আমাদের টাইপ করা বইগুলোতে বানান ভুল রয়ে গিয়েছে প্রচুর। আমরা ভুলগুলো ঠিক করার চেষ্টা করছি ক্রমাগত। ভুল শুধরানো এবং টাইপ সেটিং জড়িত কাজে সহায়তা করতে যোগাযোগ করুন আমাদের সাথে।
রাসায়েল ও মাসায়েল ৬ষ্ঠ খন্ড প্রিন্ট কর ইমেল
লিখেছেন সাইয়্যেদ আবুল আ'লা মওদূদী   
Monday, 28 February 2011
আর্টিকেল সূচি
রাসায়েল ও মাসায়েল ৬ষ্ঠ খন্ড
গ্রন্থকার পরিচিতি
১। আল্লাহর অস্তিত্ব সম্পর্কে সংশয় নিরসন
২। আল্লাহ ও তাঁর রসুলগণের মধ্যে পার্থক্য করা
৩। জীবজন্তুর উপর দয়া
৪। পাঁচ ওয়াক্ত ও পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায
৫। হানাফি মাযহাবে কি কিছু কিছু মাদক দ্রব্য হালাল?
৬। আদালতের রায় কি শুধু জাহেরীভাবেই কার্যকর, নাকি বাতেনীভাবেও কার্যকর?
৭। সুন্নাহর আইনগত মর্যাদা
৮। সাহরির শেষ সময় কোনটি?
৯। একটি হাদিস থেকে সুদের বৈধতা প্রমাণের অপচেষ্টা
১০। মুসলিম উম্মাহর বহু গোষ্ঠিতে বিভক্তি এবং মুক্তি লাভকারি গোষ্ঠি
১১। কালো খেজাব লাগানো কি বৈধ?-১
১২। কালো খেজাব কি বৈধ?-২
১৩। তাকদীর প্রসঙ্গ
১৪। গোমরাহী ও হেদায়েত
১৫। সূরা আন নাজমের প্রাথমিক আয়াত কয়টির ব্যাখ্যা
১৬। যাকাতকে প্রচলিত করের সাথে যুক্ত করা যায় না
১৭। পিতামাতার অধিকার
১৮। লোহার আংটি পরা কি জায়েয?
১৯। উশর ও খারাজের কয়েকটি সমস্যা
২০। উশরযোগ্য ফল ফসল কি কি?
২১। মোজার উপর মসেহ করার বিধান
২২। কারো সম্মানে দাঁড়ানো কি জায়েয?
২৩। 'প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ দান করা' সংক্রান্ত কুরআনের আদেশের ব্যাখ্যা
২৪। অপ্রাপ্ত বয়স্ক সন্তানদের ভরণ পোষণ প্রসঙ্গে
২৫। কবর আযাব
২৬। কুরআন শিক্ষাদান ও অন্যান্য ধর্মীয় কাজের পারিশ্রমিক নেয়া কি বৈধ?
২৭। ইসলামের ফৌজদারী দণ্ডবিধি সংক্রান্ত কিছু ব্যাখ্যা
২৮। বেতের নামাযে দোয়া কুনূত
২৯। লাইসেন্স ক্রয় বিক্রয়
৩০। কিবলার দিক নির্ণয়ের শরিয়তসম্মত বনাম বিজ্ঞানসম্মত পন্থা
৩১। মৃত ব্যক্তির জন্য ফিদিয়া দান, শোক ও কুরআন খতম
৩২। কয়েদি সৈন্যরা কি নামায কসর করবে
৩৩। পবিত্র কুরআন ও গুপ্ত ওহি
৩৪। ব্যভিচারের অপবাদ
৩৫। কোন কোন প্রাণী হালাল বা হারাম
৩৬। কুরবানীর চামড়া সম্পর্কে শরিয়তের বিধান
৩৭। মৃত ব্যক্তির চামড়া সম্পর্কে শরিয়তের বিধান
৩৮। মৃত প্রাণীর চামড়া সম্পর্কে আরো আলোচনা
৩৯। জবাই হালাল হওয়ার জন্য কি বিস্
৪০। যাকাত সংক্রান্ত কিছু খোলামেলা কথা
৪১। নগদ পুঁজির যাকাত ও তার নিসাব
৪২। বাইয়ে সালাম
৪৩। হযরত আলী রা.-এর জন্য সূর্যকে ফিরিয়ে দেয়ার ঘটনা কি সত্য?
