আমাদের টাইপ করা বইগুলোতে বানান ভুল রয়ে গিয়েছে প্রচুর। আমরা ভুলগুলো ঠিক করার চেষ্টা করছি ক্রমাগত। ভুল শুধরানো এবং টাইপ সেটিং জড়িত কাজে সহায়তা করতে যোগাযোগ করুন আমাদের সাথে।
রসূলুল্লাহর বিপ্লবী জীবন প্রিন্ট কর ইমেল
লিখেছেন আবু সলীম মুহাম্মদ আবদুল হাই   
Thursday, 21 February 2008
আর্টিকেল সূচি
রসূলুল্লাহর বিপ্লবী জীবন
ইসলামী আন্দোলন ও তার অনন্য বৈশিষ্ট্য
ইসলামী আন্দোলনের প্রাক্কালে দুনিয়ার অবস্থা
জন্ম ও বাল্যকাল
নবুয়্যাতের সূচনা
আন্দোলনের সূচনা
মু'জিযা ও মি'রাজ
হিজরত
নবপর্যায়ে ইসলামী আন্দোলন
ইসলামী আন্দোলনের প্রতিরক্ষা
বদর যুদ্ধের পটভূমি
ওহুদ যুদ্ধ
ওহুদের বিপর্যয়ের পর
খন্দকের যুদ্ধ
হুদাইবিয়া সন্ধির পটভূমি
সম্রাটদের নামে পত্রাবলী
ইসলামী রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা
মক্কা বিজয়
হুনাইনের যুদ্ধ
তাবুক যুদ্ধ
বিদায় হজ্জ এবং ওফাত
পরিশিষ্ট

ওহুদের বিপর্যয়ের পর

আগেই বলা হয়েছে যে, আরবের দু-একটি গোত্র ছাড়া বাদবাকী সমস্ত গোত্রই এই নবোত্থিত ইসলামী আন্দোলনের বিরোধী ছিলো। কারণ, এ আন্দোলন তাদের পৈত্রিক ধর্ম ও রসম-রেওয়াজের ওপর প্রচণ্ডভাবে আঘাত হানছিলো। সেই সঙ্গে মানুষ নৈতিক দিক থেকে উন্নত হোক এবং জুয়া, ব্যভিচার, মদ্যপান, লুটতরাজ ইত্যাকার প্রচলিত দুষ্কৃতি পরিত্যাগ করুক, এ-ও ছিলো এ আন্দোলনের দাবি। তাই বদর যুদ্ধের আগে এই নয়া আন্দোলনকে ধ্বংস করার বিষয়ে অনেক গোত্রই চিন্তা-ভাবনা করছিলো। কিন্তু বদরে কুরাইরশরা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হবার ফলে তারা কিছুটা হতোদ্যম হয়ে পড়লো এবং এর পরবর্তী কর্মপন্থা সম্পর্কে তাদের মধ্যে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব দেখা দিলো। কিন্তু ওহুদের যুদ্ধের পর পুনরায় অবস্থার পরিবর্তন ঘটলো। এবার আরবের বহু গোত্রই ইসলামের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়ালো। এ ধরণের কয়েকটি গোত্রের ভূমিকা এখানে উল্লেখ করা যাচ্ছে।

বিভিন্ন গোত্রের বিশ্বাসঘাতকতা

১. চতুর্থ হিজরীর মুহাররম মাসে কাতান এলাকার জুফায়দ নামক একটি গোত্র মদীনা আক্রমণের পরিকল্পনা করলো। হযরত (স) এদের মুকাবিলার জন্যে একটি ক্ষুদ্র বাহিনী নিয়ে হযরত আবু সালামাকে প্রেরণ করলেন। শেষ পর্যন্ত আক্রমণকারীরা পালিয়ে গেলো।

২. এরপর ঐ মাসেই লেহইয়ান নামক কুহিস্থান আ‘রনার একটি গোত্র মদীনা আক্রমণের সিদ্ধান্ত করলো। তাদের মুকাবিলার জন্যে হযরত আব্দুল্লাহ বিন্‌ আনীস (রা)-কে প্রেরণ করা হলো। অবশেষে তাদের সর্দার সুফিয়ান নিহত হলো এবং আক্রমণকারীরা ফিরে গেলো।

