অধিকাংশ ওলামায়ে কেরাম তথা ইসলামীক স্কলারদের মতে জিহাদ করা ফরজ তথা আবশ্যক কাজ। এটা একটা ইবাদাত। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন: كُتِبَ عَلَيْكُمُ الْقِتَالُ وَهُوَ كُرْهٌ لَكُمْ وَعَسَى أَنْ تَكْرَهُوا شَيْئًا وَهُوَ خَيْرٌ لَكُمْ وَعَسَى أَنْ تُحِبُّوا شَيْئًا وَهُوَ شَرٌّ لَكُمْ وَاللَّهُ يَعْلَمُ وَأَنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ (216)
অর্থাৎ, তোমাদেরকে যুদ্ধ করার হুকুম দেয়া হয়েছে অথচ, তা তোমাদের কাছে অপছন্দনীয়। হতে পারে তোমরা এমন কিছুকে অপছন্দ কর যা তোমাদের জন্য কল্যণকর। আবার এমনও হতে পারে কোন জিনিসকে তোমরা পছন্দ করো অথচ, তা তোমাদের জন্য অকল্যাণকর। আল্লাহ সবকিছু জানেন কিন্তু,তোমরা জানো না। (সুরা বাকারা: ২১৬)
অন্যত্র আল্লাহ তায়ালা বলেন: وَمَا لَكُمْ لَا تُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَالْمُسْتَضْعَفِينَ مِنَ الرِّجَالِ وَالنِّسَاءِ وَالْوِلْدَانِ الَّذِينَ يَقُولُونَ رَبَّنَا أَخْرِجْنَا مِنْ هَذِهِ الْقَرْيَةِ الظَّالِمِ أَهْلُهَا وَاجْعَلْ لَنَا مِنْ لَدُنْكَ وَلِيًّا وَاجْعَلْ لَنَا مِنْ لَدُنْكَ نَصِيرًا (75) الَّذِينَ آمَنُوا يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَالَّذِينَ كَفَرُوا يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ الطَّاغُوتِ فَقَاتِلُوا أَوْلِيَاءَ الشَّيْطَانِ إِنَّ كَيْدَ الشَّيْطَانِ كَانَ ضَعِيفًا (76) অর্থাৎ, তোমাদের কী হলো,তোমরা আল্লাহর পথে অসহায় নরনারী ও শিশুদের জন্য কেন লড়ছ না,যারা দুর্বলতার কারণে নির্যাতীত হচ্ছে?তারা ফরিয়াদ করছে,হে আমাদের রব! এই জনপদ থেকে আমাদের বের করে নিয়ে যাও,যার অধিবাসীরা জালেম এবং তোমার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য কোন বন্ধু,অভিভাবক ও সাহায্যকারী তৈরী করে দাও। যারা ঈমানদার তারা লড়াই করে আল্লাহর রাস্তায় আর যারা কাফের তারা লড়াই করে তাগুতের পথে। কাজেই শয়তানের সহযোগীদের সাথে লড়ে যাও।নিশ্চিত জেনে রাখ,শয়তানের কৌশল আসলেই দুর্বল। (সুরা নিসা:৭৫-৭৬)
কখন জিহাদ ফরজ তথা আবশ্যক হয়? অধিকাংশ ইসলামিক স্কলারের মতে নিম্নের কয়েকটি অবস্থায় জিহাদ ফরজ হয়।
প্রথমত: যখন দু’টি দল (মুসলিম ও অমুসলিম) পরস্পর মুখোমুখি হয়। যুদ্ধ ছাড়া আর কোন শান্তিপূর্ণ পথ খোলা থাকে না তখন উপস্থিত ব্যক্তিদের সেখান থেকে পলায়ন করা বৈধ নয়। তখন উপস্থিত প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য আবশ্যক হয়ে যায় দৃঢ়পদ ও অবিচল থাকা। আল্লাহ তায়ালা বলেন: يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا لَقِيتُمْ فِئَةً فَاثْبُتُوا وَاذْكُرُوا اللَّهَ كَثِيرًا لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ (45) وَأَطِيعُوا اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَلَا تَنَازَعُوا فَتَفْشَلُوا وَتَذْهَبَ رِيحُكُمْ وَاصْبِرُوا إِنَّ اللَّهَ مَعَ الصَّابِرِينَ (46)
অর্থাৎ, হে ঈমানদারগণ! যখন কোন দলের সাথে তোমাদের মোকাবিলা হয়,তোমরা দৃঢ়পদ থাকো এবং আল্লাহকে স্মরণ করতে থাকো বেশী বেশী করে। আশা করা যায়,এতে তোমরা সাফল্য অর্জন করতে পারবে। আর আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করো এবং নিজেদের মধ্যে বিবাদ করো না,অন্যথায় তোমাদের মধ্যে দুর্বলতা দেখা দেবে এবং তোমাদের প্রতিপত্তি নিঃশেষ হয়ে যাবে। অতএব, তোমরা ধৈর্যধারণের পন্থা অবলম্বন কর,নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন। (সুরা আনফাল: ৪৫-৪৬)
দ্বিতীয়ত: যখন শত্রুবাহিনী কোন মুসলিম সম্প্রদায়ের উপর আকস্মিক আক্রমণ করে তখন নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকলের উপর আবশ্যক হয়ে যাবে তাদের গতিরোধ করা। তারা যদি সক্ষম না হয় তাহলে, তাদের পার্শ্ববর্তী লোকদের উপর পর্যায়ক্রমে জিহাদ ফরজ হবে।
তৃতীয়ত: রাষ্ট্রপ্রধান যখন কোন সম্প্রদায়কে জিহাদে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দেন তখন জিহাদে যাওয়া আবশ্যক হবে। তবে, কারও কোন ওজর থাকলে ভিন্ন কথা। আল্লাহ তায়ালা বলেন: يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا مَا لَكُمْ إِذَا قِيلَ لَكُمُ انْفِرُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ اثَّاقَلْتُمْ إِلَى الْأَرْضِ أَرَضِيتُمْ بِالْحَيَاةِ الدُّنْيَا مِنَ الْآخِرَةِ فَمَا مَتَاعُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا فِي الْآخِرَةِ إِلَّا قَلِيلٌ (38) إِلَّا تَنْفِرُوا يُعَذِّبْكُمْ عَذَابًا أَلِيمًا وَيَسْتَبْدِلْ قَوْمًا غَيْرَكُمْ وَلَا تَضُرُّوهُ شَيْئًا وَاللَّهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ (39) অর্থাৎ, হে ঈমানদারগণ! তোমাদের কী হলো,যখনই তোমাদের আল্লাহর পথে জিহাদে বের হতে বলা হয়,তখনি তোমরা মাটি কামড়ে পড়ে থাক?তোমরা কি আখেরাতের মোকাবিলায় দুনিয়ার জীবনকে বেশী পছন্দ করে নিয়েছ?যদি তাই হয় তাহলে তোমরা মনে রেখ,দুনিয়ার জীবনের এমন সাজ সরঞ্জাম আখেরাতে খুবই সামান্য বলে প্রমাণিত হবে। তোমরা যদি না বের হও তাহলে আল্লাহ তোমাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি দেবেন এবং তোমাদের জায়গায় আরেকটি দলকে নিয়ে আসবেন,তখন তোমরা আল্লাহ তায়ালার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। তিনি সব বিষয়ের ওপর ক্ষমতাবান। (সুরা তাওবা: ৩৮-৩৯)
জিহাদকে কেন বৈধতা দেয়া হল? যুদ্ধ আসলে ভালো কাজ নয়; যুদ্ধ-বিগ্রহ দাংগা-হাংগামা মানুষের জন্য কোন কল্যাণ বয়ে আনে না। তবে, বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে বাধ্য হয়ে এটার দারস্থ হতে হয়। যখন যুদ্ধ ছাড়া সমাজকে শান্তিপূর্ণ রাখার আর কোন পথ অবশিষ্ট্য থাকেনা তখনই বাধ্য হয়ে জিহাদের চুড়ান্ত স্তর যুদ্ধের মত কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়ার অনুমতি দেয়া হয়। ঠিক তেমনি আল্লাহ তায়ালা জিহাদকে পবিত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষার সর্বশেষ চেষ্টা হিসেবে বৈধ করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন: وَقَاتِلُوهُمْ حَتَّى لَا تَكُونَ فِتْنَةٌ وَيَكُونَ الدِّينُ كُلُّهُ لِلَّهِ فَإِنِ انْتَهَوْا فَإِنَّ اللَّهَ بِمَا يَعْمَلُونَ بَصِيرٌ (39) অর্থাৎ, আর এ কাফেরদের সাথে এমন যুদ্ধ করো যেন গোমরাহী ও বিশৃংখলা নির্মূল হয়ে যায় এবং দ্বীন পুরোপুরি আল্লাহ তায়ালার জন্য নির্দিষ্ট হয়ে যায়। তারপর যদি তারা ফিতনা থেকে বিরত হয় তাহলে আল্লাহই তাদের কার্যকলাপ দেখবেন। (সুরা আনফাল: ৩৯)
অন্যত্র আল্লাহ তায়ালা বলেন: وَقَاتِلُوهُمْ حَتَّى لَا تَكُونَ فِتْنَةٌ وَيَكُونَ الدِّينُ لِلَّهِ فَإِنِ انْتَهَوْا فَلَا عُدْوَانَ إِلَّا عَلَى الظَّالِمِينَ (193) অর্থাৎ, তোমরা তাদের সাথে যুদ্ধ করতে থাকো যতক্ষণ না ফিতনা নির্মূল হয়ে যায় এবং দীন একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট হয়ে যায়। তারপর যদি তারা বিরত হয় তাহলে জেনে রাখ যালেম তথা অত্যাচারী ছাড়া আর করোর ওপর হস্তক্ষেপ করা বৈধ নয়। (সুরা বাকারা: ১৯৩)
জিহাদের উদ্দেশ্যঃ কোন কাজ করার পিছনে কোন না কোন উদ্দেশ্য নিহিত থাকে। উদ্দেশ্য ছাড়া কেউ কোন কাজ করে না। তেমনি জিহাদেরও বেশ কিছু উদ্দেশ্য আছে। সেগুলো নিম্নে উপস্থাপিত হল।
প্রথমত: আল্লাহ তায়ালার বাণী তথা বিধানকে উচ্চকিত করা। কোন স্বার্থের কারণে নয়। হাদীস শরীফে এসেছে- عَنْ أَبِي مُوسَى رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ جَاءَ رَجُلٌ إِلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ الرَّجُلُ يُقَاتِلُ لِلْمَغْنَمِ وَالرَّجُلُ يُقَاتِلُ لِلذِّكْرِ وَالرَّجُلُ يُقَاتِلُ لِيُرَى مَكَانُهُ فَمَنْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ قَالَ مَنْ قَاتَلَ لِتَكُونَ كَلِمَةُ اللَّهِ هِيَ الْعُلْيَا فَهُوَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ অর্থাৎ, আবু মুসা আশয়ারী (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসুল (সাঃ) এর কাছে একজন লোক এসে বললেন: একজন লোক যুদ্ধলব্ধ সম্পদের আশায় যুদ্ধ করে, আরেকজন নিজের নাম যশ-খ্যাতির জন্য যুদ্ধ করে এবং অন্যজন নিজের অবস্থান মানুষকে দেখানোর জন্য যুদ্ধ করে। তাদের মধ্যে কে আল্লাহ তায়ালার রাস্তায় যুদ্ধ করে? রাসুল (সাঃ) বললেন: যে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালার বাণী তথা বিধানকে উচ্চকিত করার জন্য যুদ্ধ করে সেই আল্লাহ তায়ালার রাস্তায় যুদ্ধ বা জিহাদ করে। (বুখারী, মুসলিম, মুসনাদে আহমাদ, ইবনে হিব্বান, বায়হাকী, নাসায়ী, তিরমীজি, ইবনে মাজাহ, আবু দাউদ)
দ্বিতীয়ত: মজলুম তথা অত্যাচারিতদেরকে সাহায্য করা। আল্লাহ তায়ালা বলেন: وَمَا لَكُمْ لَا تُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَالْمُسْتَضْعَفِينَ مِنَ الرِّجَالِ وَالنِّسَاءِ وَالْوِلْدَانِ الَّذِينَ يَقُولُونَ رَبَّنَا أَخْرِجْنَا مِنْ هَذِهِ الْقَرْيَةِ الظَّالِمِ أَهْلُهَا وَاجْعَلْ لَنَا مِنْ لَدُنْكَ وَلِيًّا وَاجْعَلْ لَنَا مِنْ لَدُنْكَ نَصِيرًا (75) الَّذِينَ آمَنُوا يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَالَّذِينَ كَفَرُوا يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ الطَّاغُوتِ فَقَاتِلُوا أَوْلِيَاءَ الشَّيْطَانِ إِنَّ كَيْدَ الشَّيْطَانِ كَانَ ضَعِيفًا (76)
অর্থাৎ, তোমাদের কী হলো,তোমরা কেন আল্লাহর রাস্তায় অসহায় নর-নারী ও শিশুদের জন্য লড়াই করছ না,যারা দুর্বলতার কারণে নির্যাতীত হচ্ছে? তারা ফরিয়াদ করে বলছে,হে আমাদের রব! এই জনপদ থেকে আমাদের বের করে নিয়ে যাও,যার অধিবাসীরা জালেম এবং তোমার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য কোন বন্ধু,অভিভাবক ও সাহায্যকারী তৈরী করে দাও। যারা ঈমানদার তারা লড়াই করে আল্লাহর রাস্তায় আর যারা কাফের তারা লড়াই করে তাগুতের পথে। অতএব, শয়তানের সহযোগীদের সাথে লড়াই কর এবং জেনে রাখ,শয়তানের কৌশল আসলেই দুর্বল। (সুরা নিসা:৭৫-৭৬)
তৃতীয়ত: শত্রুদেরকে প্রতিরোধ করে তাদের হাত থেকে ইসলাম ও মুসলমানদেরকে হেফাজত করা। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন: الشَّهْرُ الْحَرَامُ بِالشَّهْرِ الْحَرَامِ وَالْحُرُمَاتُ قِصَاصٌ فَمَنِ اعْتَدَى عَلَيْكُمْ فَاعْتَدُوا عَلَيْهِ بِمِثْلِ مَا اعْتَدَى عَلَيْكُمْ وَاتَّقُوا اللَّهَ وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ مَعَ الْمُتَّقِينَ (194)