৪৪। কুরাইশের ১২ জন খলিফা ও 'ফিতনায়ে আহলাস'
৪৫। আল্লাহ ও রসূলের কোনো উক্তি কি মানুষকে কর্মবিমুখ করতে পারে?
৪৬। আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয় করা সত্ত্বেও দৈন্যদশার কারণ কি?
৪৭। হযরত আলী রা.-এর বর্ম চুরি-১
৪৮। হযরত আলী রা.-এর বর্ম চুরি-২
৪৯। ইসলামের দৃষ্টিতে গানবাজনা ও নারী পুরুষের মেলামেশা
৫০। আব্দুল্লাহ বিন উবাইর জানাযা
৫১। ইমাম ইবনে তাবারি কি শিয়া ছিলেন?
৫২। ফৌজদারি অপরাধের ক্ষেত্রে আপোস নিষ্পত্তির অধিকার
৫৩। ইসলামের উত্তরাধিকার আইন সম্পর্কে অভিযোগ
৫৪। শরিয়তের দৃষ্টিতে ওয়াকফের সংজ্ঞা ও বিধান
৫৫। আত্মহননকারীর জানাযা নামায
৫৬। হারুত মারুত ফেরেশতাদ্বয় সম্পর্কে এক ভিত্তিহীন অলীক কাহিনী
৫৭। 'চাটান' সম্পাদকের নিকট দুটো চিঠি
৫৮। হাদিস অস্বীকার করা ও স্বীকার করা
৫৯। হাদিস বিরোধী গোষ্ঠির বিভ্রান্তিকর প্রচারণা
৬০। একটি হাদিস সম্পর্কে আপত্তি ও তার জবাব
৬১। সন্তান পালনে নারীর অধিকার
৬২। স্তনের দুধ পানে বিয়ে হারাম হওয়া
৬৩। পারিবারিক আইন ও অর্পিত তালাক
৬৪। ফাসিদ বিয়ে ও বাতিল বিয়ে
৬৫। রসূল সা. কি হযরত সওদা রা. কে তালাক দিতে চেয়েছিলেন?
৬৬। উম্মুল মুমিনীন হযরত সওদার বিয়ে সম্পর্কে আরো আলোচনা
৬৭। কতোখানি দুধ পান করলে বিয়ে হারাম হয়?
৬৮। পিতামাতার আদেশে স্ত্রী তালাক দেয়া যায় কি?
৬৯। রসুল সা.-এর একাধিক বিয়ের যৌক্তিকতা ও সার্থকতা
৭০। বেলুচিস্তানের বাগদান প্রথা
৭১। লটারি ও নির্বাচনী লটারি
৭২। সমবায় সমিতি

<h1>৪। পাঁচ ওয়াক্ত ও পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায</h1>
প্রশ্ন : মিরাজ সংক্রান্ত যে হাদিসটিতে প্রথমে পঞ্চাশ ওয়াক্ত এবং পরে হযরত মূসার আ. পরামর্শক্রমে সর্বশেষে পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয করার উল্লেখ রয়েছে, হাদিস বিরোধীরা সেই হাদিসটির উপর নানা রকমের বিদ্রূপমিশ্রিত আপত্তি তুলে থাকে। তারা বলে আল্লাহ যখন পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায ফরয করলেন, তখন কি তিনি বুঝতে পারেননি যে, আমি একটা অসাধ্য কাজের হুকুম দিচ্ছি? কেবল হযরত মূসার পরামর্শ এবং হযরত মুহাম্মদ সা.-এর আবেদন পাওয়ার পরই কি তিনি নিজের বাড়াবাড়ি টের পেলেন? হযরত মূসা কি (নাউজুবিল্লাহ) স্বয়ং আল্লাহ ও মুহাম্মদ সা.