à§©. একই বছর সফর মাসে কালাব গোত্রের প্রধান আবু বারাআ হযরত (স)-এর খেদমতে হাযির হয়ে বললোঃ ‘আমার সঙ্গে কতিপয় লোক পাঠিয়ে দিন; আমার কওমের লোকেরা ইসলামের দাওয়াত শুনতে চায়।’ হযরত (স) তার সঙ্গে সত্তর জন সাহাবী পাঠিয়ে দিলেন। এদের অনেকেই ছিলেন সুফ্‌ফার৪২ সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। কিন্তু ঐ ২ গোত্রের শাসনকর্তা আ'মের বিন্‌ তুফাইল এদেরকে ঘেরাও করে হত্যা করলো। এই ঘটনায় হযরত (স) যারপরনাই মনোকষ্ট পেলেন। তিনি সমগ্র মাসব্যাপী ফজরের নামাযের পর ঐ জালিমদের জন্য বদদোয়া করলেন। এই সত্তর জন সাহাবীর মধ্যে মাত্র হযরত আ’মর বিন উমাইয়া নামক একজন সাহাবীকে আ'মের এই বলে মুক্তি দিলো যে, ‘আমার মা একটি গোলাম মুক্ত করার মান্নত করেছিলো; যা এই মান্নত হিসেবে তোকেই আমি মুক্তি দিলাম।’

হযরত আম’র বিন উমাইয়া যখন ফিরে আসছিলেন তখন আ'মের গোত্রের দুজন লোকের সঙ্গে তাঁর পথে দেখা হলো। তিনি তাদেরকে হত্যা করলেন। মনে মনে ভাবলেন, আ'মের গোত্রের বিশ্বাসঘাতকতার কিছু প্রতিশোধ তো গ্রহণ করা হলো। কিন্তু হযরত (স) এ ঘটনার কথা জানতে পেরে খুব অসন্তোষ প্রকাশ করলেন। কারণ এই গোত্রের লোকদের তিনি ইতোমধ্যে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন এবং এ ঘটনা ছিল সেই প্রতিশ্রুতির খেলাফ। তাই হযরত (স) এ দু’জন লোকের হত্যার ক্ষতিপূরণ দানের কথা ঘোষণা করলেন।

এভাবে আরো দু’টি গোত্র বিশ্বসঘাতকতা করলো। হযরত (স) তাদের কথা অনুযায়ী দ্বীনী শিক্ষা বিস্তারের জন্যে দশজন সাহাবীকে প্রেরণ করলেন। কিন্তু ঐ জালিমরা বিশ্বাসঘাতকতা করলো। এর মধ্যে সাতজন সাহাবী কাফিরদের সঙ্গে লড়াই করে শহীদ হলেন। বাকী তিনজন বন্দী হলেন। এদের মধ্যে হযরত খুবাইব (র) এবং হযরত জায়েদ (রা) ও ছিলেন। দুশমনরা এদেরকে মক্কায় নিয়ে বিক্রি করে দিলো। হযরত খুবাইব (সা) ওহুদের যুদ্ধে হারেস বিন আ'মের নামক এক ব্যক্তিকে হত্য করেছিলেন। হারেসের পুত্রগণ পিতৃহত্যার বদলা নেবার জন্যে হযরত খুবাইব (রা)-কে কিনে নিলো। কয়েকদিন পর কাফিরদের হাতে তিনি শহীদ হলেন। অনুরূপভাবে সুফিয়ান বিন্‌ উমাইয়া নামক এক এক ব্যক্তি হযরত জায়ে (রা)-কে নিয়ে হত্যা করলো।

এভাবে আরবের বিভিন্ন গোত্রের সঙ্গে মুসলমানদের নিয়মিত সংঘর্ষ চলছিলো। এতে বিরুদ্ধবাদীরাই একতরফাভাবে নির্মমতার পরিচয় দিচ্ছিলো আর মুসলমানরা তাদের উৎপীড়ন সয়ে যাচ্ছিলো। এই সময় ইহুদীদের সঙ্গেও সম্পর্কের অবনতি মুসলমানদের জন্যে যথেষ্ট দুশ্চি্ন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ালো।

ইহুদী আলেম ও পীরদের বিরোধিতা

পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, মদীনায় আসার পর হযরত (স) ইহুদী গোত্রগুলোর সঙ্গে নানারূপ চুক্তি সম্পাদন করেছিলেন এবং তাদের জান-মালের কোনো ক্ষতি না করার ও তাদেরকে সর্বপ্রকার ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রদানের নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন। তথাপি ইসলামী আন্দোলনের ক্রমবর্ধমান উন্নতিতে ইহুদী আলেম ও পীরগণ বিশেষভাবে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত চিলো। এর অবশ্য কতকগুলো কারণও ছিলো। নিম্নে তার কয়েকটি কারণ উল্লেখ করা যাচ্ছে।