অর্থাৎ, হারাম (সম্মানিত) মাসের বিনিময় তো হারাম মাসই হতে পারে এবং সমস্ত মর্যাদা সমপর্যায়ের বিনিময়ের অধিকারী হবে। কাজেই যে ব্যক্তি তোমাদের ওপর হস্তক্ষেপ করবে তোমরাও তার ওপর ঠিক তেমনিভাবে হস্তক্ষেপ কর। তবে আল্লাহকে ভয় কর এবং জেনে রাখ, আল্লাহ তায়ালা খোদাভীরুদের সাথে আছেন (যারা সীমালংঘন করা থেকে বিরত থাকে)। (সুরা বাকারা:১৯৪)
অন্যত্র আল্লাহ তায়ালা বলেন: الَّذِينَ أُخْرِجُوا مِنْ دِيَارِهِمْ بِغَيْرِ حَقٍّ إِلَّا أَنْ يَقُولُوا رَبُّنَا اللَّهُ وَلَوْلَا دَفْعُ اللَّهِ النَّاسَ بَعْضَهُمْ بِبَعْضٍ لَهُدِّمَتْ صَوَامِعُ وَبِيَعٌ وَصَلَوَاتٌ وَمَسَاجِدُ يُذْكَرُ فِيهَا اسْمُ اللَّهِ كَثِيرًا وَلَيَنْصُرَنَّ اللَّهُ مَنْ يَنْصُرُهُ إِنَّ اللَّهَ لَقَوِيٌّ عَزِيزٌ (40) অর্থাৎ, তাদেরকে নিজেদের ঘরবাড়ি থেকে অন্যায়ভাবে বের করে দেয়া হয়েছে শুধুমাত্র এ অপরাধে যে,তারা বলেছিল,“আল্লাহ আমাদের রব।” যদি আল্লাহ তায়ালা লোকদের একের মাধ্যমে অন্যকে প্রতিহত করার ব্যবস্থা না করতেন,তাহলে যেখানে আল্লাহর নাম বেশী বেশী উচ্চারিত হয় সেসব আশ্রম,গীর্জা,ইবাদাতখানা ও মসজিদ ধ্বংস করে দেয়া হত। আল্লাহ তায়ালা নিশ্চয়ই তাদেরকে সাহায্য করবেন যারা তাঁকে সাহায্য করে। আল্লাহ তায়ালা বড়ই শক্তিশালী ও পরাক্রমশালী। (সুরা হজ্জ: ৪০)
জিহাদের প্রকারভেদঃ শত্রুদের বিরুদ্ধে জিহাদ বেশ কয়েক প্রকারের হতে পারে। যেমন- ১. কাফের, মুনাফিক ও মুরতাদদের সাথে যুদ্ধ। ২. ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্র ব্যবস্থা পরিবর্তন আকাংখী ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা। আল্লাহ তায়ালা বলেন: وَإِنْ طَائِفَتَانِ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ اقْتَتَلُوا فَأَصْلِحُوا بَيْنَهُمَا فَإِنْ بَغَتْ إِحْدَاهُمَا عَلَى الْأُخْرَى فَقَاتِلُوا الَّتِي تَبْغِي حَتَّى تَفِيءَ إِلَى أَمْرِ اللَّهِ فَإِنْ فَاءَتْ فَأَصْلِحُوا بَيْنَهُمَا بِالْعَدْلِ وَأَقْسِطُوا إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُقْسِطِينَ (9)
অর্থাৎ, ঈমানদারদের মধ্যকার দু’টি দল যদি পরস্পর লড়াইয়ে লিপ্ত হয়, তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দাও। তারপরও যদি দু’টি দলের কোন একটি দল অপরটির বিরুদ্ধে বাড়াবাড়ি করে বসে, তবে যে দল বাড়াবাড়ি করে তার বিরুদ্ধে লড়াই করো, যতক্ষণ না তারা আল্লাহর নির্দেশের দিকে ফিরে আসে। এরপর যদি তারা ফিরে আসে তাহলে তাদের মাঝে ন্যায় বিচারের সাথে মীমাংসা করিয়ে দাও এবং ইনসাফ প্রতিষ্ঠা কর। নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা ইনসাফ তথা ন্যায়বিচারকারীদেরকে ভালবাসেন। (সুরা হুজুরাত: ৯)
একটি হাদীসে এসেছে- রাসুল (সাঃ) বলেছেন: إِنَّهُ سَتَكُونُ هَنَاتٌ وَهَنَاتٌ فَمَنْ أَرَادَ أَنْ يُفَرِّقَ أَمْرَ هَذِهِ الأُمَّةِ وَهْىَ جَمِيعٌ فَاضْرِبُوهُ بِالسَّيْفِ كَائِنًا مَنْ كَانَ ». অর্থাৎ, অচিরেই ফিতনা ফাসাদ ও দুর্ঘটনা ঘটবে। যে এই উম্মাতের (মুসলমানদের) মাঝে ফাটল সৃষ্টি করতে চায় সে যেই হোক না কেন তাকে তরবারী দ্বারা শাস্তি দাও (এটা রাষ্ট্রের দায়িত্ব)। (মুসলিম শরিফ, মুসনাদে আহমাদ)
এই হাদিসের ব্যাখ্যায় ইসলামিক স্কলাররা বলেন: যদি কেউ ইসলামী রাষ্ট্রের মুসলমানদের ভিতর ফাটল ধরানোর ষড়যন্ত্র করে তাকে এ কাজ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিতে হবে। যদি সে বিভিন্নভাবে সতর্ক করার পরেও ক্ষান্ত না হয় তাহলে, তাকে প্রয়োজনে তরবারী দ্বারা শাস্তি দেবে। তবে,এটা রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্বের আওতায় পড়ে। সরকারের কোন সবুজ সংকেত ছাড়া এটা সাধারণ মানুষ কর্তৃক বাস্তবায়নযোগ্য নয়।
৩. দ্বীন, জীবন, পরিবার-পরিজন ও ধন-সম্পদ রক্ষায় যুদ্ধ করা বৈধ। রাস্তায় সন্ত্রাসী আক্রমণ প্রহিহত করাও এ প্রকারের অন্তর্ভুক্ত। রাসুল (সাঃ) বলেছেন:
« مَنْ قُتِلَ دُونَ مَالِهِ فَهُوَ شَهِيدٌ وَمَنْ قُتِلَ دُونَ أَهْلِهِ أَوْ دُونَ دَمِهِ أَوْ دُونَ دِينِهِ فَهُوَ شَهِيدٌ » অর্থাৎ, যে তার সম্পদ হেফাজত করতে গিয়ে নিহত হয়েছে সে শহীদ, যে পরিবার পরিজনকে হেফাজত করতে গিয়ে নিহত হয়েছে সে শহীদ। যে নিজের জীবন রক্ষা করতে গিয়ে নিহত হয়েছে সে শহীদ এবং যে দ্বীনের (ইসলামের) জন্য নিহত হয়েছে সেও শহীদ। (বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ, তিরমীজি, নাসায়ী, মুসনাদে আহমাদ)
জিহাদের ফযীলত: জিহাদের ফযীলত সম্বন্ধে কুরআন ও হাদীসে বেশ কিছু বর্ণনা এসেছে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু বর্ণনা নিম্নে বর্ণিত হল। ১. আল্লাহ তায়ালার রাস্তায় জিহাদ করা অত্যন্ত লাভজনক ব্যবসা। আল্লাহ তায়ালা বলেন: إِنَّ اللَّهَ اشْتَرَى مِنَ الْمُؤْمِنِينَ أَنْفُسَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ بِأَنَّ لَهُمُ الْجَنَّةَ يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَيَقْتُلُونَ وَيُقْتَلُونَ وَعْدًا عَلَيْهِ حَقًّا فِي التَّوْرَاةِ وَالْإِنْجِيلِ وَالْقُرْآنِ وَمَنْ أَوْفَى بِعَهْدِهِ مِنَ اللَّهِ فَاسْتَبْشِرُوا بِبَيْعِكُمُ الَّذِي بَايَعْتُمْ بِهِ وَذَلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ (111) অর্থাৎ, নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা মুমিনদের কাছ থেকে তাদের প্রাণ ও ধন-সম্পদকে জান্নাতের বিনিময়ে কিনে নিয়েছেন। তারা আল্লাহ তায়ালার পথে লড়াই করে, মারে এবং মরে। তাদের প্রতি তাওরাত,ইনজীল ও কুরআনে(জান্নাতের ওয়াদা)এটি একটি পাকাপোক্ত ওয়াদা। আর আল্লাহর চাইতে বেশী ওয়াদা রক্ষাকারী আর কে আছে?কাজেই তোমরা আল্লাহর সাথে যে কেনা-বেচা করছো সে জন্য শুভ সংবাদ গ্রহণ কর। এটাই বিরাট সাফল্য। (সুরা তাওবা:১১১)
অন্য আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন: يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا هَلْ أَدُلُّكُمْ عَلَى تِجَارَةٍ تُنْجِيكُمْ مِنْ عَذَابٍ أَلِيمٍ (10) تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَتُجَاهِدُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ بِأَمْوَالِكُمْ وَأَنْفُسِكُمْ ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ (11) يَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَيُدْخِلْكُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ وَمَسَاكِنَ طَيِّبَةً فِي جَنَّاتِ عَدْنٍ ذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ (12) وَأُخْرَى تُحِبُّونَهَا نَصْرٌ مِنَ اللَّهِ وَفَتْحٌ قَرِيبٌ وَبَشِّرِ الْمُؤْمِنِينَ (13)
অর্থাৎ, হে ঈমানদারগণ! আমি কি তোমাদেরকে এমন একটি ব্যবসার সন্ধান দেব না যা তোমাদেরকে কঠিন আযাব থেকে মুক্তি দেবে? তোমরা আল্লাহ ও তার রসূলের প্রতি ঈমান আন এবং আল্লাহর পথে অর্থ-সম্পদ ও জান-প্রাণ দিয়ে জিহাদ কর। এটাই তোমাদের জন্য অতিব কল্যাণকর যদি তোমরা তা জান। তাহলে, (পুরস্কার হিসেবে) আল্লাহ তায়ালা তোমাদের গোনাহ ক্ষমা করে দেবেন এবং তোমাদেরকে এমন বেহেশতে প্রবেশ করাবেন যার নীচে দিয়ে ঝর্ণাধারা বহমান থাকবে। আর চিরস্থায়ী বসবাসের জায়গা জান্নাতের মধ্যে তোমাদেরকে সর্বোত্তম বাসস্থান দান করবেন। এটাই বড় সফলতা। আরেকটি জিনিস যা তোমরা আকাংখা কর আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্য এবং নিকটবর্তী সময়ে বিজয়। হে নবী! ঈমানদারদেরকে সুসংবাদ দান করুন। (সুরা সফ: ১০-১৩)
ইসলামিক স্কলারদের সতর্কবাণী: ইসলামিক স্কলারগণ জিহাদে যাওয়ার সময় বেশ কিছু বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশ দিয়েছেন। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-
১. আজকাল জিহাদ ফরজ হওয়া কিংবা না হওয়ার ব্যাপারে হুকুম দেয়ার অধিকার রয়েছে শুধুমাত্র ইসলাম সম্বন্ধে জ্ঞানী ইসলামিক স্কলারদের। কেননা, এটা আল্লাহ তায়ালার হুকুম নিয়ে কথা বলার সমান। আল্লাহ তায়ালা বলেন: فَاسْأَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ (43)
অর্থাৎ, যদি তোমরা নিজেরা না জান তাহলে, দ্বীন সম্বন্ধে জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞাসা কর। (সুরা নাহল: ৪৩)
২. তোমার মতের বিরুদ্ধে কোন জ্ঞানীর মত গেলে তার নামে মিথ্যা অপবাদ ছড়াইও না। কেননা, এটা আল্লাহ তায়ালার বান্দাদের কাজ নয়। আলেমগণ যদি মানুষের ইচ্ছা খুশির ভিত্তিতে কথা বলত তাহলে, ইসলামী শরীয়ত বলে কিছুই অবশিষ্ট্য থাকত না। এজন্য যে কোন বিষয়ের মানদন্ড অবশ্যই কুরআন ও হাদিস দিয়েই নির্নয় করতে হবে।
৩. জেনে রাখ! জিহাদের বিষয়টা রাষ্ট্রপ্রধানের ব্যাপার। কোন সাধারণ মানুষের সামান্যতম অধিকার নেই কাউকে জিহাদে যাওয়ার অর্ডার দেবে কিংবা জিহাদের ডাক দেবে। এটার দায়িত্ব একমাত্র রাষ্ট্রপ্রধানের। রাসুল (সাঃ) বলেন:
إِنَّمَا الْإِمَامُ جُنَّةٌ يُقَاتَلُ مِنْ وَرَائِهِ وَيُتَّقَى بِهِ فَإِنْ أَمَرَ بِتَقْوَى اللَّهِ وَعَدَلَ فَإِنَّ لَهُ بِذَلِكَ أَجْرًا وَإِنْ قَالَ بِغَيْرِهِ فَإِنَّ عَلَيْهِ مِنْهُ
অর্থাৎ, নিশ্চয় রাষ্ট্রপ্রধান ঢালের মত। তার পিছনে থেকে যুদ্ধ করতে হয় এবং তার মাধ্যমেই নিরাপত্তা পাওয়া যায়। যদি তিনি আল্লাহ ভীতির কোন বিষয়ে নির্দেশ দেন এবং ন্যায় বিচার করেন তাহলে, তিনি এর দ্বারা সাওয়াবের অধিকারী হবেন। আর যদি এর বিপরীত কোন নির্দেশ দেন তাহলে, তিনি গুণাহের পাত্র বিবেচিত হবেন।(বুখারী, মুসলিম, নাসায়ী, মুসনাদে আহমদ)
ইসলামিক স্কলারদের মতামত থেকেও এ কথাটা উচ্চারিত হয়েছে। তারা বলেছেন: জিহাদের চিন্তা-ভাবনা ও সিদ্ধান্তের ব্যাপার রাষ্ট্রপ্রধানের। রাষ্ট্রের প্রজাদের দায়িত্ব হচ্ছে (ভালো ও কল্যাণকর কাজে) তাদের আনুগত্য করা। (আল-মুগনী, আশ-শারহুল কাবীর, কাশশাফুল কেনা’আ)
জিহাদে মানুষ হত্যা কেন?: পৃথিবীর সচেতন সকল ব্যক্তিই বলবে যে, কোন একটা দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য নিজস্ব সেনাবাহিনী দরকার। অত্যাচারী রাষ্ট্রপ্রধান ছাড়া কোন দেশ অন্য আরেকটি দেশ বা গোষ্টির সাথে যুদ্ধ করতে চায় না। শান্তিকামী রাষ্ট্র সব সময় সুযোগ খুজতে থাকবে শান্তির কোন দরজা খোলা রাখা যায় কিনা? যখন শান্তির সমস্ত পথ বন্ধ হয়ে যায় তখনই তারা অন্য দেশ বা গোষ্টির সাথে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়।