-এর চেয়েও বেশি জ্ঞানী যে, যে কথা হযরত মূসা আ. তাৎক্ষণিকভাবে বুঝতে পারলেন, তা আল্লাহ ও তাঁর শেষ নবীর মাথায় সময়মত এলোইনা? ইসলামের অকাট্য বিধানগুলো কি আল্লাহ এভাবেই নির্ধারণ করেন যে, পঞ্চাশ থেকে শুরু করেন এবং পাঁচ পর্যন্ত পেয়ে সন্তুষ্ট হয়ে যান? হাদিস বিরোধীদের ধারণা, এ হাদিস কোনো ইহুদির মনগড়া যাতে তাদের নবীর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয়। তারা বলে, নামায যদি প্রথমে পঞ্চাশ ওয়াক্ত ফরয করা হয়েও থাকে, তথাপি পাঁচ ওয়াক্ত নির্ধারিত হয়ে যাওয়ার পর আবার পঞ্চাশ ওয়াক্তের উল্লেখ করার কি দরকার ছিলো। এতে কি অকারণ একটা অন্তর্দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়না এবং এ ধরনের হাদিসগুলো কি অমুসলিমদের হরেক রকম প্রশ্ন তোলার সুযোগ করে দেয়না? কিন্তু তা সত্ত্বেও মুসলমানরা এসব হাদিসকে বুকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। এ হাদিসটি কতখানি শুদ্ধ অনুগ্রহপূর্বক জানাবেন এবং এর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণও করবেন, যাতে হাদিস বিরোধীদের আপত্তি নিরসন হয়ে যায়।

জবাব : এ হাদিস সম্পূর্ণ শুদ্ধ ও নির্ভুল। পাঁচ ওয়াক্ত নামায যে সংখ্যার দিক থেকে বেশি নয়, তাই হাদিস বিরোধীদের মতো পাঁচ ওয়াক্ত নামাযকে একটা প্রাণান্তকর বোঝা মনে করে এর সংখ্যা কমানো, তাৎপর্যকে বিকৃত করা এবং মনগড়াভাবে কিছু রহিত করা ও কিছু রদবদল করার অপচেষ্টা করা উচিত নয়, এটা বুঝানোই এ হাদিসের উদ্দেশ্য। এই হাদিস দ্বারা মুসলমানদেরকে এই ধারণা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে যে, নামায অতি নিম্ন সংখ্যক রাখা হয়েছে এবং তা আসলে পঞ্চাশ ওয়াক্তেরই স্থলাভিষিক্ত। এটা আল্লাহর অনুগ্রহ বিশেষ। নচেত পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাযও যদি ফরয হতে, তবু তা অন্যায় হতোনা।

আমরা যদি হেদায়েত অণ্বেষণের মনোভাব নিয়ে এ হাদিস অধ্যয়ন করি তাহলে তা থেকে উপরোক্ত শিক্ষাই অর্জিত হয়। কিন্তু যদি প্রত্যাখ্যান, অজ্ঞতা ও উপহাসের মনোভাব নিয়ে এ হাদিসকে দেখি, তাহলে আপনি যে সব আপত্তি ও প্রশ্ন উদ্ধৃত করেছেন, সেগুলো অবশ্যই জন্মে। আর শুধু এই হাদিস কেন, এ ধরনের মনগড়া ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা চালানো হলে অন্যান্য বহু সংখ্যক হাদিস, এমনকি বহুসংখ্যক আয়াতের উপরও এ রকম অনেক আপত্তি তোলা যাবে। উদাহরণস্বরূপ, জিহাদের নির্দেশ দিতে গিয়ে সূরা আনফালের এক জায়গায় আল্লাহ বলেন :
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