à§§. ধর্মীয় দিক থেকে এ পর্যন্ত ইহুদীদের এক প্রকার অহমিকা ছিলো। খোদাপরস্তি ও দ্বীনদারির দিক দিয়ে সবাই তাদেরকে শ্রদ্ধার পাত্র বলে গণ্য করতো। কিন্তু ইসলামী আন্দোলনের প্রসারের ফলে তাদের এই ভ্রান্ত ধার্মিকতা ও পেশাদারী খোদাপরস্তির মুখোশ খসে পড়লো। সত্যিকার ধার্মিকতা কাকে বলে এবং যথার্থ খোদাপরস্তির তাৎপর্য কি, হযরত (স) -এর বক্তব্য শুনে লোকেরা তা জানতে পরলো। ফলে ইহুদী আলেম ও পীরদের ‘ধর্ম ব্যবসায়ে’ মন্দাভাব দেখা দিলো।

২. কুরআন শরীফে ইহুদি জনগোষ্ঠী, বিশেষভাবে তাদের আলেম ও ধার্মিক শ্রেণীর লোকদের নৈতিকতা ও আচার-ব্যবহার সম্পর্কে খোলাখুলি সমালোচনামূলক আয়াত নাযিল হচ্ছিলো। যেমন : ‘তারা মিথ্যা কথা শ্রবণকারী এবং হারাম মাল ভক্ষণকারী’ (সূরা মায়েদা : ৪২), ‘তুমি এদের অধিকাংশকেই দেখবে পাপাচার ও সীমালংঘনের দিকে দ্রুত এগিয়ে চলছে’ (সূরা মায়েদা : ৬২), ‘এরা সূদখোর, অথচ এদের জন্যে সূদ নিষিদ্ধ করা হয়েছিলো’, ‘এরা লোকদের ধন-মাল খেয়ে ফেলে’ (সূরা নিসা : আয়াত ১৬১) ইত্যাদি। এছাড়া বাকারা, মায়েদা, আলে-ইমরান প্রভৃতি সূরায় এ ধরনের আরো বহু মন্তব্য বিধৃত হয়েছে। এসব মন্তব্য শুনে মাত্র কতিপয় সত্যসন্ধ লোক ছাড়া তাদের বেশির ভাগ লোকই অত্যন- ক্ষুদ্ধ হলো এবং অন্ধভাবে ইসলামী আন্দোলনের বিরোধিতায় লেগে গেলো।

৩. ইসলামের ক্রমবর্ধমান শক্তি দেখে তারা স্পষ্টত আশংকাবোধ করছিলো যে, একদিন না একদিন এর সামনে তাদের মাথা নত করতে হবেই।

এসব কারণেই ইহুদীরা ইসলামী আন্দোলনের ঘোরতর দুশমন বনে গেলো।

বনী কায়নুকার যুদ্ধ

বদরের মুসলমানদের জয়লাভের পরই ইহুদীদের সর্বপ্রথম চৈতন্যোদয় হলো। তারা গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করলো যে, ইসলাম একটি অপরাজেয় শক্তির রূপ পরিগ্রহ করে চলেছে। তাই বদর যুদ্ধের অব্যবহিত পরই- দ্বিতীয় হিজরীর শাওয়াল মাসে- ইহুদীদের বনী কায়নুকা গোত্র মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলো এবং হযরত (স) - এর সাথে সম্পাদিত চুক্তি ভেঙে দিলো। এই যুদ্ধের একটি মুখ্য কারণ ছিলো এইঃ এক ইহুদী জনৈক মুসলিম মহিলার শ্লীলতাহানি করে। এ ঘটনায় উক্ত মহিলার স্বামী ক্রুদ্ধ হয়ে একজন ইহুদীকে মেরে ফেলে। এরপর ইহুদীরা একজন মুসলমানকে হত্যা করে। হযরত (স) বিষয়টির আপোষ-রফার চেষ্টা করলেন। কিন্তু ইহুদীরা ঔদ্ধত্যের সঙ্গে বললো : ‘আমরা বদরে পরাজিত কুরাইশ নই। আমাদের সঙ্গে যখন বেধে গেছেই, তখন যুদ্ধ কাকে বলে তা আমরা দেখিয়ে দেবো।’