শান্তির ধর্ম ইসলামও এর ব্যতিক্রম নয়। কেননা, ইসলাম চায় সমাজে শান্তি বজায় থাকুক। আমরা ইতিহাসে দেখতে পাই, মুসলমানরা যেখানেই অন্যদের সাথে যুদ্ধ করতে গেছেন সেখানেই তাদের একটা অপশন ছিল সন্ধির। সন্ধিতে সাড়া দিলে তাদের সাথে আর তারা যুদ্ধে জড়াতেন না।
ইসলামে যুদ্ধের অনুমতি দেয়া হল কেন? এ প্রশ্ন অনেকের মনেই ঘুরপাক খায়। ইমাম ইবনুল কায়্যেম (রহঃ) এ প্রশ্নের খুব সুন্দর জবাব দিয়েছেন। তিনি বলেছেন:
প্রথমত: ইসলাম মুসলমানদেরকে ধৈর্য ধারণ ও ক্ষমা করার নির্দেশ দিয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন:
أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ قِيلَ لَهُمْ كُفُّوا أَيْدِيَكُمْ وَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ فَلَمَّا كُتِبَ عَلَيْهِمُ الْقِتَالُ إِذَا فَرِيقٌ مِنْهُمْ يَخْشَوْنَ النَّاسَ كَخَشْيَةِ اللَّهِ أَوْ أَشَدَّ خَشْيَةً وَقَالُوا رَبَّنَا لِمَ كَتَبْتَ عَلَيْنَا الْقِتَالَ لَوْلَا أَخَّرْتَنَا إِلَى أَجَلٍ قَرِيبٍ قُلْ مَتَاعُ الدُّنْيَا قَلِيلٌ وَالْآخِرَةُ خَيْرٌ لِمَنِ اتَّقَى وَلَا تُظْلَمُونَ فَتِيلًا (77)
অর্থাৎ, তোমরা কি তাদেরকে দেখনি,যাদেরকে বলা হয়েছিল,তোমাদের হাত গুটিয়ে রাখ, নামায কায়েম কর এবং যাকাত দাও? এখন যুদ্ধের নির্দেশ দেয়ায় তাদের একটি দলের অবস্থা এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যে,তারা মানুষকে এমনভাবে ভয় করছে যেমন আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করা উচিত অথবা তার চেয়েও বেশী। তারা বলছেঃ হে আমাদের রব! আমাদেরকে যুদ্ধের নির্দেশ কেন দিলে? আমাদের আরো কিছু সময় অবকাশ দিলে না কেন? তাদেরকে বলে দিন দুনিয়ার জীবন ও সম্পদ অতি সামান্য এবং আল্লাহর ভয়ে ভীত মানুষের জন্য আখেরাতই উত্তম আর তোমাদের ওপর সামান্য পরিমাণও জুলুম করা হবে না৷ (সুরা নিসা: ৭৭)
নাসায়ী শরীফের হাদীসে এসেছে- عَنْ ابْنِ عَبَّاسٍ أَنَّ عَبْدَ الرَّحْمَنِ بْنَ عَوْفٍ وَأَصْحَابًا لَهُ أَتَوْا النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِمَكَّةَ فَقَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنَّا كُنَّا فِي عِزٍّ وَنَحْنُ مُشْرِكُونَ فَلَمَّا آمَنَّا صِرْنَا أَذِلَّةً فَقَالَ إِنِّي أُمِرْتُ بِالْعَفْوِ فَلَا تُقَاتِلُوا
অর্থাৎ, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, আব্দুর রহমান ইবনে আওফ ও তার কিছু সাথী মক্কায় থাকাকালীন রাসুল (সাঃ) এর কাছে এসে বললেন: হে আল্লাহর রাসুল (সাঃ)! আমরা যখন মুর্তিপুজারী ছিলাম তখন সম্মানের সাথেই ছিলাম। আর ইসলাম গ্রহণ করেই আমরা লাঞ্চিত হয়ে গেলাম। (আমাদের কি কিছুই করার নেই?) রাসুল (সাঃ) বললেন: আমাকে ক্ষমা করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সুতরাং, যুদ্ধে জড়িয়ে পড় না।(নাসায়ী,মুসতাদরাকে হাকেম, বায়হাকী,মুসনাদে সাহাবা)
দ্বিতীয়ত: যখন শত্রুরা মারমুখী হয়ে গেল তখন শুধুমাত্র জিহাদের অনুমতিটুকু দেয়া হয়েছিল। আবশ্যক করা হয়নি। আল্লাহ তায়ালা বলেন: أُذِنَ لِلَّذِينَ يُقَاتَلُونَ بِأَنَّهُمْ ظُلِمُوا وَإِنَّ اللَّهَ عَلَى نَصْرِهِمْ لَقَدِيرٌ (39) الَّذِينَ أُخْرِجُوا مِنْ دِيَارِهِمْ بِغَيْرِ حَقٍّ إِلَّا أَنْ يَقُولُوا رَبُّنَا اللَّهُ وَلَوْلَا دَفْعُ اللَّهِ النَّاسَ بَعْضَهُمْ بِبَعْضٍ لَهُدِّمَتْ صَوَامِعُ وَبِيَعٌ وَصَلَوَاتٌ وَمَسَاجِدُ يُذْكَرُ فِيهَا اسْمُ اللَّهِ كَثِيرًا وَلَيَنْصُرَنَّ اللَّهُ مَنْ يَنْصُرُهُ إِنَّ اللَّهَ لَقَوِيٌّ عَزِيزٌ (40)
অর্থাৎ, যুদ্ধের অনুমতি দেয়া হলো তাদেরকে যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হচ্ছে,কেননা তারা মজলুম এবং আল্লাহ তায়ালা অবশ্যই তাদেরকে সাহায্য করার ক্ষমতা রাখেন। তাদেরকে নিজেদের ঘরবাড়ি থেকে অন্যায়ভাবে বের করে দেয়া হয়েছে শুধুমাত্র এ অপরাধে যে, তারা বলেছিল,“আল্লাহ আমাদের রব।” যদি আল্লাহ তায়ালা লোকদেরকে একের মাধ্যমে অন্যকে প্রতিহত করার ব্যবস্থা না করতেন,তাহলে যেখানে আল্লাহর নাম বেশী বেশী উচ্চারিত হয় সেসব আশ্রম,গীর্জা,ইবাদাতখানা ও মসজিদ ধ্বংস করে দেয়া হতো। আল্লাহ তায়ালা নিশ্চয়ই তাদেরকে সাহায্য করবেন যারা তাঁকে সাহায্য করবে। আল্লাহ তায়ালা বড়ই শক্তিমান ও পরাক্রমশালী। (সুরা হজ্জ: ৩৯-৪০)
তৃতীয়ত: যারা তাদের সাথে যুদ্ধ করে তাদের সাথেই যুদ্ধের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। অন্যদের সাথে নয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন: وَقَاتِلُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ الَّذِينَ يُقَاتِلُونَكُمْ وَلَا تَعْتَدُوا إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ الْمُعْتَدِينَ (190) অর্থাৎ, আর তোমরা আল্লাহর পথে তাদের সাথে যুদ্ধ কর,যারা তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে,কিন্তু খবরদার, সীমালংঘন কর না। নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা সীমালংঘনকারীদেরকে ভালবাসেন না। (সুরা বাকারা:১৯০)
চতুর্থত: অন্যান্য অমুসলিমদের সাথে শর্তসাপেক্ষে (রাষ্ট্রপ্রধানের পক্ষ থেকে নির্দেশ ইত্যাদি) জিহাদকে আবশ্যক করা হয়েছে। সেটাও হতে হবে যৌক্তিক কারণে। কেউ অমুসলিম হলেই যে, তার সাথে যুদ্ধ করা যাবে এটা ঠিক নয়। কেননা, আমরা ইতিহাসে দেখতে পাই- রাসুল (সাঃ) এর মদীনাতে অনেক অমুসলিম বসবাস করতেন। তাদের সাথে তিনি সু সম্পর্ক বজায় রেখে চলতেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন: وَقَاتِلُوا الْمُشْرِكِينَ كَافَّةً كَمَا يُقَاتِلُونَكُمْ كَافَّةً وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ مَعَ الْمُتَّقِينَ (36) অর্থাৎ, আর মুশরিকদের সাথে সবাই মিলে লড়াই কর, যেমন তারা সবাই মিলে তোমাদের সাথে লড়াই করে। আর জেনে রাখ! আল্লাহ তায়ালা মুত্তাকীদের (খোদাভীরু) সাথেই আছেন। (তাওবা:৩৬)
উল্লেখ্য যে,এখানে যাদের সাথে যুদ্ধ করা হচ্ছে শুধুমাত্র তাদের সাথেই যুদ্ধের নির্দেশ দেয়া হচ্ছে। যাদের সাথে যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছেনা তাদের ক্ষেত্রে এ নির্দেশ নয়। (ফিকহুল জিহাদ দ্রষ্টব্য)
জিহাদের অনুমতি: নিজের ইচ্ছামত কারো বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার অনুমতি ইসলামে নেই। ইসলাম যুদ্ধ করার জন্য বেশ কিছু নীতিমালা নির্ধারণ করে দিয়েছে। তন্মধ্যে জিহাদের অনুমতি নেয়ার বিধানও রয়েছে। কেউ যদি যুদ্ধে যেতে চায় তাহলে তাকে বেশ কয়েকটি স্থান থেকে অনুমতি নিতে হয়। সেগুলো হল- ১. পিতামাতার কাছ থেকে অনুমতি: মুসলিম পিতামাতার অনুমতি ব্যতিত জিহাদে অংশগ্রহণ করা বৈধ নয়। বুখারী ও মুসলিম শরীফের হাদীসে এসেছে- রাসুল (সাঃ) এর কাছে এক ব্যক্তি এসে জিহাদে শরীক হওয়ার জন্য অনুমতি চাইলেন। রাসুল (সাঃ) বললেন: তোমার পিতামাতা কি বেঁচে আছেন? তিনি বললেন: জি, তারা বেঁচে আছেন। রাসুল (সাঃ) বললেন: তাহলে তাদের মাঝেই জিহাদ কর। (তাদের খেদমতে আত্মনিয়োগ কর। তোমার জিহাদে যাওয়া লাগবে না) । (বুখারী, মুসলিম, তিরমীজি, নাসায়ী, আবু দাউদ, মুসনাদে আহমাদ, ইবনে হিব্বান)
২. ঋণদাতার কাছ থেকে অনুমতি: সমস্ত ইসলামিক স্কলার এ কথায় একমত পোষণ করেছেন যে, যদি কোন ব্যক্তি অন্য কারো কাছে ঋণী থাকে এবং তাৎক্ষনিকভাবে ঋণ পরিশোধ করার কথা থাকে তাহলে, জিহাদে যেতে হলে ঋণদাতার অনুমতি লাগবে। তবে, যদি কথা থাকে যে, পরে পরিশোধ করবে তাহলে, এ অনুমতির কোন দরকার নেই।
৩. সবচেয়ে বড় ও আসল ব্যাপার হল রাষ্ট্রপ্রধানের পক্ষ থেকে অনুমতিগ্রহণ করা। অনেকেই এটাতে ভুল করে বসেন। রাসুল (সাঃ) বলেছেন:
إِنَّمَا الْإِمَامُ جُنَّةٌ يُقَاتَلُ مِنْ وَرَائِهِ وَيُتَّقَى بِهِ فَإِنْ أَمَرَ بِتَقْوَى اللَّهِ وَعَدَلَ فَإِنَّ لَهُ بِذَلِكَ أَجْرًا وَإِنْ قَالَ بِغَيْرِهِ فَإِنَّ عَلَيْهِ مِنْهُ
অর্থাৎ, নিশ্চয় রাষ্ট্রপ্রধান ঢালের মত। তার পিছনে থেকে যুদ্ধ করতে হয় এবং তার মাধ্যমেই নিরাপত্তা পাওয়া যায়। যদি তিনি আল্লাহ ভীতির কোন বিষয়ে নির্দেশ দেন এবং ন্যায় বিচার করেন তাহলে, তিনি সাওয়াবের অধিকারী হবেন। আর যদি এর বিপরীত কোন নির্দেশ দেন তাহলে, তিনি গুণাহের পাত্র বিবেচিত হবেন। (বুখারী, মুসলিম, নাসায়ী, মুসনাদে আহমদ)
রাষ্ট্রপ্রধানের অনুমতি থাকলে আর কেউ এটা নিয়ে কোন কথা বলতে পারবে না। এটা তখন বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্যশীল বলেই গণ্য হবে।
আল্লামা ইবনে কুদামাহ (রহঃ) বলেন: জিহাদের বিষয়টা ইমাম তথা রাষ্ট্রপ্রধানের ব্যাপার। রাষ্ট্রের অধিবাসীদের জন্য তার আনুগত্য করা অবশ্য কর্তব্য। তিনি আরও বলেন: আমীরের (দায়িত্বশীল; আমরা এখানে বাহিনীপ্রধান বুঝতে পারি) অনুমতি ছাড়া সেনাদলের তাবু থেকে বের হওয়াও বৈধ নয়।(আল-মুগনী) কেননা, শত্রুর গতিবিধি তিনিই ভালো করে জানেন। অনুমতি ছাড়া বের হলে উক্ত ব্যক্তি শত্রুদলের শিকারে পরিণত হতে পারে।(আল-মুগনী)
উপরোক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, মুসলিম শাসক; হোক না সে মহাপাপী তবুও তার অনুমতি ছাড়া জিহাদে বের হওয়া যাবে না। রাষ্ট্রপ্রধানের অনুমতি ব্যতিত কোন ব্যক্তির জন্য বৈধ নয় জিহাদের ডাক দেয়া কিংবা তাতে শরীক হওয়া। কেননা, তাতে ফিতনা ফাসাদ ও বিপদের আশংকা রয়েছে।
জিহাদ ও যুদ্ধের পার্থক্যঃ জিহাদ ও যুদ্ধ এক জিনিস নয়। এ দু’টি ভিন্ন জিনিস। জিহাদের ভিতরে যুদ্ধ থাকতে পারে, আর যুদ্ধই জিহাদের চুড়ান্ত স্তর। তবে, যুদ্ধ সবসময় জিহাদ বলে গণ্য হয় না। জিহাদের একটি অংশ ও চুড়ান্ত স্তর হল যুদ্ধ। অন্য কথায় আমরা বলতে পারি, কিছু কিছু যুদ্ধকে জিহাদ বলা যায়, তবে সব যুদ্ধকে জিহাদ বলা যায় না। কেননা, অনেক সময় মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়াই করা লাগে। সেটা মোটেই জিহাদ নয়।
জিহাদে নারী-শিশু বৃদ্ধ হত্যা নিষিদ্ধ জিহাদের ময়দানে যুদ্ধ করার অনুমতি থাকলেও নারী, শিশু ও বৃদ্ধকে হত্যা করা নিষেধ করা হয়েছে। রাসুল (সাঃ) বলেছেন: « انْطَلِقُوا بِاسْمِ اللَّهِ وَبِاللَّهِ وَعَلَى مِلَّةِ رَسُولِ اللَّهِ لاَ تَقْتُلُوا شَيْخًا فَانِيًا وَلاَ طِفْلاً وَلاَ صَغِيرًا وَلاَ امْرَأَةً وَلاَ تَغُلُّوا وَضُمُّوا غَنَائِمَكُمْ وَأَصْلِحُوا وَأَحْسِنُوا إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ ».