"হে নবী ! মুমিনদেরকে লড়াইয়ে উদ্বুদ্ধ কর। তোমাদের পক্ষে বিশজন ধৈর্যশীল লোক হলে তারা দু'শ জনের উপর বিজয়ী হবে। আর একশ'জন হলে তারা এক হাজার জন কাফেরের উপর বিজয়ী হবে। কেননা তারা নির্বোধ।" (সূরা আল আনফাল, আয়াত : ৬৫)

এখানে স্পষ্টতই কাফেরদের মোকাবিলায় মুসলমানদের বিজয়ী হবার জন্য আল্লাহ তায়ালা মুসলমান ও কাফেরদের শক্তি অনুপাত যথাক্রমে এক ও দশ উল্লেখ করেছেন। কিন্তু এর অব্যবহিত অন্য আয়াতে বলা হয়েছে :
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

"এখন আল্লাহ তায়ালা তোমদের দায় দায়িত্ব আরো হালকা করে দিলেন এবং তোমাদের মধ্যে যে দুর্বলতা রয়েছে, তা তিনি অবহিত আছেন। অতএব, এখন তোমাদের পক্ষে একশ' জন ধৈর্যশীল লোক হলে তারা দু'শ জনের উপর বিজয়ী হবে। আর তোমাদের পক্ষে এক হাজার জন হলে তারা আল্লাহর ইচ্ছায় দু'হাজার জনের উপর বিজয়ী হবে। বস্তুত: আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে থাকেন।" (সূরা আল আনফাল, আয়াত: ৬৬)

এখানে লক্ষ্য করুন বিজয় নিশ্চিত করার জন্য দু'পক্ষের সংখ্যানুপাতকে ১:১০ থেকে কমিয়ে ১:২ করা হয়েছে। এখন যদি সাময়িকভাবে হাদিস অমান্যকারীদের মানসিকতা অবলম্বন করা হয়, তা হলে পূর্বোল্লিখিত হাদিসটিতে যে ধরণের আপত্তি তোলা হয়েছে, এখানেও তা তোলা যায়। যেমন বলা যায় প্রথম আয়াতটি নাযিল করার সময় কি মুসলমানদের দুর্বলতার কথা আল্লাহর জানা ছিলো না যে, খামোখাই এক ও দশের অনুপাত ঘোষণা করে দিলেন। এ কথাও বলা যেতে পারে যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে যখন আসল অনুপাতটার উল্লেখ বাদই পড়ে গেলো এবং একই নি:শ্বাসে অনুপাতটা পাল্টে দেয়া হলো, তখন পেছনের অনুপাতটা বর্ণনা করে আমাদেরকে অনর্থক ঝামেলায় ফেলা হলো কেন? অনুরূপভাবে সূরা মুযযাম্মিলে প্রথমে বললেন :
---------------------------------------------------------------------------------
"ওহে কম্বল মুড়ি দেয়া ব্যক্তি! রাত জাগো। তবে বেশি রাত জেগোনা। রাতের অর্ধেক কিংবা কিছু কম, অথবা কিছু বাড়িয়ে নাও। আর ধীরে ধীরে কুরআন অধ্যায়ন করো।" সূরা আল মুজ্জাম্মিল, আয়াত : ১-৪ পরক্ষণে আবার বললেন :
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