এভাবে চুক্তির অমর্যাদা করে ইহুদীরা যখন যুদ্ধের হুংকার ছাড়লো, তখন হযরত (স)-ও যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুতি নিলেন। ইহুদীরা একটি কিল্লার মধ্যে ঢুকে আত্নরক্ষার ব্যবস্থা করলো। কিল্লাটি পনেরো দিন অপরাধের পর স্থির করা হলো যে, ইহুদীদের নির্বাসিত করা হবে। ফলে সাত শ’ ইহুদীকে নির্বাসিত করা হলো।

কা’ব বিন আশরাফের হত্যা

কা’ব বিন আশরাফ ছিলো ইহুদীদের একজন খ্যাতনামা কবি। সে যুগে কবিদের অত্যন্ত প্রভাব ছিলো। তাই বদর যুদ্ধের পর এই লোকটি এমন উত্তেজনাপূর্ণ কবিতা রচনা করতে লাগলো যে, মক্কায় মুসলমানদের বিরুদ্ধে আগুন জ্বলে উঠলো। বদর যুদ্ধে নিহতদের সম্পর্কে সে অত্যন্ত দরদপূর্ণ মার্সিয়া রচনা করলো এবং মক্কায় গিয়ে তা লোকদের শুনাতে লাগলো। অতঃপর সে মদীনায় এসে হযরত (স)-কে হত্যা করার নানারূপ আপত্তিকর কবিতা রচনা করলো এবং তাঁর বিরুদ্ধে লোকদেরকে উত্তেজিত করতে লাগলো। এমন কি, একবার একটি নিমন্ত্রণের ভাব করে সে হযরত (স)-কে হত্যা করার ষড়যন্ত্র পর্যন্ত করলো। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে লোকটি সম্বন্ধে কি ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়, সে সম্পর্কে হযরত (স) সাহাবীদের সাথে পরামর্শ করলেন। অবশেষে তাঁর সম্মতিক্রমে তৃতীয় হিজরীর রবিউল আউয়াল মাসে মুহাম্মদ বিন মুসলিমা (রা) কা’ব বিন আশরাফকে হত্যা করেন।৪৩

বনু নযীরের নির্বাসন

বনু নযীর গোত্রের ইহুদীগণ কয়েকটি ব্যাপারে বিশ্বাসঘাতকতা করলো। তারাও হযরত (স)-কে হত্যা করার উদ্দেশ্যে কয়েকবার গোপন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলো। এ উদ্দেশ্যে মক্কার কুরাইশরাও তাদেরকে উস্কানি দিলো। তাদের এই আচরণ যখন সীমা অতিক্রম করে গেলো, তখন হযরত (স) তাদের কিল্লা অবরোধ করে ফেললেন। এই অবরোধ ১৫৫ দিন পর্যন্ত অব্যাহত রইলো। অবশেষে তারা এই মর্মে সন্ধি করলো যে, উটের পিঠে চাপিয়ে যতটুকু সম্ভব, ততোটুকু মাল-পত্র নিয়ে তারা মদীনা ছেড়ে চলে যাবে। এই সন্ধি অনুযায়ী তাদের বহু সর্দার খায়বর চলে গেলো। তারা নিজেদের সঙ্গে বহু সামান্তপত্র নিয়ে গেলো। যে সব সামান তারা নিতে পারেনি তা-ই শুধু ফেলে গেলো।

এবার মুসলমানদের উভয় দুশমন অর্থাৎ মুশরিক আরব (বিশেষত মক্কার কুরাইশ) এবং ইহুদীগণ মিলে ইসলামকে ধ্বংস করার বিষয়ে চিন্তা করতে লাগলো। অবশেষে তারা সবাই মিলে মদীনা আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিল এবং এর জন্যে প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করে দিলো। প্রথম দিকে হযরত (স) এই প্রস্তুতির কথা জানতে পেরে তাদের মুকাবিলার জন্যে মুসলমানদের একটি কাহিনী নিয়ে কিছু দূর অগ্রসরও হয়েছিলেন। কিন্তু দুশমানরা মুকাবিলা না করে পালিয়ে গেলো। এভাবে পঞ্চম হিজরীর মুহররম মাসে একবার তিনি ‘জাতুরাকা’ এবং রবিউল আউয়াল মাসে আর একবার ‘দমমাতুল জুনদাল’ পর্যন্ত অভিযান চালালেন।

à§§à§§


সর্বশেষ আপডেট ( Sunday, 08 November 2009 )