অর্থাৎ, আল্লাহ তায়ালার নামে এবং তারই উপর ভরসা করে রাসুল(সাঃ) এর আদর্শ অনুসরণ করে অভিযানে যাও। খবরদার! কোন অতিশয় বৃদ্ধ, নারী ও শিশুকে হত্যা করবে না। সম্পদ আত্মসাৎ করবে না। তোমাদের যুদ্ধলব্ধ সম্পদ একত্রিত করবে এবং সৎকাজ করবে। আল্লাহ তায়ালা সৎকর্ম পরায়ণদেরকে ভালবাসেন। (আবু দাউদ, ইবনে আবী শায়বা, বায়হাকী)
আরেকটি হাদীসে এসেছে- عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا بَعَثَ جُيُوشَهُ قَالَ اخْرُجُوا بِسْمِ اللَّهِ تُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ مَنْ كَفَرَ بِاللَّهِ لَا تَغْدِرُوا وَلَا تَغُلُّوا وَلَا تُمَثِّلُوا وَلَا تَقْتُلُوا الْوِلْدَانَ وَلَا أَصْحَابَ الصَّوَامِعِ
অর্থাৎ, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসুল (সাঃ) যখন কোথাও সেনা অভিযান প্রেরণ করতেন তখন তাদেরকে বলতেন: তোমরা আল্লাহর রাস্তায় কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য আল্লাহ তায়ালার নামে বের হও। খবরদার! বিশ্বাসঘাতকতা করবে না, আত্মসাৎ করবে না, কারো লাশকে ছিন্নভিন্ন করবে না। ছোট্ট বাচ্চা ও কুড়েঘর ওয়ালাদের (গীর্জার পাদ্রীদের মধ্যকার যাদের দুনিয়ার দিকে খেয়াল নেই শুধু গীর্জায় অবস্থান করে) হত্যা করো না।(মুসনাদে আহমাদ, বায়হাকী)
ইসলাম কি তরবারীর দ্বারা বিস্তৃত হয়েছে? এ কথাটা ইসলাম বিদ্বেষীদের কাছ থেকে প্রায়ই শুনতে পাওয়া যায় যে, ইসলাম নাকি তরবারীর মাধ্যমে বিস্তৃত হয়েছে। অনেক মুসলিমও এমনটি ধারণা করে বসে। আসলে, ইসলাম তরবারীর জোরে নয়; বরং ইসলাম বিস্তার লাভ করেছে উদারতার দ্বারা। আমরা অনেকেই না জেনে না শুনে স্টাডি না করেই বলে ফেলি ইসলাম তরবারীর জোরে বিস্তৃত হয়েছে। আসলে কি তাই? আসুন! দেখি পাশ্চাত্যের মনিষীরা ইসলামের বিস্তৃতি সম্বন্ধে কি বলে।
১. বিশিষ্ট্য পাশ্চাত্য লেখক “টমাস কারলীল” তার “আবত্বাল ওয়া ইবাদাতুল বুতুলা” নামক গ্রন্থে লিখেছেন: মুহাম্মদ (সাঃ) কে তরবারীর জোরে ইসলাম বিস্তৃতি করেছে বলে অপবাদ দেয়া বোকামী ছাড়া আর কিছুই নয়। কেননা, একজন লোক তরবারী চালিয়ে অনেককে হত্যা করবে কিংবা তার দাওয়াতে প্রচুর লোক সাড়া দেবে এটা অযৌক্তিক কথা। তার ডাকে এমন অনেকেই সাড়া দিয়েছেন যারা শত্রুদের সাথে যুদ্ধ করতে সক্ষম ছিলেন।.........
২. ফ্রান্সের খ্যাতিমান ঐতিহাসিক “গোস্তাফ লোবন” তার রচিত “আরব সভ্যতা” নামক গ্রন্থে রাসুল (সাঃ) এর যুগে ইসলামের বিস্তৃতির গূঢ় রহস্য ও বিভিন্ন এলাকা বিজিত হওয়া সম্বন্ধে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন:
ইতিহাস প্রমাণ করেছে যে, কোন ধর্ম শক্তি দিয়ে টিকে থাকতে পারেনি। ইসলামও তদ্রুপ তরবারী কিংবা শক্তি প্রয়োগ করে বিস্তৃত হয়নি; বরং, ইসলাম দাওয়াত উপস্থাপনের দ্বারাই বিস্তৃতি লাভ করেছে। শুধুমাত্র দাওয়াত উপস্থাপনের মাধ্যমে তুর্কী ও মোঘল সম্প্রদায় ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছে; অথচ, আগে তারা আরবদের উপর কর্তৃত্ব করত। কুরআন পৌছে গেছে ভারতেও। আরবরা সেখানে যাওয়া থেকেও বিরত থাকেননি। শুধুমাত্র সেখানেই এখন মুসলিম সংখ্যা ৫ কোটি। চীনেও ইসলাম কম বিস্তৃতি লাভ করেনি। অথচ, সেখানকার কোন এলাকায় আরবরা অভিযান চালায়নি। ... এখন সেখানকার মুসলিম সংখ্যা ২ কোটি।
আসুন! এবার আমরা দেখি রাসুল (সাঃ) এর জীবন থেকে কি প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি কি তরবারীর জোরে ইসলাম প্রচার করেছেন? নাকি উদারতার দ্বারা ইসলাম প্রসার লাভ করেছে। আমরা যদি হুদায়বিয়ার সন্ধির দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাব যে, রাসুল (সাঃ) সেখানে যুদ্ধ করার মত পরিস্থিতির সৃষ্টি হলেও কাফেরদের সন্ধির প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলেন। অথচ, সেখানে যুদ্ধ করার মত সৈন্যবলের অভাব সেদিন তার ছিল না। ঘটনাটা এ রকম-
৬ষ্ঠ হিজরীতে রাসুল (সাঃ) স্বপ্ন দেখলেন যে, তিনি ও তার সাহাবীগণ মক্কায় প্রবেশ করে ওমরাহ পালন করছেন, তাওয়াফ ও সায়ী সবকিছুই করছেন। তিনি কা’বা শরীফের চাবি নিয়েছেন। সাহাবীদেরকে এ স্বপ্নের কথা জানালে তারা খুশি হলেন। মনে করলেন- এ বছরই তারা ওমরাহ করতে পারবেন। এরপর রাসুল (সাঃ) ওমরাহ পালন করার উদ্দেশ্যে ১৪০০ সাহাবী নিয়ে ৬ষ্ঠ হিজরীর জিলকদ মাসের শুরুতে সোমবার দিনে মক্কা অভিমুখে যাত্রা করলেন। মদীনায় নিজের স্থলাভিষিক্ত করে রেখে গেলেন-“আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম” কিংবা “নামীলা আল-লাইসী(রাঃ)”নামক সাহাবীকে। তখনকার ঐতিহ্য হিসেবে যে অস্ত্র সাথে থাকত তা ছাড়া তিনি যুদ্ধের জন্য আলাদা কোন অস্ত্র নেননি। রাস্তার মাঝে হুদায়বিয়া নামক স্থানে রাসুল (সাঃ) ও তার সাহাবীদের বাহিনীকে গতিরোধ করল কাফেররা। তারা বিশেষ বৈঠক করে রাসুল (সাঃ) এর ওমরাহ পালনে বাধা দিতে খালেদ বিন ওয়ালিদের (তিনি পরে ইসলাম গ্রহণ করেছেন) নেতৃত্বে ২০০ ঘোড় সওয়ার বাহিনীকে মক্কার পথে নিয়োজিত করল। রাসুল (সাঃ) ও তার সাহাবীগণ যেন মক্কায় প্রবেশ করতে না পারে। তাদেরকে বাধা দেয়াই ছিল এ বাহিনীর মুল লক্ষ্য।
দুই বাহিনী মুখোমুখি। খালিদ বিন ওয়ালিদ দেখলেন সেখানে মুসলমানরা জামায়াতের সাথে জোহরের নামাজ পড়ছেন। সবাই রুকু ও সিজদাহ করছেন। পরে খালিদ বিন ওয়ালিদ বলাবলি করলেন ওরা নামাজের সময় যে অবস্থায় ছিল তাদের উপর হামলা করলে আমরাই বিজয়ী হতাম। তারা সিদ্ধান্ত নিলেন যে, মুসলমানরা যখন আছরের নামাজ আদায় করবে তখন তাদের উপর হামলা করা হবে। এমতাবস্থায় আল্লাহ তায়ালা যুদ্ধাবস্থায় বিশেষ সিস্টেমে নামাজ আদায়ের নির্দেশ দিয়ে অহী নাযিল করলেন। (ইমামের পিছনে একদল লোক এক রাকাত (চার কিংবা তিন রাকাত বিশিষ্ট্য নামাজ হলে দুই রাকাত) নামাজ আদায় করে শত্রুদের সামনে চলে যাবে। এরা ফিরে গেলে আরেকটি দল এসে ইমামের সাথে বাকী নামাজ আদায় করে সালাম না ফিরিয়েই শত্রুদের সামনে চলে যাবে। এবার প্রথম দলটা ফিরে এসে নামাজের যতটুকু বাকী ছিল তা পূর্ণ করে ফিরে যাবে এরপর অন্য দলটা এসে নামাজ পূর্ণ করবে।)
রাসুল (সাঃ) কুরাইশদের ঘোড় সওয়ার বাহিনী নিয়োজিত করার সংবাদ জানতে পেরে প্রধান পথ বাদ দিয়ে অন্য পথে মক্কায় প্রবেশ করতে এগিয়ে গেলেন। বিকল্প পথে মুসলমানদেরকে মক্কায় প্রবেশ করতে দেখে কুরাইশদেরকে সতর্ক করার জন্য খালেদ বিন ওয়ালিদ দ্রুতবেগে মক্কাভিমুখে প্রস্থান করলেন।
এক ব্যক্তি রাসুল (সাঃ) কে সংবাদ দিলেন- কাফেররা রাসুল (সাঃ) ও তার সাহাবীদের সাথে যুদ্ধ করা এবং যেকোন মুল্যে আপনাকে মক্কায় প্রবেশে বাধা দিতে হুদায়বিয়াতে অবস্থান নিয়েছে। রাসুল (সাঃ) বললেন: আমরা তো যুদ্ধ করতে আসিনি। আমরা এসেছি ওমরাহ করতে। তারা যদি যুদ্ধ ছাড়া আর কিছুতেই একমত না হয় তাহলে, অবশ্যই আমরা তাদের সাথে যুদ্ধ করব যতক্ষন পর্যন্ত না আল্লাহ তায়ালা একটা ফয়সালা দেন।
শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষা করার জন্য রাসুল (সাঃ) কুরাইশদের কাছে বারবার প্রতিনিধি পাঠালেন। তারা সেখানে গিয়ে কুরাইশদের কাছে রাসুল (সাঃ) এর বক্তব্য উপস্থাপন করতে থাকেন। একবার তিনি তৃতীয় খলীফা উসমান (রাঃ) কে প্রতিনিধি হিসেবে পাঠালে তারা তাকে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত আটক রাখে। এ দিকে মুসলমানদের মাঝে খবর রটে যায় যে, উসমান (রাঃ) কে ওরা হত্যা করেছে।
রাসুল (সাঃ) সিদ্ধান্ত নিলেন- কাফেররা যেহেতু, শান্তি শৃংখলা রক্ষা করার জন্য কোন ভুমিকা পালন করছেনা এবং, আমাদের প্রতিনিধিকে হত্যা করেছে সুতরাং, আমরা তাদের সাথে যুদ্ধ করব। রাসুল (সাঃ) সাহাবীদের কাছ থেকে যুদ্ধের জন্য শপথ নিলেন। যা ইসলামের ইতিহাসে “বায়আতে রিদওয়ান” নামে খ্যাত।
কুরাইশরা দেখল পরিস্থিতি তো ভালো না। তাই, তড়িঘড়ি করে সুহাইল বিন আমরকে দিয়ে সন্ধির প্রস্তাব পাঠাল। তারা সন্ধির যেসব শর্ত দিয়েছিল তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- ১. এ বছর মুসলমানরা ওমরাহ পালন না করেই মদীনায় ফিরে যাবে। ২. আগামী বছর তিনদিনের জন্য ওমরাহ পালন করতে আসবে। তাদেরকে বাধা দেয়া হবে না। সাথে তারা শুধুমাত্র আত্মরক্ষার জন্য তরবারী রাখতে পারবে। ৩. ১০ বছর পরস্পর পরস্পরের সাথে যুদ্ধ বন্ধ থাকবে। ৪. মক্কার কোন অমুসলিম মুসলমান হয়ে মদীনায় গেলে মদীনা সরকার তাকে মক্কায় ফেরত দেবে। তবে, মদীনার কেউ মক্কায় গেলে মক্কা তাকে ফেরত দিতে বাধ্য থাকবে না। ইত্যাদি
সন্ধির শর্তাদি মুসলমানদের বিপক্ষে গেলেও রাসুল (সাঃ) শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষার স্বার্থে তাদের এ চুক্তি মেনে নিলেন। এমনকি কাফিররা "আল্লাহর রাসুল মুহাম্মদ (সাঃ) সন্ধি করছেন" চুক্তিপত্রে এ কথা লেখায়ও রাজি হল না। বরং, তারা রাসুল শব্দ কেটে দিতে বলল। রাসুল (সাঃ) তাদের এ প্রস্তাবকেও মেনে নিয়ে সমাজে শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেন। এর মাধ্যমে সমাজে শান্তি-শৃংখলা রক্ষার স্বার্থে ত্যাগ স্বীকার করার উজ্জ্বল একটি দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করলেন।
সন্ধির শর্তানুযায়ী কয়েকজন মুসলমানকেও কাফেরদের হাতে সমর্পন করা হয়েছিল। তাদের একজনের নাম ছিল আবু বাসীর (রাঃ)। তারা মুসলমান হয়ে মক্কা থেকে মদিনায় আসলে কুরাইশরা তাদেরকে নিতে লোক পাঠাল। সন্ধির শর্ত অনুযায়ী রাসুল (সাঃ) তাকে তাদের হাতে তুলে দিলেন।
তারপরেও কি মুহাম্মদ (সাঃ) কে দোষ দেয়া যায় যে, তিনি যুদ্ধবাজ ছিলেন? কক্ষনো না। অথচ, সমাজে শান্তি-শৃংখলার খাতিরে তারই দ্বীন গ্রহণকারী লোকদেরকে তিনি শত্রুদের হাতে সমর্পন করেছেন।
জিহাদ ও রাসুল (সাঃ): রাসুল (সাঃ) মদীনা এসে যখন নতুন একটি ইসলামী রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করলেন তখন শত্রুরা নতুন ইসলামী রাষ্ট্র ও মুসলিমদের উপর ক্রমাগত ষড়যন্ত্রের বীজ রোপন করতে লাগল। কিভাবে তাদের এ নতুন রাষ্ট্রকে ধ্বংস করা যায় এটাই ছিল তাদের মেইন চিন্তা ও টার্গেট। ফলে, তাদের সাথে রাসুল (সাঃ) কে বহু যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতে হয়।