"তোমার প্রভু জানেন যে, তুমি রাতের দুই তৃতীয়াংশের কিছু কম, অর্ধাংশ এবং এক তৃতীয়াংশ জেগে কাটাও। তোমার সহচরদের একটি দলও এরূপ করে থাকে। দিন ও রাতের পরিমাণ তো আল্লাহ নিজেই নির্ধারণ করেন। আল্লাহ অবগত হয়েছেন যে, তোমরা এ কাজে সক্ষম হবেনা। তাই তিনি তোমাদের প্রতি অনুকম্পাশীল হয়েছেন। কাজেই কুরআনের যতোটা সহজসাধ্য হয় ততোটা পড়। আল্লাহ নিশ্চিত হয়েছেন যে, তোমাদের কেউ কেউ অসুস্থ থাকবে, অন্যরা আল্লাহর অনুগ্রহের সন্ধানে পৃথিবীতে পরিভ্রমণ করবে, আবার কতোক লোক আল্লাহর পক্ষে লড়াই করবে। সুতরাং কুরআন থেকে যতোটুকু হয় পড়।" (সূরা আল মুজ্জাম্মিল, আয়াতাংশ : ২০)

এখানেও আপত্তি তোলার অবকাশ রয়েছে যে, নির্দেশ জারি করার এ-তো ভারি অদ্ভুত নিয়ম! প্রথমে তো রাতের অর্ধেক বা তার চেয়ে কিছু কম বেশি জাগার হুকুম দেয়া হলো। তারপর আবার বলা হলো যে, আল্লাহ অবগত হয়েছেন তোমরা এ নির্দেশ পালন করতে পারবেনা। তিনি এ কথাও জানতে পেরেছেন যে, তোমাদের কারো অসুখ বিসুখ হবে। তাই এখন রাতের অর্ধাংশ, এক তৃতীয়াংশ ও দুই তৃতীয়াংশ সংক্রান্ত কড়াকড়ি রহিত করা হলো। তোমাদেরকে স্বাধীনতা দেয়া হলো যে, সহজে যতোটুকু কুরআন পড়তে পারো পড়। এখানে বলা যেতে পারে যে, আল্লাহ তায়ালার কি পরে হুশ হলো যে, আমি একটা অসম্ভব কাজের হুকুম দিয়ে ফেলেছি (নাউজুবিল্লাহ) এবং এখন বলছেন "তিনি জানতে পেরেছেন যে, তোমরা এ নির্দেশ পালন করতে পারবে না।" আমাদের কতোক অসুখে ভুগবে, সফর করবে, লড়াইও করবে, তা কি তিনি এখন টের পেলেন যে, রাত জাগরণের আগের নির্ধারিত পরিমাণকে একটা বাড়াবাড়ি মনে করে তা পাল্টানো হচ্ছে। আরও একটা উদাহরণ নিন। কুরআনে এক জায়গায় বলা হয়েছে :--------------------------------------------------------------------------------
"যখন আমি মূসার আ. কাছ থেকে চল্লিশ রাত অবস্থানের অঙ্গিকার গ্রহণ করলাম।" (সূরা আল বাকারা, আয়াতংশ : ৫১) অপর জায়গায় বলা হয়েছে :
---------------------------------------------------------------------------------
"আমি মূসার আ. কাছ থেকে ত্রিশ রাত অবস্থানের অঙ্গিকার নিয়েছিলাম এবং আরো দশরাত তাতে যোগ করেছিলাম" (সূরা আল আ'রাফ, আয়াতাংশ : ১৪২)
অর্থাৎ এক জায়গায় বলা হয়েছে আমি চল্লিশ দিন ঠিক করেছিলাম। অন্যত্র বলা হয় আমি প্রথমে ত্রিশ দিন ঠিক করেছিলাম এবং পরে আরো দশ দিন বাড়িয়ে চল্লিশ দিন পূর্ণ করি। একজন বিকৃত মানসিকতা সম্পন্ন লোক এখানেও প্রশ্ন তুলতে পারে যে, এটা কি ধরনের বর্ণনাভঙ্গি যে, এক জায়গায় সুস্পষ্টভাবে চল্লিশ দিনের মেয়াদ উল্লেখ করা হলো, আর অন্যত্র বলা হলো ত্রিশ দিন। অত:পর তার সাথে দশ দিন বাড়িয়ে পূর্ণ করা হলো। এই কৃত্রিমতার কারণ কি?

এই দু'তিনটি উদাহরণ থেকে সহজেই আন্দাজ করা যায় যে, সমালোচনা ও খুঁত ধরার প্রবণতা থাকলে হাদিস দূরে থাক, স্বয়ং কুরআনের এক একটি আয়াতের উপরও আপত্তির স্তূপ লাগিয়ে দেয়া সম্ভব। কিন্তু মানুষ যদি শিক্ষা, উপদেশ, হেদায়েত ও পথনির্দেশ খোঁজে, তবে সে বিভ্রাট ও বিভ্রান্তির অনুসন্ধান ব্যাপৃত হতে পারেনা এবং যা অপেক্ষাকৃত উত্তম ও কল্যাণকর, তাই অনুসরণ করে থাকে। আলোচ্য হাদিসটির ব্যাপারেও এই উভয় দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বনের অবকাশ রয়েছে। এক দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে এ হাদিসটি অধ্যয়ন করলে পাঁচ ও পঞ্চাশের বিভ্রাটে আটকা পড়ে যেতে হবে, অথবা এরূপ অবাঞ্ছিত বিতর্কে লিপ্ত হয়ে যেতে হবে যে, যে নবী পরামর্শ দিলেন, যে নবী পরামর্শ গ্রহণ করলেন এবং যে আল্লাহ পরামর্শ অনুমোদন করলেন, তাঁদের মধ্যে অধিকতর বিজ্ঞ, অধিকতর প্রাজ্ঞ ও ত্বরিৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাসম্পন্ন কে?

পক্ষান্তরে অপর দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে হাদিসটি অধ্যয়ন করলে এত ইসলামের একটি অতীব মহান মূলনীতির মনোজ্ঞ চিত্র পাঠকের সামনে ভেসে উঠবে। এই মূলনীতিটি হলো দায়িত্বের বোঝা অপেক্ষাকৃত হালকা ও সহজতর করা। এতে একদিকে বুঝানো হয়েছে যে, আল্লাহ যদি আমাদেরকে দিনে রাতে পঞ্চাশবার তার আনুগত্যের অঙ্গিকার করা ও তাঁর দরবারে সিজদা করার আদেশ দেন, তবে সেটা আল্লাহর পক্ষ থেকে 'জুলুম' হিসেবে কিছুতেই গণ্য হবেনা। পক্ষান্তরে তিনি যদি নিজের দু'জন প্রিয় রসূলের আবেদন ও সুপারিশক্রমে মাত্র পাঁচবার ঐ কাজ করার নির্দেশ দিয়ে থাকেন, তবে তাঁর অর্থ এ নয় যে, এই মাত্র নতুন একটা তথ্য তাঁর কাছে উদঘাটিত হলো, যা তিনি ইতিপূর্বে টেরও পাননি, জানতেও পারেননি। ব্যাপারটা কক্ষনো তেমন নয়। বরঞ্চ এভাবে তিনি তাঁর বান্দাদেরকে এ কথাই উপলব্ধি করাতে চান যে, তাদের উপর তাঁর করুণা ও অনুগ্রহ কি অপার এবং কি অপরিসীম তার দয়া ও ভালবাসা! নামাযের ওয়াক্ত পঞ্চাশ থেকে পাঁচে নামিয়ে তিনি যে বান্দার দায়িত্ব হালকা করার বিরাট মহানুভবতা দেখালেন, এ জন্য তিনি দু'জন নবীকে উপলক্ষ বা মাধ্যম বানালেন, যাতে তাঁদের সম্মান ও গৌরব বাড়ে, আমাদের মনে তাদের মহব্বত বদ্ধমূল হয় এবং আল্লাহর কাছে তাঁদের কতো কদর ও মর্যাদা, তা আমরা বুঝতে পারি। এ দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে যখন আমরা উল্লেখিত মি'রাজের হদিস বিবেচনা করি, তখন আমাদের মন আপত্তির কন্টকমুক্ত এবং আল্লাহর কৃতজ্ঞতা ও প্রশংসায় ভরে উঠে।