আসুন! আমরা দেখি পর্যায়ক্রমে কিভাবে জিহাদের নির্দেশ এসেছে। আগেই আমরা উল্লেখ করেছি যে,প্রথমবারেই যুদ্ধের নির্দেশ আসেনি। এর নির্দেশ এসেছে ধাপে ধাপে।
জিহাদের অনুমতি: রাসুল (সাঃ) যখন মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করলেন তখন মক্কার কুরাইশরা মদীনাবাসীদেরকে বিভিন্নভাবে ভয়-ভীতি দেখাতে লাগল। তাদেরকে হুমকি দিতে শুরু করল। বলল: তোমরা আমাদের বংশের লোককে জায়গা দিয়েছ। তার সাথে মোকাবেলা করে তাকে বের করে দাও। নইলে আমরা এসে তোমাদের সাথে যুদ্ধ করব এবং তোমাদের স্ত্রীদেরকে ছিনিয়ে আনব।ইত্যাদি
এ ছাড়া যারা রাসুল (সাঃ) এর সাথে হিজরত করে চলে গেছে তাদেরকে বলতে লাগল: তোমরা মনে করো না যে, মদীনায় গিয়ে নিজেরা নিরাপদ হয়ে গেছ। শীঘ্রই আমরা তোমাদের কাছে গিয়ে তোমাদেরকে শিকড়সহ উপড়ে ফেলব এবং তোমাদের শস্য খেতকে ধ্বংস করে ফেলব। এ অবস্থায় আল্লাহ তায়ালা যুদ্ধের সাধারণ অনুমতি দিয়ে সুরা হাজ্জের ৩৯ ও ৪০ নং আয়াত নাযিল করলেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন: أُذِنَ لِلَّذِينَ يُقَاتَلُونَ بِأَنَّهُمْ ظُلِمُوا وَإِنَّ اللَّهَ عَلَى نَصْرِهِمْ لَقَدِيرٌ (39) الَّذِينَ أُخْرِجُوا مِنْ دِيَارِهِمْ بِغَيْرِ حَقٍّ إِلَّا أَنْ يَقُولُوا رَبُّنَا اللَّهُ وَلَوْلَا دَفْعُ اللَّهِ النَّاسَ بَعْضَهُمْ بِبَعْضٍ لَهُدِّمَتْ صَوَامِعُ وَبِيَعٌ وَصَلَوَاتٌ وَمَسَاجِدُ يُذْكَرُ فِيهَا اسْمُ اللَّهِ كَثِيرًا وَلَيَنْصُرَنَّ اللَّهُ مَنْ يَنْصُرُهُ إِنَّ اللَّهَ لَقَوِيٌّ عَزِيزٌ (40)
অর্থাৎ, যুদ্ধের অনুমতি দেয়া হলো তাদেরকে যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হচ্ছে,কেননা তারা মজলুম এবং আল্লাহ তায়ালা অবশ্যই তাদেরকে সাহায্য করার ক্ষমতা রাখেন। তাদেরকে নিজেদের ঘরবাড়ি থেকে অন্যায়ভাবে বের করে দেয়া হয়েছে শুধুমাত্র এ অপরাধে যে, তারা বলেছিল,“আল্লাহ আমাদের রব।” যদি আল্লাহ তায়ালা লোকদেরকে একের মাধ্যমে অন্যকে প্রতিহত করার ব্যবস্থা না করতেন,তাহলে যেখানে আল্লাহর নাম বেশী বেশী উচ্চারিত হয় সেসব আশ্রম,গীর্জা,ইবাদাতখানা ও মসজিদ ধ্বংস করে দেয়া হত। আল্লাহ তায়ালা নিশ্চয়ই তাদেরকে সাহায্য করবেন যারা তাঁকে সাহায্য করবে। আল্লাহ তায়ালা বড়ই শক্তিমান ও পরাক্রমশালী। (সুরা হজ্জ: ৩৯-৪০)
এ যুদ্ধের উদ্দেশ্য ছিল- ১. মদীনার আশপাশের রাস্তা ঘাট সম্বন্ধে বিশেষ করে মক্কার দিকে যাওয়ার পথসমুহের খোজ খবর নেয়া। ২. মদীনার আশপাশের সমস্ত রাস্তার ধারে বসবাসরত বিভিন্ন গোত্রের সাথে চুক্তি সম্পাদন করে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখা। ৩. মদীনার মুশরিক, ইহুদী ও বেদুঈনদেরকে মুসলিমদের শক্তিপ্রদর্শন করা। যেন তারা ভবিষ্যতে দেশটির উপর আক্রমণ করার সাহস না পায়। ৪. মক্কার কাফেরদেরকে তাদের ব্যবসায় ধ্বস নামার আশংকা জানিয়ে দেয়া। এ জন্য রাসুল (সাঃ) মদীনার আশ পাশে বেশ কিছু ছোট ছোট অভিযানও প্রেরণ করেছিলেন।
জিহাদের নির্দেশঃ দ্বিতীয় হিজরীতে জিহাদ ফরজ করে আল্লাহ তায়ালা কুরআনের আয়াত নাযিল করেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন: وَقَاتِلُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ الَّذِينَ يُقَاتِلُونَكُمْ وَلَا تَعْتَدُوا إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ الْمُعْتَدِينَ (190) অর্থাৎ, আর তোমরা আল্লাহর পথে তাদের সাথে যুদ্ধ কর,যারা তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে,কিন্তু খবরদার! বাড়াবাড়ি কর না। নিশ্চয় যারা বাড়াবাড়ি করে আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে পছন্দ করেন না। (সুরা বাকারা:১৯০)
এ অবস্থায় জিহাদের নির্দেশ ছিল সময়ের দাবী। আর এ বছরই আল্লাহ তায়ালা রাসুল (সাঃ) কে বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে কা'বা শরিফের দিকে নামাজের কিবলাহ পরিবর্তনের নির্দেশ দিয়েছিলেন।
ইসলামে জিহাদ সম্বন্ধে জানতে রাসুল (সাঃ)এর জীবনে সংঘটিত যুদ্ধসমুহ সম্বন্ধে ধারণা রাখা প্রয়োজন। আসুন! আমরা সেগুলো জেনে নিই।
সংক্ষেপে রাসুল (সাঃ) এর যুদ্ধসমুহ: ১. রাসুল (সাঃ) যুদ্ধের সেনাপতি হিসেবে ২৮ টি যুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেছেন। ২. তন্মধ্যে মাত্র ৯ টি যুদ্ধে দুই পক্ষের লড়াই হয়েছে। ৩. বাকী ১৯ টাতেই কাফেররা যুদ্ধ করতে এসে পলায়ন করেছে। ৪. শত্রুদের ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পেরে ৭ টি যুদ্ধে রাসুল (সাঃ) শত্রুদের উপর অভিযানে বের হয়েছেন। ৫. সমস্ত যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে আটটি বছরে। দ্বিতীয় হিজরী থেকে ৯ম হিজরী পর্যন্ত। ৬. উপরোক্ত ২৮ টির মধ্যে রাসুল (সাঃ) সর্বোচ্চ সংখ্যক যুদ্ধে বের হয়েছেন এই আট বছরের মধ্যকার প্রথম বছর তথা দ্বিতীয় হিজরীতে।
নিম্নে সংক্ষেপে বেশ কিছু যুদ্ধের ইতিবৃত্ত উল্লেখ করা হল।
বদর যুদ্ধ: যুদ্ধের তারিখ: ১৭ ই রমজান, ২য় হিজরী স্থান: বদর। দুরত্ব: মদীনা থেকে ১৫৫ কিলোমিটার এবং মক্কা থেকে ৩১০ কিলোমিটার। মুসলিম সৈন্য সংখ্যা: ৩১৩ জন (অন্যান্য রেওয়ায়েতে কয়েকজন কমবেশী রয়েছে)। তাদের ছিল দু'টি ঘোড়া ও ৭০ টি উট। কাফের সৈন্য সংখ্যা : প্রায় ১ হাজার।
যুদ্ধের কারণ: মক্কা থেকে শাম দেশে যাওয়ার সহজ পথ ছিল মদীনার ভিতর দিয়ে যাওয়া। আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে মক্কার কুরাইশদের একটি কাফেলা মুসলমানদের চোঁখ ফাকি দিয়ে মদীনা হয়ে শাম দেশে চলে গিয়েছিল। এ কথা জানতে পেরে দেশের নিরাপত্তা রক্ষার স্বার্থেই রাসুল (সাঃ) ওই এলাকায় "তালহা বিন উবায়দুল্লাহ" ও "সাঈদ বিন যায়েদ (রাঃ)" কে পাঠিয়ে দিলেন পাহারা দেয়ার জন্য। উক্ত কাফেলা অস্ত্র নিয়ে আবার মক্কায় ফিরে যাচ্ছিল। অন্য একটি দেশের উপর দিয়ে অস্ত্র গেলে সে দেশের রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সতর্ক থাকাটাই স্বাভাবিক। রাসুল (সাঃ) ও তাদেরকে ওই বাহিনীর উপর নিয়ন্ত্রণ নেয়ার জন্য বেশ কিছু সাহাবীকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তখনও সেখানে যুদ্ধের কোন সম্ভাবনা ছিল না। তারা ফিরে যাওয়ার সময় মুসলমানদেরকে দেখে ভীত-সন্ত্রস্থ হয়ে দ্রুত মক্কায় খবর পাঠিয়ে দিল যে, মুহাম্মদ (সাঃ) আমাদেরকে আক্রমণ করতে আসছে শিঘ্রই আমাদেরকে তাদের হাত থেকে বাঁচাও।
রাসুল (সাঃ) পথিমধ্যে "ওয়াদী যাফরান"(মদীনা থেকে ৯০-১১০ কিলোমিটার দুরত্বে) এলাকায় এসে জানতে পারলেন যে, কাফেররা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ইতিমধ্যে কাফিরদের কাছে আবু সুফিয়ান খবর পাঠিয়েছে যে, মুসলমানরা তাদের কাফেলার উপর আক্রমণ করার জন্য ছুটে আসছে। দ্রুত বেগে খবর ছড়িয়ে পড়ল মক্কার আনাচে কানাচে। সবাই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। তারা ঘোষণা দিয়ে দিল কোন কুরাইশ নেতা এ যুদ্ধে অনুপস্থিত থাকলে চলবে না। হয় নিজে যাবে নয়ত কাউকে স্থলাভিষিক্ত নিযুক্ত করে পাঠাবে। এ যুদ্ধে আবু লাহাব ছাড়া সব জাদরেল জাদরেল কাফের নেতাই অংশগ্রহণ করেছিল।
রাসুল (সাঃ) সাহাবীদের সাথে পরামর্শ করলেন। কি করা যায় এ পরিস্থিতিতে? তারা সিদ্ধান্তে আসলেন যে, বদরে পৌছতে হবে। সেখানে কুরাইশদের সামনাসামনি হতে হবে কিংবা যুদ্ধ করতে হবে। যেন তারা মুসলমানদেরকে স্বাধীনভাবে ইসলাম প্রচারে আর বাধা না দিতে পারে।
যুদ্ধের প্রস্তুতিঃ যখন যুদ্ধ করা ছাড়া আর কোন উপায় অবশিষ্ট থাকল না তখন- ১. রাসুল (সাঃ) যুদ্ধের স্থানে গিয়ে ঘাটি স্থাপন করলেন। ২. তিনি মুসলমানদেরকে সারিবদ্ধভাবে দাড় করালেন। সারিবদ্ধভাবে দাড়ানোর এ সিস্টেম আগে কোন আরবের জানা ছিল না। ৩. কুরাইশ বাহিনীর কোন সেনাপতি ছিল না এবং শৃংখলা বলতে তাদের মাঝে কিছুই ছিল না। তারা বিশৃংখলভাবে যে যেভাবে ইচ্ছা যুদ্ধ করে যাচ্ছিল। ৪. কাফেররা আক্রমণ শুরু করল। তাদের একজন পানির কুপ থেকে পানি খাওয়ার জন্য গেলে মুসলমানরা তাকে হত্যা করলেন। ৫. যুদ্ধের প্রারম্ভে কাফেরদের মধ্য থেকে তিনজন নিজেদের বীরত্ব দেখানোর জন্য আসলে মুসলমানদের মধ্য থেকেও তিনজন এগিয়ে যান। উক্ত তিন কাফেরই পরাজিত ও নিহত হয়।
ফলাফল: ১. মুসলমানগণ বিজয় লাভ করেন। ২. ১৪ জন মুসলিম শহীদ হন। ৩. আবু জেহেল, উতবা, শায়বা সহ বহুসংখ্যক জাদরেল জাদরেল কাফের নেতা নিহত হয়। নিহত কাফেরের সংখ্যা ছিল ৭০ জন। বাকী ৭০ জন বন্ধী হল। বন্ধীদের মধ্যকার দুইজনকে হত্যা করা হল। বাকীদের মধ্যকার গরীবদেরকে বিনা মুক্তিপণে ছেড়ে দেয়া হল। ধনীদেরকে ছেড়ে দেয়া হল মুক্তিপণ দিয়ে। আর তাদের মাঝে যারা শিক্ষিত ছিল তাদেরকে মুসলিম শিশুদেরকে লেখাপড়া শিক্ষাদানের বিনিময়ে মুক্ত করে দেয়া হল। ৪. তিনদিন বদর প্রান্তরে অবস্থান করে মুসলমানরা মদীনায় ফিরে আসেন।
উহুদ যুদ্ধ: যুদ্ধের তারিখ: ১৫ই শাওয়াল, ৩য় হিজরী। স্থান: মদীনার পার্শ্ববর্তী উহুদ পাহাড়ের সন্নিকটে। মুসলিম সৈন্য: ৭০০ জন। তন্মধ্যে অশ্বারোহী ৫০ জন। কাফের সৈন্য: তিন হাজার। তন্মধ্যে ২০০ জন অশ্বারোহী। যুদ্ধের উদ্দেশ্য: মক্কা থেকে আগত কাফের সৈন্যদের হাত থেকে মদীনার স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব টিকিয়ে রাখা।
যুদ্ধের প্রেক্ষাপট: মক্কার কাফেররা বদর যুদ্ধের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য ছিল বদ্ধ পরিকর। সে জন্য তাদের সৈন্যরা মদীনার অত্যন্ত নিকটে উহুদ পাহাড়ের পাশে এসে পৌছল। মুসলমানগণ তাদের মদীনায় আসার খবর পেলে রাসুল (সাঃ) সাহাবীদের সাথে পরামর্শ করলেন উদ্ভুত পরিস্থিতিতে কর্ম পদ্ধতি নির্ধারণের জন্য। তিনি নিজ থেকে পরামর্শ দিলেন মদীনায় থেকেই যুদ্ধ করতে হবে; মদীনায় দুর্গ গড়ে তুলতে হবে। তারা বাইরে থাকবে অপমানের সাথে। কিন্তু, যারা বদর যুদ্ধে অংশ নেননি তারা বললেন: আমরা বাইরে গিয়ে যুদ্ধ করব। আমরা কাপুরুষ নই...... ইত্যাদি। রাসুল (সাঃ) নিজের মত পরিবর্তন করে তাদের মতকেই গ্রহণ করে নিলেন।
রাসুল (সাঃ) মাঠে নেমে গেলেন। পাহাড়ের এক গিরিপথের কাছে ৫০ জন তিরন্দাজকে নিয়োজিত করলেন। তাদেরকে নির্দেশ দিলেন পরবর্তী নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত স্থান ত্যাগ করবে না। কিন্তু, প্রথমত: কাফেররা পরাজিত হয়ে ময়দান থেকে পালিয়ে গেলে অধিকাংশ তীরন্দাজ সেখান থেকে সরে গেলেন। তখন কাফেররা রাস্তা ফাঁকা দেখে আবার আক্রমণ করে বসল। তাদের উপর্যুপরি আক্রমণে সাহাবীদের অনেকেই দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন। অনেকে নিজের শরীরের শেষ রক্ত বিন্দুটুকু ইসলামের জন্য বিলিয়ে দিয়ে শহীদ হয়ে গেলেন। তবে, রাসুল (সাঃ) এর সাথে কিছু সাহাবী তখনও দৃঢ়পদ ছিলেন।
রাসুল (সাঃ) নিজেও এ যুদ্ধে আহত হলেন। তার দাঁত ভেংগে গেল। কিছু সাহাবী তাকে কাফেরদের আঘাত থেকে বাচানোর চেষ্টায় রত ছিলেন। তারপরেও, কাফেররা যখন দেখল মুসলমানদের সাথে পেরে ওঠা অসম্ভব তখন, তারা যুদ্ধ বন্ধ করে দিয়ে মুসলমান শহীদদের লাশকে ছিন্নভিন্ন করতে শুরু করে। কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ানের (পরবর্তীতে ইসলাম গ্রহণ করেন) স্ত্রী হিন্দ বিনতে উৎবা রাসুল (সাঃ) এর চাচা শহীদ আমীর হামজা (রাঃ) এর কলিজা বের করে এনে দাত দিয়ে চিবাতে লাগল। এভাবে মুসলমান শহীদদের বিভিন্ন লাশ ছিন্ন ভিন্ন করে তারা মক্কার দিকে ফিরে যায়।
ফলাফলঃ ১. মুসলিম সৈন্যের এক দশমাংশ তথা ৭০ জন শহীদ হন। ২. কাফেরদের ২২ জন নিহত হয়। ৩. কঠিন পরিস্থিতিতে ৪ গুণ সৈন্যের বিপরীতে মুসলমানগণ মদীনাকে পরাধীনতার হাত থেকে মুক্ত রাখতে সক্ষম হন। ৪. রাসুল (সাঃ) কে হত্যা করা কিংবা মুসলমানদের বড় ধরণের কোন ক্ষতি করা এবং মদীনার শক্তি নিঃশেষ করার টার্গেট বাস্তবায়নে কাফেররা ব্যর্থ হয়।
খন্দকের যুদ্ধঃ তারিখঃ শাওয়াল মাস, ৫ম হিজরী। প্রায় একমাস স্থায়ী হয়। স্থান: মদীনা মুনাওয়ারাহ,
ব্যতিক্রমী যুদ্ধ-পদ্ধতি: হযরত সালমান ফারসী (রাঃ)রাসুল (সাঃ)কে মদীনার পার্শ্বে গভীর গর্ত খনন করার পরামর্শ দেন। রাসুল (সাঃ)এর নির্দেশে মদীনার একদিকে(পুর্ব পশ্চিম বরাবরে) তিন কিলোমিটার পর্যন্ত পরিখা খনন করা হয়। মদীনার পূর্ব ও পশ্চিম দিক পাহাড় দিয়ে ঘেরা। আর দক্ষিণ দিকটার কিছু অংশ পাহাড় ও কিছু অংশে বনী কুরায়জার বসবাস ছিল। ফলে, একদিকে পরীখা খনন করাই যথেষ্ঠ হত।
পরিখার প্রকৃতি: দৈর্ঘ:প্রায় তিন হাজার মিটার বা তিন কিলোমিটার। প্রস্থ:৭ থেকে ১০ মিটার গভীরতা:৩ থেকে ৫ মিটার। খননকারী: ১৫০০ জন পুরুষ। গড়ে একজনের অংশ:আড়াই মিটার। খনন শেষ হওয়ার সময়কাল: ৬ দিন।
মুসলিম সৈন্য: ৩০০০ জন। অন্য বর্ণনায় এসেছে ১৫০০ শত্রু পক্ষের সৈন্য: ১০,০০০ জন।
যুদ্ধের কারণ: মদীনার ইহুদী গোত্র বনী নাজীরের উৎসাহে মদীনায় ইসলাম ও মুসলমানদের উপর আক্রমণকারী সৈন্য বাহিনী থেকে মদীনাকে নিরাপদ রাখা।
যুদ্ধের অবস্থা: কাফেররা পরিখার পাশে এসে আশ্চর্যান্বিত হয় এবং ঘাবড়ে যায়। তারা এমন সিস্টেম আগে কল্পনা ই করতে পারেনি। তারা কয়েকদিন বৃথা চেষ্টা করল পরিখা পার হওয়ার একটা পদ্ধতি বের করতে। কিন্তু, মুসলমানরা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে লাগলেন। তাদেরকে তীর নিক্ষেপ করতে লাগলেন। শেষ পর্যন্ত কাফেররা ব্যর্থ হয়। এখানে অত্যধিক ব্যস্ত থাকার কারণে রাসুল (সাঃ) এর আসরের নামাজ কাজা হয়ে গিয়েছিল। এ জন্য রাসুল (সাঃ) তাদের জন্য বদ দুয়া করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন: ( مَلَأَ اللهُ عليهم بيوتَهم وقبورَهم ناراً، كما شغلونا عن الصّلاة الوسطي حتى غابت الشمس ) অর্থাৎ, আল্লাহ তায়ালা তাদের বাড়ীঘর ও কবরকে আগুণ দিয়ে পূর্ণ করে দিন। তারা আমাকে আসরের নামাজ থেকে সুর্যাস্ত পর্যন্ত ব্যস্ত করে রেখেছিল। (বুখারী শরীফ)
শেষ পর্যন্ত প্রচন্ড বাতাস, বৃষ্টি ও ব্জ্রপাত ইত্যাদি এসে তাদের তাবু উল্টিয়ে ফেলে। তাদের হাড়ি পাতিল উলটে দেয়। তাদের মনে ভয় ঢুকে যায়। ফলে, তারা দ্রুত মদীনা ত্যাগ করে।
ফলাফল: ১. মুসলমানদের মধ্যকার ৬ জন সাহাবী শহীদ হন। ২. কাফেরদের ৩ জন নিহত হয়। ৩. বিশাল বাহিনী এসেও মদীনা থেকে ইসলাম ও মুসলমানদেরকে তারা বিতাড়ন করতে পারেনি।
হুদায়বিয়া সন্ধি: তারিখ: জিলকদ মাস, ৬ষ্ট হিজরী। স্থান: মক্কা থেকে ২২ কিলোমিটার পশ্চিমে হুদায়বিয়া নামক স্থান। বর্তমানে এ এলাকার নাম "শামিসি"।
যুদ্ধের (সন্ধি) সংক্ষিপ্ত ঘটনাবলী: দুই পক্ষে কয়েক দফায় দুত প্রেরণ, রাসুল (সাঃ) এর প্রথম প্রেরিত প্রতিনিধিকে হত্যার চেষ্টা ও দ্বিতীয় প্রতিনিধিকে আটক করে রাখার (অযথা দেরী করিয়ে দেয়া) কারণে মুসলমানদের মাঝে গুজব ছড়িয়ে পড়ল যে, রাসুল (সাঃ) এর প্রতিনিধি তৃতীয় খলীফা হযরত উসমান (রাঃ) কে কুরাইশরা হত্যা করেছে। সাহাবীরা রাসুল (সাঃ) এর হাতে মৃত্যুকে আলিংগন করার শপথ নিলেন। কিন্তু, মুসলমানরা আসলেই শান্তিপূর্ণ নিয়্যাতে ওমরাহ করতে এসেছে এ কথা যখন কুরাইশরা বুঝতে পারল তখনই রাসুল (সাঃ) এর কাছে সুহাইল বিন আমরকে সন্ধি করার জন্য প্রেরণ করল। উসমান (রাঃ) ও ফিরে আসলেন।
এ পর্যায়ে উভয় পক্ষ বেশ কিছু বিষয়ে একমত হয়ে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করলেন। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ধারাগুলো হল- ১. এ বছর মুসলমানরা ওমরাহ না করেই ফিরে যাবেন। আগামী বছর এসে ওমরাহ করবেন। ২. চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দুই পক্ষের মাঝে আগামী ১০ বছর সব ধরণের যুদ্ধ বন্ধ থাকবে। ৩. যে মক্কা থেকে মদীনায় চলে যাবে রাসুল (সাঃ) তাকে ফিরিয়ে দেবেন। আর যে মদীনা থেকে মক্কায় ফিরে যাবে কুরাইশরা তাকে ফিরিয়ে দেবে না। ৪. যার ইচ্ছা হয় সে মুহাম্মদ (সাঃ) এর সাথে মৈত্রী চুক্তি সম্পাদন করবে এবং যার ইচ্ছা কুরাইশদের সাথে চুক্তি সম্পাদন করবে।
ফলাফল: ১. কুরাইশরা ইসলামী রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিল। ২. মুসলমানদেরও যে ওমরাহ করার অধিকার আছে সেটা তারা মেনে নিল। ৩. মুসলমানগণ তাদের বড় শত্রুর কাছ থেকে নিরাপদ হয়ে গেল। দাওয়াতের ক্ষেত্র কন্টকমুক্ত হল। ৪. অন্যান্য গোত্রের সাথে মৈত্রী চুক্তি করার পথ খুলে গেল। খোজাআ গোত্র রাসুল (সাঃ)এর সাথে মৈত্রী চুক্তিতে আবদ্ধ হল। ৫.ইসলাম ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করল এবং প্রচুর সংখ্যক লোক ইসলাম গ্রহণ করল। ফলে,মাত্র দেড় বছরের ব্যবধানে মক্কা বিজয়ের সময় মুসলিম বাহিনীর সংখ্যা ১০ হাজারে উন্নীত হল। ৬.আবিসিনিয়ায় হিজরতকারীরা নিরাপদ হয়ে গেলেন। এবার তারা মদীনায় ফিরে আসলেন।
খায়বার যুদ্ধ: তারিখ: মুহাররম মাস, ৭ম হিজরী। স্থান: মদীনা থেকে ১৬৫ কিলোমিটার দূরে খায়বার এলাকায়।
যুদ্ধের কারণ: মুসলমানদের শত্রু ছিল তিনটি। কুরাইশ পৌত্তলিক, ইহুদী ও নাজদ বাসী। ৬ষ্ঠ হিজরীতে মক্কার কুরাইশদের সাথে সন্ধি হওয়ায় মুসলমানরা মক্কার কাফের হতে নিরাপদ হয়ে গেলেন। এখন বাকী দু'টোর ষড়যন্ত্র প্রতিহত করতে হবে। কেননা, তারা ছিল ওই এলাকায় অশান্তি সৃষ্টিকারী ও যত সমস্যা সৃষ্টির হোতা। তাই, মদীনাকে রক্ষা করার জন্যই তারা এখানে যুদ্ধ করেছিলেন।
যুদ্ধের পটভুমি: ১. ইহুদীদের অগোচরে মুসলমানগণ রাত্রিবেলায় খায়বার পৌছলেন। ২. মুসলমানগণ ইহুদীদের দুর্গ অবরোধ করে তা বিজয় করলেন। * অবরোধের তিনদিন পরে "নায়েম" দুর্গ বিজিত হয়। *"সা'ব" দুর্গ বিজিত হয় কঠোর যুদ্ধের পর। * "কিল্লা" দুর্গ বিজিত হয় ৩ দিন পর। * "নাজ্জার" দুর্গ বিজিত হয় ইহুদীদের পক্ষ থেকে প্রচন্ড পাথর ও তীর বৃষ্টি নিক্ষিপ্ত হওয়ার পর। * "কামুস" দুর্গ বিজিত হয় ২০ দিন পর। * "ওয়াত্বিহ ও সালালেম" দুর্গদ্বয় অবরোধের ১৪ দিনের মাথায় আত্মসমর্পন করে।
ফলাফল: ১. খায়বার বিজিত হয়। ২. মদীনার উত্তরে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সেখানে সহজে ইসলাম প্রচার করার পথ সুগম হয় । ৩. মুসলমানদের ১৯ জন সাহাবী শহীদ হন। এ ছাড়া প্রচুর সাহাবী আহত হন। ৪. বহু সংখ্যক ইহুদী হতাহত হয়।
মক্কা বিজয়: তারিখ: রমজান মাস, ৮ম হিজরী স্থান: মক্কা আল মুকাররামা,মদীনা থেকে ৪২০ কিলোমিটার দক্ষিণে। মুসলিম সৈন্য: ১০ হাজার। শত্রু সৈন্য: কুরাইশ ও বনু বকর গোত্রের সবাই।
অভিযানের উদ্দেশ্য: মক্কা বিজয় ও কুরাইশ কর্তৃক হুদায়বিয়া সন্ধি ভংগের প্রতিদান প্রদান। তারা তাদের মিত্র বনু বকর গোত্রকে রাসুল (সাঃ) এর মিত্র বনী খোজা'আ গোত্রকে আক্রমণ করতে সাহায্য করেছে। এ সময় খোজা'আ গোত্র মুসলমানদের কাছে সাহায্য চেয়েছে। তাদেরকে সাহায্য করতে এবং মক্কাবাসীদেরকে চুক্তিভংগের কারণে উচিত শিক্ষা দিতেই এ অভিযান পরিচালিত হয়েছে।
মক্কা বিজয়ের ঘটনাবলী: রাসুল (সাঃ) সাহাবীদেরকে নিয়ে অভিযানে বেরিয়ে পড়লেন। কুরাইশদের কাছে বিষয়টা অজানা রয়ে গেল যে, রাসুল (সাঃ) কোথায় যাচ্ছেন? অতঃপর তিনি মক্কার ২২ কিলোমিটার উত্তরে "মারর আয-যাহরান" নামক স্থানে পৌছে তাবু টানালেন। বেশী বেশী করে আগুন জালানো হল যেন কুরাইশরা ভীত হয়ে আত্মসমর্পন করে।
কুরাইশরা আবু সুফিয়ানের প্রত্যাবর্তন ও তার সতর্ক করার মাধ্যমে জানতে পারল যে, মুসলমানরা অনেক শক্তির সমাবেশ ও সৈন্য-সামন্ত নিয়ে এসেছে। আবু সুফিয়ান ঘোষনা করে দিলেন যে, যে ব্যক্তি আবু সুফিয়ানের ঘরে প্রবেশ করবে সে নিরাপদ, যে নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে দেবে সে নিরাপদ এবং, যে আল্লাহর ঘরে তথা কা'বা শরীফে প্রবেশ করবে সেও নিরাপদ। এটাই রাসুল (সাঃ)এর ঘোষণা।
রাসুল (সাঃ) তার সৈন্যদেরকে চারটি ভাগে ভাগ করলেন। ১. একটি ভাগ "যুবাইর ইবনুল আওয়্যাম (রাঃ)" এর নেতৃত্বে উত্তর দিক দিয়ে মক্কায় প্রবেশ করবে। ২. "খালিদ ইবনুল ওয়ালিদ (রাঃ)" এর নেতৃত্বে একটি ভাগ দক্ষিন দিক দিয়ে প্রবেশ করবে। ৩. আবু উবায়দাহ ইবনুল জাররাহ (রাঃ) এর নেতৃত্বে মুহাজিরগণ উত্তর-পশ্চিম দিক দিয়ে প্রবেশ করবে। ৪. সা'দ বিন উবাদাহ (রাঃ) এর নেতৃত্বে আনসারগণ পশ্চিম দিক দিয়ে প্রবেশ করবে।