এ হাদিস প্রসঙ্গে এরূপ প্রশ্নও অবান্তর যে, এটি হযরত মূসার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের উদ্দেশ্যে কোনো ইহুদির মনগড়া কিনা। শুধুমাত্র কুটবুদ্ধিসম্পন্ন বিকৃত রুচি ও বিদ্বেষ ভাবাপন্ন লোকের পক্ষেই এরূপ প্রশ্ন তোলা সম্ভব। কুরআন ও হাদিসে সুস্পষ্টভাবে বলে দেয়া হয়েছে যে, আল্লাহর রসূলগণের মধ্যে একজনের চেয়ে আরেকজন শ্রেষ্ঠ। কারো ব্যক্তিত্বে একটা গুণ প্রাধান্য পেয়ে থকলে অপর জনের মধ্যে অন্য বৈশিষ্ট্য উজ্জল। আমরা তাদের ব্যক্তিগত গুণবৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে পারি। কিন্তু আমাদের বর্ণনা এমন হওয়া চাইনা যাতে কোনো বিশেষ নবীকে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়। আলোচ্য হাদিসে কোনো নবীর অবমাননা হতে পারে এমন ভাষায় অন্য কোনা নবীর তুলনা করা বা শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরা হয়নি। হাদিস অমান্যকারিদের চমকপ্রদ যুক্তি প্রদর্শনে প্রভাবিত হয়ে যদি এ কথা মেনেও নেই যে, এই তুখোড় ভাষাবিদরা আলোচ্য হাদিস থেকে পরামর্শ গ্রহীতার চেয়ে পরামর্শ দাতার শ্রেষ্ঠত্ব ও জ্ঞান বুদ্ধির আধিক্য প্রমাণিত হয় বলে যে তত্ত্ব হাজির করেছেন তা সঠিক, তা হলে তো স্বয়ং আল্লাহর চেয়েও হযরত মূসার শ্রেষ্ঠত্ব কুরআন থেকেই প্রমাণ করা যায়। কুরআনে একাধিক জায়গায় বর্ণিত হয়েছে যে, আল্লাহ হযরত মূসা আ. কে ফিরাউন ও তার জাতিকে ইসলামের দাওয়াত দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। হযরত মূসা বললেন যে, আমি ভালো বক্তা নই, আমার আশংকা যে, আমার দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করা হবে। তাই আপনি হারুনকে আমার উপদেষ্টা ও সহকর্মী বানিয়ে দিন। এ ঘটনা থেকে কি এ কথা প্রমাণিত হয় যে, হযরত মূসা আ. আল্লাহর চেয়ে বেশি জ্ঞানী? এ কাজের জন্য মূসা আ. যে একা যথেষ্ট নন, তা আল্লাহ বুঝতেই পারলেন না। বুঝলেন শুধু মূসা আর তার কথা শুনে আল্লাহ বুঝলেন যে, তাই তো, কথাটা তো ঠিকই। একাকী মূসার উপর এ দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়া অন্যায়। আল্লাহ তায়ালা কি এমন একজন 'অবুঝ' সম্রাট যে, অমুক কাজের জন্য কি ধরনের ও কতজন কর্মী দরকার, সে ব্যাপারে তাঁর কোনো জ্ঞানই নেই? হাদিস অমান্যকারী গোষ্ঠি যেমন প্রশ্ন করে থাকে যে, নামাযের ন্যায় মৌলিক গুরুত্বপূর্ণ বিধানও কি এরূপ পারস্পরিক মত বিনিময়ের মাধ্যমে নির্ধারিত হতো? তেমনিভাবে এ ক্ষেত্রে কি এমন প্রশ্ন তোলা যায় না যে, নবুওয়াতের মতো সুমহান দায়িত্বে নিয়োগের জন্যও কি এভাবে পারস্পরিক মতৈক্যের ভিত্তিতে লোক নির্বাচন করা হতো? কুরআনের যে সব আয়াতে আল্লাহর সাথে হযরত মূসার আ. কথোপকথনের বিবরণ দেয়া হয়েছে, তাও কি কোনো ইহুদির মনগড়া?