রাসুল (সাঃ) সতর্ক করে দিলেন, বাধ্য না হলে কেউ কারো সাথে যেন যুদ্ধে না জড়ায়।
বিনা যুদ্ধে মক্কা বিজয়ঃ মুসলিম সৈন্যরা বিনা প্রতিরোধেই মক্কায় প্রবেশ করলেন। ফলে, উল্লেখযোগ্য কোন যুদ্ধ ছাড়াই মক্কা নগরী বিজিত হল। তবে, খানদামা এলাকায় খালেদ বিন ওয়ালিদ (রাঃ) এর বাহিনী সামান্য প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়।
বিজয়ের পর রাসুল (সাঃ) এর ভূমিকাঃ মক্কা বিজিত হওয়ার পর রাসুল (সাঃ) কা'বা ঘরের ভিতরে প্রবেশ করে নামাজ আদায় করলেন। কুরাইশরা সবাই সারিবদ্ধ হয়ে কা'বা চত্বরে অপেক্ষা করছে। রাসুল (সাঃ) কুরাইশদের সামনে একটা বক্তৃতা দিলেন। আজ কুরাইশদের সবাই তার সামনে উপস্থিত। তিনিই এখানকার সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারক। ইচ্ছামত সিদ্ধান্ত নিয়ে বিনা বাধায় তা বাস্তবায়ন করার ক্ষমতা এখন তার হাতে আছে।
যারা তাকে হত্যা করার জন্য মাত্র আট বছর আগে পুরস্কার ঘোষণা করেছিল, যারা নামাজের সময় তার মাথায় উটের নাড়িভূড়ি তুলে দিত তারা সবাই এখন তার হাতের মুঠোয় বন্দী। সবার মনে ভয় জেগেছে হায়! হায়! কখন জানি তিনি আমাদেরকে হত্যা করার নির্দেশ দিয়ে দেন। কারণ, আমরা তাকে হত্যা করার চেষ্টা করেছি। তার সাহাবীদের উপর অমানুষিক অত্যাচার ও নির্যাতন চালিয়েছি। আমাদের এ সমস্ত অপরাধের শাস্তি হত্যা ছাড়া আর কিছুই হবার নয়।
রাসুল (সাঃ) নামাজ শেষ করে কা'বা ঘরের দরজা খুললেন। দেখলেন কুরাইশরা সবাই নিশ্চুপ হয়ে বসে তার সিদ্ধান্তের অপেক্ষা করছে। সবাই তার সিদ্ধান্ত শোনার অপেক্ষায় প্রহর গুনছে। কুরাইশ নেতৃবৃন্দের গলা শুকিয়ে যাওয়ার মত অবস্থা। কিছুক্ষন পরেই তাদের ভাগ্য নির্ধারিত হবে। কি ঘটতে যাচ্ছে তাদের ভাগ্যে? কারও জানা নেই।
রাসুল (সাঃ) আল্লাহ তায়ালার প্রশংসা করলেন। তারপর বললেন: হে কুরাইশগণ! আল্লাহ তায়ালা তোমাদের অন্ধকার যুগের অহংকার ও বংশ মর্যাদার বড়াইকে চুর্ণ বিচুর্ণ করে দিয়েছেন। এখন আর তার কিছুই অবশিষ্ট্য নেই। বরং, সমস্ত মানুষ আদম (আঃ) থেকে এসেছে এবং আদম (আঃ) সৃজিত হয়েছেন মাটি থেকে। অর্থাৎ, সমস্ত মানুষ সমান। এরপর রাসুল (সাঃ) কুরআনের আয়াত তেলাওয়াত করলেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন: يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِنْ ذَكَرٍ وَأُنْثَى وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوا إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ (13)
অর্থাৎ,হে মানবসমাজ!নিশ্চয়ই আমি তোমাদেরকে একজন পুরুষ ও একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি। আর তোমাদেরকে বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত করেছি যেন তোমরা পরস্পরকে চিনতে পার। তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে মর্যাদাবান ঐ ব্যক্তি যে আল্লাহ তায়ালাকে অধিক ভয় করে। নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা মহাজ্ঞানী ও সর্ব বিষয়ে সম্যক অবহিত।(সুরা হুজুরাত:১৩)
হে কুরাইশ বংশের লোকেরা!তোমরা আমার কাছে কেমন ব্যবহার আশা কর?আমি তোমাদের ব্যাপারে কি ধরণের সিদ্ধান্ত নেব বলে মনে কর?তারা বলল:আমরা আপনার কাছ থেকে উত্তম ভাই ও ভ্রাতুষ্পুত্রের মত সুন্দর ব্যবহার আশা করি। রাসুল (সাঃ) বললেন: আমি তোমাদেরকে সেই কথাই বলছি যে কথা বলেছিলেন হযরত ইউসুফ (আঃ) তার ভাইদেরকে। আল্লাহ তায়ালা তার সে কথাকে কুরআন মাজীদে সংকলন করেছেন। আল্লাহ বলেন: قَالَ لَا تَثْرِيبَ عَلَيْكُمُ الْيَوْمَ يَغْفِرُ اللَّهُ لَكُمْ وَهُوَ أَرْحَمُ الرَّاحِمِينَ (92) অর্থাৎ,তিনি জবাবে বললেনঃ আজ তোমাদের বিরুদ্ধে আমার কোন অভিযোগ নেই। আল্লাহ তোমাদেরকে মাফ করে দিক। তিনি সবার প্রতি অনুগ্রহকারী। (সুরা ইউসুফ: ৯২)
অতএব, যাও তোমরা মুক্ত। আগে যা করেছ তার কোন বিচার আমি করব না, আমি তোমাদের সবাইকে মাফ করে দিলাম।
জীবনের শত্রুদেরকে তিনি হাতের মুঠোয় পেয়েও ক্ষমা করে দিলেন। এটা এক অপুর্ব ও অনন্য দৃষ্টান্ত। তখনকার আরবের প্রথা অনুযায়ী রাসুল (সাঃ) চাইলে তাদের সবাইকে দাসে পরিণত করতে পারতেন। দাসত্বের শৃংখলে তারা আবদ্ধ হত। কিন্তু, তিনি তা না করে তাদেরকে ক্ষমা করে মুক্ত করে দিলেন। এ জন্য একজন ইসলামিক স্কলার লিখেছেন: ইসলাম মানুষকে মানুষের বান্দা বা দাস করার জন্য আসে নি। বরং, মানুষকে মানুষের দাসত্ব থেকে মুক্ত করার জন্যই এসেছে ইসলাম। (তাফসীরে শা'রাবী)
তবে,সবাইকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলেও শুধুমাত্র নয়জন অপরাধীকে তিনি এ ক্ষমার আওতায় আনেননি। তিনি ঘোষণা করে দিলেন যে, তাদেরকে যেখানেই পাওয়া যাবে সেখানেই হত্যা করা যাবে। উক্ত নয়জন হলেন: ১. ইবনে খাত্তাল: ইবনে খাত্তাল কা'বা শরীফের পাশে আশ্রয় নিয়েছিল। এক ব্যক্তি তার কথা রাসুল (সাঃ) কে বললে রাসুল (সাঃ) বললেনঃ তাকে হত্যা কর। তাকে সেখানেই হত্যা করা হল।
২. আব্দুল্লাহ ইবনে সা'দ ইবনে আবি সারাহ: আব্দুল্লাহ ইবনে সা'দ ইবনে আবি সারাহর জন্য উসমান (রাঃ) রাসুল (সাঃ) এর কাছে সুপারিশ করলে তাকে ক্ষমা করে দেয়া হয়।
৩. আবু জেহেলের ছেলে ইকরামা বিন আবি জাহল:আবু জাহলের ছেলে ইকরামা যখন জানতে পারলেন যে, তার বিরুদ্ধে হত্যার রায় জারি হয়ে গেছে, তখন ইয়ামনের দিকে পালাতে যাচ্ছিলেন। সমুদ্রের নৌকায় উঠতে যাবেন এমন সময় স্ত্রীর সাথে দেখা। তার স্ত্রী রাসুল (সাঃ) এর কাছ থেকে তার জন্য নিরাপত্তা নিয়ে এসেছিলেন। অতঃপর তিনি রাসুল (সাঃ) এর নিকট গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন।
৪. হারেস ইবনে নুফাইল ইবনে ওয়াহাব: হারেস ইবনে নুফাইল রাসুল (সাঃ)কে মক্কী জীবনে অত্যন্ত কষ্ট দিত। আলী (রাঃ) তাকে হত্যা করলেন।
৫. মাকীস ইবনে সাবাবাহ:মাকীসকে হত্যা করলেন নামিলা ইবনে আব্দুল্লাহ নামক একজন সাহাবী।
৬. হিবার ইবনে আসওয়াদ: হিবার ইবনে আসওয়াদ হিজরত করার সময় রাসুল (সাঃ) এর কন্যা হযরত যায়নাব (রাঃ) এর সামনে এসে তার বাহনে আঘাত করলে তিনি একটি পাথরের উপর পড়ে যান এবং তার গর্ভপাত হয়ে যায়। মক্কা বিজয়ের দিন সে পালিয়ে গিয়েছিল। পরে সে ইসলাম গ্রহণ করে।
৭-৮. ইবনুল আখতালের দুই গায়িকা: তারা রাসুল (সাঃ) কে গালি দিয়ে কবিতা আবৃত্তি করত।দুইজন গায়িকার একজনকে হত্যা করা হয়। অপরজনের জন্য নিরাপত্তা চাওয়া হয়। সে পরে ইসলাম গ্রহন করে।
৯. সারাহ: তার কাছে কুরাইশদের নিকট প্রেরিত গোপণ চিঠি পাওয়া গিয়েছিল। অনুরুপভাবে সারাহ'র জন্যও নিরাপত্তা চাওয়া হলে তার নিরাপত্তা প্রদান করা হয়। পরে সে ইসলামগ্রহণ করে।
ফলাফল: ১. মক্কা মুসলমানদের শাসনাধীনে চলে আসল। কাফেরদের শৌর্য-বীর্য ও অহংকার চুর্ণ বিচুর্ণ হল। ২. মক্কাবাসীদেরকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষনা করা হল। ফলে,দলে দলে মানুষ ইসলাম গ্রহণ করতে লাগলেন। ইসলাম চারিদিকে দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে লাগল। ৩. আল্লাহ তায়ালার ঘর পবিত্র কা'বা শরীফে রক্ষিত মুর্তিগুলো সমুলে উৎপাটিত হল। ৪. মুসলমানদের মধ্যকার ২ জন সাহাবী শহীদ হলেন। ৫. কাফেরদের ১৩ জন নিহত ও বাকী কয়েকজন আহত হয়।
হুনাইনের যুদ্ধ: তারিখ: শাওয়াল মাস, অষ্টম হিজরী। স্থান: হুনাইন। মক্কা থেকে ২৬ কিলোমিটার পুর্বদিকে অবস্থিত। এখন স্থানটি "শারায়ে" নামে পরিচিত। মুসলিম সৈন্য সংখ্যা: ১২ হাজার। শত্রু সৈন্য সংখ্যা: হাওয়াজেন ও সাকিফ গোত্রের অধিকাংশ লোক।
যুদ্ধের উদ্দেশ্য: হাওয়াজেন ও সাকীফ গোত্রের লোকেরা একত্রিত হয়েছিল মুসলমানদের সাথে যুদ্ধ করার ইচ্ছায়। তাদের সম্ভাব্য আক্রমণের আগেই তাদের সে পথ বন্ধ করে দেয়াই ছিল এ যুদ্ধের উদ্দেশ্য।
যুদ্ধের পটভুমিঃ হাওয়াজেন ও সাকীফ গোত্রের লোকেরা মদীনা আক্রমণ করার জন্য আওতাস উপত্যকায় এসে জড়ো হয়। সেখান থেকে হুনাইন উপত্যকায় এসে তারা পাহাড় চুড়া ও উপত্যকার সংকীর্ণ পথের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। মুসলমানগণ হুনাইন উপত্যকায় আসেন ফজর নামাজের সময়। স্থানটা ছিল ঢালু। যে কেউ সেখান থেকে নিচে পড়ে যেতে পারে। সকালবেলা যখন অধিকাংশ মুসলমান সেখানে আসলেন মুশরিকরা তাদেরকে লক্ষ করে তীরবৃষ্টি বর্ষণ করতে শুরু করল। স্থানটা অন্ধকারাচ্ছন্ন ও শত্রুদের লুকিয়ে থাকার কারণে মুসলমানরা তীরের উৎসস্থল সম্বন্ধে নিশ্চিত হতে পারছিলেন না। ফলে, মুসলমানদের অবস্থা ক্রমেই পরাজয়ের দিকে মোড় নিতে যাচ্ছিল।
রাসুল (সাঃ) এবং তার সংগী ১০ জন সাহাবী সেখানে অটল ও দৃঢ়পদ ছিলেন। তিনি বললেন: হে আনসার! হে সুরা বাকারাওয়ালা! তোমরা কোথায়? তারা আবার একত্রিত হতে লাগলেন। এবার ঝাপিয়ে পড়লেন কাফিরদের উপর। দুই পক্ষে তুমুল যুদ্ধ হল। কাফের সৈন্যদের মধ্যে ক্রমাগত হতাহতের সংখ্যা বাড়তে লাগল। শেষে কাফেররা তাদের স্ত্রী পুত্র পরিজন ও সম্পদ ছেড়ে পালিয়ে গেল।
সাকীফ গোত্র তায়েফ এবং হাওয়াজেন গোত্র আওতাস উপত্যকার দিকে পালিয়ে গেল। রাসুল (সাঃ) আওতাস উপত্যকার দিকে একটি অভিযান পাঠালেন। সেখানে তারা তাদেরকে পরাজিত করে এলাকা বিজয় করে যুদ্ধালব্ধ সম্পদ নিয়ে রাসুল (সাঃ) এর কাছে ফিরে আসেন।
ফলাফল: ১. হাওয়াজেন ও সাকীফ গোত্রের অহংকার চুর্ণ হল। ২. মুসলমানদের মধ্যে বেশ কিছু লোক শহীদ হলেন। ৩. মুশরিকদের প্রায় একশত লোক নিহত হয়। ৪. মুসলমানগণ প্রচুর যুদ্ধলব্ধ সম্পদ হস্তগত করেন। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- ক. ২৪ হাজার উট খ. চল্লিশ হাজার ছাগল গ. চার হাজার উকিয়া রৌপ্য ঘ. ছয় হাজার যুদ্ধবন্ধী।
তাবুক যুদ্ধঃ তারিখ:রজব মাস,৯ম হিজরী। স্থানঃ মদীনা থেকে ৬৮০ কিলোমিটার দূরে (রেলপথের হিসেবে)প্রসিদ্ধ শহর তাবুক। মুসলিম সৈন্য সংখ্যা: ৩০ হাজার। তন্মধ্যে ১০ হাজার অশ্বারোহী। শত্রু সংখ্যা: বিশাল রোমান বাহিনী।