সব শেষে বলা দরকার মনে করি যে, মিরাজ সংক্রান্ত যে বিস্তৃত বিবরণ কুরআন অথবা হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, তা অনেকাংশেই 'মুতাশাবিহাত' অর্থাৎ 'মানবীয় বুদ্ধির অগম্য' বিষয়সমূহের অন্তর্ভুক্ত। তাই এগুলোকে স্বীকার করে নিতে হবে এবং এর মধ্যে থেকে যা কিছু উপদেশ ও শিক্ষণীয় পাওয়া যায় তার উপরই আমাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখতে হবে। অন্যথায় এর খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে মাথা কুটলে বিভ্রান্তি ও গোমরাহী ছাড়া আর কোনো লাভ হবেনা। যেমন হাদিসে এসেছে যে, রসূল সা.-কে বিভিন্ন আকাশে নিয়ে যাওয়া হয়, ভালো কাজগুলোকে বাঞ্ছিত ও অবাঞ্ছিত আকারে ও ঘটনাবলীর রূপ দিয়ে রূপকভাবে দেখানো হয়। বেহেশত দোজখ এবং আযাব ও সওয়াব দেখানো হয়, সাবেক নবীদের সাথে সাক্ষাত করানো হয়। আলোচ্য হাদিসটিতে এ কথাও বলা হয়েছে যে, রসূল সা.-কে আল্লাহর দরবারে একাধিকবার একান্ত সাক্ষাৎকারে মিলিত হবার গৌরবে ভূষিত করা হয়। কারো যদি মাথা বিগড়ে গিয়ে থাকে তাহলে সে এর প্রতিটি কথা নিয়ে বিপুল সংখ্যক আপত্তি তুলতে পারে। এ জন্যই হাদিস অমান্যকারীরা এইসব হাদিস নিয়ে উপহাস-বিদ্রুপে লিপ্ত হয়ে থাকে। কিছুক্ষণের জন্য এই হাদিসগুলো থেকে দৃষ্টিভঙ্গি সরিয়ে রেখে আমরা যদি মিরাজ সংক্রান্ত কুরআনের আয়াতগুলো পর্যালোচনা করি তাহলে কি দেখতে পাইনা যে, সেখানেও এ ধরণের রহস্য ঘেরা দুর্বোধ্য তথ্য রয়েছে, যার সঠিক ব্যাখ্যা একমাত্র আল্লাহই ভালো জানেন বলে ক্ষান্ত থাকতে হয়। কুরআনে কি একই রাতের মধ্যে আপন বান্দাকে মসজিদে আকসায় নিয়ে যাওয়া এবং স্বীয় নিদর্শনাবলী দেখানোর কথা বলা হয়নি? "দুই ধনুকের জ্যার সমান বা তার চেয়েও ঘনিষ্ঠ হওয়ার" কথা কি কুরআনে বর্ণিত হয়নি? যদি কেউ প্রশ্ন তুলতে চায় তবে তার পক্ষে কি এখানেও এরূপ প্রশ্ন তোলা সম্ভব নয় যে, দুই ধনুকের জ্যার বলতে কি বুঝায় এবং দূরত্ব যদি দুই ধনুকের জ্যার সমানই হয়ে থাকে তা হলে আবার তার চেয়েও ঘনিষ্ঠ বলার তাৎপর্য কি?

তাছাড়া কুরআনে যে, 'সিদরাতুল মুনতাহার' উল্লেখ রয়েছে, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলা যেতে পারে যে, এটা কি সেই সুপরিচিত 'সিদরা' বা কুল গাছ? যদি তাই হয় তা হলে 'সদরাতুল মুনতাহা' অর্থাৎ শেষ প্রান্তের কুল গাছ অর্থ কি? আর এই কুল গাছটাকে যে জিনিস আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো বলা হয়েছে, সে জিনিসটি কি? এসব জিনিস নিয়ে আপত্তি তোলার সুযোগ কি অমুসলিমরা অতীতে কখনো পায়নি বা আজও পেতে পারেনা? তা হলে হাদিস অমান্যকারী কুরআনের এ আয়াতগুলোকে বুকে জড়িয়ে রাখছে কি কারণে? কুরআনের উপর সরাসরি আক্রমণ চালানোর জন্য পরিবেশ এখনো অনুকূল নয় বলে আপাতত: হাদিসের বিরুদ্ধে আক্রমনের ঘাটি তৈরিতে নিয়োজিত থাকাই এর কারণ নয় তো? [তরজমানুল কুরআন, এপ্রিল ১৯৫৬]



সর্বশেষ আপডেট ( Friday, 04 March 2011 )