যুদ্ধের প্রেক্ষাপট: পৃথিবীর তখনকার পরাশক্তি ছিল রোমানরা। তাদের কথা শুনলেই ভীতির সঞ্চার হত মানুষের মনে। তারা ছিল তৎকালীন বিশ্বের সর্ববৃহৎ ও শক্তিশালী বাহিনী। রোমান ও তাদের মিত্র বাহিনী মদীনা আক্রমণ করতে তাবুকের ২৩০ কিলোমিটার উত্তরে "বালকা" নামক স্থানে সমবেত হয়। তাদের কবল থেকে মদীনাকে রক্ষা করতেই তাদের বিরুদ্ধে রাসুল (সাঃ)অভিযানে বের হলেন। রাসুল (সাঃ)চিন্তা করলেন রোমানদেরকে যদি মোকাবেলা না করা হয় তাহলে,তারা আরও বেশী মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে এবং মুসলিম সৈন্যবাহিনী ও ইসলামী দাওয়াতের উপর একটা খারাপ প্রভাব সৃষ্টি হবে। এ ছাড়া মুসলমানদের বিপদের জন্য আকাংখী মুনাফিকরা রোমের সাথে যোগাযোগ করে পিছন দিক থেকে তাদের বিষাক্ত তীর মুসলমানদের পেটে ঢুকিয়ে দেবে। আর সামনে থেকে রোমানরা এসে হামলে পড়বে। মুসলমানদের এতদিনের সাজানো "রাষ্ট্র" নামক সংসার এবং তাদের সমস্ত অর্জন নিমিষেই ধ্বংস হয়ে যাবে। এ জন্য যত কষ্টই হোক না কেন তাদেরকে মোকাবেলা করা দরকার।
এত বড় পরাশক্তির সাথে সম্মুখযুদ্ধ হবে। প্রয়োজনমত রসদ ও সৈন্যবাহিনী দরকার। রাসুল (সাঃ) সাহাবীদেরকে নির্দেশ দিলেন যুদ্ধে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে। রাসুল (সাঃ) এর ঘোষণা শোনামাত্র সাহাবীগণ যুদ্ধে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেয়ার প্রতিযোগিতা করতে লাগলেন। সাথে সাথে যুদ্ধ ফান্ডে দান করতে লাগলেন। আবু বকর (রাঃ) তার সমস্ত সম্পদ যুদ্ধ ফান্ডে দান করে দিলেন। যার পরিমাণ ছিল ৪০০০ দিরহাম বা ১০৫০ ভরি রৌপ্য। উমার (রাঃ) দিলেন তার সমস্ত সম্পদের অর্ধেক। উসমান (রাঃ) কয়েক দফায় যা দান করলেন তার পরিমাণ ছিল নগদ অর্থ ব্যতিত ৯০০ উট ও ১০০ ঘোড়া। আব্দুর রহমান ইবনে আওফ (রাঃ) এর দানের পরিমাণ ছিল ২০০ উকিয়া তথা ২১ হাজার ভরি রৌপ্য (১ উকিয়া=৪০ দিরহাম, এবং ১ দিরহাম=০.২৬২৫ ভরি রৌপ্য)। এ যুদ্ধের জন্য সবাই যার যার সামর্থ অনুসারে সম্পদ যুদ্ধ ফান্ডে দান করেছিলেন। মেয়েরা নিজেদের গহনা খুলে দান করতেন। চারদিক থেকে দলে দলে আসতে থাকেন প্রাণ উৎসর্গকারী স্বেচ্ছাসেবকদের বাহিনী। তারা আবেদন জানাতেন,বাহন ও অস্ত্র শস্ত্রের ব্যবস্থা হয়ে গেলে আমরা প্রাণ দিতে প্রস্তুত। যারা বাহন পেতেন না তারা কাঁদতেন। তারা এমনভাবে নিজেদের আন্তরিকতা ও মানসিক অস্থিরতা প্রকাশ করতেন যার ফলে রাসূল (সাঃ) এর হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠতে,এ ঘটনাটি কার্যত মুমিন ও মুনাফিক চিহ্নিতকরার একটি মানদণ্ডে পরিণত হয়ে গিয়েছিল।
যুদ্ধের ঘটনাবলীঃ রাসুল (সাঃ) জিহাদের জন্য বের হলেন। তাবুক যুদ্ধের ময়দানে তাবু স্থাপন করলেন। যুদ্ধ হবে তৎকালীন পরাশক্তি রোমানদের সাথে। এখন সম্মুখ যুদ্ধের জন্য সবাই প্রস্তুত। রাসুল (সাঃ) সাহাবীদের সামনে হৃদয়স্পর্শী বক্তৃতা দিলেন। সেটাতে সংক্ষেপে অধিক অর্থবোধক বাক্য দিয়ে তাদেরকে কিছু দিকনির্দেশনা দেন। পৃথিবীর তৎকালীন পরাশক্তি রোমান সৈন্যরা যখন জানতে পারল যে, রাসুল (সাঃ) তার বিশাল বাহিনী নিয়ে তাবুকে ঘাটি স্থাপন করেছেন। এতেই তারা অত্যধিক ভীত সন্ত্রস্থ হয়ে গেল। কেননা, ইতিপূর্বে মু'তার যুদ্ধে তাদের এক লাখ সৈন্য অংশগ্রহণ করেও মাত্র তিনহাজার মুসলিম সৈন্যের সামনে টিকতে পারেনি। আর এবার রাসুল (সাঃ) নিজে সেনাপতি হয়ে তার দশগুণ তথা ৩০ হাজার সৈন্য নিয়ে এসেছেন। সুতরাং, তার সামনে তারা পেরে উঠবে না এটা নিশ্চিত। এসব ভেবে তারা আর সম্মুখ যুদ্ধে আসার সাহস করল না। সেখান থেকেই পালিয়ে গেল। সীমান্তে আর কোন শত্রু নেই। সুতরাং,যুদ্ধেরও কোন প্রয়োজন নেই। মুসলমানদের সাহস ও শৌর্য-বীর্যের কথা দিক বিদিক ছড়িয়ে পড়তে লাগল। দলে দলে অমুসলিমরা ইসলাম গ্রহণ করতে লাগল। রাসুল (সাঃ)সেখানে ২০ দিন অবস্থান করলেন। সেখানে আয়লা,জারবা,আজরাহ ও দাওমাতুল জান্দাল নামক গোত্রের সাথে শান্তিচুক্তি করলেন। এরপর মদীনায় ফিরে আসলেন।
যুদ্ধের ময়দানে ক্ষমা করাঃ প্রচন্ড যুদ্ধের মাঝেও যদি কোন অমুসলিম নিরাপত্তা চায় তাহলে,তাকে নিরাপত্তা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে ইসলাম। আল্লাহ তায়ালা বলেন: وَإِنْ أَحَدٌ مِنَ الْمُشْرِكِينَ اسْتَجَارَكَ فَأَجِرْهُ حَتَّى يَسْمَعَ كَلَامَ اللَّهِ ثُمَّ أَبْلِغْهُ مَأْمَنَهُ ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ قَوْمٌ لَا يَعْلَمُونَ (6) অর্থাৎ,আর যদি মুশরিকদের কোন ব্যক্তি আশ্রয় প্রার্থনা করে আপনার কাছে আসতে চায় (যাতে সে আল্লাহর কালাম শুনতে পারে) তাহলে তাকে আল্লাহর কালাম শোনা পর্যন্ত আশ্রয় দিন,তারপর তাকে নিরাপদ জায়গায় পৌঁছিয়ে দিন। এরা অজ্ঞ বলেই তাদের সাথে এমন আচরণ করা উচিত।(সুরা তাওবা:৬)
রাসুল (সাঃ)একবার কিছু লোককে অভিযানে পাঠিয়েছিলেন। উসামাহ বিন যায়েদ (রাঃ)সেদিন একজন লোককে হত্যা করেছিলেন। সে তাকে দেখেই বলল: "লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ"। উসামাহ (রাঃ) মনে করলেন লোকটা হয়ত জান বাচানোর জন্য কালিমা "লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ" উচ্চারণ করেছে। তিনি তাকে হত্যা করলেন। রাসুল (সাঃ) এর কাছে খবর আসলে তিনি বললেন: "লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ" র ঘটনা কি?!!! উসামাহ (রাঃ) বললেন: হে আল্লাহর রাসুল(সাঃ)! আমি মনে করেছিলাম সে জান বাঁচানোর তাগিদেই এ কথা বলেছে। রাসুল (সাঃ) ধমকের সুরে বললেন: তুমি কি তার অন্তর চিরে দেখেছ?!!! (তাবাকাতে ইবনে সা'দ)
বর্তমানে বিভিন্ন স্থানে হামলা ও জিহাদের মধ্যে তুলনাঃ ইদানিং বাংলাদেশ সহ পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বোমা হামলা করা হচ্ছে। হত্যা করা হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। হত্যা করা হচ্ছে সম্মানিত বিচারকদেরকে। বোমা হামলাকারীদের কেউ কেউ আবার নিজেদেরকে মুসলমান বলে দাবী করছে এবং এ হামলা গুলোকে ইসলামের দৃষ্টিতে বৈধ বলে প্রচার করছে। অথচ,ইসলামের দৃষ্টিতে এগুলোর সামান্যতমও বৈধতা নেই। আসলে,এদেরকে ভুল বুঝানো হচ্ছে। ভুল বুঝিয়ে তাদেরকে এ ধরণের ন্যাক্কারজনক কাজে নিয়ে আসা হচ্ছে, যা মুসলিম সমাজ ও দেশের জন্য অত্যন্ত দুঃখজনক। ইসলামের দৃষ্টিতে বৈধ যুদ্ধকে তারা সঠিকভাবে বুঝতে পারেনি বলেই এমন হচ্ছে। তাদের হয়ত জানা নেই কোন কোন ক্ষেত্রে এবং কি কি শর্ত থাকলে একটি যুদ্ধকে ইসলামের দৃষ্টিতে বৈধ যুদ্ধ হিসেবে গণনা করা যেতে পারে।
এ ধরণের হামলা ও আক্রমণ করে মানুষ হত্যা করা ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ইসলাম কোন নিরীহ লোককে হত্যা করার অনুমতি দেয়নি। সুতরাং, এ ধরণের সমস্ত হামলা সন্ত্রাসী হামলা বলেই বিবেচিত হবে। ইসলাম এর জন্য দায়ী নয়। ইসলাম তাদের থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। প্রশাসনের উচিত তাদেরকে চিহ্নিত করে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা। ইসলাম সন্ত্রাসীদের জন্য বিভিন্ন শাস্তি নির্ধারণ করে দিয়েছে। সেগুলো বাস্তবায়ন করতে পারলে এ ধরণের অপরাধ সমাজ থেকে অনেকাংশে বিদায় নেবে ইনশাল্লাহ।
এদের থেকে মানুষকে সতর্ক থাকা উচিত;সতর্ক থাকা উচিত কেউ যেন ইসলামের নাম ভাংগিয়ে অবৈধ কাজ না করতে পারে।
মুসলিম দেশে অমুসলিম নাগরিকদের অধিকারঃ কোন মুসলিম দেশে যে সমস্ত অমুসলিম বসবাস করেন তারা সবাই সে দেশের মেহমান। তাদের সব ধরণের নিরাপত্তার দায়িত্ব উক্ত মুসলিম দেশের নাগরিকদের। মুসলিম রাষ্ট্রের উচিত তার সমস্ত প্রকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। হোক সেটা নাগরিক অধিকার, সামাজিক কিংবা ধর্মীয় অধিকার। তাদের সে অধিকার পরিপূর্ণভাবে নিশ্চিত করতে হবে। তাদের উপর রাষ্ট্রের দাঁয়িত্ব সমুহের মধ্যকার কয়েকটি দায়িত্ব হল- ১. অমুসলিম নাগরিকদের সাথে যুদ্ধ করা যাবে না। কেননা, তারা আমাদের দেশে সরকারের কাছ থেকে নিরাপত্তাপ্রাপ্ত। ২. মুসলিম দেশের যে কোন স্থানে তারা যেতে পারবে তবে, বিশেষ বিশেষ স্থান ব্যতিত। যেমন সউদী আরবের মক্কা। সেখানে অমুসলিমরা প্রবেশ করতে পারবে না।
৩.তারা মুসলিম দেশের একটা অংশ বিশেষ। মুসলমানদের দায়িত্ব হয়ে যায় তাদের কাছ থেকে কষ্টদায়ক জিনিস সরিয়ে নেয়া। অন্য কথায় বলতে গেলে তাদেরকে রক্ষা করা ও নিরাপত্তা দেয়ার দায়িত্ব এসে যায় খোদ মুসলমানদের উপর।
হযরত উমার (রাঃ)তার পরবর্তী খলীফার প্রতি ওসিয়ত করে গেছেন যে,মুসলমানরা যেন তাদের (অমুসলিম নাগরিকদের) হক তথা অধিকারকে পুরোপুরি পরিশোধ করে দেয় এবং তাদেরকে আগলে রাখে।
৪.তাদের উপাসনালয়ের উপর হস্তক্ষেপ না করা। কেননা,নিজ নিজ ধর্ম পালন করার অধিকারও ব্যক্তিগত অধিকারের অন্তর্ভুক্ত। (আহকামুয যিম্মা ফিল ইসলাম)
সুতরাং,তাদের সে অধিকার পরিপূর্ণ রূপে প্রদান করা আবশ্যক। তাদেরকে জোর করে ইসলামে টেনে আনা যাবে না। কেননা,ইসলাম ধর্মগ্রহণের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়িকে একেবারেই সাপোর্ট করে না। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন: لَا إِكْرَاهَ فِي الدِّينِ
অর্থাৎ,দ্বীন তথা ধর্ম বা জীবন ব্যবস্থা গ্রহণের বেলায় কোন জবর দস্তি নেই । (সুরা বাকারা:২৫৬)
মোটকথা,মুসলিম প্রধান দেশে তারা সামাজিক,নাগরিক ও ধর্মীয় স্বাধীনতা পুরোপুরি ভোগ করার অধিকার রাখে। তাদের সেই অধিকারে হস্তক্ষেপ করা জুলুমের নামান্তর।
পরিশেষে বলা যায় যে,ইসলামের দৃষ্টিতে ময়দানে যুদ্ধ করতে হলে যেহেতু,রাষ্ট্রপ্রধানের অনুমতির দরকার হয়,সুতরাং,ইসলামের দৃষ্টিতে জিহাদ ও কোন দেশের সেনাবাহিনীর যুদ্ধ করা এ দিক থেকে সমান। কোন দেশের সেনাবাহিনী রাখা যদি দুষণীয় না হয় তাহলে,প্রকৃত অর্থে ইসলাম অনুমোদিত জিহাদও দুষণীয় নয়। কেননা,উভয়টাই রাষ্ট্রের ছত্রছায়ায় সংঘটিত হয়। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে তার দ্বীন ভালোভাবে বুঝার ও সেগুলো বাস্তব জীবনে সেগুলো মেনে চলার তাওফিক দান করুন। আর আমাদের সবাইকে তার দ্বীনের জন্য কবুল করে নিন। আমীন।।
মুহাম্মদ ইসমাইল জাবীহুল্লাহ অনার্স,ইসলামী আইন বিভাগ আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়,মিশর। ইমেইলঃ স্প্যামবটের হাত থেকে এই ইমেল ঠিকানা সুরক্ষিত আছে। পড়ার জন্যে জাভাস্ক্রিপ্ট অন করুন।
|